অভিনব এক নাট্যজগতে বিচরণ করেছে দর্শক। বাস্তব আর পরাবাস্তবের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, পুতুলের শরীর আর মানুষের আবেগকে এক করে তুলে ধরা হয়েছে নাটকে। ব্যতিক্রমধর্মী প্রযোজনা ‘ইনভিজিবল স্টোরিজ’ গতকাল সন্ধ্যায় মঞ্চায়ন হয়েছে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে।

ফরাসি ও বাঙালি শিল্পীর সম্মিলিত উদ্যোগে নির্মিত এই পাপেট থিয়েটার শো দর্শককে নিয়ে গেছে এক অভিযাত্রায়, যেখানে ঢাকার বিজ্ঞানীরা ভূতের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণারত। তাদের অনুসন্ধান ঢাকার গলি পেরিয়ে এক সময় সুন্দরবনের রহস্যময় গহিনে চলেছে– যেখানে শুরু হয় অতিপ্রাকৃত, অলীক; কিন্তু নিকটবর্তী এক অভিজ্ঞতার দ্বারোদ্ঘাটন।

ইনভিজিবল স্টোরিজ শুধু একটি নাটক নয়– এ এক নতুন ধারার গল্প বলা। এখানে সংলাপ শব্দে নয়, বরং দেহে, রঙে, আলো-আঁধারিতে উচ্চারিত হয়। এখানে ভূতের গল্প যেন শুধু ভয় নয়, বরং আমাদের লোককথা, ধর্মীয় কল্পনা এবং সাংস্কৃতিক চেতনার বহু বর্ণে রঙিন প্রতিচ্ছবি। পাপেট, গান, নাচ, সংলাপ ও নীরবতার সংমিশ্রণে এটি হয়ে উঠেছে এক জাদুকরী পরিবেশনা।

নাটকটির নির্দেশনায় রয়েছেন ফরাসি পাপেটিয়ার লহি ক্যানাক। তিনি এমন একজন, যিনি কল্পনাকে শরীর দিয়ে বুনে তুলতে জানেন। তাঁর সঙ্গী বাংলাদেশি শিল্পী মো.

ফারহাদ আহমেদ, যিনি শুধু অভিনয় বা নৃত্যশিল্পী নন, একাধারে পাপেটিয়ার, নৃত্যপরিচালক এবং প্রাচ্যনাট ও জলপুতুল পাপেটসের দীর্ঘস্থায়ী সদস্য।

নির্দেশক লহি ক্যানাক ক্লাসিক্যাল থিয়েটারে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন ফ্রান্সের থিয়েটার: একোল দ্য পাসাজে কিংবদন্তি থিয়েটার ব্যক্তিত্ব নিলস অ্যারেস্ট্রাপ ও আলেকজান্দ্রে দেল পেরুজিয়ার তত্ত্বাবধানে। ১৯৯৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কোম্পানি গ্রেন দ্য ভি, যা আজ আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত পাপেট থিয়েটার। তাঁর সৃষ্টিগুলো হয়ে থাকে শারীরিক, আবেগনির্ভর এবং কল্পনাপ্রবণ।

এই প্রযোজনাটি বাংলাদেশ-ফ্রান্সের যৌথ সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের অনন্য নজির। ঢাকায় দু’দিনের মঞ্চায়নের পর ‘ইনভিজিবল স্টোরিজ’ নাটক দল ফ্রান্সে যাবে। আগামী আগস্টে শারলভিল-মেজিয়ের, প্যারিস, কলুনি, ডিজ এবং বেসাঁসোঁ শহরে অনুষ্ঠিত হবে এই নাটকের প্রদর্শনী। সেখানে অংশ নেবেন মো. ফারহাদ আহমেদ ও স্বাতী ভদ্র।

আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার আমন্ত্রণে এই পরিবেশনা আজ  সন্ধ্যা ৭টায় আবারও হবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে। প্রবেশ উন্মুক্ত এবং বিনামূল্যে। আসন সংখ্যা সীমিত– আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে।

দর্শকের জন্য এটি এক বিরল অভিজ্ঞতা– যেখানে পাপেট (পুতুল) শুধু শিশুদের কল্পনার সঙ্গী নয়, বরং হয়ে ওঠে পরিণত দর্শকের গভীর উপলব্ধির প্রতিমা। ইনভিজিবল স্টোরিজ যেন এই সময়ের এক আত্মবিশ্লেষণ– যা আমরা বলি না, শুধু বহন করি। নাটকটি মনে করিয়ে দেয়, ভূত শুধু ভয়ের বস্তু নয়; ভূত মানে স্মৃতি, অনুতাপ, ব্যর্থতা, প্রেম অথবা হারিয়ে যাওয়া কোনো প্রতিশ্রুতি। সুন্দরবনের ভেজা পাতায়, ঢাকার রাতের বাতাসে কিংবা গবেষণাগারে রাখা এক অদ্ভুত যন্ত্রের গর্জনে ভেসে ওঠে এসব অদৃশ্য কাহিনি।

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’

পূর্ব সুন্দরবনের নিসর্গঘেরা অভয়ারণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র ‘আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার’। সবুজ ম্যানগ্রোভ বনের বুক চিরে, নদীর নোনাজলে ভেসে, প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্যে ঘেরা এই কেন্দ্রটি চলতি নভেম্বর মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা।

পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন আলী বান্দা এরইমধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কেড়েছে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে ট্রলারযোগে মাত্র ৪০ মিনিটের নৌপথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে। 

যাত্রাপথে চোখে পড়ে বনের গভীর সবুজ গাছগাছালি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া পাখি, কচুরিপানায় ঢাকা জলাশয় এবং সুন্দরী-গেওয়া গাছের সারি যা পর্যটকদের মোহিত করে।

বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের সমান উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে সুন্দরবনের বিস্তৃত সবুজাভ দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে। 

রয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ফুট ট্রেইল (ওয়াকওয়ে)। পথের দুই পাশে ঘন বনের মাঝে হাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতির আসল রূপ। এছাড়া রয়েছে মিষ্টি পানির পুকুর, হরিণ রাখার সেড, জেটি, বিশ্রামাগার, সুভেনিয়ার শপ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় বনরক্ষী ও স্থানীয় গাইডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আলীবান্দা বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজগম্য স্পট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কম সময় ও কম ঝুঁকিতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে এখানে। স্থানীয় পর্যটকরা এরইমধ্যে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন বলেন, “আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে স্থানীয় গাইড, নৌযানচালক, হোটেল ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়বে।”

তবে পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ ফি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আলীবান্দায় প্রবেশের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৫ টাকা।

শরণখোলা ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল বয়াতী বলেন, ‘‘আলীবান্দায় প্রবেশ ফি ৩৪৫ টাকা, অথচ একই বনের করমজল পর্যটন পয়েন্টে ফি মাত্র ৪৬ টাকা। অনেকেই আলীবান্দায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু ফি বেশি হওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’’

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “আলীবান্দা এখন প্রায় প্রস্তুত। চলতি মাসেই এখানে হরিণ আনা হবে। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্পটটি। যেহেতু এটি ২০১৭ সালে ঘোষণা করা অভয়ারণ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত, তাই সাধারণ বনাঞ্চলের তুলনায় কিছু বিধিনিষেধ ও প্রবেশ ফি বেশি রাখা হয়েছে। তবে পর্যটকদের দাবির বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে জানাব।’’

ঢাকা/শহিদুল/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’
  • সুন্দরবনের বড় গেছো প্যাঁচা