খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিদায়ের মাধ্যমে আমরা আশা করেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা কাটবে; নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম চালু হবে। সে আশায় গুড়েবালি। কুয়েটের উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যকে অব্যাহতি দিয়ে সরকার ২৬ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারি করে। ৪ মে থেকে একাডেমিক কার্যক্রম চালুর সিদ্ধান্ত ছিল আগে থেকেই। কিন্তু শ্রেণি কার্যক্রম চালু হয়নি। এবার কুয়েটের শিক্ষক সমিতি ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দেয়। আড়াই মাস পর শিক্ষার্থীরা যখন শ্রেণিতে ফেরার জন্য উন্মুখ, তখনই শিক্ষক সমিতি শিক্ষার্থীদের বিচারের দাবি তুলে শ্রেণিতে যায়নি। এভাবে দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে এবং কুয়েট পরিস্থিতি সমাধানের পরিবর্তে আরও ঘোলাটে হয়েছে। 

মঙ্গলবার সমকাল অনলাইনের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল– কুয়েটের এমন অচলাবস্থা আগে দেখেনি কেউ। যেখানে বলা হয়, তিন মাস ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসে আসা নতুন ব্যাচ, যারা নতুন উদ্দীপনায় শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন, তাদের সূচনাটাও বিলম্বিত হচ্ছে। বুধবারও কুয়েটের শিক্ষকরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। কুয়েটে প্রথমে আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। পুরোনো উপাচার্যের বিদায়ের পর শুরু হয় শিক্ষকদের আন্দোলন। দুই পক্ষের আন্দোলনের কারণেই এই অচলাবস্থা। 

এর আগে লিখেছিলাম– কুয়েট প্রশাসনের এই অবস্থান কেন! (সমকাল, ১৭ এপ্রিল ২০২৫)। সেখানেই বলেছি, কুয়েটে এ পরিস্থিতির সূচনা হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল হামলা চালায়। ওই হামলায় অংশ নেওয়া রামদা হাতে থাকা যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। সেই হামলার ঘটনায় কুয়েট উপাচার্যসহ তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিচার করেনি বলেই তা উপাচার্যের পদত্যাগ পর্যন্ত গড়ায়। অবশ্য আরও গুরুতর কারণ হলো, শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার ঘটনা। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পর ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি সেখানে কিছু অতি উৎসাহী শিক্ষার্থী শিক্ষক লাঞ্ছনা ও অসম্মানের অঘটন ঘটিয়ে বসেন। ওই সময় হামলাকারীদের বিচার চেয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই ২৫ ফেব্রুয়ারি অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয় কুয়েট প্রশাসন। ফেব্রুয়ারি, মার্চের পর এপ্রিলে ঈদের ছুটি শেষে যখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়, তখন কুয়েট শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে আসেন। নিজেরাই হল খুলে ফেলেন। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সরকার কুয়েটের সেই উপাচার্য অধ্যাপক ড.

মুহাম্মদ মাছুদকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয়। এর পর ‘অন্তর্বর্তী’ উপাচার্য হিসেবে চুয়েটের অধ্যাপক হায়দার আলীকে নিয়োগ দেওয়া হয়।       

কুয়েটের বর্তমান অচলাবস্থার সমাধান শিক্ষকদের হাতেই। এই শিক্ষকরা ১৮ বা ১৯ ফেব্রুয়ারি লাঞ্ছিত হওয়ার পর কেন আন্দোলনে নামলেন না? যখনই ড. মুহাম্মদ মাছুদকে উপাচার্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো, তারপরই লাঞ্ছনার বিষয়টি সামনে এলো। প্রথমে শিক্ষকরা শ্রেণি কার্যক্রম বর্জন করলেন, এর পর প্রশাসনিক দায়িত্বও ত্যাগ করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। আমরা দেখেছি, উপাচার্য অধ্যাপক মাছুদের পক্ষে ছিল শিক্ষক সমিতি। তার মানে কি, তাদের দাবি অনুযায়ী ওই উপাচার্যকে সরকার বহাল রাখেনি বলেই এ আন্দোলন?
সংবাদমাধ্যমেই এসেছে, অন্তর্বর্তী উপাচার্য যখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসেছেন তখন শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সঙ্গে অসম্মানজনক আচরণ করার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন এবং চিঠিও দিয়েছেন শিক্ষকদের। এর আগেও শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছে অনানুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছেন। বারবার ক্ষমা চাওয়ার পরও শিক্ষকদের মন এতটুকু গলল না? 

বলা বাহুল্য, শিক্ষকদের অসম্মান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষাগুরুর মর্যাদা সবাই জানেন। কুয়েট শিক্ষকরা যেভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন, তা গোটা শিক্ষক সমাজেরই অপমান। তবে যখন শিক্ষার্থীরা বারবার ক্ষমা চেয়েছেন, তখন শিক্ষকরা মহান এবং অভিভাবক হিসেবে বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন– এটাই প্রত্যাশিত। 
কুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাডেমিক বিষয়ে আন্তরিক হিসেবেই আমরা দেখে আসছিলাম। দেশের অন্যান্য শিক্ষাঙ্গনে সংকটের সময়ও সেখানে শিক্ষা কার্যক্রমে ছেদ পড়েনি। একজন শিক্ষার্থী সমকালের প্রতিবেদককে বলেছেন, তিন মাসের অচলাবস্থার কারণে কুয়েটের সব শিক্ষার্থী সেশনজটে পড়েছেন। তারা বুয়েট ও রুয়েট থেকেও এগিয়ে ছিলেন; এখন তাদের থেকে পিছিয়ে গেছেন। এ সত্য কুয়েট শিক্ষক ছাড়া অন্যরা নিশ্চয়ই বেশি ভালো বুঝবেন না। 

এটাও বলা জরুরি, শিক্ষার্থীদের মূল কাজ পড়াশোনা। তা বাদ দিয়ে যেভাবে শিক্ষক তথা উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছেন, তা অপ্রত্যাশিত। শাস্তির ঘোষণায় তাদের চলমান আন্দোলনও প্রত্যাশিত নয়। বস্তুত শিক্ষার্থীদের দাবির মাধ্যমে উপাচার্যের পদত্যাগও শিক্ষকদের জন্য অসম্মানজনক। শিক্ষার্থীদের বরং আন্দোলনের পথ থেকে সরে গিয়ে শ্রেণি কার্যক্রমে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। দাবিদাওয়া থাকলে তারা নিয়ম অনুযায়ী অবশ্যই পেশ করবেন। কিন্তু তা একেবারে পদত্যাগ পর্যন্ত পৌঁছবে কেন? তাদের এ প্রবণতার কারণে বরিশালেও একই ঘটনা ঘটেছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেও সরকার সম্প্রতি সরিয়ে দিয়েছে। 

সর্বশেষ বলব, কুয়েটের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে অচলাবস্থা নিরসনে এগিয়ে আসুন। যাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে, শ্রেণি কার্যক্রম চালু রেখেই তাদের বিচার হতে পারে। কুয়েট যাতে আর পিছিয়ে না যায়, সে জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়কে এখনই ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে।
 
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: উপ চ র য র শ ক ষকদ র অসম ম ন শ ক ষকর র জন য সমক ল সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সন্ত্রাস ও অর্থের প্রভাবমুক্ত রাজনীতির প্রত্যয় এনসিপির: নওগাঁয় আখতার

রাজনীতির মাঠে সন্ত্রাস, পেশিশক্তি ও অর্থের দাপট বন্ধ করে একটি কল্যাণমুখী, মানবিক ও জনগণভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন।

আজ রোববার বেলা ১১টায় নওগাঁ শহরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন।

আখতার বলেন, ‘আমরা এমন একটি রাজনীতি চাই, যেখানে নেতৃত্ব আসবে মানুষের ভালোবাসা ও আস্থার মাধ্যমে। যেখানে দেশ ও জনগণের কল্যাণ থাকবে কেন্দ্রে। সন্ত্রাস, অর্থ বা গায়ের জোরের কোনো স্থান থাকবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত রাজনীতি হলো ত্যাগ ও জনসেবার জায়গা থেকে পরিচালিত। নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে, ভালো কাজের প্রতিযোগিতা থাকতেও পারে, কিন্তু সেখানে হিংসা, দ্বন্দ্ব, বিভাজন এবং প্রভাব খাটানোর সংস্কৃতি চলতে পারে না। এনসিপি এ মূল্যবোধেই বিশ্বাস করে।’

‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ শীর্ষক ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে আখতার হোসেন নওগাঁ সফর করেন। এই পদযাত্রা উপলক্ষে শহরে প্রবেশের সময় সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও আগ্রহের কথা তুলে ধরেন তিনি।

আখতার বলেন, পদযাত্রা চলাকালে নওগাঁ শহরে জনসাধারণের ঢল নামে। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে শহর। এতে বোঝা যায় মানুষ নতুন রাজনৈতিক ধারার খোঁজে আছে। তারা আগের মতো আর বিভ্রান্ত হতে চায় না।

তবে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, নওগাঁ শহরের অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর অবস্থা অত্যন্ত করুণ। একটি সম্ভাবনাময় জেলা হিসেবে নওগাঁর উন্নয়ন খুবই জরুরি। এখানকার অবকাঠামোগত সংকট, বেকারত্ব এবং জীবনমানের চ্যালেঞ্জগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

আখতার হোসেন জানান, নওগাঁতে এনসিপির বার্তা ব্যাপকভাবে পৌঁছেছে এবং নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। শুধু তরুণ নয়, প্রবীণ, মধ্যবয়সী, নারী-পুরুষ, এমনকি শহীদ পরিবারের সদস্যরাও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। এনসিপি যে কেবল তরুণদের দল, নওগাঁ সফর সে ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছে।

এনসিপির এই নেতা বলেন, রিকশাচালক, কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আপন করে নিচ্ছেন। এটা আমাদের বড় অনুপ্রেরণা।

আখতার হোসেন জানান, ইতোমধ্যে নওগাঁয় এনসিপির একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তা দ্রুত মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে তারা গ্রাম থেকে শহর প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছান এবং দেশের নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণে এনসিপির বার্তা তুলে ধরেন।

তিনি আরও বলেন, আমরা চাই, এনসিপি হবে সাধারণ মানুষের প্ল্যাটফর্ম। যারা নিঃস্বার্থভাবে দেশকে ভালোবাসেন, পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন তাদের জন্য এই দল হবে নতুন আশ্রয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ