টোকিও চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা লড়াকু চলচ্চিত্র ‘ফিলিস্তিন ৩৬’
Published: 11th, November 2025 GMT
এশিয়া থেকে আফ্রিকা, ইউরোপ থেকে লাতিন আমেরিকা—বিশ্বজুড়ে যখন জাতিগত ও ভূরাজনৈতিক সংঘাতের উত্তেজনা প্রবল, এমন সময়ে মানুষে মানুষে সহমর্মিতা, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং বিভেদ দূরীকরণে চলচ্চিত্রের অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর গুরুত্ব দিয়ে শেষ হলো ৩৮তম টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (টিফ ২০২৫)। এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী এই আয়োজনের মূল বার্তাই ছিল—চলচ্চিত্র শুধু বিনোদন নয়, বরং বোঝাপড়ার ও ঐক্যের মাধ্যম।
টোকিওর হিবিয়া, মারুনোচি, ইউরাকুচো ও গিনজা এলাকায় অনুষ্ঠিত এই উৎসবে গত ২৭ অক্টোবর পর্দা ওঠে এবং ১০ দিনব্যাপী প্রদর্শিত হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোট ১৮৪টি চলচ্চিত্র। লালগালিচার জাঁকজমক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রবিষয়ক সেমিনার, রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনী, মাস্টারক্লাস ও আন্তর্জাতিক সংলাপে মুখর ছিল গোটা উৎসব প্রাঙ্গণ।
৫ নভেম্বর হিবিয়ার তোহো সিনেমায় আয়োজিত সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা, তারকা ও সমালোচকদের উপস্থিতিতে ঘোষণা করা হয় বিজয়ীদের নাম। উৎসবের মূল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ১৫টি চলচ্চিত্রের মধ্যে সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘টোকিও গ্র্যান্ড প্রি’ ও ‘দ্য গভর্নর অব টোকিও অ্যাওয়ার্ড’ জিতে নেয় ফিলিস্তিনি নির্মাতা আনেমারি জাসির পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘ফিলিস্তিন ৩৬’।
ইতিহাসের প্রতিধ্বনি: ‘ফিলিস্তিন ৩৬’
এই চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৩৬ সালে সূচিত ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক বিদ্রোহ। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দখলদারি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ১৯৩৬ সালে কৃষকদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন শুরু হয়, তা দ্রুতই পরিণত হয় বৃহত্তর জাতীয় সংগ্রামে। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যাতে সাড়া দেয় ব্যাপকভাবে। ইউরোপে নির্যাতন থেকে পালিয়ে আসা ইহুদি অভিবাসীদের জন্য ব্রিটিশ সরকারের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা, ভূমি দখল, মজুরি বৈষম্য এবং প্রশাসনিক নির্যাতন—সব মিলিয়ে ফিলিস্তিনজুড়ে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা।
‘ফিলিস্তিন ৩৬’-এ এই বাস্তবতাকেই রূপ দেওয়া হয়েছে শৈল্পিক ও মানবিক আবেগের মিশেলে। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নৃশংসতা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের অদম্য সংগ্রাম এখানে চিত্রিত হয়েছে সমভাবে। পরিচালক জাসির তাঁর দক্ষ বুননে দেখিয়েছেন, কীভাবে একদিকে ঔপনিবেশিক দমননীতি আর অন্যদিকে নিজ দেশের বিশ্বাসঘাতক উচ্চবিত্ত শ্রেণি মিলে ধ্বংস করে দেয় একটি জাতির স্বপ্ন।
চলচ্চিত্রে ইউসুফ (করিম দাউদ আনাইয়া) নামের এক তরুণের চোখ দিয়ে দেখা যায় সেই অস্থির সময়। গ্রামীণ জীবন থেকে উঠে এসে সে জড়িয়ে পড়ে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে। আরেক মুখ্য চরিত্র খুলুদ আতেফ (ইয়াসমিন আল মাসরি), উচ্চশিক্ষিত এক নারী, সাংবাদিকতা যার ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের ক্ষেত্র। তাঁর স্বামী ধনকুবের আমির আতেফ (ডাফের আল’আবিদিন) আবার গোপনে জায়নবাদী সংগঠনের কাছে জমি বিক্রি করেন, ব্রিটিশদের সঙ্গে রাখেন সুসম্পর্ক। এই বাস্তবতা চলচ্চিত্রে তৈরি করে দ্বান্দ্বিক আবহ।
চলচ্চিত্রে দেখা যায়, বন্দরে কাজ করা ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ, গ্রামীণ জমি দখল, ধর্মীয় বিভাজন—সবকিছু মিলিয়ে যেন এক ধূসর সময়ের প্রতিচ্ছবি। আর এই নিপীড়নই লড়াইয়ের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দেয় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে। এক শ্রমিক যখন প্রাপ্য মজুরি না পেয়ে প্রতিরোধে নামে, কিংবা বিদ্রোহীরা ট্রেন ডাকাতির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করে, আর আপামর জনতা তাকে সমর্থন করে, তখন তা হয়ে ওঠে একটি জাতির আত্মমর্যাদার সমন্বিত লড়াই।
চলচ্চিত্রের ব্যঙ্গাত্মক অথচ গভীর একটি দৃশ্যে দেখা যায়, এক শিশু তার গাধার নাম রেখেছে ‘লর্ড বেলফোর’। এ যেন ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ চ্যান্সেলর আর্থার বেলফোর যে ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদি আবাসভূমির সমর্থন জানিয়েছিলেন, সেই ঐতিহাসিক নথির প্রতিই এক ক্ষুদ্র কিন্তু তীক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়া।
ইতিহাস, প্রতীক ও বর্তমান বাস্তবতা
চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে আল-বাসা নামের এক গ্রামে ঘটে ভয়াবহ গণহত্যা। গাড়িবোমায় ব্রিটিশ সেনা নিহত হওয়ার অজুহাতে পুরো গ্রাম উজাড় করে দেয় ঔপনিবেশিক সেনারা—নিরীহ নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউ রক্ষা পায় না। দৃশ্যটি কেবল অতীত নয়; দর্শকদের মনে করিয়ে দেয় একই অজুহাতে সমকালীন গাজায় অনুরূপ ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর নিদারুণ বাস্তবতাকেও।
পরিচালক আনেমারি জাসিরের ভাষায়, ‘১৯৩৬ সালে আমরা নিজেদের একাংশ হারিয়েছিলাম। এটি এক গ্রামের গল্প, কিন্তু সেই গ্রামের ভেতরেই নিহিত আছে একটি জাতির আত্মার ইতিহাস।’ তিনি বলেন, আমরা যখন এই চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করি, তখনো ভাবিনি যে ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায় নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরাও সমসাময়িক আরেকটি ভয়াবহ সময়ের মধ্যে পড়ব। তবু আমরা দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছি, এই প্রমাণ দিতে যে যতই মুছে দিতে চাওয়া হোক—আমাদের অস্তিত্বের গল্প কখনো মুছে যাবে না।
চলচ্চিত্রের নারী সাংবাদিক খুলুদের চরিত্রে ইয়াসমিন আল মাসরি অথবা শহীদ যোদ্ধার স্ত্রী রাবাব চরিত্রে ইয়াফা বাকরির অভিনয় এই ছবির গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাঁদের প্রতিরোধ, দৃঢ়তা ও মানবিকতার মিশেলে পুরো ছবিটি জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে নারীর ভূমিকাকে মূর্ত করে তোলে। পাশাপাশি টমাস হপকিন্স (বিলি হাউল) নামের ব্রিটিশ কর্মকর্তা চরিত্রটি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার অন্তর্দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করে—যিনি শেষ পর্যন্ত নৃশংস রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে পদত্যাগ করেন।
নির্মাণের বাধা ও সংগ্রাম
‘ফিলিস্তিন ৩৬’-এর নির্মাণপ্রক্রিয়া নিজেই যেন এক লড়াই । প্রি-প্রোডাকশন শুরু হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। বিশাল সেট নির্মাণ, পোশাক, লোকেশন, যুগোপযোগী সরঞ্জাম—সবকিছু প্রস্তুত হচ্ছিল, কিন্তু সেই বছরের ৭ অক্টোবর শুরু হয় ভয়াবহ সংঘাত। শুটিং স্থগিত হয়ে যায়, পুরো ইউনিটকে স্থানান্তরিত হতে হয় জর্ডানে। এরপর দীর্ঘ ১৩ মাস পর তাঁরা ফিলিস্তিনে ফিরে গিয়ে শেষ করেন চিত্রগ্রহণ। পরিচালক জাসির বলেন, আমাদের প্রতিটি দিন ছিল অনিশ্চয়তার। তবে আমরা জানতাম, এই গল্প শেষ করতেই হবে—কারণ, এটা কেবল আমাদের সিনেমা নয়, আমাদের জাতির ইতিহাস।
জুরির মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগের জুরি সভাপতি, ইতালীয় চলচ্চিত্র সমালোচক কার্লো চ্যাট্রিয়ান বলেন, শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ নয়, চলচ্চিত্রটির নন্দনতাত্ত্বিক গঠনও শক্তিশালী। নির্মাতা ইতিহাসের এমন এক অধ্যায়কে সামনে এনেছেন, যা পশ্চিমাদের দায়ের কথাও মনে করিয়ে দেয়। এই চলচ্চিত্রে আমরা ইতিহাসকে উপনিবেশবিরোধী নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, যা এই সিনেমার শক্তি। অন্যদিকে এই ছবির একটি বড় চরিত্র যে ভূমি, সেই ইঙ্গিতও পাওয়া যায় চ্যাট্রিয়ানের ভাষ্যে। বর্তমানে গভীর ক্ষতে ভরা ভূমি যে একদা ছিল অপরূপ সৌন্দর্যের আধার, চলচ্চিত্রটির অবলোকন সেই সত্যকেই তুলে ধরে।
আনেমারি জাসির: ফিলিস্তিনের কণ্ঠস্বর
আনেমারি জাসির ফিলিস্তিনের অন্যতম প্রভাবশালী চলচ্চিত্রকার। এর আগে তাঁর তিনটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র—‘সল্ট অব দ্য সি’ (২০০৮), ‘হোয়েন আই স ইউ’ (২০১২) ও ‘ওয়াজিব’ (২০১৭)—অস্কারে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিত্ব করেছে। তাঁর সিনেমায় থাকে ইতিহাস, ব্যক্তিগত বেদনা ও জাতিগত পরিচয়ের অনুসন্ধান। পুরস্কার ঘোষণার সময় তিনি টোকিওতে ছিলেন না। ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আমাদের চলচ্চিত্র “ফিলিস্তিন ৩৬”-কে বেছে নেওয়ার জন্য সব জুরি সদস্যকে ধন্যবাদ জানাই । প্রতিকূলতার মধ্যে এই চলচ্চিত্রকে সফল করে তোলার জন্য যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, এটি তাঁদের জন্য এক দুর্দান্ত সম্মান।” তাঁর পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেন কিশোরী অভিনেত্রী ওয়ার্দি এইলাবৌনি। পুরস্কার তুলে দেন টোকিওর গভর্নর কোইকে ইউরিকো ও জুরি প্রধান কার্লো চ্যাট্রিয়ান।
অন্য পুরস্কারপ্রাপ্তরা
বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছেন কম্বোডিয়ার রিথি পান, তাঁর প্রামাণ্যচিত্র ‘উই আর দ্য ফ্রুটস অব দ্য ফরেস্ট’-এর জন্য। সেরা পরিচালকের পুরস্কার যৌথভাবে জিতেছেন চীনের ঝাং লু (‘মাদারটাং’) ও ইতালির আলেসিও রিগো দে রিঘি ও মাত্তেও জোপিস (‘হেডস অর টেইলস?’)। শৈল্পিক অবদানের জন্য পুরস্কার পেয়েছে বেলজিয়াম-উত্তর ম্যাসেডোনিয়ার যৌথ প্রযোজনা ‘মাদার’।
দর্শক পুরস্কার জিতেছে জাপানি পরিচালক সাকাশিতা ইউইচিরো-এর ‘ব্লন্ড’। এশিয়ান ফিউচার বিভাগে সেরা চলচ্চিত্র হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার রো ইয়াং-ওয়ান-এর ‘হেলো’।
যৌথভাবে সেরা অভিনেত্রী হয়েছেন ফুকুচি মোমোকো ও কাওয়াসে নাওমি (‘ইকোস অব মাদারহুড’) এবং সেরা অভিনেতা হয়েছেন ওয়াং চুয়ানজুন (‘মাদারটাং’)। এ বছর কুরোসাওয়া আকিরা পুরস্কার পেয়েছেন কোরীয় বংশোদ্ভূত জাপানি নির্মাতা লি সাং-ইল ও চীনা বংশোদ্ভূত মার্কিন নির্মাতা ক্লোয়ে ঝাও। আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয় বর্ষীয়ান চলচ্চিত্রকার ইয়ামাদা ইয়োজি ও কিংবদন্তি অভিনেত্রী ইয়োশিনাগা সায়ুরিকে।
সমাপনী বক্তব্য ও উৎসবের বার্তা
সমাপনীতে টোকিওর গভর্নর কোইকে ইউরিকো বলেন, ‘বিশ্ব যখন বিভাজন, যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত, চলচ্চিত্র তখন সাহসের সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির দেয়াল ভেঙে মানুষকে এক করে। এটি মানুষের দুঃখ, যন্ত্রণা, আনন্দ ও ভালোবাসা ভাগ করে নেওয়ার এক অভিন্ন স্থান।’ টিফ চেয়ারম্যান আন্দো হিরোইয়াসু বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে যখন বিভেদ বাড়ছে, তখন চলচ্চিত্র উৎসবগুলো আমাদের একত্র করছে, গভীর করছে পারস্পরিক বোঝাপড়া আর মানবিক সংলাপ।’ দশ দিনব্যাপী এই উৎসবে উপস্থিত ছিলেন ৬৯ হাজারের বেশি দর্শক; সংশ্লিষ্ট আয়োজনে অংশ নিয়েছেন এক লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ, যা গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশ বলেন, ‘প্রতিটি সুন্দর কবিতাই একেকটি প্রতিরোধ।’ চলচ্চিত্র যে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়, টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০২৫-ই তার প্রমাণ। ‘ফিলিস্তিন ৩৬’ যেন চলচ্চিত্রের ভাষায় এক জ্বলজ্বলে প্রতিরোধ, ইতিহাসের অমানিশার বিপরীতে একটি জাতির সংগ্রাম, ভালোবাসা, বেদনা ও মুক্তির স্বপ্নকে ধারণ করে যেটি হয়ে উঠেছে অনন্য এক শিল্পকর্ম। এই চলচ্চিত্র যেমন অতীতের প্রতিচ্ছবি, তেমনি ভবিষ্যতেরও অঙ্গীকার যে প্রতিটি জাতি, যত দমনই সহ্য করুক না কেন, নিজের গল্প বলার অধিকার কখনো হারায় না।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চলচ চ ত র উৎসব এই চলচ চ ত র ফ ল স ত ন ৩৬ চলচ চ ত র র ই চলচ চ ত র ঔপন ব শ ক প রস ক র ব স তবত চর ত র আম দ র পর চ ল র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
জীবনানন্দের হেমন্তচর্চা
জীবনানন্দের অনেক কবিতায় তাঁর প্রিয় ঋতু হেমন্তের নানাবিধ উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এই হেমন্তকে ঘিরেই তাঁর যাবতীয় ক্ষয়িষ্ণুবোধের সঞ্চালন এবং মৃত্যুচেতনার, শূন্যতার, রিক্ততার এবং অবসাদগ্রস্ততার আবহ সৃষ্টি হয়েছে। এই হেমন্ত আবার কখনো কখনো উজ্জীবনের, পূর্ণতার এবং জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি কোনো চেতনারও প্রতীক হিসেবে এসেছে। তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় সংকলিত কবিতার এক–চতুর্থাংশজুড়েই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এই হেমন্তের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। হেমন্ত জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টিপ্রেরণার অন্যতম উৎস, তাঁর কাব্যদর্শনের অনেকখানিই হেমন্তের নৈকট্যে সিদ্ধহেতু, তিনি হেমন্তের কবি হিসেবেও ভাবিত হতে পারেন। নিশ্চেতনা, মৃত্যুচেতনা এবং বিনষ্টি বা ধ্বংসের প্রতীক হেমন্ত মূলত কবির স্বপ্নমন্থিত জীবনচেতনারই এক ভিন্ন দিক। জীবনানন্দ দাশের কবি-অভিব্যক্তির সঙ্গে হেমন্তের অভিযোজন নিতান্তই ব্যক্তি জীবনানন্দের মননশীলতার লাজনম্র নিঃসঙ্গ ছায়া। ‘হেমন্তের হিম মাঠে, আকাশের আবছায়া ফুঁড়ে/ বক বধূটির মত কুয়াশায় শাদা ডানা যায় তার উড়ে’ (কবি, ঝরাপালক), অথবা ‘হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন—/ পথের পাতার মত তুমিও তখন/ আমার বুকের পরে শুয়ে রবে?’ (নির্জন স্বাক্ষর, ধূ ,পা)। জীবনানন্দ দাশের প্রেম ও যে মৃত্যু-স্বপ্নের বিষণ্ন আঁধারে, রিক্ততার গহিনে বিমলিন, সে ব্যাপারে আমাদের আর কোনো সন্দেহ থাকে না। ‘হেমন্তের হিম মাঠ’ অথবা ‘হেমন্তের ঝড়’ এই সব চিত্রকল্প নিতান্তই ক্ষয়িষ্ণুবোধেরই উদ্গিরণ।
জীবনানন্দ দাশের হেমন্ত কখনো কখনো উৎসবেরও প্রতীক, যদিও তা পূর্ণ অঙ্গীকারের ধারণারহিত; অবসাদের ছায়ায় ভারাক্রান্ত। ‘মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে—/ শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব...কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে;’ (অবসরের গান, ধূ ,পা)। এই উৎসবের চিত্রকল্প, কীটসের ‘ওড টু আ নাইটইঙ্গেলদ কবিতার ‘ডান্স, অ্যান্ড প্রভেনকাল সং, অ্যান্ড সানবার্ন্ট মার্থ’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। এই উৎসব শেষ হলে ‘দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ-অবসাদ/ আমাদের ডেকে লয়, তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা, অবসন্ন হাত’ (ঐ) এবং শেষমেশ অবসাদিত কর্ণকুহরে প্রবেশ করে ‘গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান’। মদ্য-মাতাল এই অবসাদ কবির উজ্জীবনোন্মুখ অন্তর্গত গূঢ় বেদনারই এক বিশেষ অভিজ্ঞান। আবদুল মান্নান সৈয়দ বলছেন, ‘অবসরের গান কবিতার শস্যোৎসব বস্তুত কবির হৃদয়োৎসব’ (শুদ্ধতম কবি, ১৯৭২ পৃ. ৯৪)। এই উৎসব উজ্জীবনের প্রতীক হলেও এর অন্তঃস্থিত ধ্বনি, জীবন ও মৃত্যুর চেয়ে অধিক অন্য কোনো অনুধ্যানে স্থিতধি।
হেমন্ত জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টিপ্রেরণার অন্যতম উৎস, তাঁর কাব্যদর্শনের অনেকখানিই হেমন্তের নৈকট্যে সিদ্ধহেতু, তিনি হেমন্তের কবি হিসেবেও ভাবিত হতে পারেন। নিশ্চেতনা, মৃত্যুচেতনা এবং বিনষ্টি বা ধ্বংসের প্রতীক হেমন্ত মূলত কবির স্বপ্নমন্থিত জীবনচেতনারই এক ভিন্ন দিক।‘পিরামিড’ কবিতায় মানবজীবনের নশ্বরতার ট্র্যাজিক আকুতি ফুটে উঠেছে। বিস্মৃতপ্রায় সময়ের কথা মনে করে কবি মনে হাহাকার পড়ে যায়। ‘মোদের জীবনে যবে জাগে পাতাঝরা/ হেমন্তের বিদায় কুহেলী/ অরন্তুদ আঁখি দু’টি মেলি/ গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান...অতীতের হিমগর্ভ কবরের পাশে/ ভুলে যাই দুইফোঁটা অশ্রু ঢেলে দিতে’ (পিরামিড, ঝ, পা)। এই কবিতায় পুনরুজ্জীবনবাদী চেতনার সংক্রমণ লক্ষ করা যায়।
জীবনানন্দের কবিতায় প্রকৃতির বীভৎস-বিরূপ, ভয়ার্ত রহস্যঘন বর্ণনা রয়েছে; তবে সে প্রকৃতি ইংরেজ কবি ও ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডি’র (১৮৪০-১৯২৮) শত্রুতায় অবতীর্ণ প্রকৃতির মতো নয়। হার্ডির প্রকৃতি প্রতিকূল এবং শত্রুতায় ক্রিয়াশীল, জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি কখনো কখনো বীভৎস হলেও শত্রুতায় ক্রিয়াশীল নয়। ‘ডাইনীর মতো হাত তুলে তুলে ভাঁট আশশ্যাওড়ার বন/ বাতাসে কি কথা কয় বুঝিনাকো, বুঝিনাকো চিল কেন কাঁদে; পৃথিবীর কোনপথে দেখি নাই আমি, হায় এমন বিজন শাদাপথ-সোঁদাপথ.../ সন্ধ্যা আসে সহসা কখন;/ সজিনার ডালে পেঁচা কাঁদে নিম-নিম-নিম কার্তিকের চাঁদে’ (গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে, রূ, বা)। এই কবিতায় প্রেতগ্রস্ত প্রকৃতির ভয়াবহ রহস্যঘন প্রশ্বাসই মূর্ত হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির এ রকম বিরূপ প্রতিকৃতি তিনি খুব কমসংখ্যক কবিতায়ই এঁকেছেন। গা ছমছমে, শ্বাসরুদ্ধকর ভুতুড়ে এই কাব্যচিত্র কবির প্রকৃতিবিষয়ক গূঢ় দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচায়ক।
‘হেমন্ত’ আবার কখনো কখনো নস্টালজিক আমেজে ভরপুর। ‘লোকেন বোসের জর্নাল’ কবিতায় যেমন সুজাতাকে তিনি কি এখনো ভালোবাসেন, এ প্রশ্নের জবাব তিনি নিজেই দিয়েছেন এভাবে, ‘সেটা অবসরে ভাববার কথা/ অবসর তবু নেই, / তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে।’ অথবা ‘হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোটে/ হৃদয় কেন যে কাঁপে,/ ‘ভালোবাসতাম’ স্মৃতি-অঙ্গার-পাপে,/...ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্ত রাগে’—এই সব পঙ্ক্তিতে উজ্জীবনের হঠাৎ জাগা প্রত্যাশা যেন বিষণ্নতার মহাশূন্যতায় হঠাৎ করেই হারিয়ে যায়। অতীতমুখীনতায় অন্বিষ্ট কবি স্বস্তি খোঁজেন স্মৃতি শৃঙ্গারে; স্মৃতি রোমন্থনের অবকাশ যেন একমাত্র হেমন্ত।
‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে/ হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে/ শুধু শিশিরের জল; (পেঁচা, ধূ, পা) ‘ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম পউসের রাতে’ (অন্ধকার, ব, সে) কারণ, ‘গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে’ তাঁর ‘আত্মা লালিত’; তিনি লক্ষ করেন ‘গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের.../ হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন।’ (সিন্ধুসারস, ম, পৃ)। এই সব কবিতা মূলত রিক্ততা, শূন্যতা এবং মৃত্যুচেতনার অঙ্গীকারে ঋদ্ধ।
জীবনানন্দ দাশের হেমন্ত কখনো কখনো উৎসবেরও প্রতীক, যদিও তা পূর্ণ অঙ্গীকারের ধারণারহিত; অবসাদের ছায়ায় ভারাক্রান্ত। ‘মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে—/ শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব...কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে;’ (অবসরের গান, ধূ ,পা)।‘বেড়াল’ কবিতায় ‘হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরানরঙের সূর্যের নরম শরীরে/ শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে’ খেলতে খেলতে যে ‘বেড়াল’ অন্ধকারকে ছোট ছোট বলের মতো সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিল, সেই বিড়াল এলিয়টের ম্যাকাভিটি নয়। ম্যাকাভিটিকে কেউ দেখতে পেত না; কিন্তু জীবনানন্দের বিড়ালের সঙ্গে ঘুরেফিরে কেবলই দেখা হয়, ‘মৌমাছির মতো নিমগ্ন’ এই বিড়াল মিশে গেছে প্রকৃতির অন্তর্সত্তায়। এলিয়টের ঔপনিবেশিক বিড়াল থেকে জীবনানন্দ বেরিয়ে এসেছেন ‘খণ্ডবাদ থেকে অখণ্ডবাদের দিকে’। বুদ্ধদেব বসু বলেছেন: ‘বেড়াল’ কবিতাটি অদ্ভুত রসে ভরপুর, বিস্ময়করকে চরমে টেনে নিলে কী দাঁড়ায় এটি তারই উদাহরণ (কালের পুতুল)। ‘হেমন্তের সন্ধ্যা’ এখানে প্রৌঢ়ত্বের প্রতীক, ফুরিয়ে যাওয়া জীবনের বিষাদঘন অধ্যায়। নানা কারণেই পরাবাস্তববাদী কবিদের কাছে হেমন্ত ঋতু বিশেষ আবহ নিয়ে দাঁড়ায়। মগ্নচৈতন্যের, স্বপ্নময়তার, আত্মতার বিপুল বিস্তৃত গহিনের সন্ধান পাওয়া যায় এই কবিতায়। বিড়াল এখানে কবির অন্তরাত্মার প্রতীক।
স্বপ্ন ও কল্পনার গভীর তলদেশ ছুঁয়ে অবচেতনের অন্তর্ভেদী আলোড়ন সাযুজ্য পেয়েছে তাঁর কিছু পরাবাস্তববাদী কবিতায়। তবে তাঁর এই স্বপ্ন-কল্পনার মহাযাত্রা কখনো কখনো অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। আমাদের বোঝাবুঝির জগৎ অসহায় হয়ে পড়ে। অবশ্য ভালো কবিতা বোঝাবুঝির আগে ‘কম্যুনিকেট’ করে যেমনটি বলেছেন টি এস এলিয়ট।
‘কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে’ আমরা দেখি ‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায়’। ঘোড়া কবিতায় যে পরাবাস্তব চিত্রকল্পের সন্নিবেশ ঘটেছে, তা কার্তিকের জ্যোৎস্নাকে কেন্দ্র করে বেশি প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছে। নরম বিকেল, কুয়াশা, জ্যোৎস্না এবং সর্বোপরি অন্ধকারের প্রতি তাঁর দুর্নিবার মোহ তাঁর মৃত্যুচেতনার দিগন্তকে আরও প্রসারিত করেছে। তাঁর এই মৃত্যুচেতনা এক নার্সিসাসীয় উন্মাদনায় উন্মুখ এবং গভীর মমতায় আবেশিত। ‘অন্ধকার’ কবিতায় এই বোধ সর্বাধিক উন্মোচিত এবং গাঢ়ীকৃত হয়েছে। এই কবিতার জীবন-বিমুখীনতা কখনোই জীবনহীনতা নয়; ‘যুগজ্বরে’ আক্রান্ত মানস-প্রতিক্রিয়া যা আধুনিক কবিতার চারিত্র্যলক্ষণ।
আরও পড়ুনজীবনানন্দ দাশ, কবিদের কবি২২ অক্টোবর ২০২৫‘হেমন্তের রাত আজ ক্ষুব্ধতায় জনতায় নর্মদায়-ক্লেদে/ লোভাতুর ক্রূর রাষ্ট্র সমাজের রতির নৈরাজ্যে অসম্ভব অন্ধ মৃত্যুতে...নরকের নিরাশার প্রয়োজন, রয়ে গেছে জেনে, তবু বলে;/ ‘গভীর গভীরতর তবুও জীবন’ (অনেক মৃত বিপ্লবী স্মরণে, আ, পৃ)। ইতিহাস পরিক্রমণ এবং রাষ্ট্র সমাজের বাহ্যিক আবরণের তলে এক উজ্জ্বলতর জীবনের ইঙ্গিত রয়েছে এই কবিতায়। রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, সাধারণ জনতার ক্লেদাক্ত জীবনবঞ্চনা ও গভীর নিরাশায়ও জীবনের জয়গান করেছেন কবি ‘গভীর, গভীরতর তবুও জীবন’। ‘হেমন্ত’ এখানে জরা, রিক্ততা এবং নৈরাশ্য সত্ত্বেও গভীর জীবনের আশ্বাসে ভরপুর।
‘রূপসী বাংলা’র কবি বাংলার প্রকৃতিসম্ভার ‘তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ’ দেখে আর পৃথিবীর রূপ খুঁজতে যান না, সেই কবির এই প্রকৃতিগত ভাব, ভাষা পেয়েছে ‘হেমন্ত’কে কেন্দ্র করে। তাই মৃত্যুর পরে তিনি ‘ধানসিঁড়ি নদীর তীরে এই বাংলায়...‘কার্তিকের নবান্নের দেশে’ ফিরে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন কখনো ‘শঙ্খচিল শালিখের বেশে’ অথবা ‘ভোরের কাক হয়ে’...বাংলার নদী মাঠ খেত ভালোবেসে’ (আবার আসিব ফিরে, রূ, বা)। তাঁর এই স্বাদেশিক মমতাময় উচ্চারণ তাঁর কবি-অভিব্যক্তির সম্পূরক এক স্বতন্ত্র প্রত্যয় যা সমগ্র বাংলা কবিতায় শুধু বিরলই নয়, অপ্রত্যাশিতও বটে। কবিতাটির শেষের কথা ‘আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে’ বাংলাদেশের প্রকৃতির প্রতি তাঁর নিবিড় মমতা তাঁকে প্রকৃতিরই অভিন্ন সত্তায় রূপান্তরিত করেছে যেন। যদিও সমস্ত কবিতাটিই মৃত্যুচেতনার প্রগাঢ় ছায়ায় আবৃত, তথাপি নতুন জীবনের তথা পুনরুজ্জীবনবাদী চেতনার অভিঘাতই এখানে মুখ্য।
স্বপ্ন ও কল্পনার গভীর তলদেশ ছুঁয়ে অবচেতনের অন্তর্ভেদী আলোড়ন সাযুজ্য পেয়েছে তাঁর কিছু পরাবাস্তববাদী কবিতায়। তবে তাঁর এই স্বপ্ন-কল্পনার মহাযাত্রা কখনো কখনো অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। আমাদের বোঝাবুঝির জগৎ অসহায় হয়ে পড়ে। অবশ্য ভালো কবিতা বোঝাবুঝির আগে ‘কম্যুনিকেট’ করে যেমনটি বলেছেন টি এস এলিয়ট।জীবনানন্দ দাশ সেই নতুন রাস্তার নিঃসঙ্গ পথিক, যার কাব্যচেতনার যুগনিঃসৃত ভার, কালচেতনার সংক্রাম তাঁকে চিরবহমান সময়ের দিকে ধাবিত করেছে। আধুনিক বাংলা কবিতায় মৃত্যুচেতনার তিনিই প্রথম সফল আমদানিকার এবং তাঁর কবিতায় যে ক্লান্তি, যন্ত্রণা এবং অবসাদ লেগে আছে আতীব্র, তা আধুনিক যুগ-যন্ত্রণারই প্রতিভূ। তাঁর প্রেমের সর্বাংশে লেগে আছে জরার গন্ধ; তাঁর প্রেমের মৃত্যু ঘটে ক্ষণিকেই, অতৃপ্তির ঐশ্বর্যে তাঁর প্রেমচিন্তা উচ্ছ্বসিত। ‘অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;/ সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে/ হেমন্ত এসেছে তবু; (অঘ্রান প্রান্তরে, ব, সে)। ‘আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউস সন্ধ্যায়,/ দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল/ কুয়াশার; .../ সব রাঙ্গা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে/ ধূসর মৃত্যুর মুখ—...।’ (মৃত্যুর আগে, ধূ, পা)।
এই ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটির বিষয়ে দীপ্তি ত্রিপাঠী’র বক্তব্য: ‘কবিতাটি পড়তে পড়তে মনে হয়, সর্ব ইন্দ্রিয় দিয়ে কবি জীবনের পাত্রে মৃত্যু রস পান করছেন।’ (আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয় ১৯৯২, পৃ: ১৪৫)। ভয়ংকরের মধ্যে সৌন্দর্য অবলোকনের একটি কাব্যিক অভিযান জীবনানন্দে রয়েছে এবং তাঁর গভীর মৃত্যুচেতনার, জরা ও বিনাশী বৈচিত্র্যের আড়ালেও ভেসে ওঠে এক পরিব্যাপ্ত জীবনের উন্মাদনা ‘সৌন্দর্য আস্বাদনের’ প্রত্যয়। জীবনানন্দের হেমন্ত-প্রীতির উৎস সম্পর্কে আসাদুজ্জামানের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য—‘এ হেমন্ত শীতের অস্ত্রাঘাতে জর্জর, স্থবিরতার পটভূমি হলেও এখানেই কবি সাক্ষাৎ পান জীবনের পরিপূর্ণতার; ...জীবনানন্দ দাশের কাব্যের কেন্দ্রীয় ঋতু হেমন্ত...তার আপাত ধূসরতার প্রচ্ছদে জীবনের অপর আকর্ষণকে উদগ্র করে তোলে।’ (জীবন-শিল্পী জীবনানন্দ দাশ, পৃ. ২৪)। উল্লেখ্য, জীবনানন্দের মৃত্যুচেতনার মোহন দীপাবলি হেমন্ত ও শীতের সান্নিধ্যেই মহিমান্বিত এবং মূলত হেমন্তেই পরিব্যাপ্ত, ভাস্বর। যন্ত্র-সভ্যতার প্রতি গভীর ঘৃণা ছিল তাঁর; তিনি বুঝেছিলেন ‘নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।’ শেষ আশ্রয় হিসেবে প্রকৃতির সান্নিধ্যই খুঁজেছেন এবং মৃত্যুর পরেও প্রকৃতিসত্তায় একাকার হয়ে যাওয়ার, প্রকৃতি পরিবারের চিরকালীন সখ্যই তাঁর আরাধ্য হয়েছে। আর সে কারণেই জীবনের বহিঃরঙ্গচর্চা থেকে ফিরে এসেছেন জীবনের ভেতরে, একান্ত হৃদয়ে। ‘বৃত্ত যেন শুদ্ধতায় নিরুত্তর কেন্দ্রে ফিরে এল/ এই শান্ত অঘ্রানের রাতে...বাংলার শস্যহীন ক্ষেতের শিয়রে/ মৃত্যু, বড়, গোল চাঁদ,’ (হেমন্ত, আ, পৃ। তাঁর অন্তর্মুখী বেদনার, শূন্যতার আভাসন ‘অঘ্রান’ কবিতায় ধরা পড়েছে। ‘আমি এই অঘ্রানেরে ভালোবাসি বিকেলের এই রং–রঙের শূন্যতা/ রোদের নরম রোম ঢালু মাঠ/ বিবর্ণ বাদামী পাখি হলুদ-বিচালি...এখন অঘ্রান এসে পৃথিবীর ধরেছে হৃদয়; ’(অঘ্রান, বে, অ, ক)।
প্রকৃতির বীভৎসতা, রিক্ত-শূন্য-বিরূপ আবহ, বৈনাশিক ভাব-বৈচিত্র্যের প্রচ্ছায়ায় তাঁর কিছু কিছু কবিতা উদ্বেলিত হলেও প্রকৃতিকে নিয়ে অবিশ্বাসের গান তিনি গাননি কখনো। প্রগাঢ় বিশ্বাসের মধ্যেই তাঁর প্রাকৃতিক স্বপ্নমন্থন ভাস্বরিত; ‘কোথাও আসিবে মৃত্যু কোথাও সবুজ মৃদু ঘাস/ আমারে রখিবে ঢেকে—ভোরে, রাতে, দু-প্রহরে পাখির হৃদয়’ (দূর পৃথিবীর গন্ধে, রূ, বা)।
‘অঘ্রানের বিকেলের কমলা আলোকে/ নিড়োনো খেতের কাজ করে যায় ধীরে; (আহ্বমান ব, সে) এই নির্জন খেতের মূর্খ অভিভূত চাষাদের চিরকালীন জীবনসংগ্রাম এবং দারিদ্র্য অতঃপর অস্তিত্বের টানাপোড়েন, ধ্বংস—এসবের মধ্যেই কবির নির্ঘোষ মনোবাঞ্ছা স্ফুরিত হয় ‘কবে তার ক্ষুদ্র হেমন্তের বেলা হবে নিসর্গের চেয়েও প্রবীণ’। নিম্নবর্গীয় চেতনা এবং কসমিকবোধে আক্রান্ত এই পঙ্ক্তি বিশ্বকবিতার ক্ষেত্রেও বিরল ও ব্যতিক্রম।
প্রকৃতির বীভৎসতা, রিক্ত-শূন্য-বিরূপ আবহ, বৈনাশিক ভাব-বৈচিত্র্যের প্রচ্ছায়ায় তাঁর কিছু কিছু কবিতা উদ্বেলিত হলেও প্রকৃতিকে নিয়ে অবিশ্বাসের গান তিনি গাননি কখনো। প্রগাঢ় বিশ্বাসের মধ্যেই তাঁর প্রাকৃতিক স্বপ্নমন্থন ভাস্বরিত; ‘কোথাও আসিবে মৃত্যু কোথাও সবুজ মৃদু ঘাস/ আমারে রখিবে ঢেকে—ভোরে, রাতে, দু-প্রহরে পাখির হৃদয়’।আশা ও নিরাশার মিশ্র প্রত্যয় বিভাসিত হয় তাঁর ‘কুড়ি বছর পর’ কবিতায়। জীবনানন্দের স্বপ্নচেতনে আলো ও আঁধারের যৌথ উপস্থিতি তাঁর কাব্যসত্তায় বাহিত করেছে এক অতিবর্তী সত্যতা, যা তাঁর কবিতার মৌল অঙ্গীকারকে স্থায়িত্ব দিয়েছে, বহুমাত্রিক দিকনির্দেশনায় অভিষিক্ত করেছে। ‘আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি! ...হয়ত ধানের ছড়ার পাশে/ কার্তিকের মাসে...সোনালী-সোনালী চিল - শিশির শিকার ক’রে নিয়ে গেছে তারে/ কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তাহারে’ (কুড়ি বছর পরে, ম, পৃ)। মৃত্যুর প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ জীবনের প্রতিই যে প্রচণ্ড ভালোবাসার বিষয়, সে কথা আমরা আগেই বলেছি। তিনি বলেছেন, ‘সব ভালোবাসা হলো যার, দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে।’ এ কথা নির্মম হলেও সত্য যে মৃত্যুকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই কেবল জীবনের পরিপূর্ণতাকে স্পর্শ করা যায়—জীবনানন্দ দাশ তা ভালো করেই বুঝতেন। তাঁর মধ্যে এই চেতনা দানা বেঁধে উঠেছিল হয়তো ব্যক্তিজীবনের আনন্দহীনতা কিংবা অশান্তির মিথস্ত্রিয়ায়—মৃত নক্ষত্রের শীতল আবরণে তিনি খুঁজেছিলেন আশ্রয়।
‘হেমন্তের প্রান্তরের তারার আলোক’ (তিমির হননের গান) এবং সেই আলোকের হাতছানিতে নিজেকে মানুষ হিসেবে—‘সৃষ্টির হৃদয়ে/ হৈমন্তিক স্পন্দনের পথের ফসল’ (সময়ের কাছে) তুলে দিয়ে শেষাবধি তিনি একটি নক্ষত্রের মতো এসে ‘তারপর একপায়ে চলে/ ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে’ (একটি নক্ষত্র আসে) ‘উজ্জ্বল ও নিরুজ্জ্বল নক্ষত্র-গ্রহের আলোড়নে/ অঘ্রানের রাত্রি হয়;...’ আর ‘শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন/ জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ; (ঐ)। হেমন্ত ছিল তাঁর প্রগাঢ় কবিসত্তারই অভিব্যক্তি; ধ্বংস, বিনষ্টি, বিষাদ ও অবক্ষয়ের প্রতীক হিসেবে হেমন্তের প্রতীকীসত্তা উজ্জ্বলতর হয় যখন দেখি, ব্যাপারটি কাকতালীয় যদিও, কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু হেমন্ত ঋতুতে ঘটেছে। ট্রামের ধাক্কায় আহত হওয়া এবং (২২ অক্টোবর ১৯৫৪) মৃত্যুবরণ যেন সেই বিনাশী হেমন্তেরই মহাডাক ‘শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ...।’
????️ অন্য আলোর ফেসবুক পেজ ফলো করুন