শওকত ওসমান: অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর
Published: 14th, May 2025 GMT
বাংলা সাহিত্যে এমন অনেক নাম আছে, যারা সময়কে ছাপিয়ে গিয়ে হয়ে উঠেছেন চিরন্তন। তাদের মধ্যে শওকত ওসমান ছিলেন এমন এক বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি শুধু সাহিত্যিক নন, ছিলেন দার্শনিক, সমাজ-সমালোচক এবং প্রতিবাদী চেতনার এক জ্যোতিষ্ক। সাহিত্যের অঙ্গনে তিনি বিপ্লব এনেছিলেন কলমের মাধ্যমে, আর নৈতিক অবস্থানে ছিলেন আপসহীন।
তাঁর লেখনীতে যেমন ছিল ভাষার কারুকার্য, তেমনি ছিল সত্য বলার সাহস, সমাজের গভীর অসুখ নির্ণয়ের ক্ষমতা। তিনি ছিলেন নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর, ধর্মান্ধতা ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক অটল মেধাবী যোদ্ধা।
শওকত ওসমানের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি, পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সবলসিংহপুর গ্রামে। প্রকৃত নাম শেখ আজিজুর রহমান। স্কুলজীবনে সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতা, পরবর্তী সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ এবং পরে পূর্ববঙ্গে চলে আসার মাধ্যমে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়।
দেশভাগ, দাঙ্গা, অভিবাসন এবং এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম–এই জটিল ইতিহাসের মধ্যে তিনি নিজেকে নির্মাণ করেছেন। তাঁর সাহিত্যচর্চা শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনের শেষ সময়ে, পূর্ণতা পায় পাকিস্তান আমলের শোষণ ও বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে এবং অগ্নিস্নাত মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের আশা-নৈরাশ্যের দ্বন্দ্বে।
শওকত ওসমানের সাহিত্যচর্চা ছিল বহুমাত্রিক। উপন্যাস, গল্প, নাটক, রম্যরচনা, প্রবন্ধ–প্রতিটি শাখায় তিনি রেখেছেন উজ্জ্বল স্বাক্ষর। তাঁর লেখার কেন্দ্রে ছিল মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক, শোষণের রূপ, নৈতিক সংকট এবং মানবিক প্রতিরোধ। লেখনীতে তিনি রাজনৈতিক বন্দির মনোজগৎ ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের করালচিত্র তুলে ধরেন। লেখক শুধু একজন সাহিত্যিক নন–একজন অন্তর্দর্শী সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও মনোবিদ।
‘ক্রীতদাসের হাসি’ (১৯৬২) উপন্যাসে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দমননীতি ও ভণ্ড রাজনীতির বিরুদ্ধে রূপকের আশ্রয়ে রচনা করেন এক অসাধারণ প্রতিরোধ-সাহিত্য। একজন ভাঁড়কে কেন্দ্রে রেখে লেখা হলেও এটি একটি রাষ্ট্র ও জাতিসত্তার গল্প; যেখানে প্রতিটি বাক্য হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ছুরি।
শওকত ওসমানের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্পষ্ট–তিনি ছিলেন অস্তিত্ববাদ ও মানবতাবাদের সমর্থক। তাঁর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মানুষ এবং মানুষের নৈতিক বোধ।
তিনি বারবার বলেছেন, ‘সাহিত্য শুধু বিনোদন নয়, এটা সমাজের আয়না এবং বিবেক। লেখকের দায়িত্ব সত্যকে নির্ভীকভাবে তুলে ধরা।’ পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ‘ক্রীতদাসের হাসি’ একটি তির্যক প্রতিবাদ। তিনি ছিলেন আপসহীন। তাঁর লেখনীতে বারবার ফুটে উঠেছে ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা, ধর্মান্ধতার হুমকি এবং চিন্তার স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় শওকত ওসমান কলকাতা থেকে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে। তাঁর লেখা কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক ও ভাষণ প্রচারিত হয়েছে দেশের অভ্যন্তরে ও সীমান্তে। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধু একটি রাষ্ট্রের জন্ম নয়, এটি একটি মানবিক বোধের জয়। যারা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য জীবন দেয়, তাদের পথ চিরকাল আলোকময়।’
বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৮৩) এবং স্বাধীনতা পদক (১৯৯৭) প্রাপ্ত শওকত ওসমান প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিকে অতিক্রম করে গেছেন পাঠকের চেতনায়।
যখন চিন্তার স্বাধীনতা সংকুচিত, যখন সাহিত্যকে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রলেপ দেওয়ার অস্ত্র হিসেবে, তখন শওকত ওসমান হয়ে ওঠেন আমাদের বিবেক, সাহস এবং নৈতিকতার শিক্ষক। তাঁর কলম যেমন সময়ের সঙ্গে কথা বলেছে, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য রেখে গেছে প্রশ্ন ও নির্দেশনা।তাঁকে স্মরণ করা মানে শুধু একজন লেখককে স্মরণ করা নয়; বরং সত্যের পক্ষ, মানবতার পক্ষ এবং চিন্তার মুক্তির পক্ষে দাঁড়ানো। শওকত ওসমান আজও বলেন, ‘লেখক যদি না জাগে, জাতি ঘুমিয়ে থাকে।’
অধ্যাপক ড.
দিপু সিদ্দিকী: ডিন, কলা ও সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদ, রয়্যাল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা; সাধারণ সম্পাদক, শওকত ওসমান স্মৃতি পরিষদ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ব ধ নত
এছাড়াও পড়ুন:
‘একজনের পক্ষে মেসিকে আটকানো অসম্ভব’, সতর্ক করলেন এনরিকে
ক্লাব বিশ্বকাপে রোববার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ইন্টার মায়ামির মুখোমুখি হবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের চ্যাম্পিয়ন পিএসজি। লিওনেল মেসির জন্য ম্যাচটি পুর্নমিলনীর দারুণ এক সুযোগ।
বার্সায় মেসি ট্রেবল জিতেছেন। যেটা এসেছিল স্প্যানিশ কোচ লুইস এনরিকের অধীনে। মেসির সঙ্গে এনরিকের সম্পর্ক বরাবরই খুবই ভালো ছিল। গুরু-শিষ্য সম্পর্ক তাদের। বার্সায় মেসি একই সঙ্গে খেলেছেন উসমান ডেম্বেলের সঙ্গে। ডেম্বেলে এখন পিএসজিতে খেলেন। তার সঙ্গেও দেখা হবে মেসির।
ওদিকে এনরিকে এখন পিএসজির কোচ। বার্সেলোনা ছেড়ে মেসিও যোগ দিয়েছিলেন পিএসজিতে। দলটিতে তার পুরনো সতীর্থ আছেন অনেকে। আশরাফ হাকিমির সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক মেসির। মার্কুইনোস, দোনারুম্মা, ভিতিনহা আছেন পিএসজিতে। তাদের সঙ্গেও ভালো বন্ধুত্ব মেসির।
তবে শক্তির বিচারে ম্যাচটি একতরফা হতে পারে। এরই মধ্যে ইন্টার মায়ামিকে কতগুলো গোল দেবে পিএসজি সোস্যাল মাধ্যমে ভক্তরা তা গুনতে শুরু করেছেন। তবে পিএসজির স্প্যানিশ কোচ এনরিকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তার মতে, মেসি ইতিহাসের সেরা। যে কাউকে ড্রিবল করার সামর্থ্য রাখে সে। তাকে একা আটকানোর চিন্তা করা ভুল।
পিএসজি কোচ এনরিকে বলেন, ‘আমার মতে, নিঃসন্দেহে মেসি ফুটবল ইতিহাসের সেরা। তার সেরা সময় ১০-১৫ বছর দীর্ঘ ছিল, সেরাদের জন্য সে একটা উদাহরণ। আমি তাকে অনুশীলনে এমন কিছু করতে দেখেছি, যা অন্য পর্যায়ের। অসাধারণ সেসব মুহূর্ত।’
মেসির বিপক্ষে পরিকল্পনা নিয়ে এনরিকে বলেন, ‘সত্যি বলতে, আমরা যদি একজন দিয়ে মেসিকে আটকানোর চেষ্টা করি এটা সম্ভব হবে না। এমন কিছু চেষ্টা করলে মারা পড়তে হবে। আমাদের দলগতভাবে রক্ষণ সামলানোর চেষ্টা করতে হবে। সকলকেই রক্ষণ সামলাতে হবে, বল ধরে রাখতে হবে, পাস দিতে হবে। দলীয়ভাবে খেলতে হবে, কারণ মেসি যে কাউকেই বল কাটিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।’