ওমরপুর ইউনিয়নের ভুঁইয়ার হাট এলাকার তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা তানিয়া রোববার জ্বর, রক্তশূন্যতাসহ নানা সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও চিকিৎসকের দেখা পাচ্ছিলেন না। হঠাৎ সবুজ নামে এক ব্যক্তি এসে জানান, পাশেই ফ্যামিলি কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সেখানে চিকিৎসার ভালো ব্যবস্থা আছে। ওই ব্যক্তির কথামতো সেখানে ভর্তি হন। চিকিৎসকের ফি ও পরীক্ষা বাবদ তাঁকে ব্যয় করতে হয়েছিল ২ হাজার টাকা। হাসপাতালের সেবা পেলে অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হতো না বলে জানান তানিয়া।
আবু বক্করপুর ইউনিয়নের প্রসূতি সীমা বেগম চিকিৎসক দেখাতে হাসপাতালে যান। কক্ষ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক দালাল তাঁর ব্যবস্থাপত্র কেড়ে নেন। ভুল ঝুঝিয়ে নিয়ে যান সিটি হার্ট প্রাইভেট হাসপাতালে। সেখানে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে রিপোর্ট আসে বি-পজিটিভ। সন্দেহ হলে একই পরীক্ষা পার্শ্ববর্তী এসটিএস ক্লিনিকে করালে রিপোর্ট আসে ও পজিটিভ। দুই ক্লিনিকের রিপোর্টের ভিন্নতা দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন সীমা।
১০০ শয্যার চরফ্যাসন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে দালাল চক্রের এমন দাপট চোখে পড়ে। তারা বিভিন্ন ওয়ার্ডে অবাধে ঘুরে বেড়ান। রোগী-স্বজনদের কাছে নিজেদের হাসপাতালের কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরে ক্লিনিকে নিয়ে যান। যে চিকিৎসা অল্প টাকায় করা সম্ভব, তিন-চার গুণ ব্যয়ে তা ক্লিনিক থেকে করিয়ে নিতে বাধ্য করেন। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা একাধিকবার অভিযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি।
সরকারি এ হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকা ঘিরে ৩৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ১৪টি বেসরকারী হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। এগুলোর বেশীরভাগেরই অনুমোদন নেই। সরকারি হাসপাতালের ২০০ গজের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক, মালিক ও হাসপাতালে কর্মরত ১১ জন চিকিৎসক যোগসাজশ করে শতাধিক দালাল পুষছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দালালদের সকাল ৮টা থেকে শুরু করে জরুরি বিভাগ ও আন্তর্বিভাগে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। রোগী চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হতেই হাত থেকে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে নেন। ভুল বুঝিয়ে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যান। ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ কমিশন পান। আর দালালরা রোগীপ্রতি ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। রোগীর ধরন অনুয়ায়ী কখনও তা ৫০০০ টাকায় ছাড়িয়ে যায়। ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিক মালিকরা অনেক সময় মাসিক বেতন দিয়েও এসব দালাল পুষে থাকেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডায়াগস্টিক সেন্টারে কর্মরত চিকিৎসকরা জানান, তাদের ছত্রছায়ায় দালাল নেই। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্টাফরা রোগী নিয়ে আসেন। তারা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চিকিৎসক জানান, হাসপাতালের বেশকিছু চিকিৎসক বেসরকারি ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গেও তাদের অলিখিত চুক্তি থাকে। তারা রোগীদের অহেতুক পরীক্ষা দিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক পক্ষ থেকে ৩০-৩৫ ভাগ কমিশন নেন। মিলেমিশে এ বাণিজ্য চলে। এ কারণে বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালেও ব্যবস্থা নেয় না।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে মূল ফটকের বাইরে দোকানে দালালরা বসে আছে। এ ছাড়া ফটকের ভিতরেও তারা ঘোরাফেরা করছে। রোগীরা ঢোকা মাত্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। চত্বরে কথা হয় এমন একজন দালাল সুরমা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, রোজ সকালে রোগী ধরতে বসে থাকেন হাসপাতাল চত্বরসহ সড়কের আশপাশে। রোগী পেলে মোবাইল ফোনে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে জানিয়ে দেন। যেখানে বেশি কমিশন দেয়, সেখানেই রোগী নিয়ে যান। এভাবে রোজ ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় হয়। এতেই চলে তাঁর সংসার।
দালাল সীমা বেগম বলেন, আগে সড়কে রোগীদের একেক সময় একেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যেতাম। এখন পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মাসে ৭ হাজার টাকা বেতনে কাজ করছি। সকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত হাসপাতাল চত্বরে ঘোরাঘুরি করি। রোগী পেলেই পপুলারে নিয়ে যাই। মাঝেমধ্যে বেতনের পাশাপাশি চিকিৎসকরা বকশিশ দেন।
বিষয়টি নিয়ে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক মো.
দালালের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করলেও চিকিৎসকদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন হাসপাতালের টিএইচও ডা. শোভন বসাক। তিনি বলেন, হাসপাতাল চত্বর থেকে দালাল নির্মূলের চেষ্টা চলছে।
ভোলা জেলা ডায়াগস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সভাপতি জামাল উদ্দিন লিটন জানান, অনেক আগে থেকেই ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো দালালনির্ভর হয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে। এসব বন্ধ করতে সময় লাগবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ব স থ য কমপ ল ক স ড য় গনস ট ক স ন ট র র ব যবস থ চ ক ৎসক পর ক ষ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
চবির বিশেষ ভোজের টোকেনে অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা ‘অতিথি’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) বিভিন্ন আবাসিক হলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা ও বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। এতে আবাসিকদের শিক্ষার্থী বলা হচ্ছে এবং অনাবাসিকদের অতিথি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া, আবাসিকদের জন্য টাকার পরিমাণ কম ধরলেও অনাবাসিকদের জন্য বেশি ধরা হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থীরা।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ ফরহাদ হোসেন হলে উন্নত ভোজের টোকেন আবাসিকদের জন্য ১০০ টাকা ধরা হয়েছে। অপরদিকে, অতিথিদের জন্য ধরা হয়েছে ১৭০ টাকা; এই অতিথিরা হলেন হলের অনাবাসিক শিক্ষার্থী। শামসুন নাহার হলে আবাসিকদের জন্য ৮০ টাকা, অনাবাসিকদের জন্য ১৭০ টাকা। মিল পদ্ধতি চালু থাকা আমানত হলে আবাসিকদের জন্য ফ্রি হলেও অনাবাসিকদের জন্য ৭০ টাকা। তবে সোহরাওয়ার্দী হলে আবাসিক-অনাবাসিক সবার জন্যই ১৫৫ টাকা ধরা হয়েছে।
আরো পড়ুন:
এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিল শাবিপ্রবি প্রশাসন
চবিতে বিপ্লবী ছাত্র ঐক্যের আত্মপ্রকাশ
এদিকে, বিজয়-২৪ হলের প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে আবাসিক-অনাবাসিক সবার জন্য ৮০ টাকা উল্লেখ করলেও দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তিতে অনাবাসিকদের জন্য ১৭০ টাকা ধরা হয়েছে। এভাবে অন্যান্য হলগুলোতেও একই অবস্থার কথা জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী জারিফ মাহমুদ বলেন, “৫ আগস্টের ফিস্ট নিয়ে হলে হলে বিশেষ খাবারের আয়োজন করছে, সেখানে আবাসিক-অনাবাসিক আলাদা করেছে। আমার প্রশ্ন হলো, প্রশাসনদের ছাত্র বা সন্তান কি শুধু আবাসিকরা? আমরা যারা অনাবাসিক, তারা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে উড়ে এসেছি?”
তিনি প্রশাসনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আপনারা আমাদের হলে সিট দিতে পারেননি, এটা আপনাদের ব্যর্থতা। এই আবাসিক-অনাবাসিক পরিচয় বন্ধ করুন। আয়োজন করলে সবার জন্য সমান করে আয়োজন করুন। আর সেটা না পারলে আয়োজন বন্ধ করুন।”
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী নাঈম শাহ ফেসবুকে লেখেন, “কোনো একটা বিশেষ দিন এলেই দেখা যায়, হল প্রশাসনগুলোর আবাসিক শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে দাঁড় করানোর ভণ্ডামি। ৫ তারিখে আয়োজনকে ঘিরে তারা আবার সেই অতিথি টার্ম সামনে নিয়ে আসছে। ফরহাদ হলে অনুষ্ঠান শেষে বিশেষ ভোজের আয়োজনের টোকেন আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ টাকা এবং অতিথিদের জন্য ১৭০ টাকা। বাকি হলগুলোতে বোধহয় তাই করেছে। কিন্তু এই অতিথিগুলোও তো বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী।”
তিনি বলেন, “বাহির থেকে যে কয়েকজন শিক্ষার্থী আসবে, তাদের থেকে ৭০ টাকা করে বেশি না নিলে তো হল প্রশাসন দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে না। আর আপনাদের যদি সামর্থ্য নাই থাকে, কাউকেই খাওয়ায়েন না। কিন্তু ৫ আগস্টের দিনকে কেন্দ্র করে করা অনুষ্ঠানে প্রিভিলেজড-আনপ্রিভিলেজড বিষয়টা জিইয়ে রাখাটা নিতান্ত নোংরামি লাগছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এটা নিয়ে ভাবা উচিত।”
এ বিষয়ে শহিদ মো. ফরহাদ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মান্নান বলেন, “এ সিদ্ধান্তটি শুধু ফরহাদ হলের জন্য নয়, অন্যান্য হলেও এ সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। মূলত উন্নত ভোজের আয়োজনটি আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য করা হয়েছে। তারপরেও কোনো অনাবাসিক শিক্ষার্থী বা কারো বন্ধুবান্ধব অংশ নিতে চাইলে পারবে। সেক্ষেত্রে তাদের জন্য টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে সব হল প্রাধ্যক্ষের উপস্থিতিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ঢাকা/মিজান/মেহেদী