দেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে দেশের ১৩টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পাঠক্রমে আন্তর্জাতিক শ্রম মান যুক্ত করতে যাচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়।

এ লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার (৮ মে) আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে।

সমঝোতা স্মারকটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ, অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইউনিভার্সিটি, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম এবং প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির প্রতিনিধিদের মধ্যে স্বাক্ষর হয়।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেন, “আজকের দিনটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। কারণ আইএলও এবং ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শ্রম আইন পাঠ্যক্রমের সাথে আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ড একীভূত করার জন্য শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একত্র হয়েছে।”

সচিব আশা প্রকাশ করেন, “শ্রম বিচার বিভাগ এবং পরিদর্শকদের জন্য অনুরূপ সক্ষমতা বৃদ্ধির সূচনা করার জন্য এটি একটি ভালো ভিত্তি হবে।”

শিল্প এলাকায় ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য আমাদের ট্রেড ইউনিয়ন, সরকার এবং শিল্পকে একাডেমিয়ার সাথে সংযুক্ত করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, এই উদ্যোগটি কেবল বাংলাদেশে শ্রম আইনের পাঠ্যক্রমকে এগিয়ে নেবে না বরং সামাজিকভাবে সচেতন শ্রম আইনজীবীদের একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য প্রভাষকদের সক্ষম করবে-যারা শ্রম বাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং বাংলাদেশের শ্রমিকদের মুখোমুখি বাস্তবতার সাথে গভীরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এই উদ্যোগের প্রভাব সর্ম্পকে জানাতে গিয়ে বাংলাদেশে আইএলও'র কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পোটিআইনেন বলেন, “উদ্যোগটি আইএলওর প্রতিশ্রুতির একটি অংশ। বাংলাদেশের আরো বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এই উদ্যোগে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং আমরা শীঘ্রই দ্বিতীয় দলগত চুক্তি স্বাক্ষরের প্রত্যাশা করছি।”

উদ্যোগটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ডেনমার্ক, সুইডেন এবং নেদারল্যান্ডসের অর্থায়নে টিম ইউরোপ ইনিশিয়েটিভ (টিইআই) অন ডিসেন্ট ওয়ার্ক ইন বাংলাদেশ (এডিডব্লিউআইবি) প্রকল্পের একটি অংশ। এই প্রকল্পের একটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো বাংলাদেশের শ্রম আইনগুলোকে আইএলএস-এর সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং এসব আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

টিইআই এর প্রতিনিধিত্ব করা ঢাকায় নিযুক্ত নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের ডেপুটি হেড অফ মিশন থিজ উডস্ট্রা বলেন, “আইএলএস মানবাধিকার এবং মানবিক মর্যাদার একটি অংশ। এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে শিক্ষকরা নতুন প্রজন্মকে আরো সামাজিকভাবে সচেতন ভবিষ্যৎ তৈরি করতে সক্ষম হবেন।

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আজ পরিবর্তনের বীজ রোপণ করা হচ্ছে। আমাদের এটি লালন-পালন করতে হবে, যাতে এই বীজগুলো একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজের বটবৃক্ষে পরিণত হতে পারে। শিক্ষকরা একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করবেন যাতে তারা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারে এবং শ্রমিক ও সম্প্রদায়ের সেবা করে তাদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করতে পারে।”

ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড.

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন প্রান্তিক শ্রমিকদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে আইন ও সমাজের মধ্যে ব্যবধান কমানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

তিনি বলেন, “শ্রমকে পণ্য হিসেবে দেখা উচিত নয়, বরং একটি মানবাধিকার হিসেবে দেখা উচিত-এই ধারণাটি আইএলও সমর্থন করে। এটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানগুলেতে প্রতিফলিত হওয়া উচিত।”

রিকশাচালক এবং দিনমজুরের মতো অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আইএলও-এর ছায়ানিচ থাম্পারিপাত্র আইএলএস-এর ওপর একটি তথ্যবহুল উপস্থাপনা তুলে ধরেন। এর লক্ষ্য ছিল-প্যানেল শ্রম আইন শেখানোর বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশে ভবিষ্যতের আইনি শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা বিনিময় করে আইএলএসকে একীভূত করে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার সাথে পরিচিত করা। প্যানেলিস্টরা মতামত দেন যে আইনি শিক্ষা বাস্তব জগতের সাথে প্রাসঙ্গিক এবং প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তারা আন্তর্জাতিক শ্রম মান এবং শ্রম অধিকার বোঝে এমন আইনজীবীদের নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য ভূমিকা রাখার প্রত্যাশ্যা ব্যক্ত করেন।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন আইএলও এর এলেনা গেরাসিমোভা, এআইইউবির উপদেষ্টা ড. তাসলিমা মনসুর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন ড. মুহাম্মদ একরামুল হক।

স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর, আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ড সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনুষদ সদস্যদের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ডের ওপর একটি আকর্ষণীয় পরিচিতিমূলক অধিবেশনের আয়োজন করা হয়।

ঢাকা/হাসান/সাইফ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর অন ষ ঠ ন ইন ট র র জন য র একট

এছাড়াও পড়ুন:

তরুণদের ক্ষমতায়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

সিলেটের খাসিয়া সম্প্রদায়ের ২০ বছর বয়সী মিং সাং নতুন জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পান, যখন তিনি ট্যুর গাইড প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেন। আজ তাঁর গ্রামে তিনি হোম–স্টে পর্যটনকে সক্রিয়ভাবে প্রচার করছেন, অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছেন, গর্বের সঙ্গে খাসিয়া জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরছেন এবং একই সঙ্গে উপার্জনও করছেন।

২৭ বছর বয়সী আইনুল হক জুবেল শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ও আর্থিক সংকটের কারণে একসময় জীবনকে অচল মনে করতেন। নিজেকে বোঝা মনে হতো—যতক্ষণ না একটি স্বল্পমেয়াদি গ্রাফিক ডিজাইন প্রশিক্ষণ তাঁর জন্য নতুন দ্বার উন্মুক্ত করে।

আজ জুবেল সচেতনতামূলক প্রচারে নিজের জীবনের গল্প শোনাচ্ছেন, বিশেষ করে প্রতিবন্ধী তরুণদের অভিভাবকদের সঙ্গে। তাঁর বার্তা সহজ, কিন্তু শক্তিশালী—‘হাল ছেড়ো না, দক্ষতা জীবন বদলে দিতে পারে’।

আজ ১২ আগস্ট, বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক যুব দিবস ২০২৫—তরুণদের শক্তি, সম্ভাবনা ও প্রতিশ্রুতি উদ্‌যাপনের দিন। এ বছর দিবসটির গুরুত্ব আরও বেড়েছে, কারণ, আমরা উদ্‌যাপন করছি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এর দশম বার্ষিকী—একটি ন্যায্য, সমৃদ্ধ ও পরিবেশ সংরক্ষণকারী বিশ্ব তৈরির প্রচেষ্টায়।

তবে এই স্বপ্ন তখনই বাস্তবায়িত হবে, যদি তরুণদের জাতীয় উন্নয়ন প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা যায়।

গত এক দশকে, বাংলাদেশি তরুণেরা বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসংকট, জলবায়ু বিপর্যয় ও ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে টিকে থাকার অসীম সম্ভাবনা দেখিয়েছে। তাঁদের সৃজনশীলতা ও দৃঢ়তা আমাদের আশা জোগায়। কিন্তু কেবল আশা যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে থাকতে হবে বিনিয়োগ, নীতিগত প্রতিশ্রুতি ও সহায়ক পরিবেশের সৃষ্টি। কারণ, তরুণেরা সমৃদ্ধ হলে সমৃদ্ধ হয় পুরো জাতি।

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের বয়স ১৫ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। উদ্বেগের বিষয়, তাঁদের মধ্যে ৩০ দশমিক ৯% তরুণ শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণের বাইরে (সূত্র: এনইইটি) এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের ১২% বেকার (সূত্র: বিবিএস)। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন, যাঁদের অনেকেই উচ্চ বেকারত্ব, মানসম্মত দক্ষতা প্রশিক্ষণের সীমিত সুযোগ, শিক্ষা ও শিল্প খাতের মধ্যে অসামঞ্জস্য এবং শোভন কাজের অভাবের মতো স্থায়ী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বিশ্বের শ্রমবিষয়ক জাতিসংঘ সংস্থা হিসেবে তরুণদের এসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রমে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অংশীদারত্বে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডা সরকারের অর্থায়নে, আইএলও তরুণদের জন্য দক্ষতা, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং পরিসর দিয়ে সহায়তা করছে, যা তাঁদের ক্রমবর্ধমান কর্মজগতে সাফল্যের পথে এগিয়ে নেবে।

আমাদের কাজ শুধু শ্রেণিকক্ষের প্রশিক্ষণে সীমাবদ্ধ নয়। আইএলও বাস্তবায়িত কর্মসূচিগুলো চাহিদাভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভবিষ্যৎমুখী দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করে, প্রযুক্তিগত দক্ষতা থেকে শুরু করে এর বিস্তার ডিজিটাল জ্ঞান, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, শিল্প খাতের সঙ্গে পরিচিতি এবং জীবনব্যাপী দক্ষতা উন্নয়ন পর্যন্ত। দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনীতিতে তরুণদের অভিযোজন, উদ্ভাবন ও নেতৃত্বের জন্য এগুলো অপরিহার্য।

তবে তরুণেরা কেবল সুবিধাভোগী নন, তাঁরা নিজেরাই পরিবর্তনসাধক, উদ্ভাবক ও নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এ জন্য আমরা তাঁদের নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়নে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করি, যেমন যুব পরামর্শ, স্কিলস ফেয়ার, ক্যাম্পেইন ও উদ্ভাবনী ল্যাবের মাধ্যমে। আমরা তাঁদের নেতৃত্বকে উৎসাহিত করি, উদ্যোক্তা হিসেবে ও সচেতন কর্মী হিসেবে যাঁরা নিজেদের অধিকার বোঝে ও রক্ষা করে।

বিশেষ করে তরুণ নারীদের জন্য শিক্ষা থেকে কর্মসংস্থানে যাত্রার পথটি মসৃণ হওয়া যেমন জরুরি, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকা। আইএলও মানসম্পন্ন শিক্ষানবিশ ও শিল্প-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অংশীদারত্বকে উৎসাহিত করে, যা তত্ত্ব ও তার বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে ব্যবধান কমায়। এসব সহযোগিতা তরুণদের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করে এবং আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদার সঙ্গে কর্মজগতে প্রবেশের প্রস্তুতি দেয়।

তবু বিপুলসংখ্যক তরুণ অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে কাজ করেন, যেখানে কাজ অনিরাপদ, কম বেতনের এবং শ্রম সুরক্ষার বাইরে। এসব কাজকে আনুষ্ঠানিক করা এবং সামাজিক সুরক্ষা প্রসারিত করা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সংগত ও টেকসই অর্থনীতি গঠনের জন্য অপরিহার্য। তরুণদের জন্য শোভন কাজ কেবল অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা নয়, এটি সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়।

গত এক দশকে, বাংলাদেশি তরুণেরা বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসংকট, জলবায়ু বিপর্যয় ও ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে টিকে থাকার অসীম সম্ভাবনা দেখিয়েছে। তাঁদের সৃজনশীলতা ও দৃঢ়তা আমাদের আশা জোগায়। কিন্তু কেবল আশা যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে থাকতে হবে বিনিয়োগ, নীতিগত প্রতিশ্রুতি ও সহায়ক পরিবেশের সৃষ্টি। কারণ, তরুণেরা সমৃদ্ধ হলে সমৃদ্ধ হয় পুরো জাতি।

ফারহানা আলম, যোগাযোগ কর্মকর্তা, স্কিলস প্রোগ্রাম, আইএলও বাংলাদেশ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তরুণদের ক্ষমতায়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে