ইসরায়েলের যুদ্ধ ইরানকে যেভাবে বদলে দিল
Published: 9th, July 2025 GMT
ভঙ্গুর একটি যুদ্ধবিরতি তেহরানের আকাশে পরিচিত হয়ে ওঠা বিস্ফোরণের শব্দ আপাতত বিরতি দিয়েছে। আমার জন্ম হয়েছিল ১৯৮৮ সালে, ইরাক-ইরান যুদ্ধ থামার এক বছর আগে। আমাদের প্রজন্মের কাছে যুদ্ধ ছিল অতীতের বিষয়। এই গ্রীষ্ম আসার আগে তা ছিল অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় একটা বিষয়।
১২ দিন ধরে, আমরা রাজধানীতে বসবাস করেছি ইসরায়েলের নিরবচ্ছিন্ন হামলার মধ্যে। আমরা যা দেখেছি, তা আমাদের চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছে। আমরা দেখেছি, প্রতিবেশীদের মৃতদেহ, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়িঘর এবং মানুষের সীমাহীন উদ্বেগ।
‘ইরানি জনগণ’ বলার মধ্যে একধরনের স্বস্তি কাজ করে। এতে মনে হয় যেন আমরা সবাই একটি ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠী। কিন্তু অধিকাংশ সমাজের মতো, ইরানিদের মধ্যেও বিভিন্ন মতপার্থক্যের মানুষ রয়েছেন। এমন অনেক মানুষ ছিলেন, তাঁরা (অন্তত যুদ্ধের সূচনালগ্নে) এটা দেখে খুশি হয়েছিলেন তাঁদের অপছন্দের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) শীর্ষ নেতৃত্বকে একটি বিদেশি শক্তি লক্ষ্যবস্তু করেছে।
আরও পড়ুনইরান এবার বড় যুদ্ধের জন্য যেভাবে প্রস্তুত হবে০৬ জুলাই ২০২৫আবার ভিন্নমতাবলম্বীদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ ছিলেন, যাঁরা বিদেশি শক্তির আগ্রাসনকে প্রবলভাবে ঘৃণা করেন। কিছু কট্টরপন্থী এই যুদ্ধকে দেখেছিলেন ধর্মযুদ্ধ হিসেবে। তাঁরা মনে করেছিলেন, শেষ পরিণতি না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধকে টেনে নিয়ে যেতে হবে। আর কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁরা কী ঘটছে আর না ঘটছে, সে ব্যাপারে ছিলেন পুরোপুরি উদাসীন।
সাধারণ মানুষের হতাহতের ছবি আর ভিডিওতে যতই সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর ভরে উঠছিল এবং হামলা যতই কঠোর ও নির্বিচার হতে লাগল, ততই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ‘ওয়াতান’ বা জন্মভূমির ধারণাকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করলেন। দেশপ্রেম নতুন মাত্রা পেল, বেশির ভাগ মানুষের কণ্ঠে জাতীয় গৌরবের সুর অনুরণিত হলো।
যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে ইসরায়েলকে বিশ্বাস করা হবে বোকামি। ইসরায়েল বারবার দায়মুক্তি নিয়েই চুক্তি লঙ্ঘনের রেকর্ড ধরে রেখেছে। এর মানে হলো বিস্ফোরণের শব্দ স্তিমিত হলেও তেহরানের ওপর এখনো ডেমোক্লসের তরবারি ঝুলে রয়েছে। দূর থেকে দেখলে, এক কোটির বেশি মানুষের এই শহর যেন আগের মতোই ব্যস্ত জীবনযাত্রায় ফিরে গেছে। কিন্তু অনিশ্চয়তা এখনো বাতাসে ভাসছে।আমার বিচারে ইউরোপের দেশগুলো যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, সেটা ইরানে ইসরায়েলের নির্বিচার আগ্রাসন চালিয়ে যেতে মূল ভূমিকা রেখেছে। জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে মহাদেশটির নীরব থাকা অন্য দেশগুলো ইসরায়েলি হামলাকে সমর্থন দিয়েছে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবাদে সহায়তা—পুরোনো সেই যুক্তি দিয়ে দেশগুলো এই হামলার ন্যায্যতা দিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে আগামী দিনের ইরানের কল্পিত ছবি এঁকেছেন।
কিন্তু আমরা যারা মধ্যপ্রাচ্যে বাস করি, জানি বাস্তবতাটা কী। গাজার ধ্বংসযজ্ঞের ছবি প্রতিদিন আমাদের সামনে আসে। আমরা স্মরণ করতে থাকি লিবিয়ার বিশৃঙ্খলা, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, ইরাকে দুই দশকের দখলদারত্ব এবং আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুত্থানের কথা। এসব সংঘাতে কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না, গণতন্ত্রের কোনো বীজও রোপিত হয়নি।
নিশ্চয়ই ইসরায়েলের আগ্রাসনের নগ্ন বাস্তবতা তাদের কাছেও প্রতিধ্বনিত হওয়ার কথা ছিল, যারা সঠিকভাবেই রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে নিন্দা করেছিল, যাতে আরেকটি যুদ্ধ আবারও এই অঞ্চলকে ধ্বংস না করে। আর নিঃসন্দেহে এই হামলাগুলো ছিল নিষ্ঠুর, উসকানিহীন ও ইচ্ছাকৃত।
আরও পড়ুনইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করে যে হুমকির মুখে পড়ল ইসরায়েল০৪ জুলাই ২০২৫জাতিসংঘ সনদের প্রতি এই অবজ্ঞার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও নিন্দার বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কেউই কথা বলেননি। নীরবতাটাই ছিল সবচেয়ে বড় বধিরতা। এখানে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো ইরানিদের জীবন স্পষ্টতই অন্যদের জীবনের চেয়ে কম মূল্যবান।
আমাদের অনেকের কাছে পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলকে খোলাখুলি সমর্থন দেওয়ার ঘটনার মূল শিক্ষা ছিল এটিই। যুদ্ধ ছিল ইরানের বিরুদ্ধে, কিন্তু তার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছিল সেই পুরোনো নীলনকশায়, সেটা হলো বর্ণবাদ।
অনেক ইরানি এখন পশ্চিমাদের এই অন্যায্যতার প্রতি ক্ষুব্ধ। এতটাই ক্ষুব্ধ যে তাঁরা এখন চান, ইরান যেন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে। অথচ এই ধারণা এত দিন পর্যন্ত কট্টরপন্থী রাজনৈতিক মহলে সীমাবদ্ধ ছিল। এটা এখন সাধারণ মানুষের সমর্থন পাচ্ছে। যেমন একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কেউই মনে হয় উদ্বিগ্ন নন।’ তিনি ইঙ্গিত করেছেন, পারমাণবিক অস্ত্রই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একমাত্র নির্ভরযোগ্য বাধা।
আরও পড়ুনসাইপ্রাসে কি ‘মিনি ইসরায়েল’ গড়ে উঠছে০৩ জুলাই ২০২৫যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে ইসরায়েলকে বিশ্বাস করা হবে বোকামি। ইসরায়েল বারবার দায়মুক্তি নিয়েই চুক্তি লঙ্ঘনের রেকর্ড ধরে রেখেছে। এর মানে হলো বিস্ফোরণের শব্দ স্তিমিত হলেও তেহরানের ওপর এখনো ডেমোক্লসের তরবারি ঝুলে রয়েছে। দূর থেকে দেখলে, এক কোটির বেশি মানুষের এই শহর যেন আগের মতোই ব্যস্ত জীবনযাত্রায় ফিরে গেছে। কিন্তু অনিশ্চয়তা এখনো বাতাসে ভাসছে।
যে বিষয় পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে, তা হলো যুদ্ধ শেষ করার মতো কোনো বিশ্বাসযোগ্য মধ্যস্থতাকারী এখানে নেই।
হোসেইন হামদিয়েহ বার্লিনের হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিংস কলেজ লন্ডন থেকে ভূগোল ও নৃতত্ত্ব বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র আম দ র ব স কর
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিষ্ঠার দেড় যুগ পর ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছে বেরোবি
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ব্রাকসু) নিয়ে অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে শিক্ষার্থীদের। গত ২৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মাধ্যমে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের গেজেট প্রকাশ হয়ছে গঠনতন্ত্র।
এরই মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর পর হতে যাচ্ছে কাঙিক্ষত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ তথা ব্যাকসু নির্বাচন। তবে এর জন্য আমরণ অনশন থেকে শুরু করে সব ধরনের কর্মসুচিই পালন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
আরো পড়ুন:
‘আমরা একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করতে চাই’
বেরোবিতে শহীদ আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভের মডেল প্রদর্শন
জুলাই অভ্যুত্থান পর গণরুম ও গেস্ট রুমের যে সাংস্কৃতি ছিল, তা এখন বন্ধ হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের কমকাণ্ডে সামিল হওয়াও বাধ্যতামুলক নয়।
তাই শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ ছাত্র সংসদ। যাতে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বেরোবির বিধিমালা অনুযায়ী, ১৩টি পদে সরাসরি নির্বাচন ও হল সংসদে নয়টি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সব ধরনের কথা তুলে ধরতে পারবেন।
পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী শেখর রায় বলেন, “সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও লেজুরবিত্তিক রাজনীতি ব্যতীত একটি নির্বাচন হোক। যোগ্য, আদর্শ, উত্তম চরিত্র ও মনের প্রার্থী বিজয়ী হোক। নির্বাচিত হয়ে তারা হয়ে উঠুক বেরোবির একেকজন যোগ্য প্রতিনিধি। তারা ন্যায়ের পক্ষে থাকুক । তাদের হাত ধরেই এগিয়ে যাক বেরোবি।”
গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী জাওয়াদ সাজিদ বলেন, “ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের দাবি, অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার প্রধান মঞ্চ। এটি প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে, যাতে প্রতিটি শিক্ষার্থীর কণ্ঠ পৌঁছে যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের টেবিলে। কিন্তু এজন্য সংসদকে দলীয় প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। প্রকৃত অর্থে ছাত্র সংসদ তখনই সফল, যখন তা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের সমস্যার সমাধান ও কল্যাণে কাজ করে।”
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান বলেন, “আমরা এমন ছাত্র সংসদ চাই, যেখানে যোগ্য নেতৃত্ব আসবে এবং সব শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার হয়ে কাজ করবে। সবমিলিয়ে সবার বিশ্বস্ত জায়গা হবে এই ছাত্র সংসদ।”
ঢাকা/সাজ্জাদ/মেহেদী