রামদা হাতে আলোচনায় এসে দুর্বৃত্তের গুলিতে খুন
Published: 12th, July 2025 GMT
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ক্যাম্পাসে রামদা হাতে আলোচনায় এসেছিলেন। পাঁচ মাসের মাথায় নগরীর দৌলতপুরে নিজ বাড়ির সামনে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হয়েছেন। একাধিক গুলির পর তাঁর পায়ের রগও কেটে দেওয়া হয়। নিহতের নাম মাহবুবুর রহমান মোল্লা।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে এই হত্যাকাণ্ডের পর খুলনা-যশোর মহাসড়ক অবরোধ করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। তারা সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ ও মিছিল করেন।
নিহত মাহবুবুর রহমান মোল্লা দৌলতপুর থানা যুবদলের সহসভাপতি ছিলেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে-বিপক্ষে সংঘর্ষে শতাধিক ছাত্র ও স্থানীয় মানুষ আহত হন। কুয়েট ছাত্রশিবির, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে সেদিন ছাত্রদলের সংঘর্ষ বাধে। ছাত্রদলের পক্ষে স্থানীয় বিএনপির কর্মীরা এতে যোগ দেন। যদিও ছাত্রশিবির ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরে দাবি করেছিল তারা ওই দিনের সংঘর্ষে যুক্ত ছিল না। ওই সংঘর্ষের সময় রামদা হাতে মাহবুবুর রহমানের একটি ছবি সামাজিক ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ওই রাতেই তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে তিনি নিয়মিত দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে মহেশ্বরপাশা নিজ বাড়ির সামনে সদ্য কেনা প্রাইভেটকার পরিষ্কার করছিলেন মাহবুব। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে আসা তিন ব্যক্তি মাহবুবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। মাহবুব দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। তখন তারা পেছন থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। একটি গুলি মাহবুবের মাথায় এবং একাধিক গুলি তাঁর বুক, ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাগে। গুলি খেয়ে তিনি রাস্তার পাশে পড়ে যান। তখন দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেল থেমে নেমে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাঁর পায়ের রগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে যায়।
ওই সময় মসজিদে জুমার নামাজ চলায় সড়কে তেমন লোকজন ছিল না। সুরতহাল রিপোর্টে তাঁর শরীরে ৯টি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। মাহবুবের দুই স্ত্রী ও দুই মেয়ে আছে।
গতকাল মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির সামনে উৎসুক মানুষের ভিড়। পুলিশ, পিবিআই ও সিআইডি সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করছেন। বাড়ির প্রধান ফটক ও দেয়ালে একাধিক গুলির চিহ্ন। ঘটনাস্থল থেকে সাতটি গুলির খোসা উদ্ধারের কথা জানিয়েছে সিআইডি।
বাড়ির ভেতরে মাহবুবের দুই মেয়ে, বোন ও দ্বিতীয় স্ত্রী আহাজারি করছিলেন। নিহতের একমাত্র বোন শান্তা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘দলের জন্য কত কষ্ট করেছে। গুলি খাইছে, পলায় বেড়াইছে। এখন ভালো সময়ে আমার ভাই চলে গেলে।’
প্রত্যক্ষদর্শী এক যুবক বলেন, ‘মাহবুবের সঙ্গে তিনিও গাড়ি পরিষ্কার করছিলেন। এ সময় তিনজন মোটরসাইকেলে আসে। একজনের মাথায় হেলমেট ছিল। তারা নেমেই গুলি শুরু করে। মাহবুব ভাই বাড়ির দিকে দৌড় দেন। গুলির শব্দে আমি মাথা উঁচু করলে আমাকে লক্ষ্য করেও গুলি করে। তখন আমি দৌড়ে পালিয়ে যাই।’
দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আতাহার আলী বলেন, ‘যুবকরা মোটরসাইকেল চালিয়ে তেলিগাতির দিকে চলে গেছে। তথ্য পেয়ে আমরা ওই এলাকায় অভিযান শুরু করি। আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’ তিনি বলেন, মাহবুবের বিরুদ্ধে মাদকসহ আটটি মামলা ছিল। বিষয়গুলো মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে।
আলোচনায় নানা বিষয়
পুলিশ সূত্র ও স্থানীয়রা জানান, মহেশ্বরপাশা, তেলিগাতিসহ আশপাশের এলাকায় চরমপন্থি ও সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেশি। মাহবুব দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তবে ৫ আগস্টের পর এলাকায় বেপরোয়া আচরণ, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ও জমি বিক্রির সিন্ডকেট নিয়ন্ত্রণে তাঁর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আলোচনা আছে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বিএনপির একাংশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর, গত বছরের আগস্ট মাসে বিএল কলেজ সড়কে বিএনপি অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা এবং কুয়েটে রামদা হাতে অংশ নেওয়ার বিষয় নিয়ে স্থানীয়ভাবে আলোচনা চলছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এলাকায় আধিপত্য বিস্তারসহ কয়েকটি বিষয় মাথায় নিয়ে আমরা তদন্ত করছি।’
বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীরা জানান, বিএনপির নিবেদিত কর্মী ছিলেন মাহবুব। কিন্তু ৫ আগস্টের পর বদলে যান তিনি। কুয়েটের ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ মাহবুবকে গ্রেপ্তার করেনি। ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে– এমন ইঙ্গিত করে ফেসবুকে প্রচারণাও চালাচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মীরা।
খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম মনা বলেন, ‘খুলনায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। পুলিশ কোনো প্রতিকার করতে পারছে না। আগের হত্যার ঘটনায় পদক্ষেপ নিলে মাহবুবকে খুন হতে হতো না। আমরা অবলিম্বে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার এবং খুলনা পুলিশে বড় রদবদলের দাবি জানাচ্ছি।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র মদ ম হব ব র ব এনপ র এল ক য় ত কর ম হত য ক ক র কর ন ত কর স ঘর ষ কর ম র
এছাড়াও পড়ুন:
শরীয়তপুর রুটে বাস বন্ধের নেপথ্যে যুবদল নেতার ৫ কোটির চাঁদা!
ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় ‘শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস’ নামের একটি পরিবহনের একাধিক বাস ভাঙচুর ও শ্রমিকদের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। বাস মালিকদের দাবি চাঁদার পাঁচ কোটি টাকা না পেয়ে স্থানীয় সাবেক যুবদল নেতা মুশফিকুর রহমান ফাহিম ও তার অনুসারীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
এদিকে এ ঘটনার পর থেকে যাত্রাবাড়ী-শরীয়তপুর রুটে পরিবহনটির যাত্রীসেবা বন্ধ রয়েছে। ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে এ রুটে চলাচলকারী যাত্রীরা।
এ ঘটনায় দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি ভুক্তভোগী বাস মালিকদের। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছে সাবেক যুবদল নেতা মুশফিকুর রহমান ফাহিম। আর এ ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার।
জেলার বাস মালিক সমিতি সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে শরীয়তপুর থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা এলাকায় নিয়মিত যাত্রীপরিবহন করে আসছে শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস পরিবহনের দুই শতাধিক বাস। এ রুট ধরে প্রতিনিয়ত ঢাকা ও শরীয়তপুরে যাতায়াত করে অন্তত ৩০ হাজার যাত্রী।
সম্প্রতি এ রুটে চলা পরিবহনগুলোর মালিকদের কাছে পাঁচ কোটি চাকা চাঁদা দাবি করেন বলে অভিযোগ ওঠে যাত্রাবাড়ী থানা যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি মুশফিকুর রহমান ফাহিমের বিরুদ্ধে। এদিকে তাকে চাঁদার টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ২৫টি গাড়ি ভাঙচুর ও বেশ কয়েকজন শ্রমিকদের মারধরের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার পর থেকেই বাস শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অবিলম্বে চাঁদাবাজি বন্ধ ও অভিযুক্তের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।
শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস পরিবহনের চালক মাসুদ রানা বলেন, “যাত্রাবাড়ী গেলেই বিএনপির কিছু নেতা আমাদের বাস ভেঙে ফেলে। শ্রমিকদের মারধর করে। সেই ভয়ে পাঁচ দিন ধরে বাস চালাতে পারছি না। আমরা বিষয়টির সমাধান চাই। আমার পরিবার নিয়ে চলতে কষ্ট হচ্ছে।”
মারধরের শিকার হওয়া নয়ন ব্যাপারী নামের এক বাস শ্রমিক বলেন, “যাত্রাবাড়ী যাওয়ার পর হঠাৎ আমাদের বাসে হামলা চালায় ফাহিমের লোকজন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা বাসের গ্লাস ভেঙে ফেলে। আমাকেও জখম করা হয়েছে। আমরা যাত্রাবাড়ী রুটে বাস চালাতে পারছি না।”
বাস চলাচল বন্ধ থাকায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ যাত্রীরা। সিদ্দিক নামের এক যাত্রী বলেন, “আগে আমরা সরাসরি ঢাকার যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে নামতাম। এখন শুনলাম চাঁদার টাকার জন্য সেখানে বাস না গিয়ে ধোলাইপাড় এলাকায় যাবে। আমরা খুবই ঝামেলার মধ্যে পড়েছি। আমরা সমস্যার সমাধান চাই।”
শরীয়তপুর আন্তঃজেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফারুক আহম্মেদ চৌকিদার অভিযোগ করে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে যাত্রাবাড়ী রুটে চাঁদাবাজি হয়ে আসছিল, তবে সেটা সহনশীল পর্যায়ে ছিল। সম্প্রতি এক যুবদল নেতা আমাদের মালিক সমিতির কাছ থেকে পাঁচ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছেন। তাকে টাকা না দেওয়ায় আমাদের বাস ভাঙচুর ও শ্রমিকদের মারধর করা হচ্ছে। আমরা এই সমস্যা থেকে মুক্তি চাই।”
বাস মালিক সমিতির সভাপতি ফারুক তালুকদার বলেন, “যুবদল নেতা ফাহিম চাঁদার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তিনি প্রতিমাসে আমাদের গাড়ি থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা চাঁদা নিচ্ছে। তবে তিনি আরও বড় অংকের টাকা (৫ কোটি) দাবি করছেন। আমরা তার সেই দাবি না মেনে বিএনপির হাইকমান্ডকে জানিয়েছি। এরপর থেকে তিনি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে আমাদের বাসগুলোতে ভাঙচুর চালিয়েছে। আমরা চাঁদাবাজমুক্ত পরিবহন সেক্টর চাই।”
চাঁদা দাবির বিষয়টি অস্বীকার করে যাত্রাবাড়ী থানা যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি মুশফিকুর রহমান ফাহিম বলেন, “আমাদের গাড়ির রুটপারমিট থাকার পরেও শরীয়তপুরের বাস মালিক সমিতি সেগুলোকে অন্য উপজেলায় যেতে দিচ্ছে না। এখন তারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছেন। আমি কারো কাছে পাঁচ কোটি টাকা দাবি করিনি। আমি চাঁদাবাজি করে থাকলে আমরা বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হোক। অভিযোগ প্রমাণ হলে আমি আমার অপরাধ মাথা পেতে নেব।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলার পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস নামের একটি পরিবহন যাত্রাবাড়িতে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। কতিপয় দুষ্কৃতকারী চাঁদাদাবি করেছে এবং বাসে ভাঙচুর করছে। আমরা ঘটনাটি জানার পর ডিএমপির সংশ্লিষ্ট ক্রাইম বিভাগের সাথে যোগাযোগ করেছি। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধও জানিয়েছি। আমরা বিষয়টি নিয়ে ডিএমপির সাথে যৌথভাবে কাজ করছি।”
ঢাকা/আকাশ/এস