ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোথায় বাধা
Published: 22nd, September 2025 GMT
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন বহু দশক ধরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়াও চলছে বহু দশক ধরে। ১৯৪৫ সালের পর জাতিসংঘের ১৪০টির বেশি সদস্যরাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। তার এ অবস্থান শুধু ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সম্পর্ককেই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত ভূরাজনীতি, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান মূলত ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ নীতির ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি পক্ষের মধ্যে সরাসরি আলোচনা ও চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত স্বীকৃতি, ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবির পক্ষে পদক্ষেপ না নেওয়া, সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে সামরিক–অর্থনৈতিক দিক থেকে তার সহায়তা করা মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক।
যুক্তরাষ্ট্রের এ পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান পশ্চিমা ও আরব জোটের মধ্যেও বিভাজন বাড়িয়েছে, শান্তিপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আন্তর্জাতিক মর্যাদা সীমিত করেছে। বিপরীতে, ইসরায়েলকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একগুঁয়ে ও বেপরোয়া রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এ নীতি।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের অবস্থান
২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে ‘সদস্যবহির্ভূত পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৩৮টি দেশ ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ অর্জনের প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা হয়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা ভেটো দিয়ে থামায়।
পরবর্তী মাসে (মে ২০২৪) সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রস্তাব পাস হয়। এ প্রস্তাব ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের ‘পূর্ণ সদস্য হওয়ার যোগ্য’ হিসেবে বিবেচনা ও নিরাপত্তা পরিষদকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহী হতে বলে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৪৭টি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদ এখনো হয়নি ফিলিস্তিনের। চলতি সপ্তাহে শুরু হতে যাওয়া সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আরও কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে চলেছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র এতে খুশি নয়।
ঐতিহাসিক পটভূমি: ‘দুই রাষ্ট্রের সমাধান’
বিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে ‘দুই রাষ্ট্রের সমাধান’ ফিলিস্তিন–ইসরায়েল শান্তিপ্রক্রিয়ার মূল কাঠামো হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রশাসন মূলত এই নীতিকে সমর্থন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বলে এসেছে যে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে হতে হবে, একতরফা বা আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমে নয়।
১৯৪৮ সালে দখলদার ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা, ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধ ও ১৯৯৩ সালের অসলো শান্তিচুক্তি—সব মিলিয়ে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানের’ রূপরেখা তৈরি হয়েছে।
মার্কিন প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের দাবি, একতরফাভাবে স্বীকৃতি শান্তি আলোচনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে, ‘উগ্রপন্থী’ গোষ্ঠীকে উৎসাহিত করতে পারে এবং সীমান্ত, নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক অচলাবস্থা তৈরি করতে পারে।
ফিলিস্তিনি জনগণও সমান অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের যোগ্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েল কৌশলগত সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্রের ফিলিস্তিন নীতি প্রায়ই তার ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক দিয়ে প্রভাবিত। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর যুক্তরাষ্ট্র সেনা সাহায্য, উন্নত অস্ত্র সরবরাহ, গোয়েন্দা তথ্য ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে এসেছে দেশটিকে।
এই সমর্থনের মধ্যে শুধু মার্কিন অস্ত্র বিক্রি নয়; ইসরায়েলকে সাইবার নিরাপত্তা, সামরিক প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধকৌশলীয় পরামর্শ প্রদানও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, একতরফা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে ইসরায়েলের সঙ্গে এ কৌশলগত জোটে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ লক্ষণ তৈরি হতে পারে। ইসরায়েলপন্থী লবিগুলো, যেমন ‘এআইপিএসি’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে এমন পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত রাখে।
ফিলিস্তিন সরকারের সক্ষমতা
যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের সক্ষমতা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করে। দেশটির যুক্তি, ফাতাহ (পশ্চিম তীর) ও হামাসের (গাজা) মধ্যে বিভাজন ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির জন্য উপযুক্ত নয়। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে মনে করে।
গাজা ও পশ্চিম তীরে প্রশাসনিক অচলাবস্থা, মানবিক সংকট, বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের অভাব—এসবও ফিলিস্তিনকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হতে ব্যর্থ করবে বলে বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের। এর ফলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও ফিলিস্তিনের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা চ্যালেঞ্জপূর্ণ হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান পশ্চিমা ও আরব জোটের মধ্যেও বিভাজন বাড়িয়েছে, শান্তিপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আন্তর্জাতিক মর্যাদা সীমিত করেছে।আন্তর্জাতিক আইন ও আদালতের প্রভাব
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) ২০২৪-এর পরামর্শমূলক রায় হলো, ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি অঞ্চল (গাজা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম) দখল করা অবৈধ। ইসরায়েলকে দ্রুত এ দখল ছাড়তে হবে। আবার দখলকৃত স্থানে ইহুদি বসতি নির্মাণ, এর সম্প্রসারণ ও শিক্ষানীতি বৈধ নয়।
এদিকে ২০১৫ সালে রোম সনদে স্বাক্ষর করেছে ফিলিস্তিন। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের এখতিয়ার দিয়েছে।
এসব আইনি ভিত্তি শক্তিশালী হলেও ফিলিস্তিনকে কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাধা এখনো রয়ে গেছে।
ইসরায়েলের দখলকৃত জেরুজালেমে বিশ্ব মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ আল–আকসা.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র প রক র য ইসর য় ল অবস থ ন সদস য র ইসর ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
কর্মী ভিসায় ট্রাম্পের ফি আরোপে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কোন দেশ
দক্ষ কর্মী ভিসার ওপর প্রতিবছর ১ লাখ ডলার ফি আরোপ করে গতকাল শুক্রবার একটি নির্বাহী আদেশে সই করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এইচ-১বি ভিসার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষ কর্মী নেওয়া হয়। এই ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ সিদ্ধান্তে কয়েকটি দেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এইচ-১বি ভিসার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী দেশ ছিল ভারত। ২০২৪ সালে এই ভিসার ৭১ শতাংশ সুবিধা নিয়েছেন ভারতীয় নাগরিকেরা। ভারতের পরেই আছে চীন। যদিও সংখ্যার হিসাবে দেশটি ভারতের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে। ১১ দশমিক ৭ শতাংশ সুবিধা ভোগ করে চীন দ্বিতীয় স্থানে ছিল।
এ বছরের প্রথমার্ধে অ্যামাজন ডটকম ও প্রতিষ্ঠানটির ক্লাউড কম্পিউটিং ইউনিট এডব্লিউএস ১২ হাজারের বেশি এইচ-১বি ভিসা অনুমোদন পেয়েছে।
সব বড় বড় প্রতিষ্ঠানই এইচ-১বি ভিসার জন্য বছরে ১ লাখ ডলার ফি দেওয়ার এই সিদ্ধান্তে সমর্থন দিয়েছেহাওয়ার্ড লুটনিক, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রীএকই সময়ে মাইক্রোসফট ও মেটা প্ল্যাটফর্ম—প্রত্যেকে পেয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি এইচ-১বি ভিসার অনুমোদন।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক শুক্রবার বলেন, সব বড় বড় প্রতিষ্ঠানই এইচ-১বি ভিসার জন্য বছরে ১ লাখ ডলার ফি দেওয়ার এই সিদ্ধান্তে সমর্থন দিয়েছে।
লুটনিক বলেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি।’
এ বিষয়ে জানতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি বৃহৎ প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু তারা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে অথবা মন্তব্যের অনুরোধে তৎক্ষণাৎ সাড়া দেয়নি।
গত বছর এইচ-১বি ভিসার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী দেশ ছিল ভারত। ২০২৪ সালে এই ভিসার ৭১ শতাংশ সুবিধা নিয়েছেন ভারতীয়রা। ভারতের পরেই আছে চীন।ভারত-চীনের কী প্রতিক্রিয়া
দক্ষ কর্মী ভিসার বিষয়ে ট্রাম্পের নতুন নির্বাহী আদেশ নিয়ে এখন পর্যন্ত ভারত বা চীন কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য অনুরোধ জানিয়ে রয়টার্স থেকে ওয়াশিংটনে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসে এবং নিউইয়র্কে অবস্থিত চীনা কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কোথাও থেকে সাড়া মেলেনি।
তবে চাকরির বাজারে এর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান কগনিজ্যান্ট টেকনোলজি সলিউশনস করপোরেশনের শেয়ারের মূল্য প্রায় ৫ শতাংশ পড়ে গেছে। তথ্যপ্রযুক্তি পরামর্শ ও আইটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপকভাবে এইচ-১বি ভিসাধারী কর্মীদের ওপর নির্ভরশীল।
গত বছর চীন থেকেও অনেক কর্মী যুক্তরাষ্ট্র গেছেন