নাসর মানে সাহায্য। সুরা নাসর পবিত্র কোরআনের ১১০তম সুরা। রাসুল (সা.)-এর বিদায় হজের সময় সুরাটি অবতীর্ণ হয়। আল্লাহর সহায়তায় ইসলামের পরিপূর্ণ জয়ে পৌত্তলিকেরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আল্লাহর প্রশংসাকীর্তন ও তাঁর ক্ষমা ভিক্ষা করা উচিত। এই সুরা নাজিল হওয়ার কিছুদিন পরেই রাসুল (সা.) ইন্তেকাল করেন।
সুরা নাসরের অর্থ আবার দেখে নিই:
পরম করুণাময় পরম দয়াময় আল্লাহর নামে। ১.
সুরা নাসরের সারকথা:
সুরা নাসর ৩ আয়াতের একটি ছোট্ট সুরা। প্রথম অংশে বিজয়ের জন্য যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিজয়, দ্বিতীয় অংশে বিজয়ের ফলাফল এবং তৃতীয় অংশে বিজয় এবং বিজয়ের ফল লাভ করার পর করণীয় বিষয়ে বলা হয়েছে।
মুহাম্মদ (সা.) তাঁর উম্মতদের নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। তিনি ভাবতেন, তাঁর দাওয়াত কি কাজে আসছে? মানুষ ইসলামে প্রবেশ করবে তো? প্রথম আয়াতে ‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়’ বলে মূলত ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে ইসলামের বিজয় আসন্ন। এমন অনেক ভবিষ্যদ্বাণী আছে সুরা আর রুম, সুরা লাহাবে।
আরও পড়ুনসুরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের বিশেষ ফজিলত০৭ মার্চ ২০২৫এ ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত যে এখানে বিজয় বলে মক্কা বিজয় বোঝানো হয়েছে। আর বিজয় মানে কোনো একটি সাধারণ যুদ্ধে বিজয় নয়, বরং এর মানে হচ্ছে এমন একটি চূড়ান্ত বিজয়, যার পরে ইসলামের সঙ্গে সংঘর্ষ করার মতো আর কোনো শক্তির অস্তিত্ব হিজাজ অঞ্চলে থাকবে না এবং এ কথাও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে বর্তমানে আরবে এ ধর্মই প্রাধান্য বিস্তার করবে।
হিজরতের পূর্বে মক্কায় নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ইসলাম গ্রহণের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে একজন–দুজন করে ইসলাম গ্রহণ করার যুগ শেষ হয়ে যাবে। তখন এমন এক যুগের সূচনা হবে, যখন একটি গোত্রের সবাই এবং একেকটি বড় এলাকার সব অধিবাসী কোনো প্রকার যুদ্ধ-বিগ্রহ ও চাপ প্রয়োগ ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুসলিম হয়ে যেতে থাকবে। মক্কা বিজয়ের পূর্বে এমন লোকের সংখ্যাও প্রচুর ছিল, যারা ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাসের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু কুরাইশদের ভয়ে অথবা অন্য কোনো কারণে তারা ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত ছিল।
মক্কা বিজয় তাদের সেই বাধা দূর করে দেয়। একটি অনুকূল পরিবেশ পেয়ে সে সময়ে দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে; যা দ্বিতীয় আয়াতের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতিফলন। ফলে সমগ্র আরবে ইসলাম বিজয়ী জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। (সহিহ বুখারি, আয়াত: ৪,৩০২)
একাধিক হাদিসে আছে, এ সুরায় রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকাল নিকটবর্তী হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত আছে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এটা তো রাসুলের মৃত্যুর সময়, যা তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এসে যাবে’, আর এটাই হবে আপনার জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার আলামত, ‘সুতরাং আপনি আপনার রবের সপ্রশংস তাসবিহ পাঠ করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চান; কেননা তিনিই তো তাওবা কবুলকারী।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪,৯৭০)
আরও পড়ুনআল্লাহর কাছে যে দোয়া করেছিলেন নবী সোলায়মান (আ.) ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫সুতরাং সুরার অর্থ হচ্ছে, আপনার দুনিয়াতে অবস্থান করার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে, ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালিত হয়েছে। অতএব, আপনি তাসবিহ ও ক্ষমা প্রার্থনায় মনোনিবেশ করুন। (ইবনুল কায়্যিম, ইলামুল মুয়াক্কিয়িন, ১/৪৩৬)
আয়েশা (রা.) বলেন, এই সুরা অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসুল (সা.) প্রতি নামাজের পর বলতেন, ‘সুবহানাকা আল্লাহুম্মা রব্বানা ওয়া-বিহামদিকা আল্লাহুম্মা-গ্ফিরলি (হে আল্লাহ, আপনি পবিত্র, হে আমাদের প্রতিপালক, আপনার প্রশংসাসহ আপনি পবিত্র। হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করুন)। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৯৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪৮৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৮৭৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৮৮৯)
আরও পড়ুনবিপদে হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল পাঠের মাহাত্ম্য০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম গ রহণ ইসল ম র ব জয় র আল ল হ আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
বরেণ্য সংগীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী মারা গেছেন
বরেণ্য সংগীতশিল্পী, গবেষক, লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭।
শনিবার সকাল সাতটায় বনানীর একটি হাসপাতালে তিনি মারা গেছেন। তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন তার কন্যা শারমিন আব্বাসী।
বেশ কিছুদিন ধরে বাধ্যর্কজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী। সর্বশেষ গতকাল শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী উপমহাদেশের এক প্রখ্যাত সংগীত পরিবারের সন্তান। পিতা আব্বাস উদ্দীন আহমেদ পল্লীগীতির কিংবদন্তী শিল্পী। এদেশের পল্লীসংগীতকে তিনিই প্রথম বিশ্বের দেশে দেশে জনপ্রিয় করেছেন। চাচা আব্দুল করিম ছিলেন পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি গানের জনপ্রিয় শিল্পী। বড় ভাই বিচারপতি মোস্তফা কামাল আইনবিশারদ। মোস্তফা কামালের কন্যা নাশিদ কামালও একজন বরেণ্য শিল্পী। বোন ফেরদৌসী রহমান দেশের প্রথিতযশা বহুমাত্রিক প্রতিভার সংগীতজ্ঞ হিসেবে সমাদৃত।
মোস্তফা জামান আব্বাসী ভারতের কোচবিহার জেলার বলরামপুর গ্রামে ৮ ডিসেম্বর ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব ও কৈশোর কাল কলকাতায় কাটে। এই পরিবারটির সাথে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। মুস্তাফা জামানের শিক্ষাজীবন কলকাতায় শুরু হয়। তিনি ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স এবং ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে এমএ পাস করেন। তিনি সঙ্গীতসাধনা ও সাহিত্যচর্চায় নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। সঙ্গীত বিষয়ক গবেষণাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি বেতার ও টেলিভিশনে সঙ্গীতবিষয়ক অনেক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। পত্র-পত্রিকাতে তিনি একজন সুখপাঠ্য কলাম লেখক হিসেবেও সুপরিচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স ও এমএ, হার্ভার্ড গ্রুপ থেকে মার্কেটিং অধ্যয়ন, দীর্ঘদিন শিল্পগোষ্ঠীর মহাব্যবস্থাপক ছিলেন, ছিলেন ব্যবসা সফল ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন তিনি। পঁচিশটি দেশে ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, ভাওয়াইয়া, চটকা, নজরুলগীতি পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব ও সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ইউনেস্কোর ছত্রছায়ায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিটি অব মিউজিকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এগারো বছর, একাধিকবার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন সঙ্গীতজ্ঞদের বিশ্ব অধিবেশনে।
দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ফোক মিউজিক রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক ও সংগ্রাহক হিসেবে কয়েক হাজার গান তার সংগ্রহে ছিল। বাংলা লোকসঙ্গীতের মূল্যবান লালনের গান, ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, ভাওয়াইয়া, চটকা ছিল তার সংগ্রহে। সম্পাদিত ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি’ ও স্বাধীনতা দিনের গান’ উল্লেখযোগ্য সংকলন গ্রন্থ। ‘জার্নাল অব ফোক মিউজিকের’র সম্পাদক ছিলেন তিনি। ‘লোকসংগীতের ইতিহাস’, ‘ভাওয়াইয়ার জন্মভূমি’, (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), ‘ভাটির দ্যাশের ভাটিয়ালি’ প্রথম খণ্ডে সর্বমোট ছ’শত গান স্বরলিপি ও বিবক্ষণসহ প্রকাশিত, দেশে বিদেশে প্রশংসিত।
কবি, লেখক ও গবেষক মুস্তফা জামান আব্বাসীর ২১টি গ্রন্থ পাঠকনন্দিত। জীবনকালে তিনি নানা পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, লালন পুরস্কার, নজরুল একাডেমি পুরস্কার, আব্বাসউদ্দিন গোল্ড মেডেল, এ্যাপেক্স ফাউন্ডেশন পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব লেখক পুরস্কার, সিলেট মিউজিক পুরস্কার, মানিক মিয়া পুরস্কার, নাট্যসভা উপস্থাপক পুরস্কার, বাংলা সন চৌদ্দশতবার্ষিকী পুরস্কার ইত্যাদি। এশিয়া মিডিয়া সামিট, আন্তর্জাতিক রুমি কর্মকাণ্ড, আন্তর্জাতিক সুফি সম্মেলন, লোকসংস্কৃতি সেমিনার, রেডিও টেলিভিশনে বক্তব্য ও গানের জলসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি।