আষাঢ়ের স্নিগ্ধ সন্ধ্যা। তবে বৃষ্টির ছোঁয়া ছিল না। ছিল আকাশজুড়ে সজল মেঘের আনাগোনা। এমন এক মুহূর্তে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ের গ্র্যান্ড বলরুমে বসেছিল সাহিত্যানুরাগীদের আসর; হয়ে গেল ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। 

অনুষ্ঠানে সংগীতশিল্পী শামা রহমানের কণ্ঠে যখন গুঞ্জরিত হলো ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে/ আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে.

..’, তখন অনুষ্ঠানস্থলে যেন ঢুকে পড়ল বর্ষার চিরপরিচিত আবহ। তার আগে পঞ্চকবির গানের সঙ্গে নৃত্য দিয়ে শুরু হয়েছিল অনুষ্ঠান। 
ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারের ১৩তম আসরে এবার আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই। তাঁর সমৃদ্ধ সাহিত্যকর্ম ও দীর্ঘ সাহিত্যযাত্রাকে সম্মান জানিয়ে এ পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় উৎসবমুখর এই সন্ধ্যায়। 

এ ছাড়া সাহিত্যের তিনটি শাখায় পুরস্কার পেয়েছেন তিনজন সুলেখক। আমিনুল ইসলাম ভুইয়া পেয়েছেন ‘প্লেটো প্রবেশিকা’ গ্রন্থের জন্য প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণ ও অনুবাদ শ্রেণিতে পুরস্কার। কবিতা ও কথাসাহিত্য বিভাগে ধ্রুব এষ পুরস্কার পেয়েছেন ‘আমাদের পরাবাস্তব টাউনের দিনরাত্রি’ গ্রন্থের জন্য। উম্মে ফারহানা তাঁর গ্রন্থ ‘টক টু মি’র জন্য জিতে নিয়েছেন তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার।
দেশের লেখক, কবি, অনুবাদক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং সাহিত্যপ্রেমী মননশীল মানুষের উপস্থিতিতে এই আয়োজন রূপ নেয় মিলনমেলায়। গতকাল দেওয়া হলো ২০২৩ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের জন্য ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার। করোনার কারণে দু’বছর এই পুরস্কার দেওয়া সম্ভব হয়নি। ২০২৬ সালে একসঙ্গে দেওয়া হবে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের ওপর পুরস্কার।     
আজীবন সম্মাননা পুরস্কার গ্রহণ করে প্রতিক্রিয়ায় হাসনাত আবদুল হাই বলেন, এ পুরস্কারপ্রাপ্তি নিঃসন্দেহে আনন্দ ও গৌরবের। পঞ্চাশের দশকে ছাত্রাবস্থা থেকে যখন লেখালেখি শুরু করেছিলাম, তখন সেটি ছিল শখের জন্য। পরে লেখা শুরু করলাম দায়বদ্ধতা থেকে। সমাজ, রাষ্ট্র, দেশ ও মানুষের প্রতি আমার এ দায়বদ্ধতা। লেখক হিসেবে আমার যা কিছু অর্জন, তা আমার একার সফলতা নয়। হাসনাত আবদুল হাই তাঁর বাবা-মা, প্রয়াত স্ত্রী ও পুত্রবধূর কথা স্মরণ করে বলেন, পাঠক আছে বলেই বই ছাপা হয়। আমরা লিখে যেতে পারি। 

নব্বই ছুঁইছুঁই হাসনাত আবদুল হাই বলেন, দীর্ঘ জীবনের অধিকারী হওয়া অনেক আনন্দের। আবার অনেক কষ্টেরও। অনেক স্বজনকে চলে যেতে দেখেছি। শোক সইতে সইতে পাথর হতে হয়। কিন্তু নিজেই বললেন, তিনি চলে যেতে চান না। কবির ভাষায় শক্ত উচ্চারণ তাঁর– যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব? না যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বললেন, অনেক বই সংগ্রহ করেছেন, সেগুলো পড়ে যেতে যান। আর মা-হারা ১০ বছর বয়সী নাতির সঙ্গে তিনি কাটাতে চান দীর্ঘ সময়। কবিতার ভাষায় নাতিকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন– তোকে দেব আমি আমার ছেলেবেলা।   

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাবন্ধিক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। অতিথি হিসেবে মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ, ব্র্যাক ব্যাংকের ভাইস চেয়ারপারসন ফারুক মঈনউদ্দীন আহমেদ, বিচারকমণ্ডলীর সদস্য প্রাবন্ধিক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, সাহিত্যিক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস।  অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সমকাল সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী।

তিন পুরস্কার ও প্রতিক্রিয়া
লেখক আমিনুল ইসলাম ভুইয়া পুরস্কার পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যে বইটির জন্য পুরস্কার পেলাম তা আসলে একটি সহায়ক পুস্তক; প্লেটো পাঠের সহায়িকা। প্লেটোর সব সংলাপ তথা ২৮টি সংলাপ অনুবাদ করেছি। আমাদের দেশে গ্রিক সাহিত্য বিশেষত দর্শন যে খুব একটা শক্ত শিকড় পেয়েছে, তা বলা যাবে না। আমার এই প্রচেষ্টা মাটির প্রদীপের অধিক কিছু বলে গণ্য হওয়ার নয়। তবুও প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। 

আমিনুল ইসলাম ভুইয়া বলেন, এ দেশে লেখকদের খুব একটা সম্মান দেওয়া হয় না। আপনারা পুরস্কার দিয়ে আমার লেখাকে আলোতে আনার যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। পুরস্কার প্রদানকারী বিচারকদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা, যদিও তাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। 
কিছুটা নিভৃতচারী ও লাজুক স্বভাবের ধ্রুব এষ পুরস্কার গ্রহণ করে ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে দুই শব্দে শুধু বললেন, ‘আমি খুশি।’  
তরুণ লেখিকা উম্মে ফারহানা পুরস্কার গ্রহণ করে বললেন, সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ। কারণ পরিশ্রম করার ক্ষমতা তিনিই দেন। সবার উৎসাহ অনুপ্রেরণায় লেখা শুরু করেছিলাম। এ পুরস্কারপ্রাপ্তির পর এখন  শিক্ষকের পাশাপাশি নিজেকে লেখক হিসেবেও পরিচয় দিতে পারব। সারাজীবন লিখে যেতে চাই। 

সমকালের উপসম্পাদক মাহবুব আজীজের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের আলোচনায় উঠে আসে সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, এবারের প্রতিযোগিতায় সাহিত্যের তিনটি বিভাগে ৪৬৭টি বই জমা পড়ে। সেখান থেকে প্রাথমিক বাছাই শেষে ১৮টি গ্রন্থ বিচারকমণ্ডলীর বিবেচনার জন্য নির্বাচিত হয়।
জুরি বোর্ডে ছিলেন সাহিত্যিক বেগম আকতার কামাল, গবেষক ড. ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, কবি আবিদ আনোয়ার এবং অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস। তাদের নিখুঁত বিশ্লেষণ ও বিচারে নির্বাচিত হয় তিনটি গ্রন্থ।
পুরস্কার হিসেবে আজীবন সম্মাননায় দেওয়া হয় পাঁচ লাখ টাকার চেক, ক্রেস্ট ও সম্মাননা স্মারক। প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণ ও অনুবাদ এবং কবিতা ও কথাসাহিত্য বিভাগে দুই লাখ টাকা করে; আর তরুণ সাহিত্যিক শ্রেণিতে পুরস্কার ছিল এক লাখ টাকা। সবাইকে শুরুতে উত্তরীয় পরিয়ে দেন অতিথিরা। পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রত্যেকের ওপর সংক্ষিপ্ত প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়।   

অতিথিরা যা বললেন
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলায় আমাদের আরও উন্নতি করার সুযোগ আছে। সে জন্য আমাদের দরকার রাজনৈতিক জাগরণ। তবে তেমন জাগরণের কোনো লক্ষণ আমরা এখনও দেখতে পাচ্ছি না। 
আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, এ জাতির মুক্তির জন্য দক্ষ চিন্তক দরকার। চিন্তাই মানুষকে মুক্তি দেয়। আজ যারা পুরস্কৃত হলেন, তারা এই দেশ, সমাজ, মানুষকে নিয়ে চিন্তা করেছেন। তিনি বলেন, পুরস্কার লেখকদের অনুপ্রাণিত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পর আরও সমৃদ্ধ লেখা লিখেছেন। আজকের লেখক, কবি, সাহিত্যিকদেরও স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম নিয়ে মানুষের পাশে থাকতে হবে।

হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ বলেন, এই সাহিত্য পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান শুধু একটি সাংস্কৃতিক আয়োজন নয়। এটি আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে একটি শুভ উদ্যোগ। ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার যারা পেলেন তারা সত্যিকারের মূল্যায়নের ভিত্তিতে তা পেয়েছেন। এ প্রাপ্তি গৌরবের এবং ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণার।
এ আয়োজনে সঙ্গে থাকায় ব্র্যাক ব্যাংককে ধন্যবাদ জানিয়ে এ. কে. আজাদ বলেন, একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যখন শিল্প-সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ করে, তা সমাজে সুস্থতা ও ভারসাম্যের বার্তা বয়ে আনে। ব্র্যাক ব্যাংক এ দায়িত্ব বরাবরই পালন করে চলেছে। তিনি বলেন, সমকাল বরাবরই বাংলাদেশে শিল্প ও সাহিত্যচর্চার একটি শক্ত ভিত রচনা করে এসেছে। আশা করি, আগামী দিনেও এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। 

ব্র্যাক ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ফারুক মঈনউদ্দীন আহমেদ বলেন, এই সাহিত্য পুরস্কার এখন দেশের সাহিত্যচর্চায় একটি মর্যাদার প্রতীক। তরুণ লেখকদের জন্য এটি যেমন প্রেরণা, পাঠকদের জন্যও তেমনি রুচিশীল পঠনের এক অনন্য দ্বার। আমরা গর্বিত এই উদ্যোগের অংশ হতে পেরে।
ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, বিচারক হিসেবে এক মাসের মধ্য সব বই পড়ে বিচার করাটা খুব কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। তিনি ভালো বই লেখা ও প্রকাশের ওপর গুরুত্ব দেন। 
সভাপতির বক্তব্যে সমকাল সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী বলেন, সংবাদপত্র ও সাহিত্য হাত ধরাধরি করে চলে। পত্রিকা হিসেবে সমকাল সাহিত্যের সঙ্গে তার যুগল পথচলা অব্যাহত রাখবে। সংবাদপত্র যেমন সমাজের কথা বলে; সাহিত্যও তাই। সংস্কৃতি ছাড়া সংবাদপত্র বড় হতে পারে না। কারণ দুটিই মুক্তচিন্তার বাহক। সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ। সংস্কৃতি জাতির আত্মার প্রতিচ্ছবি। তিনি আশা করেন, এই সাহিত্য পুরস্কার দেশের সাহিত্য জগতের গতিপথকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।

অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজন:
অনুষ্ঠানে রাজনীতিবিদদের মধ্যে উপস্থিত ছিলন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব ও সাংস্কৃতিক সেলের সম্পাদক লুৎফর রহমান প্রমুখ।  

ব্যবসায়ীদের মধ্যে এসেছিলেন আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ, সায়হাম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ শাফকাত আহমেদ প্রমুখ। ছিলেন ব্র্যাক বাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিএফও এম. মাসুদ রানা, হেড অব কমিউনিকেশন ইকরাম কবীরসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। 
লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নারীনেত্রীর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শিরীন হক, রামন্দেু মজুমদার, বেগম আকতার কামাল, নাসরীন জাহান, সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, খ ম হারুন, মাসুক হেলাল, মোহন রায়হান, মাহরুখ মহিউদ্দীন, রেজানুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম, ফারুক মাহমুদ, শোয়াইব জিবরান, তুষার দাশ, নাজিব তারেক, নাসিমা আনিস, কামরুল হাসান, জুনান নাশিত, স্বকৃত নোমান, শিমুল সালাহ্‌উদ্দীন,  মতিন রায়হান, মনিকা চক্রবর্তী, আফরোজা সোমা, ফারহানা রহমান, শিহাব সরকার প্রমুখ।


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স হ ত য প রস ক র প রস ক র প স ব দপত র গ রন থ র অন ষ ঠ ন র রহম ন উপস থ ত ল ইসল ম ব চ রক প রক শ অন ব দ র জন য আম দ র বলল ন

এছাড়াও পড়ুন:

বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী, আছে করোনাও

সাত দিন আগে তীব্র জ্বর, গায়ে ব্যথা ছিল নারায়ণগঞ্জের আমেনা বেগমের (৪৮)। ওষুধে জ্বর কমছিল না। পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। রক্তের প্লাটিলেট কমে ৪০ হাজারে নেমে এলে পরিবারের সদস্যরা তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ১ জুলাই

থেকে তিনি মহাখালীতে অবস্থিত উত্তর সিটি করপোরেশন পরিচালিত ডিএনসিসি কোভিড–১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি।

গতকাল শুক্রবার দুপুরে হাসপাতালের পঞ্চম তলায় অবস্থিত আইসিইউর সামনে গিয়ে দেখা হয় আমেনা বেগমের ছেলে অর্ণব মোহাম্মদের সঙ্গে। অর্ণব জানান, ভর্তির পরদিন তাঁর মায়ের প্লাটিলেট আরও কমে ১৮ হাজারে নেমে আসে। মাকে দেখভালের জন্য চার দিন ধরে তিনি ও তাঁর বাবা মো. সালাউদ্দিন হাসপাতালে রয়েছেন। রাতে বারান্দায় মাদুর পেতে ঘুমান।

আইসিইউতে ভর্তি রয়েছে জান্নাতুল (১৭) নামের একটি মেয়ে। পরিবারের সদস্যরা তার জন্য রক্ত জোগাড় করছিলেন। জান্নাতুলের মা আমেনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা রাজধানীর মোহাম্মদপুরে শেখেরটেকে থাকেন। ১০ জুন মেয়েকে নিয়ে তিনি পটুয়াখালী সদর উপজেলায় শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ২৭ জুন সেখানে মেয়ের প্রচণ্ড জ্বর হলে তিনি পরদিন জেলা হাসপাতালে নিয়ে যান। পরীক্ষায় জান্নাতুলের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। তিনি বলেন, ওই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ছিলেন অনেক বেশি। চিকিৎসকের পরামর্শে ৩০ জুন তিনি ঢাকায় এসে ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি করেন। মেয়েকে রক্ত দেওয়া হয়েছে এক ব্যাগ। শুক্রবারের রিপোর্টে প্লাটিলেট কমে ৬ হাজারে নেমে আসায় চিকিৎসক আরও রক্ত দিতে হবে জানিয়েছেন।

অর্ণব জানান, ভর্তির পরদিন তাঁর মায়ের প্লাটিলেট আরও কমে ১৮ হাজারে নেমে আসে। মাকে দেখভালের জন্য চার দিন ধরে তিনি ও তাঁর বাবা মো. সালাউদ্দিন হাসপাতালে রয়েছেন। রাতে বারান্দায় মাদুর পেতে ঘুমান।

হাসপাতালটির আইসিইউতে গতকাল ১৫ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে আমেনা বেগম, জান্নাতুলসহ ডেঙ্গু রোগী ৬ জন। হাসপাতালে গতকাল দুপুরে ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা করপোরাল মো. মিয়ারুল ইসলাম জানান, হাসপাতালে এখন আইসিইউ ও ওয়ার্ড মিলিয়ে ১৩১ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে ডেঙ্গু রোগী ২৬ জন, কোভিড রোগী ১৯ জন এবং অন্যান্য রোগী ৮৬ জন। এই হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া শনাক্তের আলাদা ব্যবস্থা নেই। উপসর্গ থেকে তাঁরা ধারণা করছেন, কিছু রোগী চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। তাঁদের অন্যান্য রোগীর সঙ্গে রাখা হয়েছে।

রাজধানীসহ সারা দেশে এখন জ্বর, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও করোনার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। জ্বর হলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, এখন ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেশি। আগামী দুই মাসে এই রোগ আরও বাড়তে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, সারা দেশে ৩ থেকে ৪ জুলাই (২৪ ঘণ্টায়) ২০৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। কেউ মারা যাননি। ঢাকা মহানগরের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ওই সময়ে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ৫৭ জন। এর মধ্যে ১৮টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে ৪৫ জন এবং ৫৯টি বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১২ জন। সবচেয়ে বেশি ভর্তি রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে—মোট ২৬ জন।

রাজধানীসহ সারা দেশে এখন জ্বর, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও করোনার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। জ্বর হলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, এখন ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেশি। আগামী দুই মাসে এই রোগ আরও বাড়তে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০ জুন ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিলেন ১৫১ জন। আর ঢাকা মহানগরের হাসপাতালগুলোয় ওই সময় ভর্তি হয়েছিলেন ২৮ জন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. টিটো মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী অনেক বেশি আসছে। পাশাপাশি কোভিড রোগীও আসছেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এখনই সরকারি পদক্ষেপ না বাড়ালে ও জনসচেতনতা সৃষ্টি না করলে বিপদ বাড়তে পারে।

টিটো মিঞা আরও বলেন, বাথরুমের কোনায়, টবে, টায়ারে পানি জমে যেন ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বিস্তার না ঘটে, সে জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। জ্বর হলে অবশ্যই রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা করতে হবে। প্লাটিলেটের চেয়ে রক্তচাপ কমে যাওয়ার বিষয়টি বেশি আশঙ্কাজনক। রোগীর রক্তচাপ কমে গেলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশিদ জানান, রোগীর সংখ্যা আরও বাড়লে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।যত আক্রান্ত

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ঢাকা মহানগরের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এখন মোট ভর্তি আছেন ৩৫১ জন। ৩ থেকে ৪ জুলাই ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি হয়েছেন ৫৭ জন। সারা দেশে এই ২৪ ঘণ্টায় নতুন ২০৪ রোগীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত বরিশাল বিভাগে ১০১ জন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৬৬০ জন। আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি বরিশাল বিভাগে, মোট ৫ হাজার ১৭০ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৪৫ জন। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মৃত্যু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এলাকায়। সেসব এলাকায় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশিদ জানান, রোগীর সংখ্যা আরও বাড়লে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।

অনেকে বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন

রামপুরার বাসিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক খালেদা আকন্দ (৫৬) গত সপ্তাহে প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হন। গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। পরিবারে চিকিৎসক আত্মীয়স্বজন থাকায় মুঠোফোনে পরামর্শ নিয়ে ফলের রস, স্যালাইনসহ তরল খাবার খাচ্ছিলেন তিনি। তৃতীয় দিন পরীক্ষায় তাঁর ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। চতুর্থ দিন তাঁর চোখ লালবর্ণ ধারণ করে এবং মাড়ি থেকে রক্ত পড়া শুরু করে। ওই সময় চিকিৎসক স্বজনের পরামর্শে আরেকবার পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।

খালেদা আকন্দের পুত্রবধূ স্কুলশিক্ষক শারমিন বাশার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর শাশুড়ির গায়ের ব্যথা এখন কমে এসেছে। শারীরিক অবস্থারও উন্নতি হচ্ছে। তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে চলছেন।

উপসর্গ ডেঙ্গু–চিকুনগুনিয়ার, রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’

রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসায় দেড় বছর ধরে এক শিশুর তত্ত্বাবধানকারী (কেয়ারগিভার) হিসেবে চাকরি করেন হাফিজা বেগম (২২)। গত ২৯ জুন রাতে তাঁর ১০৫ ডিগ্রি জ্বর ওঠে। সঙ্গে গায়ের গিটে গিটে প্রচণ্ড ব্যথা, চুলকানি। তাঁর গায়ে এত ব্যথা ছিল যে হাঁটতে পারতেন না। হুইলচেয়ারে করে তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিতে হয়। শিশুটির মা ফাতেমা আবেদীন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ৩০ জুন তিনি হাফিজাকে ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসক দেখান। পরীক্ষায় ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে হাফিজাকে তরল খাবার খাওয়ানো হচ্ছিল। তবে দুই দিন পর প্রচণ্ড বমি শুরু হয়। সঙ্গে গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, চুলকানি। রাতের বেলা ধানমন্ডির আরেকটি হাসপাতালে হাফিজাকে ভর্তি করা হয়। এরপর রক্তের অন্যান্য পরীক্ষা ও প্লাটিলেটের মাত্রা দেখে চিকিৎসক ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া বলে ধারণা করেন এবং সেভাবে চিকিৎসা করেছেন। এক দিন হাসপাতালে থাকার পর হাফিজাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁর শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল।

মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে কোভিড আইসিইউ ইউনিটে চার বছরের শিশুসন্তানকে ভর্তি করেছেন এক মা। মিতু নামের ওই মা গতকাল হাসপাতালে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মহাখালীতে থাকেন। তাঁর সন্তানের ডেঙ্গুর রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। তবে উপসর্গ দেখে চিকিৎসক ডেঙ্গু বলছেন। স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে মেয়েকে।

রয়েছে কোভিড রোগীও

মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালের ছয়তলায় কোভিড রোগীদের রাখা হয়েছে। হাসপাতালে মালা নামের এক নারী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর খালার স্বামী ও সন্তান মারা গেছেন। তিনি ছাড়া খালাকে দেখার কেউ নেই। খালা কিডনি রোগী। শ্বাসকষ্ট থাকায় তাঁকে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে তাঁকে এই হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই হাসপাতালে তাঁর খালার কোভিড শনাক্ত হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ৩–৪ জুলাই ২৪ ঘণ্টায় ২৪২ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ছয়জনের কোভিড শনাক্ত হয়েছে। কোনো মৃত্যু নেই।

গত ১১ মাসে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সেভাবে কার্যকর না থাকায় মশকনিধন কার্যক্রম তেমন ছিল না। ডেঙ্গুকে শহরভিত্তিক রোগ বলা হলেও এবার গ্রামে এর বিস্তার বেশি ঘটতে দেখা যাচ্ছে।কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি দরকার

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, আগস্ট–সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। মাঠপর্যায়ের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, দেশের প্রতিটি জেলায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নির্দেশক ব্রেটো ইনডেক্স ২০-এর ওপরে, অর্থাৎ ডেঙ্গু বিস্তারের ঝুঁকি অনেক বেশি।

কবিরুল বাশার আরও বলেন, গত ১১ মাসে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সেভাবে কার্যকর না থাকায় মশকনিধন কার্যক্রম তেমন ছিল না। ডেঙ্গুকে শহরভিত্তিক রোগ বলা হলেও এবার গ্রামে এর বিস্তার বেশি ঘটতে দেখা যাচ্ছে। তিনি মনে করেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ দরকার। দীর্ঘদিন ধরে মশা নিয়ে কাজ করছেন এমন বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে পরিকল্পনা করা দরকার। পাশাপাশি আগামী দুই মাসে রোগীর চাপ সামলাতে হাসপাতালগুলোয় যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকা দরকার। সাধারণভাবে হাসপাতালগুলোর রোগীর চাপ সামলানোর সক্ষমতা নেই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ