ব্রাজিলের বেলেমে শুরু হয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০। বিশ্বের নেতারা আবারও জলবায়ু ন্যায়বিচার নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু এক দশক পরও জেন্ডার ন্যায়বিচার, যা প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু ন্যায়বিচারের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত; তা বাস্তবে রয়ে গেছে উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। জলবায়ু–সংকটের এই জটিল মুহূর্তে একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমার প্রশ্ন, এই প্রতিশ্রুতির মূল্য কেন কেবল কথার ফ্রেমে বন্দী?

প্রতিশ্রুতির শুরু, বাস্তবতার ব্যর্থতা

২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে বিশ্বজুড়ে দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে সব জলবায়ু পদক্ষেপ হবে ‘জেন্ডার-সংবেদনশীল, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ’। এর ধারাবাহিকতায় লিমা ওয়ার্ক প্রোগ্রাম অন জেন্ডার এবং জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল জলবায়ু নীতিমালা ও অর্থায়নে নারীর সমান ভূমিকা নিশ্চিত করা।

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। জেন্ডার সমতা এখনো মূল আলোচনার বাইরের বিষয়। এটি কনফারেন্সের সাইড-ইভেন্টে সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ যেখানে নীতি নির্ধারণ হয়, যেখানে অর্থ বরাদ্দ হয়, সেই মূল আলোচনায় নারীর কণ্ঠ এখনো অনুপস্থিত। এটি কেবল অংশগ্রহণের ব্যর্থতা নয়, এটি জলবায়ু আলোচনায় নারীকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ হিসেবে দেখার একটি গভীর কাঠামোগত দুর্বলতা।

প্রতিশ্রুতি অনেক, অর্থ নেই কোথাও

একশনএইডের ২০২৪ সালের প্রতিবেদন ‘ন্যায়সংগত রূপান্তরের জন্য জলবায়ু অর্থায়ন: অর্থ কীভাবে প্রবাহিত হয়’ এই করুণ বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনটি দেখায়, বিশ্বব্যাপী মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ বহুপাক্ষিক জলবায়ু অর্থায়ন এমন প্রকল্পে ব্যয় হয়, যা নারী, শ্রমিক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যায়সংগত রূপান্তর নিশ্চিত করে।

একশনএইড এ পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেছে ‘চমকে দেওয়ার মতো অর্থের ঘাটতি’ হিসেবে। আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, ‘বিশ্ব এখনই পদক্ষেপ না নিলে জলবায়ু বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব নয়। কিন্তু এর মূল্য দিতে হবে দূষণকারীদের, শ্রমিক ও কমিউনিটিগুলোকে নয়।’

এ ব্যর্থতা শুধু অর্থের অভাব নয়; এটি একটি গভীর নীতিগত অন্ধত্বের পরিচায়ক। যাদের জীবন প্রতিদিন জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের কাছে অর্থ পৌঁছাচ্ছে না। বরং সেই অর্থ এখনো জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের ভর্তুকি হিসেবে ব্যয় হচ্ছে। আমরা নারী অধিকার আন্দোলনকারীরা এই দ্বিমুখী নীতির তীব্র নিন্দা জানাই।

নারীবাদী বিশ্লেষণ: সমস্যার শিকড় কাঠামোতে

উইমেন্স এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডব্লিউইডিও) বলেছে, ‘নারীবাদী জলবায়ু অর্থায়ন মানে হচ্ছে এমন সমাধানে বিনিয়োগ, যা নারীরা, আদিবাসীরা ও তৃণমূল কমিউনিটি নিজেরাই সংজ্ঞায়িত করে, দূরের কোনো মধ্যস্থতাকারীর দ্বারা পরিচালিত “ট্রিকল-ডাউন” প্রকল্পের মাধ্যমে নয়।’

কিন্তু বর্তমান জলবায়ু অর্থায়ন কাঠামো ঠিক এর বিপরীত। এটি বড় প্রকল্প, আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা স্থানীয় নারী সংগঠন বা কৃষক সমিতির নাগালের বাইরে। ফলাফল হলো প্রকল্প আছে, কিন্তু সত্যিকারের ন্যায়বিচার নেই। এই কাঠামোগত বৈষম্যই জেন্ডার ন্যায়বিচারের সবচেয়ে বড় বাধা, যা একজন আন্দোলনকারী হিসেবে আমাদের সব থেকে বেশি পীড়া দেয়।

জলবায়ু অর্থনীতির বিপরীতমুখিতা

একদিকে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলো জলবায়ু উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা বলছে, অন্যদিকে বছরে শত শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে। এটা শুধু নীতিবিরোধী নয়, এটি নৈতিক বিপর্যয়। প্রতিটি ডলার যা তেল, গ্যাস বা কয়লার পেছনে যায়, তা মানে নারী কৃষকদের জন্য পানি ব্যবস্থাপনায় অর্থের ঘাটতি, উপকূলীয় সুরক্ষায় কম বাজেট বরাদ্দ এবং আরেকটি প্রজন্মকে পিছিয়ে দেওয়া।

একশনএইডের দাবি একেবারে স্পষ্ট, এখনই এই অর্থ পুনর্বিন্যাস করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি নয়, নারী ও কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন সমাধানে বিনিয়োগ করতে হবে।

কেন জেন্ডার ন্যায়বিচারই জলবায়ু সমাধানের চাবিকাঠি

জেন্ডার ন্যায়বিচার কোনো ‘সহায়ক বিষয়’ নয়, এটি কার্যকর জলবায়ু নীতির মূল শর্ত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু স্থানে নারী কৃষকেরা লবণাক্ত জমি পুনরুদ্ধার করছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি চালাচ্ছেন, স্থানীয় খাদ্যনিরাপত্তা রক্ষা করছেন। কিন্তু তাঁদের হাতে অর্থ নেই, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই। তাঁদের বাদ দিয়ে তৈরি যেকোনো জলবায়ু পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

কপ৩০: এখন কী করতে হবে

কপ৩০ হতে হবে বাস্তবায়নের সম্মেলন—যেখানে প্রতিশ্রুতি নয়, অর্থ, জবাবদিহি ও কাঠামোগত পরিবর্তন আসবে।

•  জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যানে বাস্তব অর্থ বরাদ্দ: শুধু ঘোষণা নয়, প্রকৃত অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। নারীর নেতৃত্বে অভিযোজন, কর্মসংস্থান ও ন্যায়সংগত রূপান্তরে নির্দিষ্ট তহবিল নিশ্চিত করতে হবে।

•  জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকি বন্ধ: এই অর্থ সরিয়ে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাতে দিতে হবে, যারা প্রতিদিন জলবায়ু বিপর্যয়ের মোকাবিলা করছে।

•  অর্থপ্রবাহ সহজ করা: নারী সংগঠন, আদিবাসী নেটওয়ার্ক ও স্থানীয় উদ্যোগ যেন সরাসরি অর্থ পায়, তার জন্য প্রক্রিয়াগত সংস্কার জরুরি।

বাংলাদেশের ভূমিকা: দুর্বলতর দেশ থেকে নেতৃত্বের দেশে

বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী দেশগুলোর একটি। কিন্তু একই সঙ্গে এটি বিশেষ করে জেন্ডার ন্যায়বিচারভিত্তিক জলবায়ু আলোচনায় নেতৃত্ব দিতে পারে। কপ৩০-এ বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত আলোচ্যসূচি হতে পারে:

১.

জেন্ডার-সংবেদনশীল অর্থায়নের জন্য নির্দিষ্ট কোটার দাবি: অভিযোজন তহবিলের অন্তত একটি অংশ নারী নেতৃত্বাধীন প্রকল্পে বরাদ্দের আন্তর্জাতিক নীতিমালা তৈরির প্রস্তাব।

২. ন্যায়সংগত রূপান্তর কাঠামোয় নারীর অন্তর্ভুক্তি: নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে নারীদের কর্মসংস্থান ও নেতৃত্ব নিশ্চিত করার জাতীয় নীতি প্রস্তাব।

৩. সহজলভ্য অর্থায়ন ব্যবস্থার দাবি: গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডসহ বহুপাক্ষিক তহবিলে স্থানীয় পর্যায়ে সরাসরি প্রবেশাধিকার সহজ করা।

৪. জাতীয় পর্যায়ে জেন্ডার বাজেটিং: বাংলাদেশ তার এনডিসি ও অভিযোজন পরিকল্পনায় নারীর জন্য নির্দিষ্ট সূচক ও বাজেট অন্তর্ভুক্ত করে একটি উদাহরণ স্থাপন করতে পারে।

৫. গ্লোবাল সাউথের নারীবাদী জোট: আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে জেন্ডার ন্যায়বিচারের পক্ষে কণ্ঠস্বর জোরদার করা।

জেন্ডার ন্যায়বিচার কোনো অতিরিক্ত সুবিধা নয়, এটি জলবায়ু ন্যায়বিচারের মূল ভিত্তি। যদি জলবায়ু অর্থ এখনো নারী, কৃষক ও তৃণমূল জনগোষ্ঠীর কাছে না পৌঁছায়, তাহলে প্রতিটি চুক্তি কেবলই আরেকটি ব্যর্থ প্রতিশ্রুতি।

বেলেমের কপ৩০ হতে পারে সেই বাঁকবদল, যেখানে জলবায়ু আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে মানুষ, বিশেষ করে নারী। কারণ, যখন নারীরা নেতৃত্ব দেয়, তখন জলবায়ু ন্যায়বিচারের পদক্ষেপ সফল হয়। আর যখন ন্যায়বিচারকে উপেক্ষা করা হয়, তখন ভবিষ্যৎও উপেক্ষিত হয়।

ফারাহ্ কবির কান্ট্রি ডিরেক্টর, একশনএইড বাংলাদেশ

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর অর থ য ন প রকল প ন জলব য র জন য বর দ দ

এছাড়াও পড়ুন:

কপ-৩০ সম্মেলনের আগেই শাহবাগে টেকসই অর্থায়নের দাবি

কপ-৩০ সম্মেলনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের জন্য ন্যায্য, স্বচ্ছ ও টেকসই অর্থায়নের দাবি জানাতে এক ভিন্নধর্মী ক্যাম্পেইনের আয়োজন করা হয়েছে।

শনিবার (৮ নভেম্বর) রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে যুবকদের নিয়ে ‘ফেয়ার ফাইন্যান্স নাও: বাংলাদেশ’স কল বিফোর কপ৩০’ শীর্ষক এ ক্যাম্পেইনের আয়োজন করা হয়।

আরো পড়ুন:

ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সেমিনার

জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সাতক্ষীরায় প্রশিক্ষণ কর্মশালা

প্রোগ্রামটি যৌথভাবে আয়োজন করে ফেয়ার ফাইন্যান্স বাংলাদেশ কোয়ালিশন, অক্সফাম ইন বাংলাদেশ, পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক এবং ডেমোক্রেটিক বাজেট মুভমেন্ট। এছাড়াও সহযোগী হিসেবে যুক্ত ছিল প্রচেষ্টা ইয়ুথ ফাউন্ডেশন, সৌহার্দ্য ইয়ুথ ফাউন্ডেশন, আমরাই আগামী এবং শাওন মাইম একাডেমি।

ক্যাম্পেইনে জনসচেতনতা প্রদর্শনী এবং মাইম পরিবেশনার মাধ্যমে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত কীভাবে পরিবেশ ও সমাজে প্রভাব ফেলে তা তুলে ধরা হয়। যুব অংশগ্রহণকারীরা প্ল্যাকার্ড ও সৃজনশীল বার্তার মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও জলবায়ু সহনশীলতার পক্ষে সচেতনতা তৈরি করেন।

এ সময় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং নিম্ন-কার্বন উন্নয়নপথে যেতে বছরে ১২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হলেও বর্তমানে দেশটি এর কম ১১ শতাংশ অর্থায়ন পাচ্ছে। ন্যায্য অর্থায়ন কাঠামো না থাকলে জলবায়ু অভিযোজনের দায় ও ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি পড়ে প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের উপর।

পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকশন নেটওয়ার্কের প্রজেক্ট কোওর্ডিনেটর মোসলে উদ্দিন সূচক গণমাধ্যমে বলেন, “জলবায়ু অর্থায়ন কোনো দান নয়- এটি ন্যায্যতার প্রশ্ন। যে সঙ্কট বাংলাদেশ তৈরি করেনি, তার আর্থিক ঝুঁকি বহন করে স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তোলা সম্ভব নয়।”

তিনি বলেন, “এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো টেকসই অর্থায়ন সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় যুব অংশগ্রহণকে শক্তিশালী করা এবং কপ৩০ সম্মেলনে বাংলাদেশে জন্য সহজলভ্য, অনুদানভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়নের দাবিকে আরো জোরালোভাবে তুলে ধরা।”

অনুষ্ঠানটি সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, আর্থিক খাত, এবং সিভিল সোসাইটির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির আহ্বানের মাধ্যমে শেষ করা হয়, যাতে বাংলাদেশ একটি ন্যায্য, সহনশীল এবং টেকসই অর্থনীতির পথে অগ্রসর হতে পারে।

ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভিসা–জটিলতায় কপ৩০ সম্মেলনে যেতে পারল না নওশীন ও নুর
  • জলবায়ু বিপর্যয়ে এক দশকে ২৫ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত
  • পুরোনো ব্যর্থতা শুধরে নিতে শুরু হচ্ছে জলবায়ু সম্মেলন
  • কপ-৩০ সম্মেলনের আগেই শাহবাগে টেকসই অর্থায়নের দাবি