পাকিস্তান আরও স্বৈরশাসনের পথে
Published: 11th, November 2025 GMT
তিন বছরের বেশি সময় ধরে পাকিস্তান স্বৈরাচারের পথে এগোচ্ছে—এটা এখন সবার চোখে স্পষ্ট। এবার নতুন এক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, যা সেই গণতন্ত্রহীনতার পথকে আরও পোক্ত করে তুলছে।
উদ্যোগটি হলো সংবিধানের নতুন সংশোধনী। এটি ২৭তম সংশোধনী। পার্লামেন্টে ইতিমধ্যেই এটি পেশ করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে, ২৭তম সংশোধনী পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থার কাঠামোয় বড় পরিবর্তন আনবে। আর সেই বদল দেশটির শাসনব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।
গত বছর ২৬তম সংশোধনী গৃহীত হয়েছিল রাতের আঁধারে। ওই সময় প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ ভোট নিশ্চিত করতে সরকার যে চাপ প্রয়োগ করেছিল, তা প্রক্রিয়াটির বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে বিতর্কিত সংশোধনীটি পাস হয়। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের অধীন হয় এবং তা আইনের শাসনকে দুর্বল করে ফেলে। এর ফলে সাংবিধানিক ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত প্রতিটি মামলায় সরকার জয়লাভ করে।
আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের গলাগলি কতক্ষণ টিকবে২৮ অক্টোবর ২০২৫মনে হচ্ছে প্রস্তাবিত ২৭তম সংশোধনী একই পথে হাঁটছে। সংবিধানবিশেষজ্ঞরা এটিকে ‘বিচার বিভাগের ওপর রাষ্ট্রীয় দখল’ বলে আখ্যায়িত করছেন। বিরোধী নেতারা একে ‘প্রতিষ্ঠান পরিচালিত ক্ষমতা দখলের পদক্ষেপ’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। অনেকে একে গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি ও ‘বিচার ও রাজনীতির পৃথকতার নীতির ওপর আঘাত’ বলে মন্তব্য করেছেন।
সিনেটে উপস্থাপিত ২৭তম সংশোধনীতে তিনটি প্রধান বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১.
২৬তম সংশোধনীর সময়ও সরকার একটি ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত গঠনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তীব্র বিরোধিতার মুখে সেটি সম্ভব হয়নি। এর বদলে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করা হয়। তবে সেটিও সমালোচিত হয়। কারণ, বেঞ্চের সদস্য কারা হবেন, তা নির্ধারণে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব ছিল। এতে সরকার ইচ্ছেমতো বিচারক বেছে নিয়ে নিজেদের স্বার্থসম্পর্কিত সাংবিধানিক মামলা নির্দিষ্ট বিচারকদের মাধ্যমে শুনানি করাতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানে যে গণতন্ত্রের ক্ষয় ও দুর্বলতা দেখা দিয়েছে, তার পটভূমিতে ২৭তম সংশোধনী গণতন্ত্রের ওপর আরও একটি আঘাত হিসেবে এসেছে। এটি একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে দেবে।একটি সাংবিধানিক আদালত গঠনের বিরোধিতা করার যথেষ্ট যুক্তি আছে। কারণ, এতে সরকারের বেছে নেওয়া বিচারকদের দিয়ে এমন একটি আদালত তৈরি হবে, যা কার্যত সরকারের অধীনই কাজ করবে। এতে সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত মামলার এখতিয়ার হারাবে।
অন্যদিকে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, হাইকোর্টের বিচারকদের এক আদালত থেকে অন্য আদালতে তাঁদের সম্মতি ছাড়াই স্থানান্তর করা যাবে। এতে সরকার বিচার কমিশনের ওপর প্রভাব খাটিয়ে স্বাধীনচেতা বিচারকদের সরিয়ে দিতে পারবে।
সংবিধানের যে ২৪৩ অনুচ্ছেদ সরকারের হাতে সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্বের ক্ষমতা দেয়, নতুন সংশোধনীতে তাতেও পরিবর্তন আনার প্রস্তাব রয়েছে। সরকারের যুক্তি হলো, আধুনিক যুদ্ধের ধরন পাল্টে গেছে, তাই প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কাঠামোতেও পরিবর্তন দরকার এবং ‘ফিল্ড মার্শাল’ পদটির সাংবিধানিক স্বীকৃতি জরুরি।
আরও পড়ুনআমরা ভারতের হয়ে পাকিস্তানের আর পাকিস্তানের হয়ে ভারতের পক্ষে লড়ব না২৬ অক্টোবর ২০২৫এই সংশোধনীর ফলে সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব আরও বেশি সাংবিধানিক ক্ষমতা ও সুবিধা পাবেন। এখন পর্যন্ত সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তারা পর্যায়ক্রমে যে জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির প্রধানের দায়িত্ব নিতেন, তা বাতিল করা হবে। এর বদলে সৃষ্টি হবে চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস নামের পদ। আর এর নিয়ন্ত্রণ থাকবে সেনাপ্রধানের হাতে।
এ ছাড়া ফিল্ড মার্শাল, মার্শাল অব দ্য এয়ারফোর্স এবং অ্যাডমিরাল অব দ্য ফ্লিট—এই তিনজনকেই রাষ্ট্রপতির মতো আইনি দায়মুক্তি দেওয়া হবে। তাঁদের কেবল ইমপিচমেন্টের মাধ্যমে অপসারণ করা যাবে। তাঁরা আজীবন ইউনিফর্ম পরার অধিকার রাখবেন এবং একই মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করবেন। সব মিলিয়ে এই সংশোধনীর লক্ষ্য হলো, বেসামরিক ব্যবস্থার হাত থেকে ক্ষমতা আরও বেশি করে সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানে যে গণতন্ত্রের ক্ষয় ও দুর্বলতা দেখা দিয়েছে, তার পটভূমিতে ২৭তম সংশোধনী গণতন্ত্রের ওপর আরও একটি আঘাত হিসেবে এসেছে। এটি একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে দেবে।
আরও পড়ুনপাকিস্তানের মৃতপ্রায় অর্থনীতি সারিয়ে তোলার আসল দাওয়াই২৩ ডিসেম্বর ২০২৪আসলে পাকিস্তানে ‘পার্লামেন্ট আজ রাবার স্ট্যাম্পে’ পরিণত হয়েছে, জনসমাবেশের স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছে, বিরোধী দলগুলোকে দমন করা হয়েছে, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে এবং বেসামরিক-সামরিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে তা পুরোপুরি সেনাবাহিনীর পক্ষে ঝুঁকে গেছে। এসব কিছু হয়েছে এমন একটি শাসক জোটের মাধ্যমে, যারা নিজেরাই সামরিক প্রতিষ্ঠানের অধীন ‘অংশীদার’ হয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করে।
মালিহা লোধি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত
ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণতন ত র র ব চ রকদ র সরক র র ব যবস থ দ র বল র ওপর ক ষমত আরও প
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন মানে গণতন্ত্র, এই ভুয়া তত্ত্ব থেকে বের হতে হবে: ফরহাদ মজহার
নির্বাচনের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই বলে মন্তব্য করেছেন চিন্তক ও কবি ফরহাদ মজহার।
সোমবার (১০ নভেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজের উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
ফরহাদ মজহার বলেন, “যদি আমরা কিছু করতে চাই তাহলে, দয়া করে নির্বাচনের ধারণাটা বাদ দেন। নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র, এটা মারাত্মক ভুল। নির্বাচনের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। নির্বাচন মানে গণতন্ত্র, এই ভুয়া তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গণতন্ত্র মানে হচ্ছে জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় বাস্তবায়িত করা। এটার আরেকটা নাম আছে, সেটা হচ্ছে গণসার্বভৌমত্ব। জনগণের গাঠনিক ক্ষমতা কখনো হরণ করা যায় না। আন্দোলনসহ বিভিন্ন কিছুর মধ্য দিয়ে জনগণ তার এই গাঠনিক ক্ষমতাকে জারি রাখে।”
তিনি বলেন, “এখন সমস্যা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকে যেখানে দিয়েছেন, পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলো রয়ে গেছে। যেহেতু আমরা শেখ হাসিনার রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রেখেছি, সেই রাষ্ট্রটা এখনও আছে। ফলে সেই রাষ্ট্রটি আপনার সামনে দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এটাকে আপনি ভাঙতে পারছেন না। আপনি (ড. ইউনূস) বলছেন এটাকে সংস্কার করতে হবে।”
ফরহাদ মজহার বলেন, “আমাদের নতুন বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ খুব সহজ। নতুন গণপরিষদ গঠন করা এবং একটা গণপরিষদে নির্বাচন করা। গণপরিষদে আমাদের সমস্ত সাংবিধানিক প্রশ্ন, সকল আইনি প্রশ্ন, রাষ্ট্রীয় প্রশ্ন ফয়সালা করা। যখন আমরা সিম্পল ফরমুলাকে জটিল করে ফেলি, এদিক-ওদিক নিয়ে যাই, তখন বিভিন্ন শক্তির কারণে আমরা এটাকে তখন নষ্ট করে ফেলি।”
ড. ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “জনগণকে বলতে দেন, তারা কেমন বাংলাদেশ চায়। জনগণকে ক্ষমতা দেন। এটা না করে আপনি দু-তিনটা লোক নিয়ে এসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করলেন। এটার তো কোনো ভ্যালিডিটি নেই। আপনাদের কোনো এখতিয়ারই নেই।”
আলোচনা সভায় কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা/রায়হান/সাইফ