জুলাই আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পৃথক কমিশন গঠন করা উচিত। কারা প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত তাদের তালিকা তৈরি এবং বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। 

মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডিতে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) কার্যালয়ে ট্রানজিশনাল জাস্টিস বা ক্রান্তিকালীন ন্যায়বিচার বিষয়ক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা জানান। ক্রান্তিকালীন ন্যায়বিচারের জন্য ট্রুথ কমিশনের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেন তারা। 

সেমিনারে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গবেষক ও রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের (রিব) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ড.

শামসুল বারী। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একটা কমিশন হওয়া উচিত ছিল। সেটা হলে দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য তাদের রাস্তায় নামতে হতো না। 

তিনি জানান, জুলাই আন্দোলনে হতাহতদের জন্য একটা ফাউন্ডেশন হয়েছে। সেখানে ১০০ কোটি টাকা জমা হয়েছে। সেখান থেকে কারা সাহায্য পাচ্ছে, কারা পাচ্ছে না, কেন পাচ্ছে না। এগুলো সবার জানতে হবে। 

ক্রান্তিকালীন ন্যায়বিচার নিয়ে আলোচনায় বলা হয়, গৃহযুদ্ধ বা দমনমূলক স্বৈরশাসনের আমলে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত অশান্ত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ব্যবস্থাকে ক্রান্তিকালীন বিচারব্যবস্থা বলা যায়। ক্রান্তিকালীন ন্যায়বিচার ধারণার সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক রয়েছে। দেশ এখন একটি ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এ সময় মানবাধিকার কর্মীদের কী করণীয় সে সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দিতে পারে ক্রান্তিকালীন ন্যায়বিচারের ধারণা। ট্রানজিশনাল বলতে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থার দিকে যাওয়া। ক্রান্তিকালীন বা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ করে। ট্রানজিশনাল জাস্টিসের মূল লক্ষ্য হলো অপরাধীর বিচার ও দায়ব্যবস্থা নিশ্চিত করে, ভিকটিমের চাহিদা মিটিয়ে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা। তার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও মেকানিজমের মধ্যে ট্রুথ কমিশন অন্যতম।  

সেমিনার উদ্বোধন করেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল। তিনি ক্রান্তিকালীন ন্যায়বিচারের সঙ্গে মানবাধিকার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার গভীর সংযোগের বিষয়টি তুলে ধরেন। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার ট্রানজিশনের পথে  বিশাল পথ বাকি আছে৷ আমাদের পঞ্চাশ বছরের স্মৃতি সুখকর না। মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমাদের পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। আমরা সবসময় অনুকূল পরিবেশ পাবো তা নয়। মানবাধিকার কর্মীরা সব সময় প্রতিকূল পরিবেশেই কাজ করে।

সেমিনারে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন ছাড়াও বেসরকারি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ডব্লিওবিবি ট্রাস্ট, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ (রিব), স্পেচ ফাউন্ডেশন, বাঙালি সমগ্র জাদুঘর ও নিজেরা করির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

রপ্তানি রেমিট্যান্স ছাড়া সবকিছুতেই অস্বস্তি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর টালমাটাল পরিস্থিতিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে স্বাভাবিক হয়নি জনজীবন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি নেই। মূল্যস্ফীতি আগের মাসগুলোর তুলনায় সামান্য কমলেও, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে ভোগাচ্ছে। 
ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলগুলো এবং সরকার জাতীয় ঐকমত্যের কথা বললেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি। সরকারের কাজে গতিহীনতার জন্য একাধিক উপদেষ্টাসহ অনেকেই দায়ী করছেন জনপ্রশাসনের স্থবিরতাকে। অন্যদিকে বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতি, চাকরি স্থায়ীকরণ, নিয়োগসহ সরকারি চাকরিজীবীদের নানা দাবি নিয়ে আন্দোলন মোকাবিলা করতে হচ্ছে সরকারকে।

গত ছয় মাসে অন্তত দেড়শ আন্দোলন হয়েছে। যৌক্তিক, অযৌক্তিক দাবি নিয়ে সড়ক বন্ধ করে আন্দোলন সাধারণ মানুষকে ভোগালেও, তা নিরসনে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। জুলাই গণহত্যা ও আওয়ামী লীগ শাসনামলের অনিয়মের বিচারের গতি ধীর বলে অভিযোগ অভ্যুত্থানের অংশীজনের। রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, সংস্কারের গতিও ধীর। 

স্বাভাবিক হয়নি আইনশৃঙ্খলা 
ছয় মাসেও পুলিশ-র‌্যাবের কার্যক্রমে আশানুরূপ গতি আসেনি। অপরাধ দমন বা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শক্ত ভূমিকা চোখে পড়ছে না। ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ছাড়াও গত ছয় মাসে সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ ‘মব জাস্টিস’। পলাতক শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের আয়োজনে ভাষণ দেওয়ার ‘প্রতিবাদে’ গত বুধবার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া শুরু হয়। সারাদেশে অন্তত ৫০ আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িঘরে হামলা হয় পরের দুই দিনে। 

বিএনপিসহ রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজ সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় উদ্বেগ জানালেও ঢাকাসহ কোথাও এসব হামলা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর হতে দেখা যায়নি। ধানমন্ডিতে ভাঙচুর শুরু হওয়ার প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, হামলার চেষ্টা দমন করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল শুক্রবার বিবৃতিতে শেখ হাসিনার পরিবারের সম্পত্তি ধ্বংস থেকে বিরত থাকা এবং ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি কিংবা অন্য কোনো অজুহাতে কোনো নাগরিকের ওপর আক্রমণ না করার আহ্বান জানান। 

অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগের শাসন টিকিয়ে রাখতে হত্যাযজ্ঞ চালায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ৫ আগস্টের পর জনরোষের শিকার হয়ে আত্মগোপনে চলে যান বাহিনীর সদস্যরা। সপ্তাহখানেক পর দায়িত্বে ফিরলেও যাত্রাবাড়ীর মতো অনেক স্থানে থানা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ফলে বিকল্প স্থানে জোড়াতালি দিয়ে চলে কার্যক্রম, এখনও টহল ঢিলেঢালা।

ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ নানারকম অপরাধে জড়িত অনেকে জামিনে মুক্ত হয়। কারাগার থেকে বেরিয়ে তারা আবারও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করে। চাঁদাবাজি, দখল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘাতে জড়ায়। রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম করে সন্ত্রাসীরা। শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের অনুসারীরা এ ঘটনা ঘটায় বলে জানা যায়। পরে এ ঘটনায় তাঁর অনুসারী ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ হোসাইন মিথুনকে আটক করে পুলিশ। মিথুনকে ছিনিয়ে নিতে নিউমার্কেট থানার সামনে পুলিশের ওপর হামলা চালায় তার অনুসারী ছাত্রদল-যুবদলের নেতাকর্মীরা। দুই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।

গত সপ্তাহেই গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগ নেতাকে ছাড়িয়ে নিতে গোপালগঞ্জসহ তিন জেলায় পুলিশের ওপর হামলা করে ক্ষমতাচ্যুত দলটির কর্মী-সমর্থকরা। গত মঙ্গলবার আটক তিন নেতাকর্মীকে ছাড়িয়ে নিতে উত্তরা পশ্চিম থানায় হামলা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
সম্প্রতি দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ আয়োজনে বাধা দেয় ও হামলা চালায় ‘তৌহিদি জনতা’ পরিচয় দেওয়া কিছু মানুষ। সে সঙ্গে চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস, পরীমণি ও অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উদ্বোধনে বাধা দেওয়া হয়। এসব ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অপরাধী শনাক্ত বা গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রেও পূর্ণ মাত্রায় তৎপর হতে পারেনি পুলিশ।

পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে দেশে ৯৪৭ জন খুন হয়েছে। এই সময়কালে ২৪৩টি ডাকাতি ও ৫৫৩টি দস্যুতার মামলাও হয়েছে। আর চুরির ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৪৮৪টি।

শুধু রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে উন্নতি 
রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্বস্তি দিলেও মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, বাজেট বাস্তবায়ন, রাজস্ব আদায়, বেসরকারি বিনিয়োগ, পুঁজিবাজার ও বিদেশি বিনিয়োগের অবনতি হয়েছে।  সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পর্যালোচনা অনুযায়ী, পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী সরকারের কাছ থেকে ভঙ্গুর অর্থনীতি পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, শ্রীলঙ্কার চেয়েও খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ১২টি ব্যাংক ছিল অকার্যকর। আমানতকারীর টাকা নিয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি হতো ভয়াবহ।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম সাত মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ২৩ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি। সাত মাসে রপ্তানি হয়েছে মোট ২ হাজার ৮৯৭ কোটি ডলারের পণ্য, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভ বেড়ে ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে রিজার্ভ প্রতি মাসে গড়ে এক বিলিয়ন ডলার করে কমছিল। 

অর্থনীতিতে কিছুটা গতি এলেও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমায় কর্মসংস্থান বাড়েনি। জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বেকারত্বের মাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে এ পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। প্রথম চার মাসে সার্বিকভাবে বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে ১৮ শতাংশ। এ সময়ে উন্নয়ন ব্যয় রেকর্ড পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। পরিকল্পনা বিভাগের পর্যবেক্ষণ, বাজেট বাস্তবায়ন হার এত নিম্ন পর্যায়ে থাকলে আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না।

রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচন-সংস্কার নিয়ে বিরোধ 
শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে ১৫ বছর একসঙ্গে আন্দোলন করা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ৫ আগস্টের পর ঐক্যের কথা বললেও তা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দূরত্ব বিরোধে রূপ নিয়েছে। সংবিধান, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, জুলাই ঘোষণাপত্রসহ অনেক ইস্যুতেই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতৃত্বের সঙ্গে বিপরীতমুখী অবস্থান বিএনপির। ছাত্রনেতৃত্ব যে দল গঠন করতে যাচ্ছে তাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে কিনা, প্রশ্ন তুলে সন্দেহের কথা জানাচ্ছে বিএনপি। 

সরকারকে সমর্থন দেওয়ার কথা বললেও দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার বিএনপি নেতারা সমালোচনা করছেন। সংস্কার প্রশ্নেই রাজনৈতিক বিরোধ বেশি। জামায়াত ও ছাত্রনেতৃত্ব নির্বাচনের আগে সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিলেও বিএনপি চায় নির্বাচিত সরকার করবে সংস্কার। চলমান পরিস্থিতিকে নৈরাজ্যকর আখ্যা দিয়ে গতকাল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের পথ বাধাগ্রস্ত হবে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সমকালকে বলেছেন, গণতন্ত্রে ফিরতে নির্বাচন তো হতেই হবে। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানে হাজারো মানুষ শুধু নির্বাচনের জন্য জীবন দেননি। তাদের আত্মত্যাগের চেতনা এবং তারুণ্যের চাওয়াকে ধারণ করতে সংস্কার লাগবে। 
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সমকালকে বলেছেন, খুব বেশি মতপার্থক্য নেই। জামায়াত ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন চায়। নির্বাচনের আগে মৌলিক কিছু সংস্কার হতে হবে। বাকি সংস্কার নির্বাচিত সরকার করবে। 

আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। জামায়াত ও ছাত্রনেতৃত্ব আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত দলটির অংশগ্রহণ চায় না। সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আসতে দেওয়া হবে না। বিএনপি একসময়কার ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে আসছিল। সম্প্রতি দলটির নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের বিপক্ষে নয় বিএনপি। 

গতকাল শুক্রবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে সরকার শিগগিরই পদক্ষেপ নেবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের ‘ঐকমত্য’ তৈরি হচ্ছে। ঐকমত্য হলে সরকারের জন্য যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ হবে।

ইতোমধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। চলতি মাসে এসব প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা শুরুর কথা রয়েছে। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের মতো সংস্কার নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে।   

জনপ্রশাসনে অস্থিরতা
পদোন্নতি, পদায়নসহ নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ব্যস্ত জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা। পদায়ন ও আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্বে সৃষ্ট  বিশৃঙ্খলা কাটছে না।  শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,  ত্রাণ, পরিবেশ, পানি, ডাকসহ ২০টির বেশি মন্ত্রণালয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ করা সচিবরা রয়েছেন।  

গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ আটকে যাচ্ছে আমলাতন্ত্রে। নিয়মিত (রুটিন) কাজ ছাড়া নীতিনির্ধারণী বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে পারছে না প্রশাসন। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণার পর আরও কৌশলী আমলারা। অনেকে এই সরকারের আমলে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে চাইছেন না। একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, নাগরিক সেবা সহজ করা, সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের গতি বাড়ানো ও দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে তেমন নজর দেওয়া হয়নি।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর বিবৃতিতে জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ডিসিদের মামলা নেওয়ার প্রস্তাবের প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার আরেক উদাহরণ হলো কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করে আবার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। প্রজ্ঞাপন, অফিস আদেশ জারি করেও তা টেকাতে পারছে না সরকার।

বিশেষ করে ৪৩তম বিসিএসের নিয়োগ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির পর সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) ছয় সদস্যকে নিয়োগ দিয়েও বাতিল করা হয়। ডিসি পদায়নে দফায় দফায় আদেশ বদল হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদোন্নতিবঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বঞ্চনা নিরসনে গঠিত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রস্তাব গত ২৪ ডিসেম্বর অনুমোদন দেয় সরকার। আওয়ামী লীগ আমলে যেসব কর্মকর্তা সচিব হতে পারেননি; কিন্তু চাকরি করেছেন– তারাও বাড়তি সুবিধার জন্য তদবির করছেন। এতে আটকে গেছে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সুবিধা দেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি। 

মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ছয় মাসে সচিব করা হয়েছে প্রায় ৩০ কর্মকর্তাকে। গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ২২ জন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ সিদ্ধান্তই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় স্বাধীনভাবে নিতে পারেনি। ওপরের মহল থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে চাপের মুখে কোনো কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও হয়েছে। 

সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার সমকালকে বলেন, গত ছয় মাসে সরকার দক্ষ ও সাহসী লোক নিয়ে প্রশাসন সাজাতে পারেনি। প্রশাসনে অনেকে আছেন, যারা আগেও বঞ্চিত ছিলেন, এখনও কপালপোড়া। এসব কারণে সরকার ভালো সহযোগিতা পাচ্ছে না, সমন্বয় হচ্ছে না। এ জন্য দু’পক্ষই দায়ী। সরকার ঠিক থাকলে কেউ কাজে ফাঁকি দিতে পারবে না।

সম্পতি জনপ্রশাসন সচিব আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছিলেন, আর দুই-তিনটি সভার পর মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করা হবে। এখন বলা হচ্ছে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার মতো অর্থ সরকারের নেই। এতে ক্ষুব্ধ  কর্মচারীরা। ১১ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারীরা নতুন বেতন কাঠামোর দাবিতে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ