কী উদ্দেশ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তা নিয়ে এর অংশীজনের মধ্যেই রয়েছে বিতর্ক। তবে এর প্রেক্ষাপট নিয়ে বিতর্ক নেই। সবাই দেখেছি, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কীভাবে চলে গিয়েছিল সরকার পতনের দিকে। আর কোনো সংস্কারের বিষয় তখন সামনে ছিল না। সরকার এর সহজ নিষ্পত্তির দিকে গেলে আন্দোলনের দ্রুত সমাপ্তি ঘটত বলেই ধারণা।
এর বদলে নিষ্ঠুরভাবে আন্দোলন দমনের চেষ্টা সরকারের পতনকে করে ত্বরান্বিত। সরকার পতনের মাত্র দু’দিন আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জনসমাবেশ থেকে আসে সরকারের পদত্যাগের পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের ঘোষণা।
সংস্কারের প্রশ্ন সামনে এনেছিল গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী শিক্ষার্থী-তরুণেরা। তবে সংস্কারের প্রশ্নটি নতুন নয়। নব্বইয়ে সেনাশাসন অবসানের পর গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই রাষ্ট্র সংস্কারে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা ড.
সংস্কার এ দেশে অবহেলিত বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে জনসমর্থিত সংস্কারের বিপরীতেও কাজ করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য। শেখ হাসিনা সরকার এটা করে নির্বাচন ব্যবস্থাই ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিনষ্টসহ বিভিন্ন অনাচারে নিমজ্জিত হয় সরকার। তাতে জাতিও অপরিমেয় ক্ষতির শিকার হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করেছে বৈ কি। সংস্কারের প্রশ্নটি আর অবহেলিত না রেখে সেটা করা গেলে গণতন্ত্রপ্রিয় কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়।
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছে শুরু থেকেই। মুহাম্মদ ইউনূস এর প্রধান হওয়ায় বিষয়টি আরও গতি পেয়েছে। স্মর্তব্য, ড. রেহমান সোবহানের উদ্যোগে গঠিত একটি টাস্কফোর্সের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। সংস্কার ছাড়া শুধু একটি নির্বাচন আয়োজনে তারা কোনো অর্থ দেখেন না। আশার কথা, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী কোনো দলও সংস্কারের বিরোধিতা করছে না। সরকার নিজে থেকে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করলে তাদের সবাই একে স্বাগত জানায়। কমিশনগুলোর রিপোর্ট থেকে বাছাই করা সুপারিশের ওপর সংলাপেও অংশ নিচ্ছে তারা। এর দ্বিতীয় পর্যায় চলমান।
প্রথম পর্যায়ের সংলাপে যেসব প্রশ্নে ঐকমত্য মেলেনি, সেগুলোয় ঐকমত্য আনতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সংবিধান সম্পর্কিত কিছু সংস্কারকে তারা বলছে ‘মৌলিক সংস্কার’। এর বাইরে অনেক সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু একমত হয়েছে। বাছাই করা অনেক সুপারিশ নিয়ে আলোচনার আদৌ প্রয়োজন নেই বলে মনে করে সরকার। এ নিয়ে কেউ আপত্তি জানায়নি। বরং প্রশ্ন রাখা হচ্ছে– কেন এগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। এর মধ্যে কিছু আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে গিয়ে সরকার বিপাকে পড়েছে অবশ্য। এ অভিজ্ঞতার কারণেও অন্যান্য ক্ষেত্রে হাত দিতে তারা অনুৎসাহী হতে পারে। অর্থনীতি বিষয়ে কমিটি আর টাস্কফোর্সের রিপোর্ট বাস্তবায়নেও আগ্রহ দেখাচ্ছে না সরকার। এ অবস্থায় মৌলিক সংস্কারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আয়োজিত সংলাপ শেষে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণাতেই সরকার উৎসাহী। জুলাইয়ের মধ্যেই নাকি এটি সম্পন্ন হবে।
সংস্কার সুপারিশের যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা গেল না, সেসবও থাকবে জুলাই সনদে। সংস্কারের কতখানি বর্তমান শাসনামলে আর কতখানি নির্বাচিত সরকারের আমলে বাস্তবায়িত হবে, সেটাও স্পষ্ট করা হবে। একতরফাভাবে সংস্কার চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চলমান সংলাপে যেসব ঐকমত্য মিলবে, সেগুলোও অনুমোদিত হবে নির্বাচিত সংসদে। সে অর্থে জুলাই সনদ হবে রাষ্ট্র সংস্কারের অঙ্গীকারনামা। নব্বইয়ের পট পরিবর্তনের পরও রাজনৈতিক দলগুলো কিছু অঙ্গীকারে পৌঁছেছিল, যা ‘তিন জোটের রূপরেখা’ নামে পরিচিত। এটি বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতাও খারাপ। দীর্ঘদিন পর যে জুলাই সনদ আসতে যাচ্ছে, তা বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা কি ভিন্ন হবে?
প্রধান দল বিএনপি অবশ্য প্রায় দু’বছর আগেই রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা ঘোষণা করেছিল। তারা বলছে, এখনকার সংস্কার প্রস্তাবের সিংহভাগই সেই ৩১ দফায় রয়েছে। তা সত্ত্বেও মৌলিক সংস্কারের কিছু প্রশ্নে তাদের ভিন্নমত স্পষ্ট। ছাড় দেওয়ার বেলায়ও সতর্ক দেখা যাচ্ছে দলটিকে। সত্যি বলতে, বিএনপির আপত্তি উপেক্ষা করে কোনো সংস্কার এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এমনকি সংলাপে উপস্থিত সিংহভাগ দল একমত হলেও নয়। সংস্কারে থাকা চাই সব দলের ঐকমত্য। এটা অন্তর্বর্তী সরকারেরও অবস্থান। তার পক্ষে ঐকমত্য কমিশন কেবল চাইছে যতটা সম্ভব ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে। প্রধান উপদেষ্টা এ লক্ষ্যেই কমিশনটি গঠন করেছিলেন। এর মেয়াদও সুনির্দিষ্ট।
এর মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপও সুস্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিচার ও সংস্কারে ‘পর্যাপ্ত অগ্রগতি’ এলে রমজানের আগে, ফেব্রুয়ারিতেও বহুল প্রত্যাশিত নির্বাচনটি করা যেতে পারে। আদর্শস্থানীয় না হলেও গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অস্থির পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচন হওয়া যে প্রয়োজন, সেই মত এখন জোরালো। প্রায় ১১ মাসেও সংস্কারে অগ্রগতি না হওয়ায় সংস্কারবাদী অনেকেই এখন দ্রুত নির্বাচন দেখতে চাইছেন। ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে স্থবির অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণের দাবিকে করে তুলেছে প্রবল। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিকটবর্তী করতে সরকারও দৃশ্যত প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় সংস্কার আলোচনায়ও গতি এসেছে, বলতে হবে। নির্বাচন কমিশনকেও নড়েচড়ে বসতে দেখা যাচ্ছে। তারা অবশ্য ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে ধরে নিয়েই কাজ করছিল। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে আরও প্রায় দু’মাস মিলবে। নির্বাচন কমিশনেরও কিছু সংস্কারের এজেন্ডা রয়েছে। আছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সর্বসম্মত সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রশ্ন।
মৌলিক সংস্কারে শেষতক কতটা কী অগ্রগতি হয়, সেটা দেখতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। বড় ঐকমত্য না হলেও এ বিষয়ক বিতর্ক উপভোগ্য বৈ কি। বিশেষ করে ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা দলগুলো দূরদৃষ্টির পরিচয় দিলে অনেক আগেই এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আনা যেত বলে মনে হয়। মাঝে সাড়ে ১৫ বছর রাষ্ট্রকে করা হয়েছে কার্যত বিপরীতমুখী। এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি থেকে উঠে
দাঁড়াতে সংস্কারের পথেই হাঁটতে হবে। তবে ‘প্রত্যাশিত সংস্কার’ করতে গিয়ে আবার নির্বাচনকে বেশি দূরে ঠেলা যাবে না।
সংস্কার নির্বাচনের পরও করা যাবে; কিন্তু নির্বাচন আয়োজন না করে বসে থাকা যাবে না। ‘মৌলিক সংস্কার’ কাজে অগ্রগতি আসেনি বলে নির্বাচন করা অর্থহীন– এমন অবস্থানও গণতন্ত্রবিরোধী। নির্বাচিত সরকার এলে সংস্কারের সুযোগ অনুপস্থিত হয়ে যাবে– এটা মনে করারও কারণ নেই। এমন হতাশাজনক ভাবনায় আচ্ছন্ন না থেকে নির্বাচনী তপশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত সময়টাকে যতটা সম্ভব সংস্কার বাস্তবায়নে কাজে লাগানোই হবে দায়িত্বশীলদের করণীয়।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন জ ল ই সনদ সরক র র ঐকমত য
এছাড়াও পড়ুন:
প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ ১০ বছর, আলোচনায় ঐকমত্য হয়নি
এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন—সংবিধানে এমন বিধান যুক্ত করার বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশির ভাগ দল একমত হয়েছে। তবে বিএনপিসহ তিনটি দলের আপত্তি থাকায় এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘ বিতর্ক হলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে ঐকমত্য হয়নি। বিষয় দুটি নিয়ে আরও আলোচনা হবে।
গতকাল রোববার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের বৈঠকের পঞ্চম দিনে এ দুটি বিষয়ে আলোচনা হয়। বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে আলোচনা শুরু হয়। এক ঘণ্টার মতো মধ্যাহ্নবিরতি দিয়ে আলোচনা চলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। ধারাবাহিক এ আলোচনায় ৩০টি দল অংশ নিচ্ছে। আজ সোমবার ও আগামীকাল আলোচনা মুলতবি থাকবে।
একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কতবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করে সংবিধান সংস্কার কমিশন। প্রস্তাবে বলা হয়, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। গত বৃহস্পতিবার ঐকমত্য কমিশনে প্রস্তাবটি নিয়ে কিছু সময় আলোচনার পর তা মুলতবি করা হয়।
গতকাল সকালে এ নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়। দুই পূর্ণ ‘মেয়াদ’ হবে নাকি দুই ‘বার’ হবে, তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক হয়। কেউ কেউ সংসদের দুই মেয়াদের পক্ষে, কেউ কেউ দুবারের (মেয়াদ যত দিন হোক সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে পারবেন) পক্ষে মত দেন।
যুক্তিতর্কের একপর্যায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এভাবে ঐকমত্যে আসা হয়তো সম্ভব হবে না। এর বদলে একজন সর্বোচ্চ কত বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, তা ভেবে দেখার আহ্বান জানান তিনি।
পরে ঐকমত্য কমিশন বিষয়টি নিয়ে দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য সময় দিয়ে বিরতি দেয়। বিরতিতে দলগুলোর নেতারা নিজেদের মধ্যে এবং অন্য দলের নেতাদের সঙ্গে ভাগ ভাগ হয়ে আলোচনা করেন। বিরতি শেষে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বৈঠকে বলেন, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন, এ বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন।
পরে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, মেয়াদ বা বারের বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে না। বিকল্প হিসেবে এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন, এমনটা বলার ক্ষেত্রে কারও আপত্তি আছে কি না। তখন বিএনপি, এনডিএম ও বাংলাদেশ এলডিপি এ বিষয়ে দ্বিমত জানায়।
ভিন্নমত তুলে ধরে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, একটি পপুলার মতামত এসেছে ১০ বছর। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের সঙ্গে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি), সংসদের উচ্চকক্ষ গঠিত হলে তার কাজ কী হবে, এসব বিষয় সম্পর্কিত। এগুলো একসঙ্গে প্যাকেজ আকারে আলোচনা করা উচিত। এ রকম হলে তিনি হয়তো দলের একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে আসতে পারবেন।
একপর্যায়ে আলী রীয়াজ বলেন, তিনটি দলের পক্ষে আপত্তি করা হয়েছে। প্যাকেজ আকারে আলোচনা হলে আলোচনা ‘কলাপস’ করার আশঙ্কা আছে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, এ বিষয়ে বড় ধরনের ঐকমত্য আছে। তিনটি দল ছাড়া বাকিরা একমত। এ বিষয়ে লিখিত ঐকমত্যে যাওয়া যায় কি না, তা বিবেচনার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ জাসদের নেতা মুশতাক হোসেন বলেন, ৭০ ধারার ক্ষেত্রে বিএনপি যেভাবে একটি নোট দিয়েছিল, এ ক্ষেত্রেও নোট দিতে পারে। কিন্তু পরে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, এনসিসি, উচ্চকক্ষ এগুলো সম্পর্কিত বিষয়। এগুলো নিয়ে দলে একসঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাতে চান তিনি।
এ বিষয়ে বিভিন্ন দলের নেতারা নানা যুক্তিতর্ক তুলে ধরলেও শেষ পর্যন্ত কোনো ঐকমত্য হয়নি। কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা না করে আলোচনা মুলতবি করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ।
আলোচনা শেষে বিকেলে আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বৈঠকের অগ্রগতি তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি—এ দুটো বিষয় আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ আলোচনা শেষে আমরা সুস্পষ্ট এক জায়গায় এসেছি। একজন ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, এ রকম একটি জায়গায় আসার পর আমরা এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি। আলোচনার পরে তিনটি দল ভিন্নমত পোষণ করে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার কথা বলেছে। তারা তাদের নির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করে আবার আলোচনার কথা বলেছে।’
মূলনীতি
সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতির উল্লেখ আছে। সেগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাবে মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছে। তবে বিদ্যমান মূলনীতি অক্ষুণ্ন থাকবে কি না, সে বিষয়ে কিছু বলেনি কমিশন।
গতকালের আলোচনায় মূলনীতি প্রশ্নে দলগুলো মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। বামপন্থী দলগুলো বিদ্যমান চার মূলনীতি অক্ষুণ্ন রেখে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার যুক্ত করার পক্ষে। বাকি দলগুলোর বেশির ভাগ বিদ্যমান চার মূলনীতি বাদ দিয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র প্রতিস্থাপন করার পক্ষে। আর ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রস্তাব হলো মূলনীতিতে ‘মহান আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ও যুক্ত করা হোক। তারা ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরে।
এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরে সালাহউদ্দিন আহমদ আলোচনায় বলেন, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যেভাবে মূলনীতি ঠিক করা হয়েছিল, তাঁরা তার পক্ষে। এর সঙ্গে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার যুক্ত করতে তাঁদের আপত্তি নেই।
বিদ্যমান মূলনীতির বিপক্ষে জামায়াতে ইসলামী। তারা সাম্য, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র এবং মানবিক মর্যাদা প্রতিস্থাপনের পক্ষে মত দেয়। দলের অবস্থান তুলে ধরে জামায়াতে ইসলামীর নেতা হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, তাঁরা জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ এটিও রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি ও সংবিধানের প্রস্তাবনায় যুক্ত করার পক্ষে।
বিদ্যমান সংবিধানকে ‘মুজিববাদী’ আখ্যা দিয়ে এনসিপির জাবেদ রাসিন বলেন, এই চার মূলনীতি রেখে আলোচনা চলতে পারে না।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সংবিধান অর্জিত হয়েছে। এই সংবিধানের চার মূলনীতি বাদ দিয়ে এখন অন্য কিছু গ্রহণ করা ঠিক হবে না। আলোচনার একপর্যায়ে বিষয়টি পরবর্তী সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে কি না, এমন মতও আসে।
জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, যারা ক্ষমতায় যাবে তারা ঠিক করবে, এমন হলে ঐকমত্য কমিশনের কোনো প্রয়োজন থাকে না। এ ক্ষেত্রে বরং গণভোটই একটি উপায় হতে পারে।
আলোচনা শেষে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত্তি ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও সেই সময়ের ঘোষণাপত্র। সেই ঘোষণায় সাম্য, মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল। সেটাই ছিল প্রথম সংবিধানের মূল ভিত্তি। এই মূল্যবোধ সামনে রেখে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি নির্ধারণ করতে হবে।
দুপুরের বিরতিতে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনেকগুলো বিষয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে একমত হচ্ছি আমরা। কিন্তু এখানে কিছু কিছু দল একবারে নিজেদের অবস্থানে অনড়। এভাবে চলতে থাকলে কেয়ামত পর্যন্ত কোনো ঐক্যের সম্ভাবনা দেখি না।’
আলোচনা শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, বিভিন্ন দলের অনুভূতি ও অবস্থান বিবেচনা করে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে একটি সুনির্দিষ্ট লিখিত প্রস্তাব হাজির করা হবে।
আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান ও মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার আলোচনা সঞ্চালনা করেন।