নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের পর কতিপয় ধর্মপন্থি রাজনৈতিক দল সমস্বরে তা বাতিলের দাবি করেছে। জুলাই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল বৈষম্যের বিরোধিতা। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের নারীদের পুরুষ সহযোদ্ধারাই ওই ধর্মপন্থিদের সভায় গিয়ে সমঅধিকারের বিরুদ্ধে সংহতি প্রকাশ করেছেন। অথচ ৫ আগস্টের আগে ওই নেতারাই রাষ্ট্রের সেক্যুলার চরিত্র বহাল থাকবে বলে জানিয়েছিলেন। 

ইসলামবিষয়ক পণ্ডিত আফ্রো-আমেরিকান মুসলিম নারীবাদী আমিনা ওয়াদুদ,  ইরানি জিবা মির-হোসেইনি, পাকিস্তানি আসমা বারলাস, কুয়েতি খালেদ আবু এল-ফাদল, পাকিস্তানি ফজলুর রহমান মনে করেন, কোরআন কস্মিনকালেও নারীবিরোধী নয়; বরং পিতৃতান্ত্রিক ব্যাখ্যায় কোরআনের আসল বার্তা বিকৃত হয়েছে। 

মুসলিম নারীবাদীরা কোরআনের সমতাবাদী ভাষ্য প্রদান করেন। তারা কোরআনের আয়াতের ভাষা, সামাজিক প্রেক্ষাপট ও নৈতিক দিক বিবেচনায় নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যাকে (তাফসির) চ্যালেঞ্জ করে নিজেরাই হয়ে ওঠেন কোরআনের ব্যাখ্যাকারী। তারা কোরআনের কাঠামোর মধ্যে থেকেই কোরআনের প্রাসঙ্গিক পাঠ (কনটেক্সচুয়াল রিডিং) এবং আয়াতকে ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনার কথা বলেন। সপ্তম শতকে উত্তরাধিকারের আয়াতগুলো যখন নাজিল হয়েছিল তখন আরব সমাজে নারীরা সাধারণত উপার্জন করত না বা সম্পত্তির মালিক হতো না। আমিনা ওয়াদুদ বলেন, কোরআনের মধ্যেই সমতাবাদী ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। কোরআনিক টেক্সটের পুনর্পাঠে নারী সমতার দিকটি পাওয়া সম্ভব। তিনি কোরআনকে লিঙ্গ-সমতার দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠের একটি পদ্ধতি তুলে ধরেন। ফজলুর রহমান মনে করেন, কোরআনকে দুই সময়ে পার্থক্যের নিরিখে পাঠ করতে হবে (ডাবল মুভমেন্ট থিওরি)। তাঁর মতে, কোরআনের আইনি বিধানগুলো একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান সময়ে পিতৃতান্ত্রিক ভাষ্যের পুনর্ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

সুরা আন-নিসার (৪:৩৪) এই আয়াত নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। প্রচলিতভাবে এ আয়াত পুরুষের কর্তৃত্ব ও নারীর অধস্তনতার দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ‘পুরুষরা নারীদের ওপর কাওয়ামুন এই কারণে যে, আল্লাহ একের ওপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন যেহেতু তারা (পুরুষরা) তাদের (নারীদের) জন্য অর্থ ব্যয় করে।’ আমিনা ওয়াদুদ ‘কাওয়ামুন’ শব্দের বিশ্লেষণ করে বলেন, ‘কাওয়ামুন’ শব্দটি ‘কর্তা, অভিভাবক’, ‘অধিকর্তা’, ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’, অধিপতি নানাভাবে অনুবাদ করা হয় (আমিনা ওয়াদুদ: কোরআন অ্যান্ড উইমেন)। তিনি বলেন, ‘কাওয়ামুন’ শব্দের মূল অর্থ হলো আর্থিক দায়িত্ব পালনকারী। এটি কোনো উচ্চতর মর্যাদা বা কর্তৃত্ব নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক দায়িত্ব বোঝায়। সে সময়ে সাধারণভাবে আরব সমাজে নারীরা উপার্জন করত না। পুরুষরাই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। এই আয়াত সেই প্রেক্ষাপটে পুরুষদের আর্থিক দায়িত্ব তুলে ধরেছে, কিন্তু একে অপরের ওপর চিরন্তন কর্তৃত্বের কথা বলেনি। তাই যেসব ব্যাখ্যা পুরুষ আধিপত্য বা নারী নিপীড়নকে বৈধতা দেয়, তা কোরআনের মূল নৈতিক বোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই আয়াতের লক্ষ্য পরিবারের স্থিতি ও নিরাপত্তা; পুরুষ কর্তৃত্ব নয়। দুই-এক অনুপাতে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বিধানটি ছিল সেই সময়ে নারীদের সুরক্ষার জন্য একটি সামাজিক নীতি মাত্র। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি নারী বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করেন। তাই নারী ঘরে বসে পুরুষের উপার্জন খায়– এই ধারণা বাসি হয়ে গেছে।  
জিবা মির-হোসেইনি ইরানি আইন ও নৃতত্ত্ববিদ। তাঁর মূল যুক্তি– শরিয়া আর ফিকহ এক নয়। ফিকহ হলো মুসলিম আইন, যা কোরআন সম্পর্কে মানুষের ব্যাখ্যা থেকে তৈরি। এটি আল্লাহর ইচ্ছা নয়, বরং মানুষের যুক্তির ফল। কোরআনের নারীর সমানাধিকারবিরোধী ব্যাখ্যা উলামাদের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা থেকে তৈরি। মির-হোসেইনি বলেন, শরিয়া ঈশ্বর প্রদত্ত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শ– ন্যায়, সমতা ও মানব মর্যাদার ভিত্তিতে গঠিত। ফিকহ মানুষের তৈরি শরিয়ার ব্যাখ্যা– ইতিহাস ও সমাজ প্রেক্ষাপটে পুরুষ পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা ভুল হতে পারে, তাই পরিবর্তনযোগ্য। প্রচলিত ইসলামী আইন পুরুষদের ২:১ অনুপাতে উত্তরাধিকার দেয় (সুরা আন-নিসা: ৪:১১)। মির-হোসেইনি বলেন, এই নিয়ম ঐতিহাসিকভাবে উপযুক্ত ছিল। কারণ সে সময় পুরুষরাই উপার্জন করত। এখন নারীরাও উপার্জন করে। তাই সমান উত্তরাধিকারই এখন ইসলামের ন্যায়নীতির সঙ্গে মানানসই। তাঁর মতে, ইসলামের কেন্দ্রে আছে সমতা ও ন্যায়বিচার; পুরুষের প্রাধান্য নয়। তিনি আক্ষরিক অনুসরণ নয়; বরং ধর্মের অন্তর্নিহিত ন্যায়বোধ উপলব্ধির কথা বলেন। একইভাবে আসমা বারলাস বলেন, কোরআন নারীদের জন্য ন্যায় ও মর্যাদা প্রদানকারী ধর্মগ্রন্থ। তবে এর পিতৃতান্ত্রিক ব্যাখ্যায় কোরআনের মূল বার্তাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।  

কোরআনের অনেক আয়াতে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হয়েছে। যেমন– পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ; নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ (৪:৩২)। আমি তোমাদের মধ্যে কোনো কর্মনিষ্ঠ নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না, তোমরা পরস্পর সমান (৩:১৯৫) (তারিফ খালিদি, দ্য কোরআন, ‘দি ওয়ান ইজ লাইক দি আদার’)। এই আয়াতগুলোয় বৈষম্যের কথা বলা হয়নি, বরং নারী-পুরুষের সমতাকেই তুলে ধরা হয়েছে।  

এখন প্রশ্ন হলো, ধর্মপন্থিরা কি জনসংখ্যার অর্ধেক সংখ্যক নারীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, নাকি সমতার দৃষ্টি নিয়ে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গড়বেন? জুলাই আন্দোলনের বৈষম্যবিরোধী চেতনা কি তারা বিসর্জন দেবেন? ইসলামী আইনে সম্পূরক নীতি হিসেবে ইজতেহাদের কথা বলা আছে। ইজতেহাদ হলো যুক্তি-বুদ্ধির আলোকে পরির্তনশীল সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে ধর্মীয় সমাধান। পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার প্রয়োজনে আমরা ইজতেহাদ অনুসরণ করতে পারি।

ড.

আখতার সোবহান মাসরুর: লেখক ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম ছাত্রনেতা
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ম র হ স ইন কর ত ত ব ক রআন র সমত র ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

ইসরায়েলের হাইফা বন্দরে হুতিদের হামলা

ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। হাইফা বন্দর, নেগেভ, উম্ম আল-রশরাশ ও বিরসেবায় এ হামলা চালানো হয়েছে।

হুতির সামরিক মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারি বলেছেন, ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস কর্মকান্ডের জবাবে এ হামলা চালানো হয়েছে। হামলায় ছয়টি ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে। ড্রোনগুলো সফলভাবে লক্ষবস্তুতে আঘাত হেনেছে।

গাজায় ইসরায়েলের হামলা বন্ধ না করলে এবং অবরোধ তুলে না নেওয়া পর্যন্ত এ ধরনের হামলা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে হুতি।

তবে হামলার বিষয়ে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় গাজায় অন্তত ৮৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩১ জন ছিলেন ত্রাণপ্রত্যাশী। এ সময় ৫১৩ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, অনাহারের কারণে গাজায় আরও পাঁচ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে দুটি শিশু রয়েছে। এ নিয়ে উপত্যকাটিতে অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা ২২৭–এ পৌঁছাল, যাদের মধ্যে ১০৩টি শিশু।

সম্পর্কিত নিবন্ধ