মেরুদণ্ডের সমস্যার চিকিৎসা নিতে সাতক্ষীরার কলারোয়া থেকে ঢাকায় আসেন তানজিলা খাতুন। তিন বছরের সন্তান তাফসিনকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের বছিলায় মেয়ের বাসায় উঠেছিলেন তিনি। সেখানে ২৭ জুন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয় তাফসিন। রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় গত ৩০ জুন তাফসিনকে ভর্তি করা হয় শিশু হাসপাতালে। নিজের চিকিৎসা বাদ দিয়ে এখন ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় দিন কাটাচ্ছেন তিনি।
তানজিলার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাফসিনের জন্য প্রতিদিন ৭০০ টাকা শয্যা ভাড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন পরীক্ষা, ওষুধ বাবদ এখন পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি টাকা খরচ করেছেন। তাফসিনের বাবা মাছের আড়তে কাজ করেন। চিকিৎসা খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের।
তাফসিনের মতো ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের অনেকেই ভর্তি হচ্ছেন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভোগান্তির সঙ্গে চিকিৎসা খরচের ধাক্কা সামাল দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে স্বজনদের।
তানজিলার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাফসিনের জন্য প্রতিদিন ৭০০ টাকা শয্যা ভাড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন পরীক্ষা, ওষুধ বাবদ এখন পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি টাকা খরচ করেছেন। তাফসিনের বাবা মাছের আড়তে কাজ করেন। চিকিৎসা খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের।গতকাল শনিবার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতাল ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২৯৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন বরগুনা জেলায়—৬৬ জন। সব মিলে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে এ বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৯৫৪ জনে; আর মারা গেছেন ৪৫ জন। সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ডেঙ্গু রোগীর ৪৪ শতাংশই বরিশাল বিভাগে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে গতকাল পর্যন্ত ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে মোট ২ হাজার ৬৩৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ২৪ জনের।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগতকাল সকালে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালটির অষ্টম ও ১১ তম তলায় ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অষ্টম তলায় শিশু ওয়ার্ডে ১২ জন এবং ১১ তলায় সাধারণ ওয়ার্ডে নারী-পুরুষ রোগী মিলিয়ে মোট ৪২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সেবা নিচ্ছেন।
হাসপাতালের ওই দুটি তলার ডেঙ্গু ওয়ার্ড ঘুরে মোট ৫৪ জন রোগীকে দেখা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি বছরের শুরু থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫২৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন, যা গত বছরের এই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের চেয়ে ২২৬ জন বেশি। এবার এখানে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে গতকাল পর্যন্ত ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে মোট ২ হাজার ৬৩৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ২৪ জনের।মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১১ তলার ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী এবং তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভর্তি থাকা বেশির ভাগ রোগীই ঢাকার বাসিন্দা। তবে ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীও এই হাসপাতালে রয়েছেন। কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকার বাসিন্দা রিমি (১৬) ৯ দিন ধরে ভর্তি রয়েছে বলে জানান তার মা জুলিয়া বেগম। তিনি বলেন, তাঁর মেয়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক। পেটে পানি এসেছে। রক্ত দেওয়ার পরও প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। চিকিৎসা খরচ বহন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের।
আমরা শিশুদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখছি। যারা ভর্তি হচ্ছে, তাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশই ভালো হয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীদের পরীক্ষা–নিরীক্ষা বেশি করতে হয়। ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় রোগীর পরিবারের খরচ একটু বেশি হয়।মো.জাফর ইকবাল, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু সেলের দায়িত্বরত চিকিৎসক
বরগুনা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৫ বছরের ছেলে ফেরদৌসকে নিয়ে এসেছেন কৃষক আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, ফেরদৌস থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। ফলে চিকিৎসা খরচের পাশাপাশি নিয়মিত রক্ত জোগাড় করতেও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাঁর।
হাসপাতালের অষ্টম তলায় শিশু ওয়ার্ডের মূল সিঁড়ির এক পাশে ১২টি শয্যায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের। সিঁড়ির অন্য পাশে রয়েছে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্টসহ নানা অসুস্থতায় আক্রান্ত শিশুদের শয্যা। তবে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে থাকা বেডগুলোর বেশির ভাগেই মশারি খোলা অবস্থায় দেখা গেছে। এ বিষয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কেউ কথা বলতে চাননি।
চিকিৎসকেরা জানান, ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। শিশু হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। ডেঙ্গু নিয়ে আরও সতর্ক হতে হবে। নইলে সামনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।শিশু হাসপাতালগতকাল দুপুরে ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা সেল গঠন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে যাদের সার্বক্ষণিক নজরদারি প্রয়োজন, তাদের এই সেলে রাখা হয়েছে। রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা পরীক্ষা, স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিচ্ছেন সেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সরা। সেলের বাইরে থাকা রোগীদেরও প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বহির্বিভাগ থেকেও জ্বরের চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে। চিকিৎসকেরা জানান, ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। শিশু হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। ডেঙ্গু নিয়ে আরও সতর্ক হতে হবে। নইলে সামনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
এ সময় কথা হয় ফরিদপুরের সালথা উপজেলা থেকে আসা সুলতানা পারভীনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে জানান, তাঁর তিন বছরের শিশু সন্তান সাজিদের অতিরিক্ত জ্বর হওয়ায় প্রথমে ফরিদপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করান। পরীক্ষার পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। হঠাৎ করে অণুচক্রিকা কমে যাওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসেন। তবে প্লাটিলেট বাড়লেও শঙ্কা কাটেনি। তিনি বলেন, প্রতিদিনই কোনো না কোনো টেস্ট ও ওষুধ কিনতে ইতিমধ্যে সন্তানের চিকিৎসায় ৫০ হাজারের বেশি টাকা খরচ করে ফেলেছেন। কৃষক পরিবার হওয়ায় খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, চলতি বছরে হাসপাতালটিতে ৯৫টি শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়, যার মধ্যে জুন মাসে সবচেয়ে বেশি—৪১টি শিশু চিকিৎসা নেয়। এবার এ পর্যন্ত এখানে একটি শিশু মারা গেছে। এই হাসপাতালে গত বছরের জুন মাসে চিকিৎসা নেয় মাত্র ৫টি শিশু।
এ ছাড়া জুলাইয়ের প্রথম ৫ দিনেই ১১টি শিশু ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছে এই হাসপাতালে। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে একটি শিশুকে। গত বছরে শিশু হাসপাতাল থেকে মোট ৮০৬ শিশু ডেঙ্গুর চিকিৎসা নেয়।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই নতুন শিশু আসছে। দিন যতই যাচ্ছে, রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ধারণা করছি সামনে হয়তো পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। আমরা শিশুদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখছি। যারা ভর্তি হচ্ছে, তাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশই ভালো হয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীদের পরীক্ষা–নিরীক্ষা বেশি করতে হয়। ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় রোগীর পরিবারের খরচ একটু বেশি হয়।ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু সেলের দায়িত্বরত চিকিৎসক সহকারী অধ্যাপক মো. জাফর ইকবালআলাদা সেল গঠনপ্রকোপ বাড়ায় গতবারের মতো এবারও ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য আলাদা সেল গঠন করা হয়েছে শিশু হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, গত বছর ডেঙ্গু সেলে শিশুদের জন্য ৫০টির বেশি শয্যা রাখা হয়েছিল। এ বছর এখন পর্যন্ত ৭টি শয্যা রাখা হয়েছে, যার মধ্যে ৫টি ভাড়া এবং ২টি বিনা মূল্যের শয্যা রয়েছে। শয্যার জন্য রোগীকে প্রতিদিন ৭০০ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। তবে রোগী বাড়লে শয্যার সংখ্যাও বাড়ানো হবে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু সেলের দায়িত্বরত চিকিৎসক সহকারী অধ্যাপক মো. জাফর ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই নতুন শিশু আসছে। দিন যতই যাচ্ছে, রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ধারণা করছি সামনে হয়তো পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। আমরা শিশুদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখছি। যারা ভর্তি হচ্ছে, তাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশই ভালো হয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীদের পরীক্ষা–নিরীক্ষা বেশি করতে হয়। ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় রোগীর পরিবারের খরচ একটু বেশি হয়।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: খরচ ম ট ত ত চ ক ৎসক জন ড ঙ গ পর স থ ত গত বছর র জন য পর ব র পর ক ষ হয় ছ ন প রথম বছর র সরক র গতক ল র খরচ হওয় য় ত বছর
এছাড়াও পড়ুন:
চাঁদাবাজির মামলায় গাজীপুরের সাবেক বিএনপি নেতা স্বপন গ্রেফতার
গাজীপুরের টঙ্গীতে চাঁদাবাজি মামলায় সাবেক বিএনপি নেতা জিয়াউল হাসান স্বপন ওরফে জিএস স্বপনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে টঙ্গীর দত্তপাড়া এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
স্বপন দত্তপাড়া এলাকার কফিল উদ্দিন দেওয়ানের ছেলে। তিনি গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য।
টঙ্গী পূর্ব থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদুল ইসলাম বলেন, স্বপনের বিরুদ্ধে থানায় চারটি চাঁদাবাজির মামলায় রয়েছে। চারটির মামলার মধ্যে একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। দুটি মামলায় জামিনে রয়েছেন বলে শুনেছি। তার বিরুদ্ধে অন্য থানায় মামলা আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখে সোমবার আদালতে পাঠানো হবে।