১৯২৯ সালে নির্মিত শায়েস্তাগঞ্জ-বাল্লা রেলপথ এক সময় ছিল হবিগঞ্জ জেলার অর্থনীতির প্রাণ। তবে সময়ের সঙ্গে এই রেলপথের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে ঐতিহ্য। লুট হয়ে গেছে স্লিপারসহ গুরুত্বপূর্ণ সব যন্ত্রাংশ।
এ রেলপথটি চুনারুঘাট উপজেলার বাল্লা সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত; যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ থেকে ৩৬ কিলোমিটার। এ রুটে বড়কোটা, শাকির মোহাম্মদ, সুতাং বাজার, চুনারুঘাট, আমু রোড, আসামপাড়া এবং বাল্লা– এই সাতটি স্টেশন ছিল। বর্তমানে এ রেলপথটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে এবং এর অবকাঠামোসহ জমি দখল ও লুটপাটের শিকার হয়েছে। এক সময় যে রেলপথ দিয়ে প্রতিদিন চলন্ত ট্রেনের হুইসেল শোনা যেত, সেই পথে এখন রেললাইনের চিহ্নও নেই।
বাল্লা থেকে শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত রেললাইনের কোনো স্লিপার বা লাইন চোখে পড়ে না; বরং সেখান দিয়ে এখন নির্মাণ করা হয়েছে সড়ক। রেলস্টেশনগুলোর অবস্থাও করুণ। অনেক স্টেশন ঘর ধসে পড়েছে, আর অনেক ঘরের অস্তিত্ব নেই। বাকিগুলোও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। অথচ এই রেলপথ একসময় ছিল জেলার অর্থনৈতিক প্রাণ।
চুনারুঘাটের বাল্লা থেকে শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত রেলের বিশাল জমি এখন প্রভাবশালীদের দখলে। কেউ গড়ে তুলেছেন বাড়িঘর, কেউ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এলজিইডির উদ্যোগে কিছু এলাকায় রেলের স্লিপার সরিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে পাকা রাস্তা। রেলওয়ের কোনো অনুমতি বা আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া এসব কাজ চলছে, যেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি!
জমির পাশাপাশি হারিয়ে গেছে কোটি কোটি টাকার রেল সরঞ্জাম। স্থানীয়দের অভিযোগ– লাইন, স্লিপার, যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে বিক্রি হয়ে গেছে লোহা ব্যবসায়ীদের কাছে। এসব লুটপাটের কোনো তদন্ত, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বা মালপত্র উদ্ধারের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি গত ২৪ বছরে। ২০০১ সালে বন্ধ হওয়ার পর ৭টি স্টেশনের অবকাঠামোসহ কোটি কোটি টাকার মালপত্র লুটপাট শুরু হয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত ৯৫ ভাগ লুটপাট হয়েছে। লুটপাটকারীদের নির্দিষ্ট কোনো তালিকা নেই। তারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
বর্তমানে চুনারুঘাট থেকে বাল্লা পর্যন্ত রেলপথের প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার অংশ সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। রেললাইনের স্লিপার ও অন্যান্য সরঞ্জাম নেই। অনেক জায়গায় রেললাইনের ওপর পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, রেলের জমিতে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি, দোকানপাট এবং অন্যান্য স্থাপনা। এ ছাড়া এলজিইডি কর্তৃক রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে।
অথচ এসব কার্যক্রমে রেলওয়ের অনুমতি বা সরকারি নীতিমালার কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এক সময়কার ব্যস্ত রেলস্টেশনগুলো। ধসে পড়ছে ছাদ, ভেঙে পড়ছে দেয়াল। আশপাশে গড়ে উঠেছে অবৈধ বসতি। সরকারি সংস্থাগুলোর নীরবতা এই লুটপাটকে যেন বৈধতা দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে কিছু প্রভাবশালী চক্র রেলের জায়গা দখল করে রেখেছে। বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার তৎপরতার কথা বলা হলেও তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। জমিগুলোর ওপর গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা, চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম, অথচ রেল কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।
চুনারুঘাট উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দা ফারুক মিয়া বলেন, ছোটবেলায় এ রেলপথে ট্রেন চলতে দেখেছি। এখন সেই রেলপথের কোনো চিহ্ন নেই। রেলের জমি দখল করে মানুষ বসতবাড়ি বানিয়েছে, দোকানপাট গড়ে তুলেছে। কেউ কিছু বলছে না। ব্যবসায়ী মো.
চেগানগর গ্রামের ৮০ বছরের আব্দুল্লাহ বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে হবিগঞ্জ-বাল্লা রেলপথের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে। রেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ ট্রেন নিয়ে গুরুতর উদাসীনতা দেখাতে থাকেন। এ কারণে রেলপথটি আস্তে আস্তে লোকসানে পড়ে। টিকিট চেকার, নিরাপত্তাকর্মীদের দায়িত্বে প্রকট অবহেলা দেখানোর পরও আমুরোড বাজার, চুনারুঘাট ও আসামপাড়া বাজার রেলস্টেশনে চা বাগানের মালপত্র আনা-নেওয়ার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে বাল্লার ট্রেন। তা বেশিদিন চালু রাখা যায়নি। লোকসানের অজুহাতে বাল্লা ট্রেনের যাত্রা স্থগিত করা হয়।
জানা যায়, জনগণের আন্দোলনের মুখে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছিল এই পথে, ১৯৯১ সালে। এরপর ১৯৯৬ সালে আরও একবার ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় রেল বিভাগ। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে ব্যাপক আলোচনা হয়। সচেতন নাগরিকের চাপের মুখে ২০০০ সালে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ট্রেনটি কয়েক মাস চলাচল করে আবারও বন্ধ হয়ে যায়, যা এখন পর্যন্ত আর চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে রেলের জমি উদ্ধারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। রেলওয়ের পক্ষ থেকেও জমি উদ্ধারে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ফলে রেলের জমি ও সরঞ্জাম লুটপাট অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় সচেতন মহল বলছে, বারবার অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা মেলেনি। চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিন মিয়া বলেন, রেল কর্তৃপক্ষ যখন চাইবে, তখনই বেদখল হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধারে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। তবে হবিগঞ্জ-বাল্লার মধ্যে পুনরায় রেল চালুর দাবি এলাকাবাসীর।
স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, এটা শুধু অবহেলা নয়; বরং সচেতনভাবে জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করা।
শামীম আলম নামে এক ব্যক্তি বলেন, প্রায় ২৪ বছর ধরে রেলের কোটি কোটি টাকার জমি ও সরঞ্জাম লুট হয়ে গেলেও আজও এর কোনো তদন্ত হয়নি, কাউকে জবাবদিহিও করতে হয়নি। এটি রাষ্ট্রের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। তথ্য অনুযায়ী, বিশ কিলোমিটারের বেশি রেলপথ সম্পূর্ণ বিলীন। সর্বশেষ ট্রেন চলাচল বন্ধ হয় ২০০১ সালে। রেলের জমিতে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক। রেললাইনের স্লিপার, যন্ত্রাংশ লোপাট হয়েছে কোটি কোটি টাকার।
উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মীর সিরাজ বলেন, রেলপথ শুধু যাতায়াত নয়, একটি এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যম। বাল্লা রেলপথ পুনরুদ্ধার ও লুট হওয়া সম্পদের হিসাব চায় এলাকার মানুষ। নয়তো এই নীরবতা উৎসাহ দেবে আরও লুটপাটে, আরও দখলে।
শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ের স্টেশনমাস্টার লিটন বলেন, বাল্লা রেলপথ আবার চালু হবে কিনা, এটি রেল মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। রেলের মালপত্রের বিষয়টি পিডব্লিউআই দেখে।
রেলওয়ে জংশনের ঊর্ধ্বতন উপ-প্রকৌশলী (পথ) ফিরুজ আহমেদ জানান, বাল্লা একটি পরিত্যক্ত লাইন। তারা রানিং লাইন নিয়ে কাজ করেন। এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। আগে কী হয়েছিল, সে বিষয়ে তিনি অবগত নন। দখল ও চুরি রোধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
চুনারুঘাট উপজেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী ইমাম হোসেন বলেন, সড়কগুলো আরও আগে করা হয়েছে। কীভাবে করা হয়েছে, তা তাঁর জানা নেই। তবে জনগণের উপকারের জন্য সড়ক করা হচ্ছে।
উপজেলা প্রকৌশল অফিসের সার্ভেয়ার আবুল কালাম জানান, বাল্লা রেলপথ পরিত্যক্ত হওয়ার পর ৮ কিলোমিটার রাস্তা পাকা করা হয়েছে। কীভাবে করা হয়েছে, এর কোনো নথি নেই।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চ ন র ঘ ট উপজ ল ন র ম ণ কর ম লপত র র লওয় র র লপথ র সরঞ জ ম ল টপ ট ব যবস সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
অবাধ লুটপাটে পাথররাজ্য এখন ধুধু বালুর মাঠ
প্রতিদিন লুট হচ্ছে পাথর। সিলেটের অন্যতম পর্যটন গন্তব্য পাথররাজ্য ‘সাদা পাথরে’ এখন আর তেমন পাথর নেই। সবার চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির এই অমূল্য উপহার। এক বছর আগেও যেখানে ছিল পাথরের স্তূপ, সেখানে এখন ধুধু বালুর মাঠ। দিন-রাত শত শত নৌকা দিয়ে প্রকাশ্যে পাথর লুট করা হলেও প্রশাসন ছিল নির্বিকার। একাধিকবার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
টাকার অঙ্কে নির্দিষ্ট করে লুটের পরিমাণ নিশ্চিত হওয়া না গেলেও সংশ্লিষ্টদের অনুমান প্রতিদিন কোটি টাকার পাথর লুট হচ্ছে। অভিযোগ আছে, পুলিশ ও বিজিবি কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক দলের নেতাদের সম্পৃক্তায় দিন-রাত লুট হচ্ছে পাথর। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে এ লুটপাট চলছে। এজন্য প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন পরিবেশবাদীরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্র বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
দীর্ঘদিন ধরে সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পাথর লুট শুরু হয়। এখনো পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে ভেসে আসা পাথর লুটপাটের মচ্ছব চলছে। বাদ যাচ্ছে না ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বাঙ্কার এলাকাও। সবচেয়ে বেশি তাণ্ডব চালানো হয়েছে ভোলাগঞ্জ রোপওয়েতে। নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে রোপওয়ে।
ধলাই নদীর তলদেশেও আছে পাথরের বিপুল মজুদ। এ পাথর দিয়ে ৫০ বছর চালানো যাবে, এই হিসাব ধরে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সোয়া ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্প। ব্রিটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ রোপওয়ের জন্য নির্মাণ করা হয় ১২০টি টাওয়ার এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্ট। মধ্যখানে চারটি সাব-স্টেশন। দুই প্রান্তে ডিজেলচালিত দুটি ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউস, ভোলাগঞ্জে রেলওয়ে কলোনি, স্কুল, মসজিদ ও রেস্ট হাউস নির্মাণও প্রকল্পের আওতাভুক্ত ছিল। এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্টের সাহায্যে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাথর উত্তোলন করা হলেও বর্তমানে এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ আছে। সেই থেকে অনেকটা অযত্ন-অবহেলায় পড়েছিল ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের বিভিন্ন স্থাপনা। রোপওয়ের আয়তন প্রায় ১০০ একর।
একসময় ভোলাগঞ্জ এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো ছিল। ধলাই নদী বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্ল্যান্টের চারপাশ ঘুরে আবার একীভূত হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের কাছে ধলাই নদী মিলিত হয়েছে পিয়াইন নদীর সাথে।
২০১৭ সালে দেশজুড়ে পরিচিতি পায় পর্যটনকেন্দ্র সাদা পাথর। ওই বছর পাহাড়ি ঢলে ধলাই নদের উৎসমুখে প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে পাথরের বিশাল স্তূপ জমা হয়, যা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর আরও কয়েক দফায় পাহাড়ি ঢল নেমে এখানে পাথরের একটি আস্তরণ পড়ে। সেই পাথরের বিছানার ওপর দিয়ে স্বচ্ছ পানির ছুটে চলার দৃশ্য পর্যটকদের নজর কাড়ে। সেই থেকে সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রে সব মৌসুমে পর্যটকদের ভিড় লেগইে থাকে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সাদা পাথর নামের এই পর্যটন কেন্দ্রের জিরো লাইনে দিন-রাত সমানতালে হাজার হাজার শ্রমিক কোদাল, বেলচা, শাবল আর টুকরি নিয়ে কোয়ারি ও এর আশপাশের এলাকায় গিয়ে মাটি খুঁড়ে পাথর বের করছেন। হাজার হাজার বারকি নৌকায় সেসব পাথর বহন করে এনে মিলমালিকদের কাছে বিক্রি করছেন তারা। পরে সেসব পাথর মেশিনে ভেঙে ছোট করে ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করা হয়। ওই ব্যবসায়ীরা ট্রাক ও পিকআপে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠান সেসব পাথর।
দুই-তিন মাস আগের চিত্রের সঙ্গে কোনো মিল নেই বর্তমান সাদা পাথর এলাকার। বড় আকারের পাথর এরইমধ্যে গায়েব হয়ে গেছে। এখন পর্যটন কেন্দ্রের মাটি খুড়তে শুরু করেছেন পাথরখেকোরা। এতে কিছু দিনের মধ্যে পাথরশূন্য হয়ে পড়বে এ স্থানটি।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পাথর লুটের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় বিএনপি ও যুবদলের নেতারা। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে পুরো ‘পাথর রাজ্য’ তাদের নিয়ন্ত্রণে। বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরাও এই সিন্ডিকেটে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এর আগে বিজিবি ও পুলিশের চাঁদা তোলার ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। মাঝে-মধ্যে নামমাত্র অভিযান হলেও পরে থেমে যায়।
রফিকুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, আগে নৌকাপ্রতি ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হতো। পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করা হতো আরো ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। পাথর উত্তোলনকারীরা প্রতি নৌকা পাথর বিক্রি করতেন ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায়। এখন সেই সিস্টেমে পরিবর্তন এসেছে। এখন পাথর যে কেউ তুলতে পারে, তবে বিক্রি করতে হবে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে। অন্যথায়, সেই পাথর কেউ কিনবে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার বলেছেন, “প্রশাসনকে আমি সাদা পাথর রক্ষার্থে ব্যর্থ বলব না। ব্যর্থ তারা তখনই হতো, যখন চেষ্টা করত। সাদা পাথর রক্ষার্থে তো তারা কখনো কোনো চেষ্টাই করেনি। প্রশাসনের উদাসীনতাই সাদা পাথরের জন্য কাল হয়েছে। অথচ, এক বছর আগেও সাদা পাথরে কেউ হাত দেওয়ার সাহস পায়নি।”
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ভূমি সন্তান বাংলাদেশ’-এর সংগঠক শুয়াইবুল ইসলাম জানিয়েছেন, জাফলং কিংবা সাদা পাথর, সবখানে সমানতালে লুটপাট করছে সংঘবদ্ধ চক্র। প্রশাসন কঠোর হলে এই লুটপাট ঠেকানো যেত। প্রকৃতিকে কীভাবে গিলে খাচ্ছে অসাধু চক্র, তা দেখতে চাইলে সাদা পাথর ঘুরে আসা যায়। আমরা মনে করি, প্রশাসন কঠোর না হলে যতই চিল্লাচিল্লি করি, কোনো কাজে আসবে না।
সাদ পাথর লুটপাটের বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার বলেছেন, “আমরা ডিসি অফিসে কথা বলেছি। আশা করছি, খুব দ্রুত, হয়তো এ সপ্তাহের মধ্যে আবার ক্রাশারগুলোতে অভিযান হবে। আগেরবার আমরা অনেকটা শক্ত অভিযানে ছিলাম। পরবর্তীতে পরিবহন শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এরপর থেকেই এই লুটপাট হচ্ছে।”
এ বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের মাহমুদ আদনান বলেছেন, “পাথর উত্তোলনের খবর পেলে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে স্পেশাল টাস্কফোর্স অভিযান চালায়। পুলিশ তাতে সহযোগিতা করে। পুলিশের পক্ষে একা এটি ঠেকানো সম্ভব নয়।”
পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয়ের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেছেন, ‘সাদা পাথর ইসিএ-ভুক্ত এলাকা না হওয়ায় আমরা সেখানে গিয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছি না। তবু, আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে অভিযানে সহযোগিতা করছি।”
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেছেন, “সাদা পাথর রক্ষার্থে আমরা তো নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু, কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না।”
আগে এটি রক্ষা করতে পারলেও এখন কেন পারছেন না, প্রশ্ন করলে একই উত্তর দেন যে, “আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।”
ঢাকা/রফিক