ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ের পরিণতি নির্যাতন, বিচ্ছেদ, মৃত্যু
Published: 22nd, June 2025 GMT
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে জানা যায়, সে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। ধর্ষণে অভিযুক্ত তরুণ একই গ্রামের। ২০২৩ সালের শুরুর দিকের এই ঘটনায় কিশোরীর পরিবার ধর্ষণের অভিযোগে ওই তরুণকে আসামি করে মামলা করে। মামলা থেকে বাঁচতে কিশোরীর সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তরুণের পরিবার। পরে তাঁদের বিয়ে হয়।
মেয়েটি প্রথম আলোকে বলে, বিয়ের পর স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে নির্যাতন করা শুরু করে। বেশ কয়েকবার মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গর্ভপাতের জন্য হাসপাতালে নিয়ে গেলে কৌশলে সে পালিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসে। দুই বছর ধরে সে সন্তানসহ বাবার বাড়িতে থাকছে। স্বামী খোঁজ নেন না। মেয়েটি বলে, ‘বাচ্চার বয়স এখন দেড় বছর। পালাইয়া আইসা বাচ্চা বাঁচাইছি। তারা কয় বাচ্চা তারার না।’
আরও পড়ুনধর্ষণ মামলার বাদীকে বিয়ে করার অনুমতি পেলেন নোবেল১৮ জুন ২০২৫ধর্ষণ ফৌজদারি অপরাধ।...যে ব্যক্তির মাধ্যমে মেয়েটিকে অপমানিত হতে হলো তার সঙ্গে বিয়ে মর্যাদাহানিকর। এসব বিয়ে টেকে না।ফওজিয়া মোসলেম, সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ওই মেয়েটিসহ একই ধরনের দুটি মামলা পরিচালনা করছিলেন সিলেটের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী বিলকিস জাহান (হলি)। গত ২১ এপ্রিল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আরেক কিশোরীকে স্ত্রী ও বড় বড় সন্তান রয়েছে এমন এক ব্যক্তি ধর্ষণ করেন। কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে মামলা থেকে বাঁচতে ওই ব্যক্তি তাকে বিয়ে করেন। পরে মেয়েটি যমজ সন্তান জন্ম দিলেও তারা বাঁচেনি। সন্তানের মৃত্যুর পর মেয়েটিকে বাসা থেকে বের করে দেন ওই ব্যক্তি।
ওই আইনজীবী বলেন, মামলা থেকে বাঁচতে ভুক্তভোগীর সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিয়ের এমন অনেক ঘটনা ঘটে। ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে হওয়া মামলা আপসযোগ্য নয়। গ্রাম্য সালিসে বা পারিবারিকভাবে সমঝোতা হলে বাদী মামলায় হাজির থাকেন না। মামলা ঝুলে যায়। সমঝোতার মাধ্যমে অভিযুক্তের সঙ্গে বিয়ের পর মেয়েগুলো নির্যাতনের শিকার হয়, বিবাহবিচ্ছেদ হয় বা বিয়ে টেকে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রথম আলো গত চার বছরের মধ্যে অভিযুক্তের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে এমন ৮ জন ভুক্তভোগী ও পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেছে। তারা সংসার তো করতে পারেনই-নি, উপরন্তু ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানের স্বীকৃতি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। একজন ভুক্তভোগী হত্যারও শিকার হয়েছেন। এছাড়া আরও ৫ জন ভুক্তভোগী ও পরিবারগুলোর সঙ্গে প্রথম আলো কথা বলেছে, যাঁরা লোকলজ্জার ভয়ে নিজেরাই অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ের মাধ্যমে সমাধান চাইছে। যে কিশোরী ও তরুণী ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছেন, তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ‘বিয়ে ছাড়া উপায় নেই’ এমন অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।
আরও পড়ুনধর্ষণ মামলার বাদীকে বিয়ে করলেন নোবেল২০ জুন ২০২৫এ ছাড়া প্রথম আলোতে ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে সাড়ে ৬ বছরের শিশু থেকে শুরু করে কিশোরী ও তরুণী ভুক্তভোগীর বিয়ের অন্তত ২০টি খবর প্রকাশ হয়। এর মধ্যে ১১টি বিয়ে টিকে না থাকার তথ্যের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। একটি ঘটনায় সংসার টিকলেও মেয়েটিকে নির্যাতন করা হয় বলে জানা গেছে। বাকি ৮টি ঘটনার বিষয়ে আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৭১টি। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ধর্ষণের মামলার তথ্য পাওয়া গেছে, সে সংখ্যা ৪ হাজার ৩৩২টি। অর্থাৎ ওই ৯ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে হওয়া মোট মামলার ৩৪ শতাংশ ছিল ধর্ষণের। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ৯ ধারা অনুসারে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড।
প্রথম আলো গত চার বছরের মধ্যে অভিযুক্তের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে এমন ৮ জন ভুক্তভোগী ও পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেছে। তারা সংসার তো করতে পারেনই-নি, উপরন্তু ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানের স্বীকৃতি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। একজন ভুক্তভোগী হত্যারও শিকার হয়েছেন।আরও পড়ুনধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে কোনো সমাধান নয়২২ ডিসেম্বর ২০২০বিয়ের পর খুন, আত্মহত্যা, খোঁজ না রাখাবছর পাঁচেক আগে দুই সন্তানের মা কুমিল্লার দাউদকান্দির শামীমা আক্তারের (২৫) বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। চার বছর আগে মাসুদ নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছিলেন শামীমা। তাঁর সঙ্গে বিয়ের সমঝোতায় জামিন পান মাসুদ। বিয়ের পর তাঁদের দুটি শিশু সন্তান হয়। গত বছরের ১৯ নভেম্বর মাসুদ এলোপাতাড়ি কুপিয়ে শামীমাকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে।
নিহত শামীমার বড় ভাই জয়নাল আবেদিন ২৩ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাসুদকে প্রধান করে ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এতদিন পেরিয়ে গেলেও মাসুদ গ্রেপ্তার হয়নি।’
জানতে চাইলে দাউদকান্দি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জুনায়েত চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে শামীমাকে তাঁর স্বামী মাসুদ সহযোগীদের নিয়ে খুন করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে।
অর্ন্তবর্তী সরকার গত ২৫ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করেছে। এতে ৯(খ) ধারা সংযোজন করে ‘বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম করিবার দণ্ড’ ধারা যুক্ত করে এটাকে ধর্ষণের মূল ধারা ৯ (ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, ইত্যাদির শাস্তি) থেকে আলাদা করা হয়েছে। সরকারের যুক্তি, এতে করে ৯ ধারায় হওয়া গুরুতর ধর্ষণের মামলার জট কমবে ও দ্রুত বিচার করা সম্ভব হবে।
প্রথম আলোতে ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে সাড়ে ৬ বছরের শিশু থেকে শুরু করে কিশোরী ও তরুণী ভুক্তভোগীর বিয়ের অন্তত ২০টি খবর প্রকাশ হয়। এর মধ্যে ১১টি বিয়ে টিকে না থাকার তথ্যের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।আরও পড়ুনধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীর বিয়ে কীভাবে সম্ভব২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ঢাকার অদূরে সাভারে বসবাস করা এক তরুণী প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, ২০১৯ সালে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের কার্যসহকারী হিসেবে কর্মরত আকতার ফারুক নামে পূর্বপরিচিত এক ব্যক্তি তাঁকে একা পেয়ে ধর্ষণ করেন। ওই সময়ে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে ওই ব্যক্তি গর্ভপাত করান। প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের কথা বলে তিনি তরুণীকে বিয়ে করতে রাজি না হলেও খরচ চালানোর টাকা দিতেন। ২০২৩ সালে মেয়েটি আবারও অন্তঃসত্ত্বা হয়ে সন্তানের জন্ম দেন। মেয়েটির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের শুরুতে তৎকালীণ স্থানীয় সংসদ সদস্য তাঁর কার্যালয়ে কাজী ডেকে তাঁদের বিয়ে পড়ান ও নিবন্ধন করান। এর এক মাস পরই তালাকের নোটিশ পাঠান আকতার ফারুক। ওই তরুণী বলেন, ফারুক সন্তানের নিয়মিত ভরণপোষণ দেন না।
ধর্ষণ ও গর্ভপাতের অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে আকতার ফারুক (৬০) প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ সদস্যের কার্যালয়ে বিয়ে নিবন্ধনের আগে ২০২১ সালে বাসায় হুজুর ডেকে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। গত বছর তিনি তালাকের নোটিশ পাঠিয়েছেন।
২০১৬ সালে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় মামলা করার পর আপসের মাধ্যমে অভিযুক্তের সঙ্গে তরুণীর বিয়ে হয়। বিয়ের চার মাসের মধ্যে আত্মহত্যা করেন ওই তরুণী।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, অভিযুক্তের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ের মাধ্যমে আইনের লঙ্ঘন করা হয়। মেয়েটিকে আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। তিনি আরও বলেন, আদালত চাইলে ভুক্তভোগীর স্বার্থে যেকোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন। তবে সেটা মেয়েটির জন্য ভালো হবে কি না, তা আগে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। মেয়েরা যেন কোনো প্রতারণামূলক সম্পর্কে না জড়ায়, সে লক্ষ্যে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে সর্তকতামূলক প্রচার বাড়ানো উচিত।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৭১টি। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ধর্ষণের মামলার যে তথ্য পাওয়া গেছে, সে সংখ্যা ৪ হাজার ৩৩২টি। অর্থাৎ ওই ৯ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে হওয়া মোট মামলার ৩৪ শতাংশ ছিল ধর্ষণের।আরও পড়ুনফেনীতে কারাফটকে বিয়ে করা ধর্ষণ মামলার আসামির জামিন৩০ নভেম্বর ২০২০বিয়ের বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত সালিসেব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় ২০১১ সালের ১৭ মার্চ অভিযুক্তের সঙ্গে মাত্র সাড়ে ৬ বছর বয়সী ভুক্তভোগী শিশুকে বিয়ে দেওয়ার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। মেয়ে সাবালিকা না হওয়া পর্যন্ত বাবার বাড়িতে থাকবে এবং এক শতক জমি মেয়ের নামে লিখে দেওয়ার শর্তে ওই বিয়ে হয়। ওই ঘটনা প্রথম আলোয় প্রকাশের পর অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
ঘটনার ১৪ বছর পর চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৩ বছর বয়স হলে ওই ব্যক্তির সঙ্গে শিশুটির বিয়ে নোটারি পাবলিক থেকে হলফনামা করা হয়। তবে স্বামী জুয়ারি হওয়ায় প্রায়ই দিন বাসায় ফেরেন না। ওই এক শতক জমি লিখে নেওয়ার জন্য স্ত্রীকে চাপ দিচ্ছেন এবং প্রায়ই মারধর করেন।
ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে এবং বাল্যবিবাহের বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়েটির বড় ভাই মুঠোফোনে ২৫ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাম্য সালিসে ‘মানবতা’ বিবেচনায় সবাই বিয়ের কথা বলছিল বলে তাঁরা রাজি হয়েছিলেন।
অভিযুক্ত ছেলের বাবাও প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন, তাঁর ছেলে জুয়ারি এবং প্রায়ই বাসায় ফেরেন না।
শুরুতে উল্লেখ করা প্রথম আলোয় প্রকাশিত ২০টি ঘটনার সবগুলো বিয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছিল গ্রাম্য সালিসে। ২০০৪ সালে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে গ্রাম্য সালিসে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়েতে বাধ্য হন পড়াশোনা জানা এক তরুণী। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমার ধর্ষক স্বামীকে শত চেষ্টা করেও স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারছি না। যখনই স্বামী হিসেবে ভাবার চেষ্টা করি, তখনই তাঁর সেই হিংস্র চেহারাটি চোখরে সামনে ভেসে ওঠে। এই মানসিক যন্ত্রণা আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে।’
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ৯ ধারা অনুসারে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড।আরও পড়ুনধর্ষণ মামলার জট কমাতে ‘বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম’ আলাদা ধারা করা হয়েছে২৮ মার্চ ২০২৫২০০৫ সালে হবিগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার কিশোরীকে তিন অভিযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে অবিবাহিত ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে গ্রাম্য সালিসে।
কখনো কখনো আদালত ‘বিয়ের শর্তে’ জামিন দেন। তবে জামিনের আদেশে ‘বিয়ের শর্ত’ বলে কিছু লেখা থাকে না। দুই পক্ষের আইনজীবীরা জানান, তাঁরা সমঝোতা করতে চাইছেন। অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগী দুজন দুজনকে বিয়ে করতে সম্মত হয়েছেন। তখন শুনানির পর আদালত জামিন দিলে সেটাকে ‘বিয়ের শর্তে জামিন’ হিসেবে মুখে মুখে বলা হয়। গত ২১ এপ্রিল হাইকোর্টের ২৯ নম্বর কোর্টে এমন এক জামিন আদেশ হয়। ওই সময় ওই আদালতে উপস্থিত এক আইনজীবী প্রথম আলোকে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এমন জামিন অহরহই হচ্ছে’।
এ ধরনের জামিনের আদেশে ২০২০ সালে কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী জেলা কারাগারের ফটকে, নাটোরের আদালত চত্বরে, রাজশাহী কারাগারের ফটকে, ২০২১ সালে ঝিনাইদহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়।
২০২২ সালের মার্চে পঞ্চগড়ে দুই সন্তানের মা বিধবা এক নারীকে (৩৭) ধর্ষণের দায়ে কারাগারে যেতে হয়েছিল পুলিশের এক উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল জলিলকে। পঞ্চগড় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের বিচারক ওই নারীকে ‘বিয়ের শর্তে’ জামিন দেন এসআইকে। আসামির প্রথম স্ত্রীও বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। ওই নারী সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামিন নিয়েই আবদুল জলিল আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। আর কোনো যোগাযোগ করেনি।’
অর্ন্তবর্তী সরকার গত ২৫ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করেছে। এতে ৯(খ) ধারা সংযোজন করে ‘বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম করিবার দণ্ড’ ধারা যুক্ত করে এটাকে ধর্ষণের মূল ধারা ৯ (ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, ইত্যাদির শাস্তি) থেকে আলাদা করা হয়েছে। সরকারের যুক্তি, এতে করে ৯ ধারায় হওয়া গুরুতর ধর্ষণের মামলার জট কমবে ও দ্রুত বিচার করা সম্ভব হবে।আরও পড়ুন‘বিয়ের প্রলোভনে যৌন সম্পর্ক’ কি শুধু পুরুষেরই অপরাধ২৩ মার্চ ২০২৫ব্যতিক্রমও রয়েছে২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক সাবেরা সুলতানা খানম দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের আয়োজনের আবেদন নাকচ করে আসামির জামিন না মঞ্জুর করেন। এই প্রতিবেদক ওই সময় আদালত কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। বিচারক বলেছিলেন, ‘সবাই মিলে কীভাবে মেয়েটিকে (১৩) প্রতিষ্ঠিত করা যায়, সেই চেষ্টা করুন। ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেবেন না। এই মেয়েটি প্রতিষ্ঠিত হলে অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়াবে।’
২০১০ সালে চাঁদপুরে ৬০ বছর বয়সী মাদ্রাসা শিক্ষক আবদুল জলিলের বিরুদ্ধে ১১ বছরের মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এতে শিশুটি অন্তঃসত্ত্বা হয়। সালিসে বিয়ের সিদ্ধান্ত হলে শিশুটির বাবা আপত্তি জানিয়ে মামলা করেন। আসামি গ্রেপ্তার হয়। ২০১৩ সালে চাঁদপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালত আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এর দুই বছর পর কারাগারে মৃত্যু হয় আসামির।
মেয়েটির বাবা ২৫ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি তাঁর মেয়ে ও মেয়ের শিশুসন্তানকে ঢাকায় নিয়ে যায়। তাঁর মেয়ে এখন বিএ পড়ছে। শিশুটিকে দত্তক দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দুই মেয়ের মধ্যে ও ছোট। মেয়েটা অনেক কষ্ট পেল। ও পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করতে চায়।’
আরও পড়ুনফেব্রুয়ারির চেয়ে মার্চে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি৩১ মার্চ ২০২৫‘বিয়ে নয়, ধর্ষকের সাজা নিশ্চিত জরুরি’বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণ ফৌজদারি অপরাধ। তাই ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে দিতে স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ দেওয়ার পরিবর্তে আদালতের উচিত ধর্ষকের সাজা নিশ্চিত করা। যে ব্যক্তির মাধ্যমে মেয়েটিকে অপমানিত হতে হলো তার সঙ্গে বিয়ে মর্যাদা হানিকর। এসব বিয়ে টেকে না। নিজের অধিকার পেতে হলে মেয়েদেরও দায়িত্ব ও মর্যাদা নিয়ে সচেতন হতে হবে। প্রতারণার ফাঁদের ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, ভৈরব, প্রতিনিধি চাঁদপুর, পঞ্চগড় ও সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ২০২৪ স ল ব য় র পর শ ক র হয় আইনজ ব হয় ছ ল কর ছ ন আস ম র র পর ব পর ব র অন স র প রক শ র জন য সরক র বছর র র বয়স উপজ ল অপর ধ সমঝ ত
এছাড়াও পড়ুন:
সজলকে ধরে রাখে রনি, পরে একটি গুলির শব্দ পাই
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকার অদূরে আশুলিয়া থানার সামনে সাজ্জাদ হোসেন সজলকে আওয়ামী লীগ (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) নেতা রনি ভূইয়া ধরে রাখেন বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন সাক্ষী মো. শাহরিয়ার হোসেন। তিনি বলেন, পরদিন (২০২৪ সালের ৬ আগস্ট) তিনি খবর পান, তাঁর বন্ধু সজলের লাশ আশুলিয়া থানার সামনে পাওয়া গেছে।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় আশুলিয়ায় সজলসহ ছয়জনের লাশ পোড়ানোর ঘটনায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২২তম সাক্ষী হিসেবে শাহরিয়ার হোসেন জবানবন্দি দিয়েছেন। আজ বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ তিনি এ জবানবন্দি দেন।
সাভারে স্টার্লিং গার্মেন্টসে চাকরি করা শাহরিয়ার হোসেনের বন্ধু ছিলেন সজল। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা করে জবানবন্দিতে শাহরিয়ার হোসেন বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট সকালে বাইপাইল মোড় এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। সেদিন বেলা আড়াইটায় শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে তাঁরা বিজয় মিছিল করছিলেন। ওই সময় তাঁরা আশুলিয়া থানার দিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পান।
তখন বিজয় মিছিল নিয়ে আশুলিয়া থানার দিকে যান উল্লেখ করে জবানবন্দিতে শাহরিয়ার হোসেন বলেন, থানার সামনে পুলিশের কয়েকজন সদস্য অবস্থান করছিলেন। সজল তাঁর আগেই থানার সামনে চলে যান। তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন, সজলকে আওয়ামী লীগ নেতা রনি ভূইয়া ধরে আছেন। ছেড়ে দিতে বললে সজলকে ছেড়ে তাঁকে ধরেন রনি। তারপর তিনি দেখেন, পেছনে একজন বন্দুকের গুলি লোড করছিলেন। তিনি তখন বন্ধু সজলকে সেখান থেকে সরে যেতে বলেন। তারপর তাঁরা একটি গুলির শব্দ পান।
জবানবন্দিতে শাহরিয়ার হোসেন বলেন, গুলির শব্দ শুনে তিনি সেখানকার এসএ পরিবহন অফিসমুখী রাস্তার দিকে যান। অল্প কিছু দূর যাওয়ার পর তিনি পড়ে যান। তখন দেখেন, তাঁর পায়ে ছিটা গুলি লেগেছে। সামনে একটি বাসার গেট খোলা পেয়ে ভেতরে চলে যান তিনি। সেখান থেকে সেদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে বের হওয়ার সময় থানার সামনে পুলিশের একটি পিকআপ গাড়িতে কয়েকটি লাশ পোড়ানো দেখেন।
এজলাস থেকে বেরিয়ে যান এক প্রসিকিউটরজবানবন্দি শেষে আজ সাক্ষী শাহরিয়ার হোসেনকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। তাঁকে এ মামলার আসামি আবদুল্লাহিল কাফীর আইনজীবী সৈয়দ মিজানুর রহমান প্রশ্ন করেন, গত বছরের ৫ আগস্ট বেলা আড়াইটার সময় ওভারপাসে (আশুলিয়া থানার কাছে) পুলিশের দুজন কর্মকর্তার লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেছেন।
এর জবাবে সাক্ষী শাহরিয়ার বলেন, তিনি দেখেননি।
আইনজীবী মিজানুরের এমন প্রশ্নের প্রতিবাদ জানান প্রসিকিউটর মো. আবদুস সোবহান তরফদার। তিনি বলেন, পুলিশের দুজন কর্মকর্তার লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল, এটিই প্রতিষ্ঠিত নয়। ফলে এই সাক্ষীর কাছে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই যে পুলিশের দুজন কর্মকর্তার লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেছেন কি না।
তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট বেলা আড়াইটার সময় ওভারপাসে পুলিশের দুজন কর্মকর্তার লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেননি—এ কথা সাক্ষী বলেছেন। এর মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় না যে সেখানে কোনো লাশ ছিল।
ট্রাইব্যুনালের কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি প্রসিকিউটর আবদুস সোবহান তরফদার। পাল্টাপাল্টি যুক্তির একপর্যায়ে প্রসিকিউটর সোবহান এজলাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, সেটি প্রসিকিউটর সোবহানের ইচ্ছা। এরপর এজলাস থেকে বেরিয়ে যান প্রসিকিউটর সোবহান।
এ ঘটনার ১০–১৫ মিনিট পর এজলাসে প্রবেশ করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তখন আরও কিছু প্রশ্ন করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী এবং সেসবের জবাবও দেন সাক্ষী।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান প্রশ্ন করেন, ৫ আগস্ট বেলা ৩টার পর আশুলিয়া থানা লুট হতে দেখেছেন কি না?
এর জবাবে সাক্ষী শাহরিয়ার বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
পরে আইনজীবী মিজানুর প্রশ্ন করেন, আশুলিয়া থানায় অগ্নিসংযোগ হতে দেখেছেন কি না?
সাক্ষী শাহরিয়ার জবাব দেন, তিনি থানায় অগ্নিসংযোগ হতে দেখেননি।
তখন চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আশুলিয়া থানায় অগ্নিসংযোগ বা লুট হয়েছে কি না, সেই বিষয় এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে সাক্ষীকে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই যে থানা লুট বা অগ্নিসংযোগ হয়েছে কি না। এসব মিসলিডিং কোয়েশ্চেন।
চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্য আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। আসামিপক্ষের আইনজীবীর আশুলিয়া থানা লুট বা অগ্নিসংযোগ–সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো আমলে নেননি ট্রাইব্যুনাল।
আশুলিয়া থানা–সংলগ্ন ওভারপাসে পুলিশের দুজন কর্মকর্তার লাশ ঝুলে থাকার বিষয়ে প্রশ্নেও তখন ট্রাইব্যুনাল পরিবর্তন আনেন। সাক্ষী বলেছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট ওভারপাসে পুলিশের কোনো কর্মকর্তার লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেননি—এভাবে প্রশ্নের জবাব গ্রহণ করা হয়।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ মামলাটির বিচার চলছে। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারক মো. মঞ্জুরুল বাছিদ ও বিচারক নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
এক আ. লীগ নেতাকে ২৭ নভেম্বর হাজিরের নির্দেশজুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় ময়মনসিংহের গৌরীপুরে তিনজনকে হত্যায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা তানজির আহমেদকে (রাজীব) ২৭ নভেম্বর হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল এই আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল–২।
তানজির ইতিমধ্যে অন্য একটি মামলায় গ্রেপ্তার আছেন। ২৭ নভেম্বর আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা শাহাবুল আলম, মো. জোসেফ উদ্দিন জজ ও মো. আতাউর রহমানকেও প্রথমবারের মতো হাজির করা হবে। তাঁরা ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
এ ছাড়া এই মামলায় পুলিশের সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) শফিকুল আলম ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) দেলোয়ার হোসেন গ্রেপ্তার আছেন।
শিবির নেতাকে গুলির ঘটনায় প্রতিবেদন দাখিলের সময় বাড়ল
২০১৬ সালে যশোরের চৌগাছায় ছাত্রশিবিরের দুজন নেতার পায়ে গুলি করার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আগামী বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করা হয়েছে। গতকাল ট্রাইব্যুনাল–১ এই দিন ধার্য করেন।