পাহাড় কাটার পরও ৫০ কোটি টাকা জরিমানা মাফ
Published: 22nd, May 2025 GMT
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের সময় চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতি এলাকায় একাধিক পাহাড় কেটে পরিবেশের ক্ষতি করায় দুটি প্রতিষ্ঠানকে ৫০ কোটি টাকা জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। এর বিরুদ্ধে আপিল করলে প্রতিষ্ঠান দুটির একটিকে জরিমানা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অন্য প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতিপূরণের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করার আদেশ দিয়ে পরবর্তী শুনানিতে বিষয়টি নিষ্পত্তির কথা বলা হয়। তবে বিষয়টি পরে ধামাচাপা দেওয়া হয়।
প্রতিষ্ঠান দুটি হলো তমা কনস্ট্রাকশন ও মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনাল। তৎকালীন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান দুটিকে ওই ছাড় দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এটা ক্ষমতার ভয়াবহ অপব্যবহার। পরিষ্কারভাবে বোধগম্য যে দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সচিবের যোগসাজশ ও সম্পৃক্ততায় এটি (জরিমানা মওকুফ) হয়েছে।ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবিযদিও পাহাড় কাটা ও খাল ভরাট করার মাধ্যমে অপরাধ সংগঠনের অভিযোগে করা মামলায় মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনাল চট্টগ্রামের পরিবেশ আদালতের কাছে দায় স্বীকার করেছে। প্রতিষ্ঠানটিকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন আদালত। তমা কনস্ট্রাকশনকেও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
অথচ সাবেক সচিব মোস্তফা কামাল জরিমানা মওকুফের কারণ হিসেবে বলেছিলেন, মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনাল পাহাড় কাটায় জড়িত নয়। আর তমা কনস্ট্রাকশনের আপিল আবেদনের শুনানিতে তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরকে ক্ষতিপূরণের প্রকৃত মূল্যায়ন ও কারিগরি মূল্যায়ন উপস্থাপন করার কথা বলেছিলেন। পরবর্তী শুনানির দিন আপিল নিষ্পত্তি করা হবে বলে আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তমা কনস্ট্রাকশনের পরিবেশের ক্ষতির প্রকৃত মূল্যায়নে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকার মতো আসে। ফলে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়।
তমা কনস্ট্রাকশন ও মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনালকে ছাড় দেওয়ার ঘটনাটি ২০২২ সালের জুন মাসের। সে সময় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আপিল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ছিলেন মোস্তফা কামাল। তিনি প্রতিষ্ঠান দুটিকে ছাড় দেন।পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্ষতিপূরণসংক্রান্ত বিধি অনুযায়ী, ১ বর্গফুট থেকে ১ একর পর্যন্ত পাহাড় কাটায় প্রতি বর্গফুটের জন্য ১০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা জরিমানা করা যায়। এক একরের বেশি হলে প্রতি বর্গফুটের জন্য জরিমানার অঙ্ক দাঁড়াবে ১ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। আর কারিগরি মূল্যায়ন (টেকনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট) হলো অনুমোদিত সীমার (অ্যালাইনমেন্ট) বাইরে গিয়ে কতটুকু পাহাড় কাটা হয়েছে, তার বিবরণ। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। ওই ১০১ কিলোমিটারের মধ্যে ১১ দশমিক ৯২ কিলোমিটার এলাকায় পাহাড় কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, সেটিই অ্যালাইনমেন্ট।
তমা কনস্ট্রাকশন ও মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনালকে ছাড় দেওয়ার ঘটনাটি ২০২২ সালের জুন মাসের। সে সময় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আপিল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ছিলেন মোস্তফা কামাল। তিনি প্রতিষ্ঠান দুটিকে ছাড় দেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে তাঁকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। তিনি তখন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের দায়িত্বে ছিলেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তমা কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী আতাউর রহমান ভূঁইয়া দেশ ছেড়ে গেছেন। এ জন্য তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তমা কনস্ট্রাকশনের ওয়েবসাইটে থাকা টেলিফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে ওই নম্বরে কল ঢোকেনি।
পাহাড় কাটা ও খাল ভরাটের ঘটনায় তমা কনস্ট্রাকশন ও মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের নভেম্বরে মামলা করে চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তর।যেভাবে জরিমানা মওকুফপরিবেশ অধিদপ্তরের নথি বলছে, লোহাগাড়ার চুনতি ইউনিয়নে প্রায় ২০টি পাহাড় কেটে ২ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট মাটি সংগ্রহ করে মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনাল। এ ক্ষেত্রে রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য অনুমোদিত পাহাড় কাটার সীমা লঙ্ঘন করা হয়। এ ছাড়া রাঙ্গাখাল নামের একটি খাল ভরাট করা হয়।
নথি অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য, ছবি এবং প্রতিষ্ঠানের চুক্তি ও অন্যান্য কাগজপত্র পর্যালোচনা করে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতির বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ৭ ধারায় মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনাল ও তমা কনস্ট্রাকশনকে ৫০ কোটি টাকা জরিমানা করা হলো। জরিমানার টাকা পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
একই বছরের ১৮ জানুয়ারি অধিদপ্তরের ওই রায়ের বিরুদ্ধে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আপিল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালের কাছে আপিল করে মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃপক্ষ। আপিলে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, তিনি সামান্য ব্যবসায়ী। তমা কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে এক লাখ ঘনফুট বালু সরবরাহের কার্যাদেশ পেয়েছেন। আপিলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালকের বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য না নিয়ে জরিমানা করার অভিযোগও করেন ইলিয়াছ।
২০২২ সালের ১৬ জুন ওই আপিলের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে ইলিয়াছের বক্তব্য এবং পাহাড় কাটায় আরেক অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনের দেওয়া সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আপিল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল জরিমানা মওকুফের সিদ্ধান্ত দেন। ওই সিদ্ধান্তে বলা হয়, মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনাল পাহাড় কাটায় ও খাল ভরাটে জড়িত নয়।
মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইলিয়াছ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাহাড় কাটার বিষয়টি রেলওয়ে ও তমার বিষয়। আমি কিছুতে ছিলাম না। আপিল করেছি। নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি। আমাকে খালাস করে দিয়েছে।’
মামলা দায়েরে দেরিপাহাড় কাটা ও খাল ভরাটের ঘটনায় তমা কনস্ট্রাকশন ও মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের নভেম্বরে মামলা করে চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তর।
পরিবেশের ক্ষতির আর্থিক মূল্য হিসেবে ২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি তমা কনস্ট্রাকশন ও মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনালকে ৫০ কোটি টাকা জরিমানা করেছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের (চট্টগ্রাম) তৎকালীন পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জম হোসাইন। অথচ মামলা করা হয় এর ৯ মাস পর, নভেম্বরে। এ মামলায় গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করেন চট্টগ্রামের পরিবেশ আদালত।
বক্তব্য জানতে সাবেক সচিব মোস্তফা কামালের মুঠোফোনে কল দেওয়া হয়। খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠানো হয়। তবে তাৎক্ষণিক সাড়া পাওয়া যায়নি। দুদিন পর ২০ মে খুদে বার্তার জবাব দেন মোস্তফা কামাল। সেখানে তিনি বলেন, বিষয়টি ঠিক মনে করতে পারছেন না। সংশ্লিষ্ট অফিসে এটার ফাইল আছে। সেখানে যোগাযোগ করে তথ্য নিতে পারেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ক্ষমতার ভয়াবহ অপব্যবহার। পরিষ্কারভাবে বোধগম্য যে দুটি প্রতিষ্ঠানের (তমা কনস্ট্রাকশন ও মেসার্স হাসান ইন্টারন্যাশনাল) সঙ্গে সচিবের যোগসাজশ ও সম্পৃক্ততায় এটি হয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হিসেবে সচিবকে বিবেচনা করা উচিত।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কনস ট র কশন র ২০২১ স ল র ও খ ল ভর ট ৫০ ক ট ন পর ব র আপ ল মওক ফ র ঘটন ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
তিন চ্যাম্পিয়ন দলসহ যেসব তারকাকে দেখা যাবে না ক্লাব বিশ্বকাপে
আর মাত্র এক দিনের অপেক্ষা। এরপরই শুরু হবে বহুল আলোচিত ক্লাব বিশ্বকাপের মহারণ। রোববার সকাল ছয়টায় স্বাগতিক ইন্টার মায়ামি ও আল আহলির মধ্যে ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে আন্তমহাদেশীয় ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের এই লড়াই।
এরই মধ্যে ক্লাব বিশ্বকাপের ট্রফিকে পাখির চোখ করে প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছে দলগুলো। যেখানে এক মাসব্যাপী দেখা যাবে তারার দ্যুতিও। তবে ক্লাবের বিশ্বকাপের ঝলমলের প্রদীপের নিচে আছে কিছু অন্ধকারও।নিয়মের কারণে বেশ কিছু শীর্ষ দল ও তারকাদের এই টুর্নামেন্টে থাকতে হবে দর্শক হয়ে। ক্লাবগুলোর মধ্যে যে তালিকায় আছে ইউরোপে চলতি মৌসুমের তিনটি চ্যাম্পিয়ন দলও।
ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে কেবল বুন্দেসলিগাজয়ী বায়ার্ন মিউনিখ এবং ফরাসি লিগ আঁ চ্যাম্পিয়ন পিএসজি এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারছে। প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন লিভারপুল, লা লিগা বিজয়ী বার্সেলোনা এবং সিরি ‘আ’ চ্যাম্পিয়ন নাপোলিকে দেখা যাবে না এই প্রতিযোগিতায়।
আরও পড়ুনক্লাব বিশ্বকাপ শুরুর আগে রিয়াল মাদ্রিদ যেখানে ব্যতিক্রম৮ ঘণ্টা আগেবার্সেলোনা, লিভারপুল এবং নাপোলি কেন জায়গা পায়নিফিফার ঠিক করা নিয়ম অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৪ সময়ের মধ্যে আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় যারা মহাদেশীয় ক্লাব প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, ২০২৫ ক্লাব বিশ্বকাপে তারাই শুধু জায়গা পাবে। এ নিয়ম অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৪—এই চার বছরে চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী চেলসি (২০২১), ম্যানচেস্টার সিটি (২০২৩) ও রিয়াল মাদ্রিদ (২০২২ ও ২০২৪) ক্লাব বিশ্বকাপে সরাসরি জায়গা করে নিয়েছে।
দারুণ ছন্দে থাকা বার্সা ক্লাব বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায়নি