ভারত ও পাকিস্তানের সর্বসাম্প্রতিক হামলা-পাল্টা হামলায় ‘যুদ্ধাস্ত্র’ হিসেবে আলোচনায় এসেছে পানি। কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পরপরই দুই দেশের মধ্যকার সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করে ভারত। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও পরদিনই চেনাব নদীতে দেওয়া বাঁধের একাধিক গেট খুলে দিয়েছে ভারত। এর ফলে আবারও পাকিস্তানের দিকে প্লাবনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে (সমকাল, ১২ মে ২০২৫)।
ভারত থেকে পাকিস্তানের দিকে যাওয়া চেনাব নদীর বাগলিহার বাঁধটি তৈরি হয়েছিল সিন্ধু পানিচুক্তি মেনে– শর্তমতে বাঁধটির মাধ্যমে সাময়িকভাবে সীমিত পরিমাণ পানি ধরে রাখা গেলেও পরে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু সেটিই ‘পানি অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
পানিকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার কি নতুন? প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় সেই খ্রিষ্টপূর্ব ২৫ শতকেই পানি নিয়ে বিরোধ এবং পানিকে ব্যবহার করে পরস্পর প্রতিশোধ নিতে দেখা যায়। ১৬৭২ সালে তৃতীয় ডাচ যুদ্ধে প্রতিরক্ষার খাতিরে ডাচরা তাদের বাঁধগুলো খুলে দিয়ে প্লাবন সৃষ্টি করলে ফরাসিদের জন্য সেটা দুর্ভেদ্য হয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক ইতিহাসেও দেখা যায়, ১৯৭৪ সালে ইরাক অভিযোগ করে, সিরিয়া ইউফ্রেটিস নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি কমিয়ে দিয়েছে। এই অভিযোগে ইরাক সীমান্তে সশস্ত্র সৈন্য সমাবেশ ঘটায়; বোমা মেরে বাঁধটি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। ১৯৭৬ সালে পানির দূষণ ঘটিয়ে মোজাম্বিকের ক্ষতি করার চেষ্টা করে দক্ষিণ আফ্রিকা। ওই সময়ে মোজাম্বিকের ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানিতে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অভিযোগ ওঠে, রোডেশিয়ান সরকার কৃষ্ণাঙ্গদের শায়েস্তা করার জন্য মোজাম্বিকের পানিতে এই ব্যাকটেরিয়ার দূষণ ঘটায়।
মধ্যপ্রাচ্যে জর্ডান নদী অববাহিকার দেশ জর্ডান, ফিলিস্তিন, ইসরায়েলসহ অনেক অঞ্চল জর্ডান নদীর পানি ব্যবহার করে এবং এর বণ্টন নিয়ে এ অঞ্চলে উত্তেজনা লেগেই থাকে। পানির অভাবে সিরিয়ায় সহস্রাব্দের দীর্ঘ ভয়াবহ খরায় সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রায় এক শতাব্দী ধরে মিসর ও ইথিওপিয়া নীল নদের পানি ব্যবহার করে আসছে তাদের উন্নয়নকাজে। ২০১৫ সালে নীল নদের ওপর গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এ নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে পানির ন্যায্য হিস্যা বিষয়ে চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এতে অসন্তোষ পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে ফিলিস্তিন জবরদখলকারী ইসরায়েলের সৈন্যরা পশ্চিম তীরের ইবজিকে পানির ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে দেয় এবং কৃষি ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। একই বছর ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে রাশিয়ার সৈন্যরা ইউক্রেনে দখলকৃত অঞ্চলে ইউক্রেন ও ক্রিমিয়ার মাঝে ২০১৪ সালে নির্মিত কংক্রিট বাঁধ ধ্বংস করে দেয় এবং এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬০ সালে হওয়া সিন্ধু পানিচুক্তি অনুযায়ী বিপাশা, রবি ও শতদ্রুর নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়েছিল ভারতকে। অন্যদিকে সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও ঝিলাম নদীর নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানকে। সিন্ধু অববাহিকার উৎস নদীর অবস্থান ভারতে হওয়ায় পাকিস্তান সব সময় শঙ্কায় থাকে– কখন নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়! ভারত সেই নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ করার অস্ত্রটিই কাজে লাগাল। এই নদীর প্রবাহের ওপর নির্ভর করে পাকিস্তানের বিরাট জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হলেও ভারত থেকে পাকিস্তানের দিকে শিগগিরই পানি প্রবাহ চালু হচ্ছে না।
বস্তুত নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে ভাটির দেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করার ভয়ানক প্রতিশোধ নেওয়ার নজির সেই অনেক আগে থেকেই। ভাটির দেশে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অনেক সময় দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবেও পানিকে ব্যবহার করা হয়। নদীর পানি ভাগাভাগি যে কোনো সময় যুদ্ধাস্ত্রে পরিণত হতে পারে– সেটি পরিষ্কার হয়ে উঠছে ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। এটি স্মরণ করিয়ে দিল– ভাটির দেশগুলোকে পানি অস্ত্রের বিষয়েও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে; নিতে হবে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা।
ড.
saifullahasm@yahoo.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ব যবহ র ক নদ র প ন হয় ছ ল প রব হ
এছাড়াও পড়ুন:
নামাজে যে ১০টি ভুল অনেকে করে থাকেন
নামাজ একটি দৈনিক ইবাদত, প্রতিদিন পাঁচবার পড়তে হয়। এরপরও আমাদের অজান্তে নামাজে এমন কতগুলো ভুল হয়ে যায়, যা নামাজের গুণগত মান ও আধ্যাত্মিক উপকার কমিয়ে দেয়। নামাজে আন্তরিকতা বাড়াতে এ ভুলগুলো চিহ্নিত করে সংশোধন করা গুরুত্বপূর্ণ।
নিচে নামাজে সাধারণ ১০টি ভুল এবং সেগুলো সংশোধনের উপায় আলোচনা করা হলো।
সবচেয়ে খারাপ চোর সে যে তার নামাজ থেকে চুরি করে।মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২২,৬৮৬১. ভুল নিয়তভুল: অনেকে সঠিক নিয়ত ছাড়া নামাজ শুরু করেন। কখনো মনে মনে নিয়ত না করেই নামাজে দাঁড়ান।
সংশোধন: নামাজ শুরুর আগে হৃদয়ে স্পষ্ট নিয়ত করুন যে আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নামাজ পড়ছেন। নিয়ত মুখে বলার দরকার নেই, তবে মনে সচেতনভাবে নির্ধারণ করতে হবে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘আমলে মূল্য নির্ভর করে নিয়তের ওপর।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১)
২. তাড়াহুড়া করাভুল: তাড়াহুড়া বা মনোযোগের অভাবে অনেকে নামাজের অঙ্গভঙ্গি দ্রুত করেন। ফলে রুকু, সিজদায় সঠিক অবস্থান বজায় থাকে না।
সংশোধন: প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে সময় নিন। রুকুতে পিঠ সোজা রাখুন, হাঁটুতে হাত দৃঢ়ভাবে রাখুন। সিজদায় কপাল, নাক, হাতের তালু, হাঁটু ও পায়ের আঙুল মাটিতে রাখুন। নামাজ আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন। তাই প্রতিটি অবস্থানে মনোযোগ দিন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘সবচেয়ে খারাপ চোর সে যে তার নামাজ থেকে চুরি করে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২২,৬৮৬)
আরও পড়ুন‘আত-তাহিয়্যাতু’র মর্মবাণী কী১১ এপ্রিল ২০২৫৩. ‘তাকবিরে তাহরিমা’ ভুল উচ্চারণভুল: নামাজ শুরুর সময় ‘আল্লাহু আকবার’ দ্রুত বা মনোযোগ ছাড়া বলা অথবা হাত সঠিকভাবে না তোলা।
সংশোধন: তাকবিরে তাহরিমা বলার সময় উভয় হাত কাঁধ বা কানের সমান উঠিয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ মনোযোগসহ বলুন। এটি নামাজের সূচনা এবং পুরো নামাজের সুর ও তাল নির্ধারণ করে দেয়।
৪. সুরা ফাতিহা ভুল পড়াভুল: সুরা ফাতিহার উচ্চারণ ভুল করা বা তাড়াহুড়া করে ‘মাদ’ (দীর্ঘ স্বর) সঠিকভাবে আদায় না করে পড়া।
সংশোধন: সুরা ফাতিহা নামাজের অপরিহার্য অংশ। সঠিক তাজবিদসহ পড়ুন ও শব্দের অর্থের প্রতি মনোযোগ দিন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে নামাজে সুরা ফাতিহা পড়া হয় না, সে নামাজ অপূর্ণ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩৯৪)
৫. রুকু ও সিজদায় ভুল অবস্থানভুল: রুকুতে পিঠ সোজা না রাখা, সিজদায় কপাল মাটিতে পুরোপুরি না রাখা।
সংশোধন: রুকুতে পিঠ মাটির সমান্তরাল রাখুন, হাঁটুতে হাত দৃঢ়ভাবে রাখুন। সিজদায় কপাল, নাক, হাতের তালু, হাঁটু ও পায়ের আঙুল মাটিতে রাখুন, বাহু শরীর থেকে দূরে রাখুন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘সিজদায় তোমার সাতটি অঙ্গ মাটিতে রাখো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮০৯)
নামাজ পড়ো যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখো।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩১৬. তাশাহুদ ভুল বা বাদ দেওয়াভুল: তাশাহুদ দ্রুত বা ভুল উচ্চারণ করা বা এর অর্থের প্রতি মনোযোগ না দেওয়া।
সংশোধন: দ্বিতীয় রাকাতের পর তাশাহুদের অবস্থানে বসে ধীরে ধীরে পড়ুন, ‘আত-তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস সালাওয়াতু ওয়াত তাইয়্যিবাতু, আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু, আসসালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস সালিহিন। আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।’
অর্থাৎ সব মৌখিক, শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত আল্লাহর জন্য। হে নবী, আপনার প্রতি সালাম এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত নাজিল হোক। সালাম আমাদের প্রতি এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের প্রতি। আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিশ্চয়ই মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। (বুখারি, হাদিস: ৬২৬৫)
অর্থের প্রতি মনোযোগ দিন ও এ সময়ে দোয়া করুন।
আরও পড়ুনকেন দরুদ পাঠ করব১৫ মার্চ ২০২৫৭. কিবলার দিকে না পড়াভুল: অপরিচিত স্থানে ভুল দিকে নামাজ পড়া এবং পরিচিত স্থানে কিবলা কখনো যাচাই না করা।
সংশোধন: নামাজের সময় মক্কার কাবার দিকে মুখ করুন। কিবলার দিক নিশ্চিত করতে কিবলা কম্পাস বা স্মার্টফোন অ্যাপ ব্যবহার করুন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কিবলার দিকে মুখ করো। কারণ, এটি নামাজের শর্ত।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫৫৫)
৮. অপ্রয়োজনীয় নড়াচড়া করাভুল: নামাজে পোশাক ঠিক করা, ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো, ফোন পকেটে আছে কি না চেক করা বা চুলকানোর মতো অপ্রয়োজনীয় নড়াচড়া করা।
সংশোধন: নামাজে নড়াচড়া কম করুন। খুব প্রয়োজন হলে দ্রুত ও শান্তভাবে করুন। ভুল হলে ‘সাহু সিজদাহ’ দিয়ে নামাজ শেষ করুন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘নামাজে কথা বললে তা বাতিল হয়।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৯২২)
যে নামাজে সুরা ফাতিহা পড়া হয় না, সে নামাজ অপূর্ণ।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩৯৪৯. সঠিক স্থানে হাত না রাখাভুল: নামাজে অপ্রয়োজনীয় হাত তোলা বা রুকু, সিজদা বা বৈঠকে সঠিক স্থানে হাত না রাখা।
সংশোধন: শুধু সুন্নাহ অনুযায়ী নির্ধারিত স্থানে হাত তুলুন। কোন রোকন আদায় করার সময় কোথায় হাত কীভাবে রাখতে হবে, তা ভালোভাবে জেনে নিন। যেমন-তেমন করে হাত রাখা নামাজের অমনোযোগিতার প্রমাণ। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমার মতো নামাজ পড়ো যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩১)
১০. খুশু-খুজু না থাকাভুল: দুনিয়াবি চিন্তা বা অর্থ না বোঝার কারণে নামাজে মনোযোগের অভাব।
সংশোধন: খুশু অর্থ ভয় ও খুজু অর্থ বিনয়। মনপ্রাণ আল্লাহর দিকে কেন্দ্রীভূত করে পড়াটাই নামাজের দাবি। পঠিত আয়াতের অর্থ চিন্তা করুন। মন ভ্রান্ত হলে ধীরে ধীরে তা ফিরিয়ে আনুন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় সফল হয়েছে মুমিনগণ, যারা তাদের নামাজে খুশু অবলম্বন করে।’ (সুরা মুমিনুন, ২৩:১-২)
নামাজ ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং এটি পূর্ণ করতে আন্তরিকতা, মনোযোগ ও সঠিক জ্ঞান প্রয়োজন। সাধারণ ভুলগুলো সম্পর্কে সচেতন হয়ে এবং সেগুলো সংশোধনের চেষ্টা করে আপনি নামাজের গুণগত মান বাড়াতে ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারেন।
আরও পড়ুনঘড়ির চাপে কি আমাদের ইবাদতের ক্ষতি হচ্ছে২২ মে ২০২৫