চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। ইয়াঙ্গুন থেকে ব্যাংকক হয়ে মধ্যরাতে ঢাকায় পা রাখা। বিমানবন্দর থেকে হাতিরঝিলের অ্যাম্ফিথিয়েটারে বাফুফের সংবর্ধনা। ঘুমাতে ঘুমাতে ভোর, তার পরও গতকাল দুপুরে টাইমস মিডিয়ায় এসে সমকালের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে মন খুলে কথা বলেন নারী দলের অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার প্রান্তি। শোনালেন বিশ্বকাপে যাওয়ার নতুন স্বপ্নের কথা, পাশাপাশি আক্ষেপ করলেন মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো মাঠ না থাকার, লিগ না হওয়ার এবং আর্থিকভাবে আরেকটু সচ্ছলতার। শুনেছেন সাখাওয়াত হোসেন জয়। 

সমকাল: অভিনন্দন। দেশকে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার জন্য। 
আফঈদা:
ধন্যবাদ, আসলে এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এটি আমাদের কষ্টের ফল। দীর্ঘদিনব্যাপী আমরা যে কষ্টটা করেছি, এটার ফলই এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করা।

সমকাল: কী ধরনের কষ্ট বা ত্যাগ করতে হয়েছে আপনারদের? 
আফঈদা:
সব মিলিয়েই অনেক কষ্ট করেছি আমরা। পরিবার থেকে দূরে এসে ফেডারেশনে দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্প করে আসছি। আমি ক্যাম্পে যোগদান করেছি ২০১৮ সালে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত টানা এখানে ক্যাম্পে আছি। ঈদসহ যত উৎসব বেশির ভাগ সময় ফেডারেশনে করা হয়। আর পড়াশোনার একটু ক্ষতি হচ্ছে। কারণ সারা বছরই যেহেতু ক্যাম্পে থাকতে হয়, তাই ক্লাস করার সুযোগ থাকে না। ভার্সিটি স্কলারশিপ দিয়েছে। তারা বলেছে, খেলা থাকলে সুযোগ-সুবিধা দেবে। 

সমকাল: পড়ালেখার সঙ্গে খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়া, কীভাবে ব্যালান্স করেন? 
আফঈদা:
চাইলেই পারা যায়। কারণ, আমাদের অনুশীলন থাকে সকালে, দুপুরে জিম সেশন থাকে। রাতে ফ্রি থাকি। ওই সময় আমরা একটু পড়াশোনা করি। কারণ পড়ালেখা না থাকলে ভবিষ্যতে কী করব। ফুটবল তো বেশিদিন খেলতে পারব না। পড়ালেখা আর ফুটবল, দুইটা মিলিয়ে ভালো কিছু করতে পারব। এ জন্যই সবাইকে বলব, খেলাধুলার পাশাপাশি পড়ালেখাটাও যেন ঠিকভাবে করা হয়।

সমকাল: ফুটবলে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেখছেন কেন? 
আফঈদা:
এটি বলেছি এই কারণে যে আমাদের দেশে এখনও সেভাবে নারী ফুটবলকে ভালো চোখে দেখা হয় না। তবে ধীরে ধীরে মানুষ ফুটবলের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। একটা বয়সের পর কিন্তু ফুটবল খেলতে পারব না। আর আমাদের দেশে তেমন লিগও হয় না যে আমরা আর্থিকভাবে খুব বেনিফিট হবে। দিন শেষে কিন্তু আমাদের আর্থিক দুর্বলতাটা সবদিক থেকেই আসে। লিগ হয় না, ফেডারেশন আমাদের যে বেতন দিচ্ছে, ওটাতে আমাদের ওইভাবে পোষায় না। তাই ভবিষ্যতে আমরা কী করব, সেই চিন্তাটা এসেই যায়।  

সমকাল: মেয়েরা বাফুফে থেকে যে বেতন পাচ্ছে, আপনি কি মনে করেন সেটি আরও বাড়ানো উচিত?
আফঈদা:
অবশ্যই বাড়ানো উচিত। যেহেতু আমরা এত সাফল্য এনে দিচ্ছি, তাই আমাদের পারিশ্রমিকও যেন বাড়ানো হয়; এটি আমাদের চাওয়া। আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকলে কোনোদিক থেকে ভালো থাকা যায় না। একটা বুট কিনতে গেলেও অনেক টাকা লাগে। নিজেকে চলতে হয়, সঙ্গে পরিবারকেও চালাতে হয়। 

সমকাল: এশিয়া কাপের মঞ্চটা বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ। আপনারা কি সেই স্বপ্ন দেখছেন?
আফঈদা:
আমরা অনেক দিন আগে থেকেই বলতাম যে চোখ হচ্ছে বিশ্বকাপের দিকে। আমাদের এই পথটা পাড়ি দিতে হলে অনেক বাধা আসবে, অনেক পরিশ্রম করতে হবে। আমরা এগুলোই করে যাচ্ছি। যেভাবেই হোক বিশ্বকাপের মঞ্চে যেতে হবে।

সমকাল: এশিয়ান কাপের বাকি ১০ মাসের মতো। এই সময় আপনারা কী কী সুযোগ-সুবিধা চান?
আফঈদা:
প্রথমে সরকারের কাছে চাইব আমাদের নির্দিষ্ট একটা মাঠ দেওয়া হোক। কারণ আমাদের মাঠের সমস্যা আছে। একবার বসুন্ধরা, একবার জাতীয় স্টেডিয়াম, বিভিন্ন ক্লাবের মাঠে যেতে হয়। নির্দিষ্ট একটা ট্রেনিং গ্রাউন্ড থাকলে প্রতিদিন অনুশীলন করতে পারতাম। ভালো সুযোগ-সুবিধা আমাদের দরকার। এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে খেলতে যাওয়ার আগে বাফুফে আমাদের ফিটনেস ট্রেইনার দিয়েছে, ইয়োগা টিচার দিয়েছে। আরও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে বলেছে। আমরা যদি বাইরের দেশে গিয়ে ট্রেনিং করতে পারি, ওদের সুবিধাগুলো পাই, তাহলে অনেক ভালো হবে। কারণ আমাদের দেশে এসব সুযোগ-সুবিধা কম।

সমকাল: টানা দুবার সাফ জয় নাকি এশিয়ান কাপ। কোনটাকে এগিয়ে রাখবেন?
আফঈদা:
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতেছি বলেই আমাদের সাহস বেড়ে গেছে যে আমরা এশিয়াতে যেতে পারব। পরপর দুবার সাফ জেতা, এটিও কম বড় অর্জন নয়। ২০২৪ সাল পর্যন্ত ওটাই সবচেয়ে বড় ছিল। ২০২৫ সালে এসে আমরা এশিয়াতে কোয়ালিফাই করেছি। তো, প্রতিটি বছরই কিন্তু একেকটা নতুন যাত্রা।

সমকাল: গ্রুপে ফেভারিট ছিল মিয়ানমার। তাদের হটিয়ে সেরা হয়েছে বাংলাদেশ। সাফল্যের পেছনে কারণ কী?
আফঈদা:
পেছনের গল্প বললে যার কথা না বললেই নয়, তিনি আমাদের কিরণ (মাহফুজা আক্তার কিরণ) ম্যাডাম। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল আমরা পাচ্ছি। তাঁর কারণে দীর্ঘদিন ধরে আমরা একটা ক্যাম্প করছি, যা পৃথিবীর অন্য কোথায় আছে কিনা আমার জানা নেই। এটা যদি আমরা না করতাম, তাহলে এই সাফল্য আসত না। খেলার এক মাস, তিন মাস আগে অনুশীলন করে কোনো টিমের জন্য সাফল্য এনে দেওয়া খুব কঠিন। আমরা ঈদ, পার্বণ থেকে শুরু করে উৎসব– সবকিছুই একসঙ্গে করি ফেডারেশনে। আমাদের তারা ওইভাবে সাপোর্ট দেয়। 

সমকাল: পিটার বাটলারের হাই লাইন ডিফেন্স কৌশলটা আপনারা কীভাবে রপ্ত করেছেন?
আফঈদা:
বাটলার স্যার আসার পর থেকেই আমাদের হাই লাইন ডিফেন্সে খেলার কৌশলটা শুরু হয়েছে। এক থেকে দেড় বছর তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন। যখনই গেম ট্রেনিং করেছি, তখনই আমাদের ভুল হলে খেলা থামিয়ে বলেন, তোমরা হাই লাইন ডিফেন্সে খেলবা, এক সিরিয়ালে থাকবা, তাহলে তোমাদের জন্য সুবিধা হব। আমরা এটা খেলে দেখেছি এটা ভালো। চারজন একই লাইনে থাকা কঠিন। সেটা আমরা রপ্ত করেছি।

সমকাল: ঋতুপর্ণাকে অনেকেই বলে বাংলাদেশের মেসি। আপনি তাঁকে কী বলবেন?
আফঈদা:
মেসি মেসির মতো। ঋতু আপু তাঁর মতোই। ঋতু আপুকে কোনো নাম দিয়ে বিশেষণ করতে চাই না।

সমকাল: বেশ কয়েকজন সিনিয়র ফুটবলারের মধ্যেও অধিনায়ক আপনি। কতটা চ্যালেঞ্জিং এই দায়িত্ব পালন করা।
আফঈদা:
এটি চ্যালেঞ্জিং ঠিক না। আমি যদি নিজে থেকে গিয়ে তাদের (সিনিয়র) সঙ্গে কাজ করি, আবার তারাও যদি আমার সঙ্গে কাজ করে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। তারা সিনিয়র দেখে আমি তাদের কাছে যাব না, এ রকম করলে তো হবে না। আমাকে যেহেতু ফেডারেশন অধিনায়ক বানিয়েছে, তাই আমাকে সবাইকে নিয়েই চলতে হবে। 

সমকাল: কোন দেশে গিয়ে অনুশীলন করলে ভালো হয়?
আফঈদা:
আমরা যখন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কাতারে গিয়েছিলাম, সেখানে ওদের একটা স্পেয়ার একাডেমি দেখেছি। সেখানে অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের টিম ক্যাম্প করতে যায়। এক জায়গায় সবকিছু আছে। আমার দেখা ওইটা সবচেয়ে ভালো।

সমকাল: মিয়ানমার থেকে ফিরেই মধ্যরাতে আপনাদের সংবর্ধনা দিয়েছে বাফুফে।
আফঈদা:
আমরা শুনেছিলাম, আমাদের সংবর্ধনা রাতে দেওয়া হবে। কারণ আমাদের দু’জন প্লেয়ার ভুটান চলে যাবে। তাদের ছাড়া তো আমরা কিছু করব না। ফেডারেশনের এই পদ্ধতিটা আমার খুবই ভালো লেগেছে। রাতের বেলায় সংবর্ধনা দিয়ে বাফুফে কাউকে হতাশ করেনি। এত মানুষ থাকবে, ভাবতে পারিনি। ভেবেছি, রাত আড়াইটার দিকে হয়তো কোনো দর্শক থাকবে না। কিন্তু ফুটবলটাকে এত মানুষ ভালোবাসে– এটি কালকে সমর্থকরা প্রমাণ করে দিয়েছেন।

সমকাল: সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের কোনো বিশেষ ঘোষণা আসেনি। এটি নিয়ে আফসোস আছে কিনা?
আফঈদা:
না, এটি নিয়ে আফসোস হয়নি। এখন ফেডারেশন আর সরকার কী করে, সেটি দেখা যাবে। আর আগেরটা (দেড় কোটি টাকা) তারা বলেছেন তো দেবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন র ফ টবল র আম দ র দ ই আম দ র ব শ বক প আর থ ক ই ল ইন স ফল য র জন য ফ টবল সমক ল আপন র

এছাড়াও পড়ুন:

ওসমানী উদ্যানে আবার স্থাপনার পেছনে লক্ষ্য ‘টাকা কামানো’: বাপা

রাজধানীর ঐতিহাসিক ওসমানী উদ্যান উন্নয়নের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নেতারা। তাঁদের ভাষায়, পুরান ঢাকার ফুসফুসখ্যাত এই উদ্যানকে ঘিরে চলছে ‘অর্থ কামাইয়ের উন্নয়ন’, যার সঙ্গে জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের ইতিহাস বা চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ওসমানী উদ্যান পরিদর্শন করেন বাপার নেতারা। পরিদর্শন শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে এ কথাগুলো বলেন সংগঠনটির নেতারা।

বাপার সভাপতি অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদারের নেতৃত্বে উদ্যান পরিদর্শনকালে উপস্থিত ছিলেন বাপার সহসভাপতি মহিদুল হক খান, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতা রুহিন হোসেন, বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির, যুগ্ম সম্পাদক আমিনুর, ফরিদুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবির, নির্বাহী কমিটির সদস্য জাভেদ জাহান, জাতীয় কমিটির সদস্য শেখ আনছার আলী প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গে গ্রীন ভয়েসের নেতা–কর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সাল থেকে ওসমানী উদ্যান সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ। এই সময়ে উদ্যান উন্নয়নের নামে ব্যয় হয়েছে প্রায় শতকোটি টাকা। এখন সেখানে ‘জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণে আরও প্রায় ৪৭ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। পরিবেশবিদদের অভিযোগ, এই উদ্যানের আইনগত মর্যাদা উপেক্ষা করে বারবার অবকাঠামো নির্মাণই এখন মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘উন্নয়ন’ নামে উদ্যানের ভেতরে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে আসলে জনগণের সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে।

বাপার সভাপতি অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, ‘এখানে যেটা করা হইতেছে, এটা টাকা বানানো। এর সঙ্গে জুলাই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। প্রমাণটা হলো, এখানে যে ওয়াটার বডিজ আছে, ওখানে গেলেই দেখা যায়, ওখান থেকেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হচ্ছে। এই স্মৃতি করে লাভটা কী? এই প্ল্যানটা আমি স্মৃতিস্তম্ভ বলি না, এটা স্রেফ মানি মেকিং প্রজেক্ট। আজকে যারা এগুলা (জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ) করছে, এগুলো কিছু মানি মেকিংয়ের জন্য করছে। এর মধ্যে আমি কোনো সঠিক প্ল্যানও দেখছি।’

ওসমানী উদ্যানকে তথাকথিত উন্নয়নের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন। তিনি বলেন, ‘যেই সরকারই আসুক, তাদের মাথায় থাকে শুধু উন্নয়নের নামে টাকা কামানোর চিন্তা। বহুদিন ধরে উদ্যানটা ব্যারিকেড দিয়ে ঘেরা, জনগণ ঢুকতেই পারে না। এই প্রকল্পে জনগণের টাকা লুটপাট ছাড়া অন্য কোনো কর্মকাণ্ড আমি দেখি না। ওসমানী উদ্যান জনগণের সম্পদ। এই উদ্যান উন্মুক্ত থাকা দরকার। বিশেষ করে মেহনতি, সাধারণ মানুষের হাঁটাচলার ও বিশ্রামের জায়গা হিসেবে। অথচ আজ সেটাকে দখল করে তথাকথিত উন্নয়ন দেখানো হচ্ছে। আসলে এটা পরিবেশ ধ্বংসেরই আরেক নাম।’

ওসমানী উদ্যান পরিদর্শন শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় নগর ভবনে গিয়ে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ক্ষোভের কথা জানান বাপার নেতারা। এ সময় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বাপা নেতাদের বলেন, সরকারের সিদ্ধান্তে ওসমানী উদ্যানে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।

আরও পড়ুনওসমানী উদ্যান: ঢাকার ‘ফুসফুসে’ আবার স্থাপনা ১১ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ