বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্যনীতি কেবল অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এটি ভূরাজনৈতিক কৌশল, প্রযুক্তিগত আধিপত্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রতিফলন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক শুল্কনীতি একদিকে যেমন এশীয় দেশগুলোর ওপর চাপ তৈরি করছে, অন্যদিকে তাদের বিশ্ববাণিজ্য–ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

শুল্ক, সরবরাহ চেইন, উৎপাদনকেন্দ্র, বাজার—সবকিছু যেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে একসময় যুক্তরাষ্ট্রকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাণিজ্যিক অংশীদার মনে করত, আজ সেখানেই তৈরি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব।

টান ইউ কং তাঁর কোম্পানিকে দরজির দোকানের সঙ্গে তুলনা করেন, যেখানে গ্রাহকের পছন্দ অনুযায়ী চিপ তৈরি হয়। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমরাই কাপড় দিই, হাতার বোতাম থেকে শুরু করে সবকিছু দিই। গ্রাহক শুধু বলেন কী ডিজাইন তাঁর পছন্দ, আমরা তা বানিয়ে দিই।’ টানের কোম্পানির নাম গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজ। এখন প্রতিষ্ঠানটি শুধু চিপ নয়, নিজেদের ভবিষ্যৎও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনিশ্চিত শুল্কনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নির্ধারণ করতে চান। ৯ জুলাইয়ের আগে ওয়াশিংটনকে খুশি রাখতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দেশ। শুল্কযুদ্ধে যে ৯০ দিনের বিরতি দিয়েছিলেন ট্রাম্প, সেদিন তা শেষ হবে।

গত শুক্রবার ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ১ আগস্ট কার্যকর হতে যাওয়া নতুন উচ্চ শুল্কের বিস্তারিতসংবলিত ১২টি চিঠি বিভিন্ন দেশকে পাঠানো হবে। এই শুল্কের হার হবে ১০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত সেমিকন্ডাক্টরে শুল্ক আরোপ করা হয়নি, কিন্তু ট্রাম্প এ নিয়ে বারবার হুমকি দিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলোর পক্ষে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ব্লুমবার্গ সম্প্রতি জানিয়েছে, হোয়াইট হাউস মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে এআই চিপ রপ্তানির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করতে যাচ্ছে। তাদের সন্দেহ, এসব প্রযুক্তি চীনে পাচার হচ্ছে। টানের প্রশ্ন, প্রতিদিন নীতি বদলাতে থাকলে কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা সম্ভব।

এএমডি, ব্রডকম ও কোয়ালকমের মতো বড় কোম্পানির জন্য চিপ তৈরি করে গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে এশিয়ায়-ভারত থেকে দক্ষিণ কোরিয়া পর্যন্ত রয়েছে তাদের কারখানা। প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তারা ১৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ বাড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থার একাংশ স্থানান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গেও কাজ করছে কোম্পানিটি।

চিপ, বস্ত্রশিল্প ও গাড়ির যন্ত্রাংশ—এসব খাত যাদের সরবরাহব্যবস্থা এশিয়া অঞ্চলে ঘনীভূত, তারা এখন বাজারের অস্থিরতার মধ্যে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের অপর্ণা ভরদ্বাজ বিবিসিকে বলেন, এখন ব্যবসা-বাণিজ্যে বিকল্প পরিকল্পনা করে রাখতে হচ্ছে। তাঁর মতে, এতে নতুন সুযোগ তৈরি হলেও কিছু দেশের বাজার হারানোর ঝুঁকিও রয়েছে।

জয়-পরাজয়ের হিসাব

এপ্রিল মাসে ট্রাম্পের ঘোষিত পাল্টা শুল্কের সময় এশিয়ার দেশগুলোই ছিল মূল নিশানায়-জাপানের ওপর ২৪ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ ও ভিয়েতনামের ওপর সর্বোচ্চ ৪৬ শতাংশ শুল্ক। পরে তিনি ৯০ দিনের জন্য তা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনেন। তবে আগামী বুধবার থেকেই তা ২ এপ্রিলের ঘোষিত শুল্কহারে ফিরতে পারে।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই শুল্কের কারণে বস্ত্র, আসবাব, রাবার ও প্লাস্টিকশিল্পের ভয়াবহ ক্ষতি হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থাকা সত্ত্বেও সিঙ্গাপুরকে ১০ শতাংশ শুল্কের আওতায় আনা হয়েছে—এ নীতি বন্ধুত্বসুলভ নয় বলে মনে করেন তিনি।

২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতির মোট জিডিপির ৭ দশমিক ২ শতাংশের জোগান দিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। নতুন শুল্ক এসব দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করছে।

এ অঞ্চলে এখন পর্যন্ত কেবল ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে পেরেছে—তাদের পণ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক ধার্য হলেও যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি থাকবে শুল্কমুক্ত। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এখনো আলোচনার টেবিলে থাকলেও ট্রাম্প জাপানের পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। মাজদার মতো গাড়ি কোম্পানি বলছে, সরবরাহকারী বদলানো বা উৎপাদন স্থানান্তর করা সময়সাপেক্ষ, যে কারণে তারা এখন কেবল টিকে থাকার পর্যায়ে চলে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সামরিক মিত্র অস্ট্রেলিয়া বলছে, তাদের ওপর শুল্ক ‘শূন্য’ হওয়া উচিত। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি পণ্য কিনতে চাইছে এবং তারা শুল্কছাড় দিতে প্রস্তুত। কিন্তু কম্বোডিয়ার মতো দরিদ্র দেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমভাবে লেনদেন করা সম্ভব নয়, তাদের জন্য ৪৯ শতাংশ শুল্ক ভয়ংকর আঘাত।

অর্থনীতি ও রাজনীতির অধ্যাপক পুষণ দত্ত বলেন, এশিয়ার অর্থনীতি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—উভয়ের ওপর নির্ভরশীল.

..তারা বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থার কেন্দ্রস্থলে। তাঁর মতে, যেসব দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেশি, যেমন ভারত, তারা কিছুটা সুরক্ষিত; কিন্তু রপ্তানিনির্ভর দেশ, যেমন সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, এমনকি চীন বড় ধাক্কা খাবে।

নতুন বিশ্বব্যবস্থা

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো চিপ নির্মাণ ও ডেটা সেন্টারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে। এ উদ্যোগ উৎপাদন ও সরবরাহ চেইন এমন বন্ধুপ্রতিম বা মিত্রদেশগুলোয় সরিয়ে নেওয়া, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে এমন দেশে উৎপাদন স্থানান্তর করা। একই সঙ্গে ‘চায়না + ১’ কৌশলের মাধ্যমে অনেক প্রতিষ্ঠান চীন ও তাইওয়ান ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কার্যক্রম বিস্তার করছে।

এই কৌশলের মূল লক্ষ্য ছিল মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার ধরে রাখা। অপর্ণা ভরদ্বাজ বলেন, ‘যা–ই ঘটুক, যুক্তরাষ্ট্র এখনো অনেক এশিয়ান ব্যবসার জন্য বড় বাজার। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতি এবং সবচেয়ে গতিশীল ভোক্তা বাজার।’ তবে শুল্ক শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকেই আঘাত করছে না, এ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা বহু মার্কিন প্রতিষ্ঠানও ক্ষতির মুখে।

বিশেষ করে পোশাক ও জুতাশিল্প—যেমন নাইকি—অনেক আগেই উৎপাদন স্থানান্তর করেছে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে; এখন তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে তা ভোক্তার ওপর চাপাতে বাধ্য হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন বিনিয়োগকারীরা কম শুল্কের দেশের দিকে ঝুঁকতে পারেন, যেমন ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকার মতো বাজারেও নতুন গ্রাহক খুঁজছে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

গ্লোবালফাউন্ড্রিজের টান বলেন, ‘আমরা এখন আর বিশ্বায়ন করছি না, বরং আঞ্চলিকীকরণ করছি।’ যেখানে নিরাপদ, যেখানে সরবরাহব্যবস্থা নিশ্চিত থাকবে, সেখানে বসতি গড়তে হবে। তবে আগের মতো সস্তা আর থাকবে না—এটা বুঝতে হবে।’

যেমনটা বাণিজ্য সম্পর্ক বদলে যাচ্ছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। পুষণ দত্ত বলেন, চীন এই সুযোগই নিয়েছে—নিজেকে নতুন বিশ্ববাণিজ্য–ব্যবস্থার অভিভাবক হিসেবে উপস্থাপন করার। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি চুক্তি করেছে—যুক্তরাজ্য, চীন ও ভিয়েতনামের সঙ্গে। এর বাইরে বাকি এশীয় দেশগুলোর পক্ষে নিজেদের পথ খুঁজে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

অপর্ণা ভরদ্বাজ বলেন, ‘যখন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ সুরক্ষাবাদী নীতি গ্রহণ করছে, তখন এশিয়ার ব্যবসাবান্ধব সরকারগুলো উল্টো পথ নিচ্ছে—বাণিজ্য উন্মুক্ত করছে।’ ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে দুটি বৃহৎ প্রবণতা জোরদার হয়েছে—চীন ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে বাণিজ্য কমে যাওয়া এবং চীন ও এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বেড়ে যাওয়া।

এ নীতিই হয়তো নতুন অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার সূচনা করবে। কিন্তু কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্রই যে এর নেতৃত্বে থাকবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। পুষণ দত্ত প্রাচীন এ পরিস্থিতি বোঝাতে এক প্রবাদের আশ্রয় নেন, ‘রাজাকে সালাম দাও, তারপর নিজের মতো চলো।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স থ ন ন তর ব যবস থ র সরবর হ র জন য ব শ বব সবচ য় র ওপর এখন প

এছাড়াও পড়ুন:

কার্ড কৃষকের, গুদামে ধান দেন মিলার-নেতারা

প্রচুর উৎপাদন, ভালো দাম। তবু ঘাম ঝরানো ফসল হাতে নিয়ে হতাশ কৃষক। সরকার নির্ধারিত মূল্যে গুদামে ধান বিক্রি করতে পারছেন না তারা। মুনাফা গিলছেন রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, মিলার ও কিছু সরকারি কর্মকর্তা। কৃষকের নামে কার্ড; কিন্তু সরকারি গুদামে ধান দিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা ও মিল মালিক। কৃষককে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করে বাড়তি লাভ নিচ্ছে ফড়িয়া সিন্ডিকেট। এভাবেই প্রকৃত কৃষক বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারের দেওয়া সুযোগ থেকে। 

চলতি বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি ধান ৩৬ এবং চালের মূল্য ৪৯ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। প্রতি মণ ধানের দাম ১ হাজার ৪৪০ টাকা, যা বাজারমূল্যের চেয়ে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা বেশি। ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রতি বছরই কৃষক পর্যায় থেকে সরকারিভাবে ধান কেনার খবর ছড়িয়ে দিতে চেষ্টার কমতি থাকে না খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের। তবে বাড়তি দাম কৃষকের মধ্যে আশা জাগালেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল থেকে শুরু করে শেরপুর, ফেনী, রাজশাহী, সুনামগঞ্জ, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন জেলায় কৃষকের পরিবর্তে দালাল ও মিলাররা সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করছে।

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার শ্রীরামকাঠি খাদ্যগুদামে চলতি বোরো মৌসুমে ৯৬৫ টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় বিএনপি নেতারা সরবরাহ করেছেন ৬০০ টন, জামায়াত নেতারা ৩০০ টন। প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে মাত্র ৬৫ টন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, কার্ডধারী কোনো কৃষকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৩ টন পর্যন্ত ধান সংগ্রহের কথা। কিন্তু বাস্তবে কৃষকের কার্ড ও পরিচয় ব্যবহার করে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা ধান সরবরাহ করে বিল উঠিয়ে নিচ্ছেন। তারা কৃষকের কাছ থেকে প্রতি মণ ১ হাজার ১০০ টাকায় কিনে সরকারি গুদাম থেকে ১ হাজার ৪৪০ টাকা বিল তুলছেন। 

কৃষকদের অভিযোগ, যারা ভালো মানের শুকনো ধান নিয়ে গুদামে যান, তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু নেতাদের সরবরাহ করা ভেজা, পচা ধানও গ্রহণ করে গুদাম। এতে প্রকৃত কৃষক সরকার নির্ধারিত দামে ধান বিক্রি করতে না পেরে বাজারে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় আদিবাসী ও দরিদ্র কৃষকদের নামে ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে সরকারি ধান সংগ্রহ কার্যক্রমে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী আতাউর রহমান ‘সাথী চালকল’ নামে একটি ক্ষুদ্র মিলের মাধ্যমে সরকারকে ৪৬ টন চাল সরবরাহ করেছেন। অথচ তাঁর মিলের উৎপাদন ক্ষমতা এত নয়। বিষয়টি স্বীকার করে আতাউর বলেন, ‘আমি বাইরে থেকে ধান কিনে স্থানীয় কৃষকের নামে গুদামে দিই। বিনিময়ে তাদের ৫০০ টাকা করে দিই।’ আদিবাসী অনুকূল সরদার বলেন, ‘আমাদের এলাকার ৩০-৪০ জনকে দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে চেক বইয়ের পাতায় আগেভাগেই সই করিয়ে নিয়েছে। এর পর এই নামেই চাল সরবরাহ করা হয়েছে।’

সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে হলে কৃষককে আগে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। তারপর গুদামে ধান দিয়ে কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় টাকার জন্য। অনেক সময় এই টাকা পৌঁছাতে আরও বেশি সময় লেগে যায়। তাই কৃষকরা স্থানীয় বাজারে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করে দেন। এতে প্রকৃত কৃষকের প্রতি মণে অন্তত ২৪০ থেকে ৪৪০ টাকা ক্ষতি হয়। এই সুযোগটাই নিচ্ছেন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা। তারা গরিব কৃষকদের নাম ব্যবহার করে সরকারিভাবে ধান জমা দিচ্ছেন এবং বড় অঙ্কের মুনাফা করছেন।

গোদাগাড়ীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ বিষয়ে নাজিরপুরের খাদ্য কর্মকর্তাদের কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
হাওরবেষ্টিত কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে কৃষক সারাবছরে শুধু একবার বোরো ফসল ঘরে তোলেন। সেখানে সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে গিয়ে চাষিদের গুনতে হচ্ছে ঘুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, অষ্টগ্রামের খাদ্য পরিদর্শক জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া একজন কৃষকের কাছ থেকে প্রতি টন ধানে ২ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করছেন। কৃষকরা জানান, ঘুষ না দিলে ধান ‘ভেজা’ বা ‘অনুপযুক্ত’ বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অষ্টগ্রাম খাদ্যগুদামের প্রহরীও কাগজ তৈরির নামে প্রতি টনে ২৭০ টাকা করে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

শুধু ঘুষই নয়, প্রকৃত কৃষকদের না জানিয়েই তাদের নাম ব্যবহার করে অন্যরা ধান দিচ্ছে। কৃষক জাকির হোসেন বলেন, ‘সরকারি গুদামে ধান দিতে পারিনি, অথচ আমার নামে কেউ স্লিপ নিয়েছে।’ কৃষক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ধানে আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের কম হলেও তা নেয়নি গুদামের লোকজন। কারণ আমি ঘুষ দেইনি।’

শেরপুর জেলায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘ফার্মার সিন্ডিকেট’। সরকারি অ্যাপে আবেদন করে যারা ধান দেওয়ার অনুমতি পান, তাদের অনেকেই ধান দেন না। এতে সুযোগ নেয় গুদামের দালাল চক্র। ৪০০ জন সাধারণ নারী-পুরুষকে দিয়ে ৪০০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। পরে সরকারি অ্যাকাউন্টে প্রতিজনের নামে ১ লাখ ৮ হাজার টাকা জমা হয়। ওই চক্র প্রত্যেককে মাত্র ২ হাজার টাকা দিয়ে বাকি অর্থ তুলে নেয়।

এ ঘটনায় দুই দালালকে আটক করে পুলিশ, তবে অভিযোগকারী না থাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়। শেরপুরের খাদ্য নিয়ন্ত্রক নাজমুল হক ভূঁইয়া বলেন, এত সংখ্যক কৃষকের নামে হিসাব খোলাটা সন্দেহজনক। বিষয়টি তদন্ত করা হবে।

ফেনীর দাগনভুঞা উপজেলার কৃষকদের দাবি, সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করতে গেলে টনপ্রতি ২ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ না দিলে ধান ফেরত দেওয়া হয়। দালালরা কৃষকের কার্ড কিনে নিজেরাই ধান দিয়ে মুনাফা করছে। কৃষক সাদেক হোসেন বলেন, আমরা ধান নিয়ে গেলে ঘুষ চাওয়া হয়, দালালের ধান ঠিকই নেয়। 

দাগনভুঞার ১৬ জন কৃষক লিখিতভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স ম আজহারুল ইসলাম বলেন, কৃষকের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা থেকে খাদ্য উপদেষ্টার দপ্তরে পাঠানো কৃষকদের অভিযোগপত্রে বলা হয়, প্রতি টন ধানে ১ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে বেশি আর্দ্রতার ধান গ্রহণ করছেন গুদামের কর্মকর্তারা। এ কাজে সহায়তা করছে স্থানীয় দালাল সিন্ডিকেট, যারা কৃষকদের কার্ড কিনে চেকে স্বাক্ষর করিয়ে দিচ্ছে। এতে প্রকৃত কৃষকরা সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

নওগাঁয় চাল ও ধান মজুত করে বাজার অস্থির করার অভিযোগে জেলা খাদ্য বিভাগ এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে ২২ হাজার টাকা জরিমানা করে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ফরহাদ খন্দকার বলেন, বাজারে দাম বাড়ার পেছনে মজুতদারির অভিযোগ ছিল। নিয়ম না মেনে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

তাহিরপুর উপজেলার খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা নুরুল হকের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের অভিযোগ তুলেছেন কৃষকরা। স্থানীয় কৃষক আশরাফুল আলম, ঝিনুক তালুকদারসহ অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ করেন, খাদ্যগুদামে ধান দিতে গিয়ে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আর্দ্রতার অজুহাতে তাদের ধান না নিয়ে ব্যবসায়ীদের নিম্নমানের ধান গুদামে তোলা হচ্ছে। এ নিয়ে উপজেলার মাসিক উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় একাধিক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাসেম বলেন, প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলায় খাদ্য ও কৃষি বিভাগের কিছু কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং দালালের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ধান সংগ্রহ সিন্ডিকেট। কৃষকদের অভিযোগ, যাচাই-বাছাই ছাড়া কৃষি বিভাগ তালিকা তৈরি করেছে এবং গোপনে লটারির মাধ্যমে নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। কৃষকরা নতুন তালিকা করে ধান সংগ্রহের দাবি জানিয়েছেন।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এভাবে চলতে থাকলে সরকারিভাবে ধান সংগ্রহের প্রতি কৃষকের আস্থা চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়বে। বাজার নিয়ন্ত্রণও সম্ভব হবে না।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ধানের দাম বাড়িয়ে সরকার এটিকে কৃষকের জন্য ‘সুবর্ণ সুযোগ’ ভেবেছিল, বাস্তবে তা পরিণত হয়েছে দুর্নীতির উৎসে। কৃষক নয়, লাভবান হচ্ছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও দলীয় শক্তি। এখনই কঠোর নজরদারি ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ না নিলে ন্যায্য দামে ধান বিক্রির স্বপ্ন কৃষকের কাছে রয়ে যাবে অধরাই।

খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর বলেন, সারাদেশে এবার কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছেন। তার পরও কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ১৩ লাখ টন আমদানি, ফলন ভালো, তবু বাড়ছে চালের দাম
  • যেসব এলাকায় আজ ১১ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
  • বৈশ্বিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে তেল উৎপাদন বাড়াবে ওপেক জোট
  • সোমবার ১১ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
  • সাজা মাথায় নিয়ে ঘুরছিলেন ধামাকার চেয়ারম্যান মোজতবা আলী
  • ধামাকার চেয়ারম্যান কারাগারে, সাজা মাথায় নিয়ে ঘুরছিলেন
  • রেকর্ড উৎপাদন, বেড়েছে মজুত, তবুও চালের বাজারে উত্তাপ
  • হামলা চালিয়ে যাবে মস্কো, পুতিনে হতাশ ট্রাম্প
  • কার্ড কৃষকের, গুদামে ধান দেন মিলার-নেতারা