দাউদকান্দিতে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ৫১ জন
Published: 9th, July 2025 GMT
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। আজ বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৫১ জন ডেঙ্গু রোগী উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে মোট ২৯৬ জনের ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান আজ সকালে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ওই ২৪ ঘণ্টায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ৫১ জনের। এর মধ্যে ১৮ জন দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। একজনকে আজ সকাল ১০টার দিকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ জুন থেকে আজ ৯ জুলাই সকাল ১০টা পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ১০ হাজার ৫৮ জনের ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৭৪ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। গুরুতর অসুস্থ ৩৩ জন রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চলতি বছর দাউদকান্দি পৌরসভার দোনারচর গ্রামের এক বাসিন্দা প্রথম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর পর থেকে উপজেলায় আক্রান্তের হার বাড়ছে। জুবাইদা আক্তার নামের এক স্কুলশিক্ষক জানান, তাঁর নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে সাবিহা খন্দকার গত সোমবার থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছে না সে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ উদক ন দ সরক র উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও পরিণতি
সিনেমায় সাধারণত কোনো বড়লোকের ছেলের সঙ্গে বস্তির গরিবের মেয়ের প্রেম হলে তা শুধু বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। এই কাহিনি আরেকটু টানলে কোনো প্রযোজক সিনেমায় টাকা ঢালতে রাজি হবেন না। কারণ, এদের বিয়ের পরবর্তী জীবন সুখের হবে না। তাই পরবর্তী জীবনটিকে স্বপ্নের মধ্যে রেখে সান্ত্বনা নেওয়াই ভালো। দেশের পরিচালনায় যদি অতি জ্ঞানী-গুণী লোকের আগমন ঘটে, তাহলে নানা স্বপ্নের আমোদ ওই আগমন পর্যন্তই। এর পরের বাস্তবতায় গরিবের কপাল খোলে না।
চলমান সরকারের গত এক বছরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সে কথাই প্রমাণিত হয়েছে। উল্টো গতিতে দারিদ্র৵ বৃদ্ধি, শিল্পাঙ্গনে চাকরিহীনতা, রাষ্ট্রীয় শান্তিসূচকে অধঃপতন ও মূল্যস্ফীতির যন্ত্রণা, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং পুঁজিবাজারের অবিশ্রান্ত অধঃপতন প্রমাণ করে সরকার জ্ঞানী–গুণী বটে; কিন্তু তারা ব্যবস্থাপনায় অদক্ষ এবং লক্ষ্যে বিভ্রান্ত। তাদের ‘রোডম্যাপ’ নেই। কারণ, তারা ‘রোডে’ নেই। ইদানীং অর্থনীতিবিদেরা সরকারের সমালোচনাতে বড়ই নীরব।
আমাদের মনে আছে, একটি শ্বেতপত্র কমিটি হয়েছিল, ডাকসাইটে সব অর্থনীতিবিদ সেখানে ছিলেন। মাত্র তিন মাসেই তাঁরা ৫০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন বানালেন। যেখানে দেখানো হলো আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ বছরে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। আওয়ামী লীগ আমলের ব্যাংক লুট ও অর্থ পাচার আমাদের সবারই জানা। এর পতনের মূল কারণও দুর্নীতি। কিন্তু একজন অর্থনীতিবিদ যখন সংখ্যা বের করেন, তখন প্রেম বা ঘৃণা—এসব চেপে রেখে পরিসংখ্যান ও গণিতের শাসনে চলতে হয়। একই সময়ে সরকারের একজন উচ্চস্থানীয় ব্যক্তি অর্থ পাচারের সংখ্যাটিকে বললেন ১৭ বিলিয়ন ডলার। এদিকে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির আরেক হিসাব। সব মিলিয়ে শ্বেতপত্র এখন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। কেউ আর আগ্রহ দেখায় না; বরং সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের হঠাৎ আমানত বৃদ্ধি ও কয়েকজন উপদেষ্টার পিয়নদের সম্পদস্ফীতি নতুন করে আরেকটি শ্বেতপত্র কমিটির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।
স্বচ্ছতার অভাব অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার প্রধান কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অদক্ষতা। সম্প্রতি সাবেক একজন এনবিআর-প্রধান সরকারকে ‘দ্য মোস্ট উইকেস্ট’ বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এই শব্দগুচ্ছে ব্যাকরণের বিভ্রাট তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে করেছেন কিছুটা রসিকতা করে। অর্থাৎ ইতিহাসে এর চেয়ে কমজোর সরকার আর দেশের ভাগ্যে জোটেনি। শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান এত দিনে আক্ষেপ করেছেন, এই সরকার কোনো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সংস্কার করতে সক্ষম হয়নি।
সাবেক একজন বিআইডিএস-প্রধান দুঃখ করে বলেছেন, তাঁদের করা প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার সংস্কার সুপারিশ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের নাকি পড়ার সময় নেই। তাঁদের কেউ বলেছেন এই সুপারিশ ছোট্ট করে লিখে দিতে। এই কর্তাব্যক্তিরা বোঝেন না, সংস্কারের গবেষণাপত্র স্বামী-স্ত্রীর রাজনৈতিক দলের ইশতেহার নয়, যা একটি পোস্টারের মধ্যেই সাঁটিয়ে দেওয়া যাবে। এটি ঐকমত্য কমিশনের একাধিক সভার সারাংশ নয়, যা তিন লাইনে লেখা যাবে। আজ থেকে প্রায় ৯ মাস আগে এই একই পত্রিকায় লিখেছিলাম, অর্থনীতিতে সরকারের মনোযোগ নেই। মনোযোগ চলে গেছে ইতিহাস সংস্কারে। ফলে অর্থনীতির জিডিপিতে গত ৩৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি পেতে চলেছে দেশ। সরকারি সংস্থার রিপোর্টেই বেকারত্ব বেড়েছে।
প্রাচীন কবি, সম্ভবত রত্নাকর বলেছিলেন, ‘ফলেন পরিচয়েৎ’। বর্তমান সরকারের অর্থনীতির স্কোরবোর্ডে কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি দেখা গেছে। যেমন রিজার্ভ বৃদ্ধি। গত ২৬ জুনের হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ সাড়ে ২৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছর এ সময়ে এটি ছিল প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার। বৃদ্ধি কমবেশি যা-ই হোক, অন্তত পতন ঠেকানো গেছে, যা গভর্নরের নেতৃত্বের এক কৃতিত্ব। এর পেছনে কাজ করেছে মূলত চারটি কারণ—১. প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স; ২. আইএমএফের ঋণপ্রাপ্তি; ৩. রপ্তানি মৃদু বৃদ্ধি ৪. সর্বোপরি আমদানিতে ব্যাপক কষনি।
এই রিজার্ভ বৃদ্ধির পুরোটাই সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বলে মেনে নেওয়া যায় না। কোনো মোটা লোককে চিকিৎসক বললেন ব্যায়াম করে ওজন কমাতে। তিনি যদি উপোস করে ওজন কমান, তাহলে তা দীর্ঘ মেয়াদে রোগীর সক্ষমতা কমাবে। ২০২৫ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল কালপর্বে আগের অর্থবছরের কালপর্বের তুলনায় মূলধনি পণ্যের আমদানির ‘সেটেলমেন্ট’ কমেছে শতকরা ২৬ ভাগ, যা আগে দেখা যায়নি। পুঁজিপণ্যের আমদানি কমে গেলে উৎপাদনশীলতা ও নিয়োগ কমে যায়—যা আবার জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমায় ও বেকারত্ব বাড়ায়। সুতরাং রিজার্ভ বৃদ্ধির কারণগুলো সবটাই নির্ভেজাল নয়।
আওয়ামী আমলের শেষ ২০২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল কালপর্বে রাজস্ব বৃদ্ধির হার ছিল ১১ দশমিক ১৭ ভাগ। ২০২৫ অর্থবছরের একই কালপর্বে এই সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির হার দেখাতে পেরেছে মাত্র ৩ দশমিক ৯৬ ভাগ। অথচ সরকার পরিচালন ব্যয়ে কোনো সাশ্রয় আনতে পারেনি। এই ‘আদায় কম খরচ বেশি’র অবস্থা শুধু অদক্ষতাই প্রমাণ করে না, উপরন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার অপচয় ও বিপন্নতার সংকেত দেয়। নতুন বছরের বাজেটেও একই বিপদ আসবে বলে মনে হচ্ছে।
প্রয়োজন ছিল আলাদা রাজস্ব মন্ত্রণালয় গঠনের, যা সরকার ও কর-আমলাদের মধ্যে কোনো বিরোধ তৈরি করত না। প্রয়োজন ছিল রাজস্ব বছরকে উৎপাদনশীল করার স্বার্থে ক্যালেন্ডার বছরের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া, যা করা হলে কেউ রাস্তায় নামত না। এগুলো করলে ভবিষ্যতে মানুষ এই সরকারকে মনে রাখত। অর্থনীতিও উপকৃত হতো।
বর্তমান শাসনের উপকারভোগীরা হয়তো যুক্তি দেবেন যে অন্তর্বর্তী ধাঁচের সরকার অন্য সরকারের মতো রাজস্ব আদায় করতে পারে না। কারণ, মানুষ এর অস্থায়িত্ব বিবেচনা করে কর দিতে চায় না। বাংলাদেশের ইতিহাস তা বলে না। এক-এগারোর সরকারটিও এই ধাঁচের শাসন ছিল। তারাও দুর্নীতিবাজ ও অনেক ব্যবসায়ীর ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ করেছে; কিন্তু রাজস্ব আদায়ের বেলায় অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বিএনপির শেষ বছর ২০০৬ সালে রাজস্ব বৃদ্ধির মাত্রা ছিল শতকরা প্রায় ১১ ভাগ। এক-এগারোর অন্তর্বর্তী সরকার ২০০৭ সালে এটিকে শতকরা ১৪ ভাগ এবং ২০০৮ সালে এটিকে শতকরা ২৩ ভাগে উন্নীত করে, যা ছিল এক রেকর্ড। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের শাসনের প্রথম বছরে এটি শতকরা ১৪ ভাগে নেমে আসে। ২০১০ সালেও তা ১৪ ভাগের একটু বেশি ছিল।
বলা বাহুল্য, ২০০৮ সাল ছিল বিশ্বমন্দার ভরদুপুর। সে জন্য এক-এগারোর সরকার এটিকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করায়নি। তবে মন্দা শেষ হয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষণে এই বিশ্বমন্দাকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের ফাটাফাটি করেছে তাদের সরকার—এমন কথা শুনেছি ২০১৬ সাল পর্যন্ত। একই সুর শোনা যায় বর্তমান পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বচনসুধায়। কিছুদিন আগে তিনি বলেন, বিশ্বের টালমাটাল অবস্থা সামাল দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ কথা শুনে প্রথমে ভেবেছিলাম, বিশ্বযুদ্ধ বোধ হয় শুরু হয়ে গেছে। পরে দেখি কিছুই না। বিশ্বের টালমাটাল অবস্থাটা তিনি কোথায় দেখলেন বোঝা গেল না। এ হচ্ছে নিজেদের অদক্ষতা ঢাকার জন্য বিশ্বের ওপর দায় চাপানো।
উন্নত বিশ্বে বেকারত্ব নেই বললেই চলে। মূল্যস্ফীতিও সহনীয়। অথচ ২০০৭-০৯ কালপর্বের বিকট মন্দাকে পল ক্রুগম্যান বলেছেন ‘ত্রিশের বিশ্ব মহামন্দার পর সবচেয়ে নিষ্ঠুর মন্দা’। এই অজুহাতে এক-এগারোর সরকার রাজস্ব আদায় কমায়নি। বলছি না যে সেটিই উত্তম সরকারব্যবস্থা। কিন্তু লক্ষ্যে অটল ও কর্মে শক্ত থাকলে সব সম্ভব। একদিকে মব-তাণ্ডবের প্রশ্রয় দেওয়া, অন্যদিকে ঐকমত্যের নাটকে বিপ্লবী সুরের বদহজম আর যা-ই করুক, বিনিয়োগকারীকে স্বস্তি দেয় না। সে জন্যই ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে ‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে’। এই অদক্ষ ব্যবস্থাপনার পরিণতি জাতিকে ভাবিয়ে তোলে বৈকি। তাই ‘ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচনটি’ দিয়ে ফেলে ক্রম-অধোগতি থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধার করা উচিত।
ড. বিরূপাক্ষ পাল স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক
*মতামত লেখকের নিজস্ব