রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারা বিষয়গুলো স্বচ্ছতার স্বার্থে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেছেন, স্বচ্ছতার জন্য, জনগণের পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করার জন্য তা করা হবে। এটা খুবই জরুরি। 

গতকাল রোববার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সুশীল সমাজের আলোচনায় দেওয়া বক্তব্যে এসব কথা বলেন আলী রীয়াজ। 

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছা সিদ্ধান্তগুলো যেন পরবর্তী সময়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, সে জন্য প্রয়োজনে এ বিষয়ে আইন করারও তাগিদ দেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। আলোচনা সভায় তারা বলেন, যা কিছুই ঘটুক, রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সবকিছুতে যেন জনগণের অংশগ্রহণ থাকে।  

আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা মানবাধিকার, নারী অধিকার, ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারসহ মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর একমত হওয়ার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরির তাগিদ দিয়ে তারা দাবি করেন, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর তরুণ প্রজন্মের নারীরা প্রবল আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাজনীতিতে আসতে চাচ্ছেন। 

ঐকমত্যের বিষয়টি জাতীয় সনদের মাধ্যমে প্রতিফলনের আশাবাদ ব্যক্ত করে বক্তারা বলেন, ভবিষ্যতে প্রতিটি রাজনৈতিক দল যেন সেই জাতীয় সনদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে ভূমিকা পালন করতে পারে।

ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, ঐকমত্য গঠনে শুধু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকই যথেষ্ট নয়, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের সঙ্গেও আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ ছাড়া সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতির সুযোগ নেই। 

জাতীয় সনদ প্রতিষ্ঠা করাই অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় অনেক বিষয়ে ঐকমত্য যেমন হয়েছে, তেমনই অনেক বিষয়ে মত ভিন্নতাও রয়েছে। যেসব বিষয়ে মত ভিন্নতা আছে, সেগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার বিষয়টি তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, দলগতভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ে যেমন ঐকমত্য হয়েছে, আবার কিছু মৌলিক বিষয়ে এখনও ঐকমত্য হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক আদর্শিক অবস্থানের কারণে মতপার্থক্য থাকবে। সব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না, এটা হচ্ছে বাস্তব।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা বারবার বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য গঠনে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা যথেষ্ট নয়, নাগরিক সমাজের মধ্যেও এ বিষয়ে এক ধরনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তাই নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ সংস্কার কর্মসূচি থেকে বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

কমিশনের সহসভাপতি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে যোগাযোগ করেছেন। দলগুলো তাদের মতামত দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

তিনি বলেন, আমরা একটা মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। অমিত সম্ভাবনা তৈরি করেছি, কিন্তু যে কোনো সম্ভাবনা যেমন চ্যালেঞ্জ তৈরি করে, এই পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জগুলো অত্যন্ত কঠিন। এই যে ৫৩ বছরের চেষ্টা এবং তার পাশাপাশি ১৬ বছরের যে সংগ্রাম, সর্বোপরি জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে রক্তপাত ও প্রাণনাশ হয়েছে, সেগুলোর প্রতি আমাদের দায় আছে। সেই দায় এবং দায়িত্বের জায়গা থেকেই আমরা আশা করি, সবাই তাদের নিজস্ব জায়গা থেকে এই কাঠামোগত পরিবর্তনগুলো যতটা অর্জন করা সম্ভব, সেজন্য সক্রিয় থাকবেন। আশা করি, আপনাদের মতামত আমাদের সহযোগিতা করবে।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ঐকমত্যের পাশাপাশি সংস্কার প্রয়োজন। তবে নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতীত সংস্কার কর্মসূচির অগ্রসর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আগেই বলেছি, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা। আমরা চেষ্টা করব, যে জাতীয় সনদ তৈরি হচ্ছে, তার পাশাপাশি যে প্রতিবেদন আমরা তৈরি করতে চাই, সেখানে যেন এই মতামত প্রতিফলিত হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো.

আবদুল মতিন আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, অনেকে মত দেন সংবিধানে যেন হাত না দেওয়া হয়। সংবিধানে অতীতে যেসব সংশোধনী এনে সংবিধানকে অকেজো করে ফেলা হলো, তা কি আমরা দূর করব না? সংবিধান কোনো ঐশ্বরিক বাণী নয় যে, তা সংশোধন করা যাবে না। দেশে দেশে বিপ্লব হয় সংবিধানকে উপেক্ষা করে। কোনো রাজনৈতিক দল এ সরকার গঠন করেনি। করেছে যারা অভ্যুত্থানে সফল হয়েছে তারা।

আলোচনায় অংশ নিয়ে নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোকে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। তিনি বলেন, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা একটি অসাধারণ সময় ও সুযোগ পার করছেন। প্রতিটি আন্দোলনে নারীরা সামনে থেকে ভূমিকা রেখেছেন। এই ভূমিকার পর আন্দোলন শেষে তারা আবার ঘরে ফেরত গেছেন গৃহস্থালির কাজে। কিন্তু এবারই দেখা গেছে, তরুণ প্রজন্মের নারীরা প্রবল আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাজনীতিতে আসতে চাইছেন। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বার্তা দেওয়া প্রয়োজন, নারীরা রাজনীতিতে আসতে চাইছেন তাদের সেই সুযোগটা করে দিতে হবে। এ কারণে তারা দাবি করছেন, নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন পদ্ধতিতে নারীদের অংশগ্রহণে আগ্রহী করার প্রক্রিয়া থাকতে হবে।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রসঙ্গ টেনে সামিনা লুৎফা বলেন, কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে প্রচুর তর্কবিতর্ক ও আলোচনা হয়েছে। আলোচনাটা খুব জরুরি। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনসহ অন্যান্য কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে এ আলোচনা চালু থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন বলেন, জুলাই আন্দোলনে নারীদের সক্রিয়া ভূমিকা আমরা দেখেছি। অথচ সংস্কার কমিশনগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। নারী কমিশনের সুপারিশ নিয়ে নারীদের যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। আর এ ঘটনায় সরকার যেভাবে চুপ থাকল, তাতে আমরা আর আশাবাদী হতে পারি না। তিনি বলেন, নারীর প্রতি বৈষম্য এখনও প্রকট এবং রাজনৈতিক দলগুলো আগামী নির্বাচনের আগেই নারীদের বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিরা দেওয়ান বলেন, আমরা আদিবাসীরা সমাজের অনগ্রসর অংশ হিসেবে গত ৫০টি বছরই রয়ে গেছি। সংবিধান সংশোধন করে আমাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পরিচয় ও অধিকার যেন নিশ্চিত করা হয়।

আলোচনায় সুশীল সমাজের ১১ প্রতিনিধি অংশ নেন। অন্যরা হলেন– বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ও ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম ওয়ারেসুল করিম, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মির্জা এম হাসান, নারী প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আশরাফুন নাহার মিষ্টি, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা রাজিয়া।

এ সময় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ ত য় সনদ য় ঐকমত য র জন ত ত আম দ র গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

ঐকমত্য না হওয়া বিষয়গুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে: আলী রীয়াজ

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম ধাপের আলোচনায় অনেক বিষয়েই ঐকমত্য তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, বিপুল রক্তপাতের মধ্য দিয়ে আমরা এ পর্যায়ে উপনীত হয়েছি। ঐক্যের এমন সুযোগ বারবার আসবে না। একমত না হওয়া বিষয়গুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য জাতীয় সনদ প্রতিষ্ঠা করা।

রোববার সকালে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সুশীল সমাজের আলোচনায় সূচনা বক্তব্যে ড. আলী রীয়াজ এসব কথা। তিনি বলেন, প্রথম ধাপের আলোচনায় অনেক বিষয়েই ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এছাড়া যেসব বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি করা যাবে না, সেসব বিষয়ও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।

তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ প্রায় ৬ মাস হয়ে গেল। এই সময়ে ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় কিছু বিষয়ে একমত হয়েছি, আবার কিছু বিষয়ে একমত হইনি। সংস্কারের অসীম সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। মানুষের ত্যাগের প্রতি দায় ও দায়িত্বের জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছি।

আলী রীয়াজ বলেন, ঐকমত্য গঠনে শুধু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক যথেষ্ট নয়। এজন্য নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ ছাড়া সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রতির সুযোগ নেই। 

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন বিচারপতি আবদুল মতিন, ড. গীতিয়ারা নাসরীন, জেনারেল (অব) মুনীরুজ্জামান, ড. ওয়ারেসুল করিম, ড. সামিনা লুৎফা, ড. মির্জা হাসান, আশরাফুন নাহার মিষ্টি, বাসুদেব ধর, সুলতানা রাজিয়া ও ইলিরা দেওয়ান।

 

 

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নাগরিক সমাজ ছাড়া সংস্কার সম্ভব নয়: অধ্যাপক আলী রীয়াজ
  • যেসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, সেগুলোও জানানো হবে: আলী রীয়াজ
  • নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোকে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের দাবি সামিনা লুৎফার
  • ঐকমত্য না হওয়া বিষয়গুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে: আলী রীয়াজ
  • সংবিধানে হাত দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে না: মুনীরুজ্জামান
  • পুঁজিবাজার কার্যকর করতে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা
  • দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ চায় বিএনপি
  • ইউনূসের ‘পদত্যাগ’ ভাবনা, যেভাবে সংকট কাটতে পারে
  • অবিলম্বে বিচার-সংস্কার-নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ঘোষণা করুন