শাসানো পুরুষতন্ত্র ফ্যাসিবাদেরই অংশ
Published: 11th, May 2025 GMT
নারীর অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নটি আবারও রাজনীতির আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। গত সপ্তাহে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ থেকে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্যদের অশালীন ভাষায় গালাগাল করা হয়েছে। নতুন দল এনসিপির কয়েকজন নেতাও সেই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। তারা তো প্রতিবাদ করেনইনি, উল্টো হেফাজতের সঙ্গে বেসুরা হলেও গান গেয়েছেন।
গত ৩ মে শনিবার সামাজিক মাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হওয়া ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে রশি দিয়ে ফাঁসির মতো ঝুলানো নারী প্রতিকৃতিতে কয়েকজন জুতাপেটা করছেন। এক পর্যায়ে প্রতিকৃতিতে পেঁচানো শাড়ি খুলে যায়। পরে দু’জন এসে শাড়িটি পরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, নীল রঙের কাতান শাড়ি পরানো কুশপুত্তলিকাটি দু’দিন ধরেই টিএসসিতে ঝুলানো ছিল। কোনো একটি সংগঠন সেটি ঝুলিয়েছে। তারা জানতে পেরেছেন, এটি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কুশপুত্তলিকা। এখন প্রশ্ন হলো, সেটা তারা সরালেন না কেন? কয়েক মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য থেকেই তো এসব রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাল্টানোর তাগাদায় গণঅভ্যুথানের সূচনা হয়েছিল; তাহলে কর্তৃপক্ষ নিজেই কি সেটি অন্য পক্ষের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে চায়?
প্রশ্ন আরও আছে। শেখ হাসিনার বিচারের দাবির সঙ্গে তাঁর কুশপুত্তলিকায় পেটানোর সম্পর্ক কী? যারা যুক্তি দিচ্ছেন, নিপীড়কের লিঙ্গ নেই। শেখ হাসিনা নারী বলেই তাঁকে রেহাই দেওয়া হবে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ থেকে? আমার কাছে অন্তত বিষয়টি সে রকম নয়। বরং আমার কাছে মনে হয়, শেখ হাসিনার নারীর অবয়ব চোখের সামনে আছে বলেই এই যুক্তি দিচ্ছেন। তা না হলে একটি পুতুলকে ‘কাপড় খুলে’ প্রহারের কারণ কী? কুশপুত্তলিকাতে কারও নাম লেখা ছিল না এবং পরবর্তী সময়ে এ ধরনের অশালীনতাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনার নামে।
এদিকে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে নারী সংস্কার কমিশনের সদস্যদের গালাগালে সমালোচনা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির তিন নেত্রীসহ ছয়জনের পক্ষ থেকে আইনি নোটিশ পাঠানোর পর দুঃখ প্রকাশ করেছে হেফাজতে ইসলাম। এ জন্য ওই ছয়জন এই দুঃখ প্রকাশকে সাধুবাদও জানিয়েছেন। ছয়জন নারীর তিনজনই এনসিপির নেতা। তারা নিজেদের নেতৃত্বের কাছে তাদের নারীবিরোধী বক্তব্যের জন্য জবাবাদিহি চেয়েছেন কিনা?
বাংলাদেশে এখন আসলে নারী প্রশ্নেই রাজনীতিকে চেনা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। যেমন, এনসিপি এখন পর্যন্ত তাদের গঠনতন্ত্র, ইশতেহার না দিয়ে নিজেদের মধ্যপন্থি দল হিসেবে ঘোষণা দিলেও তাদের কর্মকাণ্ড এবং আলাপ অনেকটাই চরম ডানের দিকে কাত হওয়া। অন্যদিকে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে নারীর পক্ষে কোনো কোনো জায়গায় বক্তব্য থাকলেও হেফাজতের বক্তব্য এবং অবস্থান নিয়ে কোনো তাদের বক্তব্য নেই।
ঢাকার টিএসসি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে এসব ঘটনার প্রায় একই সময়ে কুড়িগ্রামের কচাকাটা কলেজের ফিন্যান্স ও ব্যাংকিংয়ের প্রভাষক লাকী খাতুন ফেসবুকে নারীর পর্দা প্রথার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে পোস্ট দেওয়ার কারণে তাঁকে নিয়ে এলাকায় সালিশ বসে। যদিও তিনি তাঁর ফেসবুক পোস্টটি মুছে ফেলেন এবং ক্ষমা প্রাথর্না করেছিলেন। তার পরও সালিশে তাঁকে আবারও ক্ষমা প্রার্থনা করানো এবং হেনস্তা করা হয়। শুধু তাই নয়, সালিশকারীরা পুরো সালিশটি ফেসবুকে লাইভ প্রচার করে।
প্রশ্ন জাগে, বিভিন্ন আবাসিক হল থেকে ছাত্রীরা গণঅভ্যুথানের সময় রাত-দিন তোয়াক্কা না করে মাঠে ছিলেন। কিন্তু এই সময় তারা মাঠে নেই কেন? রোকেয়ার মুখ যখন কালি দিয়ে লেপে দেওয়া হলো, তখনও অল্প-স্বল্প প্রতিবাদ হয়েছিল। এবার যখন বড় পরিসর থেকেই বর্তমান নারী নেত্রীদের অশালীন গালি দেওয়া হলো, তখন বড়সড় প্রতিবাদ হলো না কেন? এগুলোর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ হলে কেউ এ ধরনের বাড়াবাড়ি করার সাহস পেত না।
নারীর বিরুদ্ধে যখন এত কিছু হচ্ছে, তখন সরকার কী করছে? প্রকাশ্যে নারীকে গালি এবং হেয় করে বক্তব্য দিলেও এখন পর্যন্ত সরকার সেই নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সরকারিভাবে কোনো ধরনের পদক্ষেপ না নিলেও সরকারি বিভিন্ন পদে থাকা অনেকেই ইনিয়ে বিনিয়ে হেফাজতের অবস্থানকে প্রকারান্তরে সমর্থন দিচ্ছেন। তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন, কেন নারী সংস্কার কমিশন পাশ্চাত্যের অনেক বিষয় আমদানি করেছে? কেন এসব সুপারিশ করার আগে ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন সদস্যরা আলাপের জন্য বসেনি? তার মানে, অন্য কমিশন যা করুক আর না করুক, নারী কমিশনকে ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে বসতেই হবে? সব কমিশনই কি ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে বসে তাদের সুপারিশ ঠিক করেছে?
বস্তুত গণতন্ত্র, রাষ্ট্র, সংবিধান, জাতীয়তাবাদ– সবই তো পাশ্চাত্য টার্ম থেকে আমদানি করা শব্দ। সেগুলো নিয়ে কেউ তো এ ধরনের যুক্তি দিচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে যখন আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, তাতেও পাশ্চাত্যঘেঁষার প্রশ্ন ওঠে না। হালের সবচেয়ে আলোচিত ও ব্যবহৃত শব্দ ‘ফ্যাসিস্ট’। এটি কি
বাংলা শব্দ?
যদি ফেমিনিস্ট বললেই পাশ্চাত্যের আমদানি করা মতবাদ বলে খারিজ করে দেওয়া হয়; বৈবাহিক ধর্ষণের কথা এলেই বলা হয়, এগুলো পাশ্চাত্যের। তাহলে আমাদের দেশের নারীই হবে শুধু প্রাচ্যের সংস্কৃতি রক্ষার ধারক? নারী সম্পত্তিতে সমানাধিকার চাইলেই সংস্কৃতি ধুয়ে যায়। লিঙ্গ রাজনীতি নিয়ে কথা বললেই নারীরা ‘খারাপ’ হয়ে যায়? এখানেই সমাজ, রাষ্ট্র আর রাজনীতি এক হয়ে ওঠে; নারীর বিরুদ্ধে যায়, অন্যদিকে শাসানো পুরুষতন্ত্রকে ফ্যাসিবাদবিরোধী ভাবে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প র ষতন ত র র জন ত ক ধরন র ইসল ম সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আ’লীগের পোড়া অফিস দখল করে বিএনপি নেতাদের সাইনবোর্ড
কুড়িগ্রামের উলিপুরে আগুনে পুড়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের কার্যালয় দখল করে নিয়েছেন বিএনপির নেতারা। তারা সেখানে ‘চর উন্নয়ন কমিটি, উলিপুর শাখা’ লেখা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছেন। রোববার বিকেলে সাইনবোর্ডটি লাগানো হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট উপজেলা আওয়ামী লীগের এ কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। পুড়ে যাওয়া কার্যালয়টিতে বর্তমানে দরজা-জানালা নেই। সেখানে কুড়িগ্রামে চর উন্নয়ন কমিটি গঠন করা হয়। চরাঞ্চলের উন্নয়নের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় গঠনের দাবিতে এ কমিটি কাজ করছে। কমিটিতে বিএনপি ও সমমনা লোকদের রাখা হয়েছে। তবে দায়িত্বশীলদের দাবি, এটি অরাজনৈতিক সংগঠন।
জানা গেছে, উপজেলা চর উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক সোলায়মান আলী সরকার পৌর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক। যুগ্ম আহ্বায়ক এরশাদুল হাবীব নয়ন উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এ কমিটির বেশির ভাগ সদস্য বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সাইনবোর্ড টাঙানো প্রসঙ্গে সোলায়মান আলী বলেন, ‘ভবনটি নোংরা ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। একে পরিচ্ছন্ন রাখতে চর উন্নয়ন কমিটির অফিসকক্ষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। আইনি কোনো বাধা থাকলে সরে যাব।’
সোলায়মান আরও বলেন, ‘আমরা যতটা জানি, জায়গাটি কারও নামে নেই। চর উন্নয়ন কমিটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন। আমরা মনে করি, জায়গাটি যদি ব্যবহার করা যায় তাহলে আশপাশের পরিবেশ ভালো থাকবে।’
এরশাদুল হাবীব বলেন, ‘এটি আওয়ামী লীগের কার্যালয় ছিল। কিন্তু যথাযথ কাগজপত্রের হদিস পাবেন না। তারা অবৈধভাবে এটি ব্যবহার করেছে। আমরা প্রক্রিয়া মেনে এ জায়গা ব্যবহার করব। প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে লিজ নেওয়া যায় তা দেখা হবে। পরিচ্ছন্নতার স্বার্থে আপাতত ভবনটিতে উপজেলা চর উন্নয়ন কমিটির কার্যক্রম চালানো হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘এভাবে রাজনৈতিক দলের কার্যালয় দখল করা নিন্দনীয়। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে আমাদের কিছু করার নেই। নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারছি না।’
উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হায়দার আলী মিয়া বলেন, সাইনবোর্ড টাঙানোর বিষয় আমরা অবগত নয়। এ ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য নেই।
উলিপুর থানার ওসি জিল্লুর রহমান বলেন, বিষয়টি আমি জানি না।