নিকট প্রতিবেশী উত্তর-পূর্ব ভারত ভ্রমণ
Published: 17th, October 2025 GMT
আমাদের অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত ভিন্ন ভূগোলের রাজ্যগুলোতে বেড়াতে যাবার, আদর করে যাদের ‘সাত বোন’ নামে ডাকা হয়ে থাকে। তো, এই সপ্ত ভগিনীর দুইজন, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের মুখদর্শন হয়েছিল আমাদের আগেই। আর, বাড়ির পাশের মিজোরামকেও উঁকি মেরে কিঞ্চিৎ দেখে নেওয়া গিয়েছিল ইতঃপূর্বে সাজেক ভ্রমণের সময়।
হাতে রইল আর চার রাজ্য: অরুণাচল, আসাম, নাগাল্যান্ড ও মণিপুর। আদতে, এই চার বোনের দেখা পেতেই, আমরা ক’জন সমমনা ভ্রমণসঙ্গী মিলে ২০১৯ সালের অক্টোবরের শুরুতে বেরিয়ে পড়েছিলাম প্রায় তিন সপ্তাহের এক দীর্ঘ সফরে। গল্পে গানে কবিতায়, আহারে ও বিহারে, হাসি ও ঠাট্টায়, প্রাপ্তির উচ্ছ্বাস ও প্রত্যাশাভঙ্গের বেদনায়, ক্ষণিকের অভিমান ও বন্ধুত্বের অমলিন উষ্ণতায়, সর্বোপরি সৌন্দর্যসান্নিধ্যের বিস্ময় ও মুগ্ধতায় এক অন্যরকম অপার্থিব আনন্দে কেটে গিয়েছিল আমাদের সেই স্মরণীয় ভ্রমণের দিনগুলো। এখানে, রাইজিংবিডি’র ভ্রমণপ্রিয় পাঠকদের জন্য পর্বে পর্বে লিপিবদ্ধ করে রাখলাম আমাদের সেই অসামান্য পর্যটন অভিজ্ঞতার একখানি চকিত সারসংক্ষেপ।
আগরতলায় প্রবেশ ও ইম্ফলে প্রস্থান
আমরা তিনজন: আমি, জীবনসঙ্গিনী মাহীয়া ও বিশ্বপর্যটক বন্ধু মধুমিতা, ভ্রমণ শুরু করেছিলাম স্থলপথে; আখাউড়া সীমান্ত হয়ে আগরতলার ভেতর দিয়ে। সেখানে, শহরের প্রান্তে, নির্জন, নিরিবিলি এক হোম স্টে’তে রাত কাটিয়ে পরদিন দুপুরে আগরতলা বিমানবন্দর থেকে আমরা উড়াল দিই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবরঞ্জিত ও নেতাজির শেষজীবনের স্মৃতিবিজড়িত মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের উদ্দেশে।
সেখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন অপর চার ভ্রমণসঙ্গী, স্থপতিত্রয়ী জেরিনা হোসেন, আবু ইমামউদ্দিন, হোসনে আরা ও চাটগাঁর বিশিষ্ট চা-বিশারদ মাহমুদ হোসেন মুরাদ। ইম্ফলে আমাদের প্রথম সন্ধ্যাটি কাটে বিশ্বের সর্ববৃহৎ নারী পরিচালিত বাজার ‘ইমা কেইথাল’ পরিদর্শন করে, যেখানে প্রায় পাঁচ হাজার নারী প্রতিদিন অত্যন্ত পেশাদারভাবে জগতের তাবৎ পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে সানন্দে ও নির্ভয়ে তাদের বাণিজ্য পরিচালনা করেন। এটি স্বচক্ষে অবলোকন করা ছিল সত্যি এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
এরপর, কাছেই একখানি সাদামাটা রেস্তোরাঁয় মণিপুরের ঐতিহ্যবাহী খাবার খেয়ে, আমাদের ডেরা ‘হোটেল ক্লাসিক গ্রান্দে’ ফিরে গানে, গল্পে, কবিতায় মহানন্দে উদ্বোধন করা হয় মোহনীয় এক ম্যারাথন নৈশআড্ডামালার।
মণিপুরে প্রথম পূর্ণাঙ্গ দিন
দিনটি বেশ ঘটনাবহুলই ছিল বলা চলে। সকালে দলবেঁধে হোটেল-রেস্তোরাঁর সমৃদ্ধ বুফেতে সৌজন্যমূলক প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম দিনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে। প্রথম বিরতি ইম্ফল ওয়ার সেমেটারিতে, যেটি দেখতে ছিল অনেকটা আমাদের চাটগাঁরটির মতোই।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ নারী পরিচালিত বাজার ‘ইমা কেইথাল’
সেখানে খানিকটা সময় কাটিয়ে আমরা চলে গেলাম মণিপুর রাজন্যের প্রাচীন দুর্গপ্রাসাদ ‘কাংলা ফোর্ট’ পরিদর্শনে। বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই দুর্গ আঙিনা ঘুরে দেখতে আমরা তাই একখানা চতুশ্চক্রযান ভাড়া করে ফেলি। তাতে চড়ে বেশ আয়েশ করেই গোটা অঙ্গন ঘুরে দেখে মণিপুর রাজ্যের সুপ্রাচীন ইতিহাসের একটি চকিত পাঠ নেওয়া গেল। সেখান থেকে গিয়েছিলাম ঐতিহ্যবাহী গোবিন্দজির মন্দিরে, মূলত বিশুদ্ধ নিরামিষ ভোজনের লোভে। কিন্তু আমরা গিয়ে পৌঁছানোর আগেই ভোজনপর্ব সাঙ্গ হওয়াতে অগত্যা মন্দির দর্শনশেষে একটি চৈন রেস্তোরাঁতেই মধ্যাহ্নভোজন সারতে হলো।
আহার শেষে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিলো জওহরলাল নেহেরু মণিপুর ডান্স একাডেমি। উদ্দেশ্য, ইম্ফলের স্বনামধন্য নাট্যকেন্দ্র ‘কলাক্ষেত্র’ প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন এবং এর প্রতিষ্ঠাতা, কিংবদন্তিতুল্য নাট্যব্যক্তিত্ব হাইসনাম কানহাইলালের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে আয়োজিত, তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরি হাইসনাম তোম্বা নির্দেশিত নতুনতম নাটক, ‘ইয়ামাতা আমাসুং কেইবু কেইঐবা’র প্রারম্ভিক প্রদর্শনী অবলোকন। যুগপৎ মণিপুরি ও জাপানি উপকথা আশ্রিত নিরীক্ষাধর্মী নাটকটি উপভোগের পাশাপাশি, সেদিনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল নাটক শেষে কানহাইলালের সাধনসঙ্গিনী, সর্বজনশ্রদ্ধেয় নাট্যাভিনেত্রী ইমা সাবিত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলাপচারিতা।
বুকভরা তৃপ্তি নিয়ে হোটেলে ফিরে আসার একটু পরেই পূর্বের কথামতো, একখানি ঐতিহ্যবাহী মণিপুরি পুতুল হাতে, আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন প্রতিভাবান তরুণ চলচ্চিত্রকার পবন হাওবাম। তিনি পরদিন ভোরেই বিশ্বখ্যাত ইয়ামাগাতা প্রামাণ্যচিত্র উৎসবে যোগ দিতে জাপান চলে যাবেন বলে লবিতে দাঁড়িয়েই সংক্ষিপ্ত আলাপ হলো তাঁর সঙ্গে। রাতে হোটেলের উল্টো দিকের ঝুপড়িতে বসে গরম গরম রুটি-তড়কা আর সবজি-মাংসের নৈশাহার শেষে যথারীতি ঘরোয়া আড্ডায় মেতে উঠি আমরা। আর এর মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটে মণিপুর রাজ্যে আমাদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ, মনোরম দিনটির।
ইম্ফলে দ্বিতীয় দিবস
সকালে যথারীতি দলবেঁধে প্রভূত খুঁনসুটি ও কলহাস্যসমেত উপাদেয় বুফে ব্রেকফাস্ট সেরে, হোটেল লবিতে আরও খানিকটা গল্পগুজব করে অবশেষে বেরিয়ে পড়া গেল দিনের প্রথম কর্মসূচি― বর্তমান ভারতের অন্যতম প্রধান ও নন্দিত নাট্যনির্দেশক, প্রবীণ নাট্যজন রতন থিয়ামের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎ ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত, পরিচালিত বিশ্বখ্যাত নাট্যাঙ্গন ‘কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার’ দর্শনের উদ্দেশ্যে।
ভারতের সর্ববৃহৎ মিষ্টি পানির হ্রদ ‘লকটাক’
ইম্ফল শহরের প্রান্তসীমায় অবস্থিত কোরাসের বিশাল, বিস্তীর্ণ ও অপূর্ব নান্দনিক ক্যাম্পাস দেখে তো আমরা রীতিমত স্তম্ভিত! দূরদর্শী ও স্বাপ্নিক রতন থিয়াম মাত্র আটাশ বছর বয়সে ১৯৭৬ সালে তাঁর এই স্বপ্নের চারাটি রোপণ করেছিলেন, যা আজ ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়ে বিশ্বনন্দিত এক নাট্য নন্দনকাননে পরিণত হয়েছে। পুরো অঙ্গন ঘুরে দেখার পর আমরা এর প্রাণপুরুষ রতন থিয়ামের সঙ্গে মিলিত হই চমৎকার এক ছায়াসুনিবিড় উন্মুক্ত আঙিনায়। সেখানে তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তাঁর এই নাট্যাঙ্গন নির্মাণের উদ্দেশ্য ও অভিজ্ঞতা, সর্বোপরি তাঁর দীর্ঘ দিনের অর্জিত নাট্যভাবনা ও দর্শনবিষয়ে মন খুলে কথা বলেন, আমরা যা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাই গভীর মনোযোগে। তাঁর এই মূল্যবান নাট্যালাপের একপর্যায়ে প্রায় বেরসিকের মতোই আমাদের গাত্রোত্থান করতে হলো পরবর্তী গন্তব্যের টানে। তবে, তার আগে জগদ্বিখ্যাত এই নাট্যগুরুর সঙ্গে এবং তাঁর সৃষ্ট শিল্পাঙ্গনের কিছু ছবি তুলে নিতে ভুলিনি আমরা।
পরবর্তী কর্মসূচি উত্তর-পূর্ব ভারতের সর্ববৃহৎ মিষ্টি পানির হ্রদ ‘লকটাক’ ভ্রমণ, যা বিশ্বময় পরিচিতি পেয়েছে হ্র্রদের ওপর জৈববস্তু দ্বারা গঠিত, অগুনতি ভাসমান ক্ষুদ্রাকার দ্বীপভূমিসমূহের কল্যাণে। সেখানে পৌঁছে লেকের লাগোয়া পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে হ্রদদর্শন, পাশেই এক পর্যটন রেস্তোরাঁয় মাছভাতের মধ্যাহ্ন ভোজন, অতঃপর নীল জলরাশির বুকে নৌকা ভ্রমণ ইত্যাদি সাঙ্গ করে আমরা ছুটে চলি পার্শ্ববর্তী ঐতিহাসিক মৈরাং শহরে অবস্থিত নেতাজি সুভাষ বসুর স্মৃতিজড়িত, আজাদ হিন্দ ফৌজ বা আইএনএ মিউজিয়াম পরিদর্শনে। কিন্তু আমাদের কপাল মন্দ। আমরা পৌঁছানোর মিনিট কয়েক আগেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়, তবু দ্বাররক্ষীকে বলেকয়ে আমরা মিউজিয়াম আঙিনায় ঢুকে নেতাজির ভাস্কর্যের সঙ্গে ছবি তুলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই। এখানে উল্লেখ্য, এই মৈরাং শহরেই নেতাজির নেতৃত্বে বীরত্বপূর্ণ সম্মুখযুদ্ধে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ বাহিনীর পরাজয় ঘটে; যে কারণে মৈরাংকেই আজাদ হিন্দ ফৌজের সদর দপ্তর ঘোষণা করে সেখানে সগৌরবে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করা হয় সেদিন। দিনটা ছিল ১৪ এপ্রিল, ১৯৪৪ সাল।
ঐতিহাসিকভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালাটি ঘুরে দেখতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে আমরা এরপর যাই কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত পৃথিবীর একমাত্র ভাসমান বন্যপ্রাণী উদ্যান ‘কেইবুল লামজাও’ সন্দর্শনে, যেটি মূলত লকটাক হ্রদেরই একটি সম্প্রসারিত অংশ। এই ভাসমান পার্কের আরেকটি সুখ্যাতি রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় নাচিয়ে হরিণ সাংগাইয়ের সর্বশেষ চারণভূমি হিসেবে। উদ্যানের মূল প্রাঙ্গণে পৌঁছে প্রথমেই আমরা একটা নৌকো ভাড়া করে ঘন তৃণভূমির ভেতর দিয়ে, সরু খাল বেয়ে ভাসমান পার্কের খুব কাছাকাছি চলে যাই সেই দুর্লভ সোনার হরিণের সন্ধানে। সেখানে হরিণের দেখা না মিললেও নৌকো থেকে নেমে ভাসমান উদ্যানের জলজ ভূমিতে বেশ খানিকটা লম্পঝম্প করা গিয়েছিল বটে। তবে ফেরার আগে, উঁচু পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে টেলিস্কোপের মাধ্যমে দূরে, আবছায়ার মতো একখানি হরিণ দেখার সাধও মিটেছিল বৈকি আমাদের কারও কারও।
ততক্ষণে সূর্যদেব পাটে বসে গেছেন বলে আমরাও ফেরার পথ ধরি। পথিমধ্যে টংঘরের বিস্বাদ চা-পান, হোটেলে ফিরে খানিক চাঙা হয়েই ফের নবমীর রাতে ইম্ফলের সবচেয়ে বড় ও জমজমাট পুজোমণ্ডপ দর্শনে বেরিয়ে পড়া এবং তুমুল হৈহল্লা শেষে, ঝাঁপ বন্ধ হতে চলা দিল্লি দরবার রেস্টুরেন্টের মুসলিম মালিক মোহাম্মদ আকবরের প্রায় হাতেপায়ে ধরে দোকান খুলিয়ে গোশত-পরোটা ও বিরিয়ানি সহযোগে জম্পেশ এক নৈশভোজের মাধ্যমেই সফল সমাপ্তি ঘটে ইম্ফলে আমাদের ঘটনাবহুল দ্বিতীয় দিবসের।
ইম্ফল থেকে কোহিমা
ইম্ফলের হোটেলে আমাদের স্মরণীয় শেষ প্রাতরাশ সেরেই আমরা বাকশোপ্যাটরা বাঁধাছাঁদা করে প্রস্তুত হই, প্রতিবেশী বোন নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমার উদ্দেশে রওনা হবো বলে। এবড়োথেবড়ো পার্বত্যপথে অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ এবং যথারীতি হাসি গানে মেতে থেকে বিকেল নাগাদ আমরা পৌঁছে যাই কোহিমার উপকণ্ঠে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল ভিলেজে। ফি-বছর ডিসেম্বরের এক থেকে দশ তারিখ অব্দি চলা এই উৎসবে নাগাল্যান্ডের মানুষ, প্রকৃতি, ইতিহাস, হস্তশিল্প, সংগীত ও সাহিত্যকে সাড়ম্বরে উদযাপন করা হয় বেশ বিস্তৃত পরিসরে, যা ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের কাছে একটি অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। এর আগে অবশ্য ছোট্ট দুটো পাহাড়ি শহরে চা-পান এবং মধ্যাহ্নভোজনের প্রলম্বিত বিরতি নেওয়া হয়েছিলো বার দু’য়েকের জন্য।
নাগাল্যান্ডের একটা পার্কের সামনে তাদের জাতীয় পাখি ইগলের ভাস্কর্য
হর্নবিল নামের দীর্ঘোষ্ঠ ঈগল পাখিটি নাগাল্যান্ডের জাতীয় বিহঙ্গ বিশেষ, যার উল্লেখ নাগা সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা ও লোককথার অনেকটুকু জুড়ে আছে। হর্নবিল ভিলেজে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই শুরু হলো বেরসিক বৃষ্টির বাগড়া। তো, এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই, পাহাড়ের পাদদেশে বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে সুবিন্যস্ত পুরো উৎসব প্রাঙ্গণটি তড়িঘড়ি ঘুরে দেখা আর ছবি তোলা হলো বেশুমার। তারপর বৃষ্টিস্নাত বাকি পথটুকু পাড়ি দিয়ে সোজা কোহিমায় আমাদের এক রাতের ডেরা, ছিমছাম, নিরিবিলি ইস্ট গেট হোটেলে।
সেখানে দ্রুত সাফসুতরো হয়ে, একপ্রস্থ আড্ডা দিয়ে, হোটেলের ডাইনিংয়েই সুস্বাদু ডিনার সেরে নেওয়া গেল। দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত আমাদের কেউ কেউ তখনই শয্যায় ঢলে পড়লেও, অদম্য চার সাহসিকাকে সঙ্গে নিয়ে আমি রাতের কোহিমা দেখতে বেরিয়ে পড়ি। ইম্ফলের মতো এখানেও দেখলাম শহরগুলো অল্প রাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। তবে আমাদের হোটেলখানি শহরের মোটামুটি কেন্দ্রস্থলে হওয়াতে, তখনও কিছুটা জীবনের স্পন্দন ধ্বনিত হচ্ছিল চারপাশে; বিশেষ করে মশলার সুগন্ধে ম ম করা জমজমাট স্ট্রিট ফুডের স্টলগুলোকে ঘিরে। আমাদের খাদ্যরসিক দুই স্থপতি জেরিনা আপা ও হোসনে আপার উৎসাহে, পরদিন প্রাতরাশের জন্য মোমো আর সসেজ নিয়ে আমরা অতঃপর, আসামের শিলচর থেকে আগত জনৈক পানদোকানির কাছ থেকে মাহীয়ার কেনা রসালো পানের খিলিতে ভাগ বসিয়ে, ফুরফুরে মেজাজে, হালকা চালের পদব্রজে শীতার্ত হোটেল কক্ষে ফিরে নিদ্রা দেবীর উষ্ণ আলিঙ্গনে ধরা দিই সে-রাতের মতো।
ইতিহাসকন্যা কোহিমা দর্শন
নাগাল্যান্ড প্রদেশের রাজধানী কোহিমা। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ব্রিটিশদের হাতে, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তৈরি ছোট্ট, ছিমছাম নান্দনিক শহর একখানি। এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী এবং ইংরেজিতে অভ্যস্ত। মেয়েরা পোশাকে-আশাকে পাশ্চাত্যের অনুসারী এবং সর্বত্রই বেশ স্বাধীন, স্বনির্ভর ও সপ্রতিভ।
তো, সকালে আমরা হোটেলে কন্টিনেন্টাল কায়দায় প্রাতরাশ সেরে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়ি। প্রথমেই যাই, হোটেলের পাশেই অবস্থিত পাহাড়জুড়ে তৈরি বিশালায়তন ওয়ার সেমেটারিতে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানের সঙ্গে সম্মুখসমরে নিহত অগুনতি সৈনিকের শেষ শান্তির ঠিকানায়। দর্শন শেষে স্থানীয় হস্তশিল্প বিপণী থেকে কিঞ্চিৎ কেনাকাটা সেরে, নিকটবর্তী রাজভবন ও ইংরেজ আমলের ডিসি বাংলো দেখে, আমরা চলে যাই পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত সুবিশাল, দৃষ্টিনন্দন মেরি হেল্প কোহিমা গির্জা দর্শনে।
পাহাড়ের অনেক উঁচুতে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক গির্জাটির নির্মাণের সঙ্গে আমাদের ঢাকার তৎকালীন পাদ্রি সম্প্রদায়ের সম্পৃক্তির কথা জেনে খুব ভালো লাগল। অতঃপর, পাহাড় থেকে নেমে কর্মব্যস্ত অথচ সুশৃঙ্খল শহরের পথে খানিক ঘোরাঘুরি করে, সম্পূর্ণ বাঁশ দিয়ে নির্মিত ‘ব্যাম্বু মার্কেটে’ টুকটাক কেনাকাটা শেষে, স্থানীয় একটি ছোট্ট ঘরোয়া রেস্তোরাঁয় বসে, আমাদের দুপুরের আহার সেরে রওনা দিই এশিয়ার প্রথম ‘গ্রিন ভিলেজ’, খনোমার এক পার্বত্য কুটিরে রাত্রি যাপনের উদ্দেশে। (চলবে)
ঢাকা/তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উদ দ শ য প র তর শ আম দ র স র উদ দ শ মণ প র র অবস থ ত র প রথম পর চ ল র জন য ভ রমণ শহর র স মরণ
এছাড়াও পড়ুন:
রাকসু নির্বাচন: ভোটের আগের রাতে গান–স্লোগানে মেতেছেন শিক্ষার্থীরা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের আগের রাতে ক্যাম্পাসে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। ‘রাকসু, রাকসু, রাকসু’ স্লোগান আর ঢোলের তালে তালে নানা সুরের গানে উৎসবে মেতেছেন শিক্ষার্থীরা। উৎসবে মেতে থাকা এই শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে সংহতি জানিয়েছেন বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা।
বুধবার রাত ৮টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেটের আমতলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা এ আসর বসান। রাত সাড়ে ১১টার দিকে এ প্রতিবেদন লেখার সময় শিক্ষার্থীরা সেখানে অবস্থান করছিলেন। নির্বাচনের আগের রাতে শিক্ষার্থীদের এ রকম উৎসবে বিভিন্ন বিভাগের পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী জড়ো হয়েছেন। কেউ দলবেঁধে ছবি তুলছেন।
রাত পৌনে ১০টার দিকে পরিবহন মার্কেটে গানের তালে তালে ঠোঁট মেলাচ্ছিলেন শিক্ষার্থী কাউছার আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সচরাচর নির্বাচনের আগের দিন থমথমে পরিবেশ থাকে, কিন্তু আজ আমাদের ঈদের মতো আনন্দ। আমরা বিশ্বাস করি, বিগত দিনে যে দাবিদাওয়াগুলো প্রশাসনের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, এই নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের প্রতিনিধিরা সেই দাবি তুলে ধরবেন।’
গানের আসরে অংশ নিয়ে রাকসু নির্বাচনে সাংস্কৃতিক সম্পাদক প্রার্থী কাজী শফিউল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘ ৩৫ বছর একটা নির্বাচন হচ্ছে। এ জন্য ক্যাম্পাসে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আমাদের প্রথম পরিচয় শিক্ষার্থী। তারপর আমরা ভোটার, তারপর আমরা প্রার্থী। শিক্ষার্থী হিসেবেই আমরা এই উৎসবে এসেছি।’
রাত পোহালেই রাকসু নির্বাচন। আজ রাতে ক্যাম্পাসে উৎসবে মেতেছেন শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৫ অক্টোবর