হাতি হত্যায় থানায় অভিযোগ দিয়ে দায় সারছে বন বিভাগ
Published: 4th, May 2025 GMT
হাতি হত্যার বিচারে বন অধিদপ্তরের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ বন্য প্রাণী আইনে তাদের সে ক্ষমতা আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি সে আইন প্রয়োগ না করে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে দায় সারছে। এদিকে প্রতিবছরই হাতি হত্যার ঘটনা ঘটছে। গত ৯ বছরে ১৪৬টি হাতি মারা যাওয়ার ঘটনায় বন আদালতে মাত্র ২০টি মামলা করেছে অধিদপ্তর।
বন বিভাগের তথ্য বলছে, গত ৯ বছরে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ১১৪টি হাতি মারা গেছে; কিন্তু বন আদালতে মামলা হয়েছে মাত্র ১৯টি। আর থানায় সাধারণ ডায়েরি হয়েছে ৭৫টি। একই সময়ে নেত্রকোনা, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও জামালপুরে ৩২টি হাতি হত্যার শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি হয়েছে মাত্র সাতটি। থানায় মামলা হয়েছে একটি আর বন আদালতে মামলা হয়েছে একটি।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, হাতি হত্যার ঘটনায় যে ময়নাতদন্ত হয়, সেখানে প্রকৃত কারণ গোপন করে বার্ধক্যের কারণ বা অসুস্থতার কারণে মারা গেছে উল্লেখ করার প্রবণতা আছে বন বিভাগের।শেরপুর বন বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এখানে বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হাতি হত্যা করা হয়। বনের জায়গা দখল করে ধান চাষ ও নানা জাতের ফলের বাগান রক্ষা করতে এসব হাতি হত্যা করা হয়।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে মৃত্যু হওয়া ১১৪টি হাতির মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ৭টি; বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়েছে ২৬টি হাতি। দুর্ঘটনার কারণে ১৮টি, অসুস্থ হয়ে ৪০টি, বয়সের কারণে ১৫টি ও অজ্ঞাত কারণে ১০টি হাতি মারা গেছে। তবে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হাতি হত্যার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ সময়ে শুধু কক্সবাজার এলাকাতেই ১৮টি হাতি গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, হাতি হত্যার ঘটনায় যে ময়নাতদন্ত হয়, সেখানে প্রকৃত কারণ গোপন করে বার্ধক্যের কারণ বা অসুস্থতার কারণে মারা গেছে উল্লেখ করার প্রবণতা আছে বন বিভাগের।
আইনে যা বলা আছে
বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর ৩৬ ধারার ১ উপধারায় বলা আছে, বন্য প্রাণী হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তা বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শক্রমে বন আদালতে প্রসিকিউশন অফেন্স রিপোর্ট (অপরাধ–সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন) মামলা করতে পারবেন।
একই উপধারায় আরও বলা আছে, কোনো ব্যক্তি ধারা ২৪ এর অধীন লাইসেন্স বা পারমিট ছাড়া তফসিল ১-ভুক্ত হাতি বা বাঘ হত্যা করলে সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে সর্বোচ্চ ১২ বছরের কারাদণ্ডসহ সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে।
তবে বাঘ বা হাতি কর্তৃক কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে এবং এ কারণে তাঁর প্রাণ সংশয় হলে জীবন রক্ষার্থে ওই আক্রমণকারী বাঘ বা হাতিকে হত্যার ক্ষেত্রে এই ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে না।
হত্যা ছাড়াও নানা কারণে হাতি মারা যায়। হাতিকে কে গুলি করল সেটি যদি জানা না যায়, তাহলে মামলা করে কোনো লাভ হয় না। সে ক্ষেত্রে তাঁরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ময়নাতদন্তে নিশ্চিত হলেই তাঁরা বন আদালতে মামলা করেন।বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মো.ছানাউল্যা পাটওয়ারী
যে কারণে আইন প্রয়োগে অনীহা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন অধিদপ্তরের শীর্ষ তিন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বন কর্মকর্তারা দুর্গম এলাকায় থাকেন। বনসংলগ্ন এলাকার লোকজন বনের জায়গায় ফলের চাষ করেন। সেগুলো হাতি থেকে রক্ষা করতে তাঁরা গুলি করে ও বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হাতি হত্যা করেন। এসব লোকজনকে আসামি করে মামলা দিতে গেলে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বন কর্মীদের বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়। এ কারণে স্থানীয় বন কর্মকর্তারা বন আদালতে মামলা করতে চান না। অধিকাংশ সময় তাঁরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করে দায় সারেন। অন্যদিকে বন্য প্রাণী আইনে দায়ের হওয়া কোনো মামলায় যদি আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে খালাস দেন এবং আদালতে যদি প্রমাণিত হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও হয়রানিমূলক, তাহলে মামলা দায়েরকারী বন কর্মকর্তার সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। এ কারণে বন কর্মকর্তারা বন্য প্রাণী আইনে মামলা করতে অনাগ্রহী থাকেন বলে জানিয়েছেন ওই তিন শীর্ষ কর্মকর্তা।
বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মো. ছানাউল্যা পাটওয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, হত্যা ছাড়াও নানা কারণে হাতি মারা যায়। হাতিকে কে গুলি করল সেটি যদি জানা না যায়, তাহলে মামলা করে কোনো লাভ হয় না। সে ক্ষেত্রে তাঁরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ময়নাতদন্তে নিশ্চিত হলেই তাঁরা বন আদালতে মামলা করেন।
বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হাতিটিকে হত্যা করেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। আমরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেছি। বন বিভাগ এ ঘটনায় মামলাটি করেছে।নালিতাবাড়ী থানার ওসি মো. মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়াচলতি বছরের ২১ মার্চ শেরপুরের নালিতাবাড়ী থানার মধুটিলা এলাকায় বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে একটি হাতি হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আসামির নাম-ঠিকানা জানা গেলেও বন বিভাগ বন আদালতে মামলা না করে থানায় মামলা করে।
এ বিষয়ে নালিতাবাড়ী থানার ওসি মো. মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হাতিটিকে হত্যা করেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। আমরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেছি। বন বিভাগ এ ঘটনায় মামলাটি করেছে।’
বন বিভাগের ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (শেরপুর অঞ্চলও এ বিভাগের অধীন) আ ন ম ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পুলিশের সাহায্য ছাড়া এসব তদন্ত করতে পারি; কিন্তু বন আদালতে মামলা করলে স্লো অ্যাকশন হয়। ঝক্কিঝামেলা আছে। সহজতর করতে (পুরো প্রক্রিয়া) থানায় মামলা করা হয়।’
বন বিভাগের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি হাতি মারা গেছে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগে। গত ৯ বছরে এখানে ৩২টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। এর পর আছে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ, একই সময়ে এখানে মারা গেছে ৩০টি হাতি।কোন বিভাগে হাতি হত্যা বেশি
বন বিভাগের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি হাতি মারা গেছে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগে। গত ৯ বছরে এখানে ৩২টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। এর পর আছে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ, একই সময়ে এখানে মারা গেছে ৩০টি হাতি।
কক্সবাজার ও শেরপুরে হাতি হত্যার কারণ জানতে ২০২২ সালে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিদর্শনে আমরা দেখেছি, হাতির করিডরগুলো মানববসতি, ধান চাষ ও সড়ক হয়ে গেছে। হাতি যখন তার স্বাভাবিক পথে চলাচল করতে যায়, তখন অবৈধ দখলদারেরা হাতিকে উপদ্রব মনে করে। তারা বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হাতি হত্যা করে।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক ময়ন তদন ত বন য প র ণ র বন ব ভ গ গত ৯ বছর র ঘটন য় কর ত র
এছাড়াও পড়ুন:
শিক্ষার্থীরা মুচলেকা দিলে মামলা-জিডি প্রত্যাহার করা হবে, জানালেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মুচলেকা দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে করা মামলা ও সাধারণ ডায়েরি (জিডি) প্রত্যাহার করা হবে বলে জানিয়েছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শুচিতা শরমিন।
আজ রোববার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপাচার্যের বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শুচিতা শরমিন এ কথা জানান। সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য বলেন, সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেওয়া হবে।
শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলা ও জিডি প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, মুচলেকার মাধ্যমে এসব মামলা ও জিডি প্রত্যাহার করা হবে। সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিল থেকে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মহসিন উদ্দীনকে অব্যাহতির বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি হাইকোর্টে বিচারাধীন। আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে ফ্যাসিস্ট সরকারের সমর্থক শিক্ষক-কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে ও ব্যবস্থা নিতে একজন সিন্ডিকেট সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ সময় সম্প্রতি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জেবুন্নেছা হকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন উপাচার্য। তিনি জানান, জেবুন্নেছা চিকিৎসা সহায়তার আবেদন করলেও তা না পাওয়ার অভিযোগে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
২৭ এপ্রিল রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামের অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নামেন একদল শিক্ষার্থী। তাঁরা রেজিস্ট্রারকে ‘ফ্যাসিস্টদের দোসর’ দাবি করে কুশপুত্তলিকা দাহ করেন ও রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে তালা লাগান। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার (নিরাপত্তা) কে এম সানোয়ার পারভেজ ১০ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১০-১২ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে জিডি করেন। এর আগে ১৬ ফেব্রুয়ারি উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে শিক্ষার্থীরা তাঁর বাসভবনের ফটক ভাঙচুর করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানায়, রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামের চার বছরের চাকরির মেয়াদ শেষ হয় ৩০ জানুয়ারি। এরপর উপাচার্য তাঁকে দায়িত্বে রাখার নির্দেশ দেন এবং পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। এরপর শিক্ষার্থীদের একটি অংশ মনিরুলকে অপসারণের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। গতকাল শনিবার অনুষ্ঠিত ৮৮তম বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় মনিরুল ইসলামকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।