স্থানীয় বাসিন্দাদের চাপে ফেলে কৃষিজমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে রিসোর্ট। অথচ জমির মালিকদের অনেককে এখনো দাম পরিশোধ করা হয়নি। জনবহুল এলাকায় গড়ে তোলা রিসোর্টটির ফায়ার সার্ভিসের হালনাগাদ লাইসেন্স (অনুমোদন) নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও মেয়াদোত্তীর্ণ। অনুমোদনের সময় দেওয়া অনেক শর্তও মানা হচ্ছে না।

মানিকগঞ্জে অবস্থিত ‘ডেরা রিসোর্ট ও স্পা’ নামের বিলাসবহুল রিসোর্ট সম্পর্কে জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে এ কথাগুলো বলা হয়েছে। সম্প্রতি তদন্ত কমিটি জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন দেয়। পরে তা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। জেলার ঘিওর উপজেলার পুরানগ্রাম এলাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া লাইসেন্সটিও মেয়াদোত্তীর্ণ। গত বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব শেখ রাশেদউজ্জামান স্বাক্ষরিত চিঠিতে রিসোর্টটির বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

২০২২ সালের ৫ জুলাই উদ্বোধন করা হয় এই বিনোদন ও অবকাশযানকেন্দ্রটি। তবে এখনো জমির মালিকদের অনেকেই জমির মূল্য পাননি। বিনোদনকেন্দ্রটিতে মাদক সেবন ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ করে জেলা প্রশাসনকে স্মারকলিপিও দেন এলাকাবাসী। এ নিয়ে গত ৩ মার্চ ‘চাপে ফেলে জমি ক্রয়, কৃষকেরা পাননি টাকা’ শিরোনামে প্রথম আলোতে সংবাদ ছাপা হয়। পরে অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ নাজমুল হাসান খানকে প্রধান করা হয়।

এশিউর গ্রুপের মালিকাধীন এই রিসোর্টে অবকাশযাপনের জন্য বিভিন্ন কটেজ, সুইমিং, স্পা, রেস্তোরাঁ, খেলার মাঠ ইত্যাদি রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা আয়োজনে ভেন্যু হিসেবেও ডেরা রিসোর্ট ব্যবহৃ হয়। এর মালিক তিনজন বলে জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তাঁরা হলেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.

শেখ সাদী, চেয়ারম্যান জেসিয়া আফরিন ও পরিচালক (উন্নয়ন) মো. রবিউল ইবনে কামরুল।

শেখ সাদী এশিউর গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক। তবে তিনি আগে কুষ্টিয়া-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের আত্মীয় পরিচয় দিতেন বলে তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শেখ সাদীর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ধরেননি। রিসোর্টের ব্যবস্থাপক (অপারেশন) ওমর ফারুক বলেন, ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্সের আবেদন করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করা হবে। জমির মালিকদের কে কত টাকা পাবেন, তা তিনি জানেন না। মালিকেরা তাঁকে জানাননি।

জমির মূল্য পাননি মালিকেরা
গত ২৯ এপ্রিল জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির সদস্যরা উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে দিনব্যাপী জমির মালিক এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেন। তদন্তের শুরুতে জমির মালিকেরা ও এলাকাবাসী ডেরা রিসোর্টের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেন। তাঁরা ডেরা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ রিসোর্টটির কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানান। পরে কমিটির সদস্যরা জেলা প্রশাসক মানোয়ার হোসেন মোল্লার কাছে তদন্তের প্রতিবেদন জমা দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০-১১ সালের দিকে চাপে ফেলে শুরুতে গরুর খামার স্থাপনের নামে কৃষকদের কাছ থেকে জমি নেওয়া হয়। পরে কৃষকদের চাপে ফেলে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে জমি দখলে নেওয়া শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। একপর্যায়ে মাটি ফেলে তিন ফসলি জমি ভরাট করে চারদিকে নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে রিসোর্টের নির্মাণকাজ করে কর্তৃপক্ষ।
এই কৃষকদের অনেকেই এখনো জমির মূল্য পাননি। বেশ কয়েকজন জমির মালিক বলেছেন, উল্টো মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। স্থানীয় ইসমাইল হোসেন ও তাঁর তিন ভাইয়ের ১৩ শতক, আবদুর রাজ্জাকের ৪৫ শতক, ফজলুল দেওয়ানের প্রায় ৪ শতক জমির মূল্য এখনো পাননি। এ ছাড়া স্থানীয় আরও বেশ কয়েকজনের জমি রিসোর্ট দখল করে রেখেছেন, যার মূল্য তাঁরা এখনো পাননি।

রিসোর্টের উত্তর-পূর্ব পাশে একটি সেতু রয়েছে। সেতুর নিচে মাটি ফেলে তা ভরাট করায় পানিনিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে দিয়েছে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ। এতে আশপাশের বিপুল কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

পরিবেশের ছাড়পত্র নেই
২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর রিসোর্টের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০টি শর্ত আরোপ করে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ গত বছরের ২৫ জুন সেই ছাড়পত্র নবায়ন করা হয়। মেয়াদ ছিল গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি দল প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করে। তখন দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ছাড়পত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও নবায়নের কোনো আবেদন দাখিল করা হয়নি। পরিবেশগত ছাড়পত্রের শর্ত অনুযায়ী এসটিপি (পয়ঃশোধন কেন্দ্র) নির্মাণ করা হয়নি। এ ছাড়া অনুমোদিত নকশার তুলনায় কক্ষসংখ্যা বেশি।

এ বিষয়ে গত ৯ ফেব্রুয়ারি ডেরা কর্তৃপক্ষকে লিখিত নোটিশ দেওয়া হয়। ২৩ মার্চ ডেরা কর্তৃপক্ষ নোটিশের যে জবাব দিয়েছে, তা সন্তোষজনক নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ছাড়পত্র নবায়ন ছাড়া প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং শর্তভঙ্গের কারণে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের সদর দপ্তরের এনফোর্সমেন্ট শাখায় গত ২৮ জুলাই নথি পাঠানো হয়েছে।

নবায়ন নেই ফায়ার লাইসেন্স
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত রিসোর্টটির ফায়ার লাইসেন্সের মেয়াদ ছিল। লাইসেন্সে ৪০ হাজার বর্গফুটের অনুমোদন থাকলেও প্রতিষ্ঠানের আয়তন বেশি, যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অগ্নিপ্রতিরোধ, অগ্নিনির্বাপণ ও জননিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালকের অনুমোদন গ্রহণ এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভিন্ন সময় ডেরা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে।

অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন–২০০৩ অনুযায়ী রিসোর্টের ফায়ার লাইসেন্সটি দুই বছর ধরে নবায়ন করা হয়নি। ফায়ার লাইসেন্স নবায়নের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো আবেদন না করে রিসোর্টটি সরকারি বিধি লঙ্ঘন করে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
জেলা প্রশাসক মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার চিঠি তিনি পেয়েছেন। এ ব্যাপারে দ্রুত সময়ের মধ্যে রিসোর্টটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ইন্তাজ উদ্দিন বলেন, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিন ফসলি কৃষিজমি নষ্ট করে রিসোর্ট স্থাপন করা হয়েছে। কৃষিজমি বিনষ্টের পাশাপাশি স্থানীয় জনসাধারণের প্রশান্তি বিঘ্ন না করে এটি অন্য কোনো পর্যটন এলাকায় নির্মাণ করা সমীচীন ছিল।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ছ ড়পত র ব যবস থ শ সন র র জন য র অন ক অন ম দ গ রহণ বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

আলোচনার জন্য মির্জা ফখরুলকে জামায়াত নেতা তাহেরের ফোন

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে আলোচনার জন্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ফোন করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। বিএনপির মহাসচিব বিষয়টি নিয়ে দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বলেছেন। বৃহস্পতিবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে তুলেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

এর আগে বিকেলে জামায়াত নেতা আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ফোন করে আলোচনায় বসার বিষয়ে কথা বলেছেন। বিএনপির মহাসচিব দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে এ বিষয়ে তাঁদের জানাবেন বলে জানিয়েছেন।

গত ২৮ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রস্তাব জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের সঙ্গে ওই প্রস্তাবের তফসিলে উল্লেখিত সনদের নানা অসংগতি রয়েছে জানিয়ে তাতে আপত্তি তুলেছে বিএনপি। এ ছাড়া সনদ বাস্তবায়নে গণভোট কবে হবে, তা নিয়েও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে।

বিএনপি সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট করার পক্ষে। অপর দিকে জামায়াতে ইসলামী চায়, আগে গণভোট করে জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার পর তার আলোকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে জুলাই সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে সমাধানে পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত রোববার উপদেষ্টা পরিষদের এক সভা থেকে বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলো যদি এক সপ্তাহের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে না পারে, তাহলে সরকার তার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভা

বিএনপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, তারেক রহমানের সভাপতিত্বে রাতে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে দীর্ঘ ও বিস্তারিত আলোচনা শেষে কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টসহ (ভিন্নমত) যেসব বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ১৭ অক্টোবর যে জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে, তার অংশীদার হিসেবে সনদে বর্ণিত সব বিষয় ধারণ করে বিএনপি। দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী তা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ দলটি।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সর্বসম্মতভাবে গৃহীত জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে নতুন প্রশ্ন কিংবা সংকট সৃষ্টির সব অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে বিএনপি। দলটি মনে করে, দীর্ঘ আলোচনায় উপনীত ঐকমত্য বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং কোনো মতেই নিত্যনতুন প্রশ্ন উত্থাপন কিংবা সংকট সৃষ্টি করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করবে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জুলাই জাতীয় সনদের যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তার আইনানুগ বাস্তবায়নের জন্য এবং যথাসময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্তরিক ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ