চলতি বছর ঢাকা বোর্ডের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪১ শতাংশ বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করেছে। গত ১৯ জুন সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ‘বিয়ে হয়ে গেছে অনুপস্থিত ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থীর’– এমন উদ্বেগজনক তথ্যটি উঠে আসে। ঢাকা বোর্ড পরিচালিত এই জরিপে দেখা যায়, ঝরে পড়া এসব স্কুলশিক্ষার্থীর ৯৭ শতাংশ নারী এবং তারা আর কখনও লেখাপড়ায় ফিরবে না বলে মতামত দেয়।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। আমরা যখন খুব গর্বের সঙ্গে চিন্তা করি যে দেশে নারীশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান কদমে এগিয়ে চলছে, তখন সাম্প্রতিককালে পরিচালিত ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জরিপটি যথেষ্ট চিন্তার উদ্রেক করে। এ দেশে জনসংখ্যায় ১৮ বছরের নিচে অর্থাৎ বাল্যবিয়ের হার ২০২২ সালে ছিল ৫০ শতাংশ।
২০২৪ সালের মার্চ মাসে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, বাল্যবিয়ের হার ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমানে ৫১.
এ কথা অবশ্যই ঠিক যে, বর্তমানে নারীরা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ভেঙে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এমনকি কর্মক্ষেত্রে কোনো কোনো জায়গায় মেধা ও দক্ষতায় তারা পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও নারীরা পুরুষদের ছাড়িয়েও যাচ্ছে। পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কর্মক্ষেত্রে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ, সমাজ ও রাজনীতিতে তাদের ক্ষমতায়ন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু নারীর অগ্রযাত্রায় প্রধান প্রতিবন্ধক বাল্যবিয়ের প্রবণতা কিছুতেই হ্রাস করা যাচ্ছে না। পুরুষের সমকক্ষ হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য দরকার সর্বপ্রথম অর্থনৈতিক মুক্তি। আর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সর্বত্র দরকার নারীশিক্ষার প্রসারে যত বাধা আছে তা দূর করা।
একজন কিশোরীর স্বল্পশিক্ষিত বাবা-মা যখন দেখেন তাদের মেয়েটি সমাজে নানা ক্ষেত্রে হেনস্তার শিকার হচ্ছে, তখন তাকে নিয়ে পদে পদে বিড়ম্বনায় ভোগেন। পরিবারপ্রধানরা তখন ভাবেন, বিয়েই হবে মেয়েটির নিরাপদ আশ্রয়। এতে মেয়েটির সম্মান রক্ষা হবে। অর্থাৎ পড়াশোনা শিখিয়ে মেয়েটিকে স্বাবলম্বী করার স্বাভাবিক সাহস তারা পান না। বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া অসহায় মেয়েটি অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে যদি কখনও স্বামী পরিত্যক্ত অথবা বিধবা হয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসে, তখন সমাজ তাকে বোঝা মনে করে। লোকের করুণার পাত্রে পরিণত হয়। কিন্তু একজন শিক্ষিত স্বাবলম্বী নারী স্বামী পরিত্যক্ত হলেও সে নিজের দায়িত্ব ও সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারে।
বহু মেধাবী শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের কারণে প্রতিনিয়ত ঝরে পড়ছে শিক্ষাজীবন থেকে। তাদের অস্ফুট কান্না হয়তো কেবল বাতাসই শুনতে পায়। অধিকাংশ বিয়ে হয় মেয়েটির মতামত না নিয়েই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিবাদ করার মতো মানসিকতা তখন গড়ে ওঠে না।
অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে হলে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় সমস্যা দেখা যায়। বাল্যবিয়ে নারীদের স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ। অকালে গর্ভধারণ, প্রসবকালীন জটিলতা, মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি, অপুষ্ট ও রুগ্ণ সন্তান প্রসব তো আছেই; পাশাপাশি বাল্যবিয়ে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলে। যতদিন পর্যন্ত আমরা সমাজকে বাল্যবিয়ের কলঙ্ক থেকে মুক্ত করতে না পারব ততদিন নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন নিয়ে যা কিছু বলি না কেন, তা পুরোপুরি ফলপ্রসূ হবে না।
এ জন্য সমাজে কন্যাবান্ধব পরিবেশ তৈরি হওয়া দরকার, যেখানে নারী মাত্রই শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হওয়ার পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা তার পরিবার থেকেই পাবে। তখন একজন নারী মানুষ হিসেবে তার ব্যক্তিসত্তার সর্বোচ্চ বিকাশের পথে এগিয়ে যেতে পারবে। প্রত্যেক কন্যাসন্তানের শিক্ষা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার।
মাহজাবিন আলমগীর: শিক্ষিকা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদন
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে আরো শক্তিশালী ও কার্যকর করার লক্ষ্যে নতুন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশটির অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
আরো পড়ুন:
নির্বাচন বানচালের যেকোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা হবে: প্রধান উপদেষ্টা
১৫ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার
আইন উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের আগে একটা মানবাধিকার কমিশন ছিল, কিন্তু সেটি কার্যত দন্তহীন একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। নিয়োগ পদ্ধতিতে ত্রুটি, এখতিয়ারে ঘাটতি এবং নেতৃত্বের দুর্বলতায় প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এবার সেটিকে সত্যিকারের এখতিয়ারসম্পন্ন, ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।”
তিনি জানান, নতুন অধ্যাদেশে মানবাধিকার কমিশনের কাঠামো, এখতিয়ার ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। কমিশন একজন চেয়ারম্যান ও চারজন সার্বক্ষণিক সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও যোগ্যতা নিশ্চিত করতে আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আবেদন আহ্বান করা হবে এবং প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বাছাই কমিটি সুপারিশ করবে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, “আমরা নিয়োগ পদ্ধতিটা এমনভাবে করেছি যাতে অভিজ্ঞ, যোগ্য ও মানবাধিকার রক্ষায় সক্রিয় মানুষরা কমিশনে জায়গা পান।”
তিনি আরো বলেন, “আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি এবং প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত মানবাধিকারগুলোকেও এই কমিশনের এখতিয়ারে আনা হয়েছে। এর ফলে কমিশন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী কাজ করতে পারবে।”
অধ্যাদেশে কমিশনের এখতিয়ার বহুলাংশে বাড়ানো হয়েছে। এখন থেকে শৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাতেও কমিশন তদন্ত করতে পারবে। আইন উপদেষ্টা বলেন, “আগের কমিশনের এখতিয়ারে গুরুতর সীমাবদ্ধতা ছিল, বিশেষ করে শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের ক্ষেত্রে। এবার সেই সীমাবদ্ধতা দূর করা হয়েছে।”
এছাড়া, গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা আইনসহ মানবাধিকার সংরক্ষণমূলক যেকোনো আইনের বাস্তবায়নের দায়িত্ব মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আলাদা করে ‘গুম কমিশন’ গঠনের প্রয়োজন হবে না বলে তিনি জানান।
অধ্যাদেশে কমিশনের আদেশ প্রতিপালনকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, “এখন থেকে কমিশনের সুপারিশ বা নির্দেশ উপেক্ষা করা যাবে না। এর বাধ্যবাধকতা আইনি কাঠামোয় যুক্ত করা হয়েছে।”
ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার উপস্থিত ছিলেন। খবর বাসসের।
ঢাকা/এসবি