যত দ্রুত দেশকে নির্বাচনের ট্র্যাকে ওঠানো যাবে ততই মঙ্গল: মির্জা ফখরুল
Published: 9th, July 2025 GMT
যত দ্রুত দেশকে নির্বাচনের ট্র্যাকে ওঠানো যাবে ততই দেশের জন্য মঙ্গল বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বুধবার রাজধানীর নিউরো সায়েন্স হসপিটালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস এবং অধ্যাপক সিরাজ উদ্দিন আহমেদকে দেখার পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এই মন্তব্য করেন। সকাল সাড়ে ১১টায় আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরো সায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালে চিকিৎধীন অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুসকে দেখতে যান বিএনপি মহাসচিব। তিনি চিকিৎসকদের সঙ্গে তার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হন। এরপর একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অধ্যাপক সিরাজ উদ্দিন আহমেদকে দেখতে যান বিএনপির মহাসচিব এবং তার চিকিৎসার খোঁজ-খবর নেন।
এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘একটা কথা বলতে চাই, গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি যদি কেউ থাকে সেটা হচ্ছে বিএনপি এবং সবচেয়ে বেশি লড়াই যদি করে গণতন্ত্রের জন্য সেটা বিএনপি। বাংলাদেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে বিএনপি নিয়ে এসেছে বহুদলীয় গণতন্ত্রে এবং পরবর্তিকালে সংসদীয় গণতন্ত্রে। সুতরাং এই বিষয়ে প্রশ্ন করার কোনো প্রয়োজন নেই। দেশটাকে সকলে মিলে বাঁচাতে হবে। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হচ্ছে দেশকে সঠিক ট্র্যাকে ওঠানো এবং যত দ্রুত সেটাকে ওঠানো যাবে ততই মঙ্গল।’
তিনি বলেন, ‘যারা মনে করে যে, নির্বাচন প্রয়োজন নেই- আমার মনে হয়, তারা আবার চিন্তা করবেন। নির্বাচন প্রয়োজন জনগণের জন্য। একটা নির্বাচিত সরকার দরকার, যে সরকার জনগণের সম্পর্ক থাকবে। সেই কারণেই আমরা সংস্কারে অংশ নিচ্ছি। প্রত্যেকটি সংস্কারের দাবি আমরাই তুলেছি। সুতরাং সংস্কার এবং নির্বাচনের মধ্যে কোনো সাংঘর্ষিকতা নেই, দুইটা একসঙ্গে চলবে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আপনারা খুব ভালো করে জানেন, আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে নির্যাতন-হত্যা-গুম-খুনের সবচেয়ে বড় ভিক্টিম আমাদের দল বিএনপি। আমি নিজেও ১১২টা মামলার আসামি এবং ১৩ বার জেলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। আমরা সবসময়ে মনে করি যে, যারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে কাজ করবে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ কাজ করেছে তাদের প্রতিটি ব্যক্তির শাস্তি হওয়া প্রয়োজন, তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত এবং শাস্তি হওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা তিনি এককভাবে, আমি মনে করি দ্য রেসপোসিবল ফর দ্য কিলিং অব দ্য থাউজেন্ডস অব পিপল। তার বিচার শুরু হয়েছে, আমরা আশাবাদী তার এবং তার সঙ্গে যারা গণহত্যার সঙ্গে এবং এই ফ্যাসিস্ট আক্রমণের সঙ্গে জড়িত তাদের প্রত্যেকেরেই বিচার হবে। সেই হিসেবে আইনের আওতায় নিয়ে এসে দলও যদি দেখা যায়, দলগত হিসেবে তাদের বিচার হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম র জ ফখর ল গণতন ত র ন ব এনপ ফখর ল
এছাড়াও পড়ুন:
যে কারণে এখনই জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলনীতি জরুরি
একটি সুসংগঠিত নিরাপত্তা খাতের পূর্বশর্ত হলো সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলনীতি। এই কৌশলনীতির ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে সামগ্রিক নিরাপত্তা অবকাঠামো।
যেকোনো দেশের নিরাপত্তা খাতের পরিধি শুধু সীমান্ত রক্ষা করা বা অপরাধ দমন করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, প্রাতিষ্ঠানিক শাসনব্যবস্থা এবং যাঁরা এ ব্যবস্থার ভেতরে কাজ করেন, তাঁরা সবাই এই খাতের আওতাধীন।
আজকের বিশ্বে নিরাপত্তার মান কেবল সেনাবাহিনীর শক্তি বা পুলিশের উপস্থিতি দিয়ে নির্ধারিত হয় না; বরং নির্ধারিত হয় প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা দক্ষ, স্বচ্ছ ও জনগণের প্রতি কতটা জবাবদিহিমূলক তার ওপর। যেমন পুলিশ স্টেশন, ফরেনসিক ল্যাব, নজরদারিব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ একাডেমি, জরুরি সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি এ খাতের অবকাঠামোগত ভিত্তি।
আর শাসনব্যবস্থা নির্ধারণ করে এই প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা বৈধভাবে কাজ করছে, আইন কতটা হালনাগাদ, জবাবদিহির ব্যবস্থা আছে কি না এবং প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবে কতটা কার্যকরভাবে কাজ করছে তার ওপর।
এ বিশাল কাঠামোর কেন্দ্রে রয়েছে জনগণ। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই প্রধান উদ্দেশ্য। আধুনিক গণতন্ত্রে তাই নিরাপত্তা নির্ধারিত হয় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধতা, পেশাদারি ও নাগরিকদের আস্থার ওপর।
২.জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে নিরাপত্তা খাত নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো নিরাপত্তাব্যবস্থার কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে এখনো কোনো সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলনীতি নেই। ফলে নিরাপত্তা খাতের জন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি দিকনির্দেশনা বা সমন্বিত কাঠামো তৈরি হয়নি।
তাই প্রথম জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলনীতি প্রণয়ন প্রয়োজন। যতক্ষণ পর্যন্ত একটি স্বচ্ছ জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলনীতি তৈরি এবং এর ভিত্তিতে অবকাঠামো পুনর্গঠন করা না হবে, ততক্ষণ বাংলাদেশের মৌলিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করা সম্ভব হবে না।
জুলাই-পরবর্তী সময়ে পুলিশ বাহিনীর কাঠামোগত দুর্বলতা আরও স্পষ্ট হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানকে আবার পুর্নগঠন করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করেছে।
দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সেনা বা আধা সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। কখনো কখনো তাদের এমন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে সামরিক ভূমিকা থাকা উচিত নয়।এই কমিশন সংস্কারের জন্য ১০৮টি সুপারিশ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বডি–ওর্ন ক্যামেরা ও জিপিএস ট্র্যাকিং চালু করা, পুরোনো পুলিশ অ্যাক্ট আধুনিকায়ন করা, রাতের বেলায় গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে কঠোর বিচারিক তদারকি নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক মানসম্মত পাঁচ স্তরের বলপ্রয়োগ নীতি তৈরি করা।
কমিশন আরও প্রস্তাব করেছে একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করার, যারা বদলি, পদোন্নতি ও অনিয়ম নিয়ে কাজ করবে। রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
কিন্তু সংস্কারে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রভাব, জনগণের ওপর অন্যায্য ও অপ্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ এবং জবাবদিহির সীমাবদ্ধতার কারণে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
নাগরিকেরা মনে করছেন, পুলিশ আর জনগণের সেবক নয়; বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত একটি হাতিয়ার। এ অবিশ্বাসের ফলে পুলিশ-জনসম্পর্কে গভীর ফাটল তৈরি হয়েছে।
এটি কার্যকর আইনপ্রয়োগ ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারই এখন পুলিশ সংস্কারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি।
৩.তবে এককভাবে পুলিশের সংস্কার খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না। নিরাপত্তা খাতের আরও বড় অংশজুড়ে আছে সশস্ত্র বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভূমিকা ও প্রভাব আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সব সময় দেশের সংকটকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের শৃঙ্খলা ও দক্ষতা প্রায়ই অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় আলাদা মানদণ্ড তৈরি করে। গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের পথে বাংলাদেশ যখন এগোচ্ছে, তখন এই বাহিনীর ওপর আরও গুরুদায়িত্ব আরোপিত হয়েছে।
একটি সুস্থ গণতন্ত্রে সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের অধীন কাজ করে। নীতিনির্ধারণ, বাজেট অনুমোদন, মোতায়েন ও সামরিক ব্যয়সংক্রান্ত তদারকির ক্ষমতা থাকে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে; যদিও সশস্ত্র বাহিনী সাধারণত রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না, তবু জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থার অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব রয়েছে, যা প্রায়ই শক্তিশালী বেসামরিক তদারকি ছাড়াই পরিচালিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, প্রতিরক্ষা বাজেট খুব কমই প্রকাশ্য পর্যালোচনার মুখোমুখি হয়; অস্ত্র ও সরঞ্জাম ক্রয়ের প্রক্রিয়ায় রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব এবং কোনো বার্ষিক প্রতিরক্ষা শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয় না। এখানে সংসদীয় প্রতিরক্ষা কমিটিগুলোর কার্যক্রমও অত্যন্ত সীমিত।
আরও পড়ুনজাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা কীভাবে নির্ধারণ করব২৮ এপ্রিল ২০২৫৪.রাজনীতিকরণ এখানে আরেকটি বড় সমস্যা। দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সেনা বা আধা সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। কখনো কখনো তাদের এমন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে সামরিক ভূমিকা থাকা উচিত নয়।
ফলে বাহিনীগুলোর কার্যক্রমে রাজনীতিকরণের প্রবণতা দেখা দিয়েছে। প্রকাশ্য রাজনীতিকরণের বাইরে বিশেষ সুবিধা দেওয়া, নির্দিষ্ট পদে নিয়োগ, অনিয়মিত পদোন্নতি—এ ধরনের কর্মকাণ্ড প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রহণযোগ্যতাকে নষ্ট করেছে। এ পটভূমিতে নিরাপত্তা খাতে অর্থবহ সংস্কারের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
সংসদীয় প্রতিরক্ষা কমিটির কার্যক্রম আরও গতিশীল করা প্রয়োজন। তাদের কাজের ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে, যাতে তারা প্রতিরক্ষা বাজেট, নীতি, ব্যয় ও কাঠামোগত বিষয়ে কার্যকর পর্যালোচনা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে।
একই সঙ্গে তারা প্রতিরক্ষা ব্যয় খতিয়ে দেখবে, সামরিক ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং প্রতিবছর একটি প্রতিরক্ষা শ্বেতপত্র প্রকাশ বাধ্যতামূলক করবে। পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর ভূমিকা এবং পুলিশ-আধা সামরিক বাহিনীর ভূমিকার মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন থাকা জরুরি। অত্যন্ত বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া সামরিক বাহিনীকে দেশের ভেতর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যুক্ত করা উচিত নয়।
এ সিদ্ধান্তের ওপর সংসদের সরাসরি নজরদারি থাকতে হবে। গণতন্ত্র পুনর্গঠনে যদি বাংলাদেশ সত্যিই অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, তবে সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, পেশাদার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বেসামরিক কর্তৃপক্ষের অধীন কাজ করতে হবে।
৫.দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতেও সংস্কার আনা অত্যন্ত জরুরি। প্রচলিত ধারায় তারা প্রায় কোনো প্রকাশ্য তদারকি ছাড়াই কাজ করে। তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অভিযোগও দীর্ঘদিনের।
তাই সংসদের অধীন একটি গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন অপরিহার্য। এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা যাবে, তারা নির্দিষ্ট আদেশ অনুযায়ী কাজ করছে, নাগরিকের অধিকারকে সম্মান করছে এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের ক্ষেত্রে জবাবদিহির মুখোমুখি হচ্ছে।
বাংলাদেশের আধা সামরিক বাহিনী, যেমন আনসার, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সংস্কার করাও জরুরি। তাদের প্রশাসনিক কাঠামো রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের খুব কাছাকাছি হওয়ায় রাজনৈতিক প্রভাবের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদারকি যথেষ্ট নয়, এদের জন্য স্বাধীন, জবাবদিহিমূলক একটি তদারকি কাঠামো প্রয়োজন।
আরও পড়ুনসরকার ও সেনাবাহিনী: গণতন্ত্রে উত্তরণ ও ন্যায়বিচার যেন ব্যাহত না হয়২০ অক্টোবর ২০২৫৬.নিরাপত্তা খাতের সংস্কারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সামরিক-গণমাধ্যম সম্পর্ক। সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে গণমাধ্যমের যে নিবিড়, পেশাদার ও স্বচ্ছ সম্পর্ক থাকা উচিত, তা বাংলাদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি।
গণতান্ত্রিক নিরাপত্তা শাসন অনেকাংশে নির্ভর করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ এবং রাষ্ট্রের জবাবদিহি নিশ্চিত করায় গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকায়।
কিন্তু বাংলাদেশে বিশেষায়িত নিরাপত্তা সাংবাদিকতা প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে অনেক প্রতিবেদন অসম্পূর্ণ বা ভুল তথ্যভিত্তিক হয়, যা নাগরিকদের বিভ্রান্ত করে।
দক্ষ নিরাপত্তা রিপোর্টার তৈরি, তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা এবং সাংবাদিকদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া—এসবই নিরাপত্তা খাতে স্বচ্ছতা বাড়াতে সহায়ক হবে।
পাশাপাশি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে গণমাধ্যমের ওপর চাপ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে হবে। এ আস্থাহীনতা দূর করতে পারলে শুধু তথ্যের মানই বাড়বে না, জনআস্থাও আরও সুদৃঢ় হবে।
৭.নিরাপত্তা খাতে লিঙ্গসমতা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ শান্তি রক্ষা মিশনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করলেও দেশের ভেতরে পুলিশ, সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও আধা সামরিক বাহিনীগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো কম।
জাতিসংঘের ২০২২ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, ৩০টি দেশের গড় হিসাবে সেনাবাহিনীতে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় ১২ শতাংশ, বিমানবাহিনীতে ১৫ শতাংশ, নৌবাহিনীতে ১৪ শতাংশ এবং ৩৪টি দেশের পুলিশের ক্ষেত্রে গড়ে ২৪ শতাংশ। এর তুলনায় বাংলাদেশে পুলিশের মধ্যে নারীর সংখ্যা এখনো মাত্র ৮ শতাংশ তথা ১৬ হাজার ৮০১ জন।
নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণ, নারীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, নেতৃত্বের সুযোগ বৃদ্ধি এবং লিঙ্গ-সংবেদনশীল প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করা—এসবই টেকসই সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
৮.সবশেষে নিরাপত্তা খাতের সব প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি দৃঢ় নৈতিক কাঠামো থাকা অপরিহার্য। পেশাগত মানদণ্ড রক্ষা, অনিয়মের তদন্ত ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কার্যকর নৈতিক কমিটি গঠন প্রয়োজন।
পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও আধা সামরিক বাহিনী—সব ক্ষেত্রেই এ ধরনের কমিটি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ন্যায়ভিত্তিক আচরণ নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন, নিয়মিত পর্যালোচনা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানকে আরও মানবিক ও নাগরিকমুখী করে তোলা সম্ভব।
বিশেষ করে পুলিশের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগনির্ভর মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে কমিউনিটিভিত্তিক, মানবিক ও অধিকার-সংবেদনশীল পুলিশিং ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়া জরুরি।
পুলিশের ভূমিকা কেবল আইন প্রয়োগ নয়; বরং জনগণের আস্থা অর্জন এবং নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ—এই উপলব্ধিই একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক নিরাপত্তা খাতের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের সামনে সুযোগ এসেছে গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর তার নিরাপত্তা খাতকে নতুন করে গড়ে তোলার। গভীর, কাঠামোগত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশ সেই গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অর্জন করতে পারবে না।
প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য জবাবদিহিমূলক পুলিশিং, স্বচ্ছ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সংস্থা, মুক্ত গণমাধ্যম এবং বেসামরিক কর্তৃত্বের কার্যকর তত্ত্বাবধান প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। তাই নিরাপত্তা খাতের সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।
আ ন ম মুনীরুজ্জামান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ
*মতামত লেখকের নিজস্ব