গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন শুল্ক চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ এবং বাণিজ্য উপদেষ্টার ভাষায়, সেটি এখন স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে। গত ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের যে ঘোষণা দেন, যেখানে বাংলাদেশের ওপর বর্ধিত শুল্কহার প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৭ শতাংশ, বস্তুত সেটির ধারাবাহিকতাতেই এ চুক্তি। চুক্তির উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে বাণিজ্য উপদেষ্টা অবশ্য বলেছেন, ‘যদি মনে করি, বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতা বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শর্তগুলো মানা সম্ভব, তাহলেই চুক্তি হবে।’ তাঁর এ বক্তব্য ইঙ্গিত দেয়, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শর্তাবলির মধ্যে সম্ভবত এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতা বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য নয়। আর সে আশঙ্কা আছে বলেই হয়তো তিনি এটাও বলেছেন, ‘শর্তসহ পুরো প্রক্রিয়া উপদেষ্টা পরিষদকে জানাব।’  

সংবাদমাধ্যমের খবর, ওই চুক্তির খসড়া চূড়ান্তকরণ বৈঠকে যোগদানের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মো.

খলিলুর রহমান আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করছেন। শুল্ক চুক্তির খসড়া নিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা গত ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ওয়াশিংটনে একটি বৈঠকও করে ফেলেছেন। কী অবাক কাণ্ড! চুক্তি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের, আর বৈঠক করেছেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা! 
জানা যায়, উল্লিখিত শুল্ক চুক্তি-সংক্রান্ত বাংলাদেশের প্রস্তাব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ছয়টি বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে সেসবের জবাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন কোন বিষয়ে কী কী জানতে চাওয়া হয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তা প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছে, ‘এ বিষয়ে কথা না বলার শর্ত রয়েছে।’

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের মানুষ খুবই উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে, বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই (যার অধিকাংশই আন্তর্জাতিক বিষয়) সরকার গোপনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া চলাকালে তারা তা অস্বীকার করছে। পরে সেটি প্রকাশ পেয়ে গেলে নানা অযৌক্তিক ও জোড়াতালিমূলক বক্তব্য দিয়ে সেসবের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়া, চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানির কাছে ন্যস্ত করা, পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে মিলে ত্রিপক্ষীয় জোট গঠন ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এগুলোর সঙ্গে সর্বশেষ, সম্ভবত যুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক চুক্তি।  

শুল্ক চুক্তি স্বাক্ষর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অতি উচ্চ ও অযৌক্তিক মূল্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৩ লাখ টন গম কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রতি টনে ২৫ ডলার অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে (প্রথম আলো, ২৭ জুন, ২০২৫)। প্রক্রিয়াধীন শুল্ক চুক্তির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ কোনো কোনো পণ্য অন্য দেশ থেকে আমদানি না করে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। এমনকি তা দু-চার ডলার বেশি দিয়ে হলেও। তাই বলে প্রতি টনে ২৫ ডলার! তো চুক্তি করে শুল্ক কমিয়ে সে হ্রাসকৃত শুল্কের একটি বড় অংশ যদি আবার পণ্য ক্রয় করে তাদেরকেই ফিরিয়ে দিতে হয়, তাহলে আর চুক্তি করে লাভ কী?

উল্লেখ্য, তিন লাখ টন পণ্য ক্রয় তো মাত্র একটি ছোট্ট ঘটনা এবং সবে এর শুরু। এখন যদি এই ধারায় সারাবছর ধরেই গমের পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যের ক্রয় এভাবে অব্যাহত থাকে, তাহলে লাভের গুড় তো পিঁপড়াই খেয়ে খেলবে। আরও উল্লেখ্য, মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানি বোয়িংয়ের ওই আকাশযান যখন একের পর এক দুর্ঘটনায় নিপতিত হচ্ছে (সর্বশেষ গত ১২ জুন ভারতের আহমেদাবাদ দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করা যেতে পারে), তখন যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির কাছ থেকে উড়োজাহাজ কেনাটাই সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত কিনা, সেটি আরেকবার যাচাই করে দেখা প্রয়োজন নয় কি? এসব ক্রয় সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি) চুক্তির আওতায় হচ্ছে বলেই যে এগুলোর তুলনাভিত্তিক সুবিধাজনক মূল্য যাচাই করে দেখা হবে না– এটি কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ আসলেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় শুল্ক চুক্তি স্বাক্ষরের একেবার দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সে চুক্তি সত্যি সত্যি বাংলাদেশের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে কিনা, সে বিষয়টি কি উপযুক্ত বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে? এ বিষয়ে প্রকৃত ব্যবসায়ী ও ভোক্তা অংশীজনের মতামত কি গ্রহণ করা হয়েছে? দেশে বর্তমানে কোনো নির্বাচিত নিয়মিত সরকার নেই। সে কারণে এ ধরনের বড় সিদ্ধান্ত অনুমোদনের জন্য কোনো জাতীয় সংসদও নেই। সে ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের বিকল্প হিসেবে আপৎকালীন ব্যবস্থায় এ জাতীয় বিষয় অন্তত উপদেষ্টা পরিষদে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া উচিত বলে মনে করি। কিন্তু যতটুকু জানা যায়, সেখানে এগুলো নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, একটি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কি এ ধরনের বড় ক্রয় ও কৌশলগত আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করাটা যুক্তি ও বৈধতার আওতায় পড়ে? অতীতের কোনো অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারই এমনটি করেনি। তারপরও যদি ধরে নিই, জরুরি কাজ চালানোর জন্য কোনো কোনো বিষয়ে সরকারকে নিরুপায় হয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, তাহলে সেটি অন্তত উপদেষ্টা পরিষদের পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে আলাপ-আলোচনা করা দরকার। যদি সেটি করা না হয়, তাহলে সাধারণের মধ্যে খুব স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ জাগবে যে, খসড়া পর্যায়ে অপ্রকাশিত ও অনালোচিত থেকে যাওয়া বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক চুক্তির ভার শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণ বহন করতে পারবে তো?

আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক, 
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন
(বিসিক), শিল্প মন্ত্রণালয়
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রক র য় উপদ ষ ট উল ল খ র জন য প রক শ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

‘ফিরিয়ে দাও’ থেকে ‘ধূসর সময়’: সিডনিতে একই মঞ্চে মাইলস ও আর্টসেল

সিডনির বসন্তের সন্ধ্যা। লিভারপুলের হুইটল্যাম লেজার সেন্টারের বাইরে তখন লম্বা লাইন—হাতে পতাকা, কাঁধে ব্যাগ, চোখে প্রত্যাশা। সাউন্ডচেকের শব্দ ভেসে আসছে বাইরে। ভেতরে যেন উন্মুখ এক ‘সাগর’, যেখানে মিশে আছে দুই প্রজন্মের মুখ, কণ্ঠ আর স্মৃতি। শনিবার রাতটি হয়ে উঠেছিল প্রবাসী বাঙালিদের জন্য এক ব্যতিক্রমী উৎসব—বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের দুই যুগের দুই প্রতীক, মাইলস ও আর্টসেল; প্রথমবারের মতো একই মঞ্চে গান করল সিডনিতে।
‘গ্রিনফিল্ড এন্টারটেইনমেন্ট’ আয়োজিত এই ‘মিউজিক ফেস্ট’ ঘিরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল, তা যেন উপচে পড়ল সেই রাতে। টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার পরপরই সব শেষ। অনুষ্ঠান শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে থেকেই সিডনির দক্ষিণ-পশ্চিম উপশহর লিভারপুলের রাস্তাগুলো ভরে গেল গানের ভক্তে।

আয়োজনের আগে ভিডিও বার্তায় মাইলস জানায় তাদের উচ্ছ্বাস। ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য হামিন আহমেদ বলেন, ‘সিডনি বরাবরই আমাদের কাছে বিশেষ কিছু। সম্ভবত ১৯৯৬ সালে আমরাই প্রথম বাংলাদেশি ব্যান্ড হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় পারফর্ম করি। এরপর এ নিয়ে অন্তত পঞ্চমবারের মতো সিডনিতে এলাম। এখানকার দর্শকদের ভালোবাসা সব সময়ই অবিশ্বাস্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানতাম এটি স্মরণীয় একটি আয়োজন হতে যাচ্ছে। আমরা চেয়েছি সবাই একসঙ্গে গাইবে, চিৎকার করবে—ভক্তরা সেটাই করেছেন।’ গিটারিস্ট তুজো যোগ করেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটি শহরে ট্যুর করছি, কিন্তু সিডনির আবহ একেবারেই আলাদা। দর্শকেরা আমাদের রাতটিকে স্মরণীয় করে দিয়েছেন।’

মঞ্চে আর্টসেল

সম্পর্কিত নিবন্ধ