‘মানচিত্র’ সমকালীন বাংলাদেশের অন্যতম কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতারের বইমেলা ২০২৫–এ প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ। বইটির মলাট ওলটানো মাত্র হাজার হাজার পিঁপড়ে ছুটে বেরোবে পাতার ভেতর থেকে। তারপর, বইয়ের শরীর থেকে নিচে, মেঝের রুখু জমিনে আছড়ে পড়ে তারা দিগ্‌ভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকবে এদিক–সেদিক, মাথাগোঁজার ঠাঁইয়ের তালাশে। যদি আপনি নরম হৃদয়ের মানুষ হন, বইটি হয়তো ছুড়ে ফেলবেন হাত থেকে বা নিজে থেকেই বইটা হাত ফসকে পড়ে যাবে। আপনি আবিষ্কার করবেন আপনার দুহাত রক্তে মাখা। সে রক্ত নিজের না অন্য কারও, আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন না।

বাম ফ্লাপে লেখা বই পরিচিতি পড়লে মনে হবে, এই গল্পগ্রন্থ লেখকের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই আদ্যোপান্ত লেখা। তবে কেন এর পাঠ প্রতিক্রিয়ার এ রকম রক্তিম শুরুয়াদ? কারণ, শাহীন আখতারের গল্পগুলোর মূল স্রোতের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য চোরাস্রোত, যারা গল্পের গতিপথ নির্ধারণের জন্য প্রবাহিত হয় মানুষের ইতিহাসের অন্ধকারতম সব বাঁক ঘেঁষে।

চারটি মাত্র গল্প এ বইয়ে—সাগরপাড়ি, মানচিত্র, সোনার আংটি আর ভালোবাসার শহর সারায়েভো। পৃষ্ঠা সংখ্যা সাকল্যে ৯৬। এই সংক্ষিপ্ত পথপরিক্রমাতেই শাহীন হেঁটে ফেলেছেন মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি; আরাকান, ইন্দোনেশিয়া, ক্রিসমাস আইল্যান্ড, পাপুয়া নিউগিনি হয়ে বাংলার ভাসান চর; বার্লিনের পাইন বন হয়ে রাশিয়ার সাইবেরিয়া; বসনিয়া হার্জেগোভিনার প্রাণকেন্দ্র সারায়েভো। তৃতীয় গল্প, মানচিত্র বাদে বাকি তিনটি গল্পের কথক এক নারী। আমরা ধারণা করতে পারি, সে কণ্ঠস্বর লেখকের নিজেরই।

প্রথম গল্প ‘সাগরপাড়ি’তে চিত্রিত হয় বাংলাদেশের জীবনযাত্রার মানে পিছিয়ে থাকা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বৈধ কিংবা অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার ঘটনা। জানা যায় নতুন একধরনের ‘গেম’–এর ব্যাপারে। জানা যায় ‘গেম’ খেলতে নামার নামে কনটেইনারে ঢুকে কিংবা বাতাসে ফোলানো রাবারের বোটে করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশি তরুণদেরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে, ইতালি হয়ে ইউরোপের অভিবাসনপ্রত্যাশী হওয়ার কাহিনি।

দ্বিতীয় গল্প ‘মানচিত্র’তে আমরা দেখতে পাই আরাকানে জন্ম নেওয়া এক রোহিঙ্গা শিশুর জন্মভূমি থেকে নিপীড়িত অবস্থায় নতুন আবাসের তালাশে সমুদ্রে নৌকা ভাসানো। সমুদ্র থেকে ইন্দোনেশিয়ার এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটক থাকার পর সেখান থেকে আবারও জলে ভেসে পাপুয়া নিউগিনিতে আশ্রয় নেওয়ার গল্প। গল্পের কথক, নামহীন রোহিঙ্গা শিশুটি এই অভিযানের ফাঁকেতালে প্রবাহিত সময়ের স্রোতে ‘ছোট রোহিঙ্গা’ থেকে পরিণত হয় ‘মেজ রোহিঙ্গা’তে। শেষমেশ সে আবারও সমুদ্রের বুকে বেরিয়ে পড়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ক্যাপ্টেন কুকের মতো নতুন, অনাবিষ্কৃত এক দ্বীপের খোঁজে। তার দ্বীপ তালাশের খবর চিঠির মাধ্যমে গিয়ে পৌঁছায় তার মা ও ভাইয়ের কাছে, যারা নিজেরাও তত দিনে জন্মভূমি আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশের ভাসানচরে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

তৃতীয় গল্প, ‘সোনার আংটি’র কথক সাদিকা রহমান তার একদা বাংলাদেশের এক এনজিওতে কর্মরত কলিগ, জার্মানির মেয়ে অ্যাগনেসের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর জার্মানিতে গিয়ে দেখা করে। প্রবহমান বছর এবং বয়সের ফাঁকে তালে দুই বান্ধবী আবিষ্কার করে, তাদের মাঝে আলাপের তান আর আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ত নয়। একই সঙ্গে সাদিকা জানতে পারে, অ্যাগনেসের পূর্বপুরুষ, তার নানা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেতাজি বোসের অধীনে ইন্ডিয়ান লিজিয়নে কাজ করতেন। হিটলারের বাহিনীর সঙ্গে বোস বাহিনী একীভূত হয়ে এলে নাৎসিদের সঙ্গে মিলেই যুদ্ধ করেন তিনি। শেষমেশ নিখোঁজ হন। নিজের পূর্বপুরুষের তত্ত্বতালাশে অ্যাগনেস চষে বেড়াচ্ছে সুইজারল্যান্ড–রাশিয়া হয়ে নয়াদিল্লি।

শেষ গল্প, ‘ভালোবাসার শহর সারায়েভো’ মূলত লেখকের বলকান রাষ্ট্র বসনিয়া হয়ে তুরস্ক ভ্রমণের ইতিবৃত্ত, মাঝখানে বলকানদের প্রাচীন ইতিহাস প্রক্ষেপণ। চোখধাঁধানো নৈসর্গিক সৌন্দর্যে অধ্যুষিত এ অঞ্চলটিই দগদগে ঘায়ের মতো শরীরে বহন করছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নের দুঃস্মৃতি এবং ১৯৯৫–এ সার্বিয়ার বসনিয়ান মুসলিম গণহত্যার বেদনা।

আখ্যানের বয়ন ও বয়ানের নির্মিতিতে এ গল্পগুলোতে শাহীন আখতার বিশেষ কোনো নিরীক্ষাধর্মিতা অবলম্বন করেননি। ন্যারেটিভ মোটামুটি সোজাসাপটা। প্রথম গল্পটি কেবল ফ্ল্যাশব্যাকে এগোয়। প্রতিটি গল্পের ফাঁকফোকরে অনেক অনেক ঐতিহাসিক তথ্যসংবলিত ডাইভারশন এবং অ্যানেকডোট বা ছোট ছোটগল্প থাকে।

ভাষার প্রয়োগ, শাহীন আখতারের যেকোনো লেখায় মূল কাহিনি বা মুখ্য চরিত্রগুলোর মতোই সমপরিমাণ গুরুত্ব নিয়ে প্রতিভাত হয়। উদাহরণত, প্রথম উপন্যাস ‘পালাবার পথ নেই’তে গল্প বলার নিজস্ব এক ভাষারীতির খোঁজে থাকা শাহীন নারীর যাপিত জীবনের বর্ণনায় এক বিদ্রূপাত্মক ও শ্লেষমাখা ভাষা খুঁজে পান উপন্যাস তালাশে এসে। ‘সখী রঙ্গমালা’য় পাথরের মতো ভারী আঞ্চলিক নোয়াখালী ভাষার সঙ্গে বৈসাদৃশ্য তৈরি করে সটান মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায় আরবি–ফারসিখচিত পরবর্তী উপন্যাস ‘ময়ূর সিংহাসন’–এর ভাষা। একইভাবে অসুখী দিনে দুটি ভিন্ন ন্যারেটিভের দুটি ভিন্ন ভাষা এবং সর্বশেষ এক শ এক রাতের গল্পে একাধিক কথকের উপযুক্ত ভাষার নির্মাণে তার ভাষিক তালাশ একধরনের পরিণতিতে পৌঁছে।

গল্পবই ‘মানচিত্র’–এ শাহীন আখতারের ভাষা অনেকটাই ডায়েরিতে এন্ট্রি তোলার মতো ছিপছিপে নির্মেদ। যেন অনেকটা নিজের জন্যই টুকে রাখছেন তথ্য। হুটহাট অনেক ইংরেজি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। কিছু শব্দ টেকনিক্যাল জারগন, যাদের অর্থ আগে থেকে জানা না থাকলে গল্পের প্রসঙ্গ থেকে মানে উদ্ধার করা যায় না। (উদাহরণত: ডিটেনি, স্পাইগ্লাস, ট্রান্সফিল্ড বিহাইক্যাল, ইত্যাদি)। আর এত এত জায়গা এবং দর্শনীয় স্থানের নাম তিনি উল্লেখ করতে থাকেন, তা–ও এত দ্রুতগতিতে, যে ক্ষেত্রবিশেষে সে গতির সঙ্গে তাল মেলানো মুশকিল হয়ে যায়। তবু এই গল্পগুলোর ভাষা অনেক বেশি ওয়েলকামিং। মস্তিষ্ক ও মনোযোগের খুব বেশি পরীক্ষা দেওয়া ছাড়াই গল্পের ভেতরে ঢুকে পড়া যায়।

আবার এ সোজাসাপটা বয়ানের মাঝেই, যে জায়গায় কাব্যিক কুহকের জাল বিছানো প্রয়োজন, তা তিনি বিছান অনায়াসে। উদাহরণত, তাঁর প্রথম গল্পে, গ্রামের অলস সকালের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লেখেন,

‘গাঁয়ে বেশির ভাগ দিন তাঁর ঘুম ভাঙে মাইকে মৃত্যুসংবাদ শুনে। মৃত্যুসংবাদের পর শুনতে পান টুপটাপ শিশির পতন। আর জানালার পর্দার ফাঁকে ধোঁয়া—নীল আলো দেখে বোঝেন যে সকাল হতে আর বাকি নেই। সূর্যের দেখা না মিললেও মোরগের ডাকাডাকিতে একসময় সকাল হয়। শিশিরের জালে জড়ানো সকাল। হঠাৎ হঠাৎ দু–চারজন মানুষ সেই জাল ফুঁড়ে মেঠোপথে নেমে আসে। ধ্যানমগ্ন হয়ে হাঁটে। নিঃশব্দ শিশিরের রেশমি আদরের আড়ালে ফের মিলিয়ে যায়। নৈঃশব্দ্য ভেদ করে আচমকা চিলের চিৎকার ভেসে আসে। তখন একটি–দুটি কাক শিশিরে ডানা ভিজিয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে পতপত শব্দে উড়ে যায়।’

শাহীন আখতার সারা জীবন নারীর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পৃথিবী দেখে নারীদের ভাষাতেই সেটা তুলে ধরেছেন তাঁর লেখার ডালায়। কিন্তু তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত এই গল্পগুলোয় শাহীন আখতার যেন পৃথিবীর সঙ্গে বোঝাপড়ার এক নৈর্ব্যত্তিক অবস্থানে পৌঁছেছেন। সর্বজনীন, লিঙ্গনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে পৃথিবীর দিকে তাকাতে সক্ষম হয়েছেন।

মানচিত্র
শাহীন আখতার

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রকাশক: বাতিঘর
পৃষ্ঠা: ৯৬
মূল্য: ৩০০

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ হ ন আখত র র ই গল প গল প র প রক শ র গল প প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

শাহীন আখতারের ‘মানচিত্রে’ পিঁপড়েদের ঘরবাড়ির তালাশ

‘মানচিত্র’ সমকালীন বাংলাদেশের অন্যতম কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতারের বইমেলা ২০২৫–এ প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ। বইটির মলাট ওলটানো মাত্র হাজার হাজার পিঁপড়ে ছুটে বেরোবে পাতার ভেতর থেকে। তারপর, বইয়ের শরীর থেকে নিচে, মেঝের রুখু জমিনে আছড়ে পড়ে তারা দিগ্‌ভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকবে এদিক–সেদিক, মাথাগোঁজার ঠাঁইয়ের তালাশে। যদি আপনি নরম হৃদয়ের মানুষ হন, বইটি হয়তো ছুড়ে ফেলবেন হাত থেকে বা নিজে থেকেই বইটা হাত ফসকে পড়ে যাবে। আপনি আবিষ্কার করবেন আপনার দুহাত রক্তে মাখা। সে রক্ত নিজের না অন্য কারও, আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন না।

বাম ফ্লাপে লেখা বই পরিচিতি পড়লে মনে হবে, এই গল্পগ্রন্থ লেখকের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই আদ্যোপান্ত লেখা। তবে কেন এর পাঠ প্রতিক্রিয়ার এ রকম রক্তিম শুরুয়াদ? কারণ, শাহীন আখতারের গল্পগুলোর মূল স্রোতের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য চোরাস্রোত, যারা গল্পের গতিপথ নির্ধারণের জন্য প্রবাহিত হয় মানুষের ইতিহাসের অন্ধকারতম সব বাঁক ঘেঁষে।

চারটি মাত্র গল্প এ বইয়ে—সাগরপাড়ি, মানচিত্র, সোনার আংটি আর ভালোবাসার শহর সারায়েভো। পৃষ্ঠা সংখ্যা সাকল্যে ৯৬। এই সংক্ষিপ্ত পথপরিক্রমাতেই শাহীন হেঁটে ফেলেছেন মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি; আরাকান, ইন্দোনেশিয়া, ক্রিসমাস আইল্যান্ড, পাপুয়া নিউগিনি হয়ে বাংলার ভাসান চর; বার্লিনের পাইন বন হয়ে রাশিয়ার সাইবেরিয়া; বসনিয়া হার্জেগোভিনার প্রাণকেন্দ্র সারায়েভো। তৃতীয় গল্প, মানচিত্র বাদে বাকি তিনটি গল্পের কথক এক নারী। আমরা ধারণা করতে পারি, সে কণ্ঠস্বর লেখকের নিজেরই।

প্রথম গল্প ‘সাগরপাড়ি’তে চিত্রিত হয় বাংলাদেশের জীবনযাত্রার মানে পিছিয়ে থাকা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বৈধ কিংবা অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার ঘটনা। জানা যায় নতুন একধরনের ‘গেম’–এর ব্যাপারে। জানা যায় ‘গেম’ খেলতে নামার নামে কনটেইনারে ঢুকে কিংবা বাতাসে ফোলানো রাবারের বোটে করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশি তরুণদেরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে, ইতালি হয়ে ইউরোপের অভিবাসনপ্রত্যাশী হওয়ার কাহিনি।

দ্বিতীয় গল্প ‘মানচিত্র’তে আমরা দেখতে পাই আরাকানে জন্ম নেওয়া এক রোহিঙ্গা শিশুর জন্মভূমি থেকে নিপীড়িত অবস্থায় নতুন আবাসের তালাশে সমুদ্রে নৌকা ভাসানো। সমুদ্র থেকে ইন্দোনেশিয়ার এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটক থাকার পর সেখান থেকে আবারও জলে ভেসে পাপুয়া নিউগিনিতে আশ্রয় নেওয়ার গল্প। গল্পের কথক, নামহীন রোহিঙ্গা শিশুটি এই অভিযানের ফাঁকেতালে প্রবাহিত সময়ের স্রোতে ‘ছোট রোহিঙ্গা’ থেকে পরিণত হয় ‘মেজ রোহিঙ্গা’তে। শেষমেশ সে আবারও সমুদ্রের বুকে বেরিয়ে পড়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ক্যাপ্টেন কুকের মতো নতুন, অনাবিষ্কৃত এক দ্বীপের খোঁজে। তার দ্বীপ তালাশের খবর চিঠির মাধ্যমে গিয়ে পৌঁছায় তার মা ও ভাইয়ের কাছে, যারা নিজেরাও তত দিনে জন্মভূমি আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশের ভাসানচরে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

তৃতীয় গল্প, ‘সোনার আংটি’র কথক সাদিকা রহমান তার একদা বাংলাদেশের এক এনজিওতে কর্মরত কলিগ, জার্মানির মেয়ে অ্যাগনেসের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর জার্মানিতে গিয়ে দেখা করে। প্রবহমান বছর এবং বয়সের ফাঁকে তালে দুই বান্ধবী আবিষ্কার করে, তাদের মাঝে আলাপের তান আর আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ত নয়। একই সঙ্গে সাদিকা জানতে পারে, অ্যাগনেসের পূর্বপুরুষ, তার নানা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেতাজি বোসের অধীনে ইন্ডিয়ান লিজিয়নে কাজ করতেন। হিটলারের বাহিনীর সঙ্গে বোস বাহিনী একীভূত হয়ে এলে নাৎসিদের সঙ্গে মিলেই যুদ্ধ করেন তিনি। শেষমেশ নিখোঁজ হন। নিজের পূর্বপুরুষের তত্ত্বতালাশে অ্যাগনেস চষে বেড়াচ্ছে সুইজারল্যান্ড–রাশিয়া হয়ে নয়াদিল্লি।

শেষ গল্প, ‘ভালোবাসার শহর সারায়েভো’ মূলত লেখকের বলকান রাষ্ট্র বসনিয়া হয়ে তুরস্ক ভ্রমণের ইতিবৃত্ত, মাঝখানে বলকানদের প্রাচীন ইতিহাস প্রক্ষেপণ। চোখধাঁধানো নৈসর্গিক সৌন্দর্যে অধ্যুষিত এ অঞ্চলটিই দগদগে ঘায়ের মতো শরীরে বহন করছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নের দুঃস্মৃতি এবং ১৯৯৫–এ সার্বিয়ার বসনিয়ান মুসলিম গণহত্যার বেদনা।

আখ্যানের বয়ন ও বয়ানের নির্মিতিতে এ গল্পগুলোতে শাহীন আখতার বিশেষ কোনো নিরীক্ষাধর্মিতা অবলম্বন করেননি। ন্যারেটিভ মোটামুটি সোজাসাপটা। প্রথম গল্পটি কেবল ফ্ল্যাশব্যাকে এগোয়। প্রতিটি গল্পের ফাঁকফোকরে অনেক অনেক ঐতিহাসিক তথ্যসংবলিত ডাইভারশন এবং অ্যানেকডোট বা ছোট ছোটগল্প থাকে।

ভাষার প্রয়োগ, শাহীন আখতারের যেকোনো লেখায় মূল কাহিনি বা মুখ্য চরিত্রগুলোর মতোই সমপরিমাণ গুরুত্ব নিয়ে প্রতিভাত হয়। উদাহরণত, প্রথম উপন্যাস ‘পালাবার পথ নেই’তে গল্প বলার নিজস্ব এক ভাষারীতির খোঁজে থাকা শাহীন নারীর যাপিত জীবনের বর্ণনায় এক বিদ্রূপাত্মক ও শ্লেষমাখা ভাষা খুঁজে পান উপন্যাস তালাশে এসে। ‘সখী রঙ্গমালা’য় পাথরের মতো ভারী আঞ্চলিক নোয়াখালী ভাষার সঙ্গে বৈসাদৃশ্য তৈরি করে সটান মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায় আরবি–ফারসিখচিত পরবর্তী উপন্যাস ‘ময়ূর সিংহাসন’–এর ভাষা। একইভাবে অসুখী দিনে দুটি ভিন্ন ন্যারেটিভের দুটি ভিন্ন ভাষা এবং সর্বশেষ এক শ এক রাতের গল্পে একাধিক কথকের উপযুক্ত ভাষার নির্মাণে তার ভাষিক তালাশ একধরনের পরিণতিতে পৌঁছে।

গল্পবই ‘মানচিত্র’–এ শাহীন আখতারের ভাষা অনেকটাই ডায়েরিতে এন্ট্রি তোলার মতো ছিপছিপে নির্মেদ। যেন অনেকটা নিজের জন্যই টুকে রাখছেন তথ্য। হুটহাট অনেক ইংরেজি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। কিছু শব্দ টেকনিক্যাল জারগন, যাদের অর্থ আগে থেকে জানা না থাকলে গল্পের প্রসঙ্গ থেকে মানে উদ্ধার করা যায় না। (উদাহরণত: ডিটেনি, স্পাইগ্লাস, ট্রান্সফিল্ড বিহাইক্যাল, ইত্যাদি)। আর এত এত জায়গা এবং দর্শনীয় স্থানের নাম তিনি উল্লেখ করতে থাকেন, তা–ও এত দ্রুতগতিতে, যে ক্ষেত্রবিশেষে সে গতির সঙ্গে তাল মেলানো মুশকিল হয়ে যায়। তবু এই গল্পগুলোর ভাষা অনেক বেশি ওয়েলকামিং। মস্তিষ্ক ও মনোযোগের খুব বেশি পরীক্ষা দেওয়া ছাড়াই গল্পের ভেতরে ঢুকে পড়া যায়।

আবার এ সোজাসাপটা বয়ানের মাঝেই, যে জায়গায় কাব্যিক কুহকের জাল বিছানো প্রয়োজন, তা তিনি বিছান অনায়াসে। উদাহরণত, তাঁর প্রথম গল্পে, গ্রামের অলস সকালের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লেখেন,

‘গাঁয়ে বেশির ভাগ দিন তাঁর ঘুম ভাঙে মাইকে মৃত্যুসংবাদ শুনে। মৃত্যুসংবাদের পর শুনতে পান টুপটাপ শিশির পতন। আর জানালার পর্দার ফাঁকে ধোঁয়া—নীল আলো দেখে বোঝেন যে সকাল হতে আর বাকি নেই। সূর্যের দেখা না মিললেও মোরগের ডাকাডাকিতে একসময় সকাল হয়। শিশিরের জালে জড়ানো সকাল। হঠাৎ হঠাৎ দু–চারজন মানুষ সেই জাল ফুঁড়ে মেঠোপথে নেমে আসে। ধ্যানমগ্ন হয়ে হাঁটে। নিঃশব্দ শিশিরের রেশমি আদরের আড়ালে ফের মিলিয়ে যায়। নৈঃশব্দ্য ভেদ করে আচমকা চিলের চিৎকার ভেসে আসে। তখন একটি–দুটি কাক শিশিরে ডানা ভিজিয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে পতপত শব্দে উড়ে যায়।’

শাহীন আখতার সারা জীবন নারীর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পৃথিবী দেখে নারীদের ভাষাতেই সেটা তুলে ধরেছেন তাঁর লেখার ডালায়। কিন্তু তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত এই গল্পগুলোয় শাহীন আখতার যেন পৃথিবীর সঙ্গে বোঝাপড়ার এক নৈর্ব্যত্তিক অবস্থানে পৌঁছেছেন। সর্বজনীন, লিঙ্গনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে পৃথিবীর দিকে তাকাতে সক্ষম হয়েছেন।

মানচিত্র
শাহীন আখতার

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রকাশক: বাতিঘর
পৃষ্ঠা: ৯৬
মূল্য: ৩০০

সম্পর্কিত নিবন্ধ