‘আমাদের দেশের মানুষ আর্সেনিকে মারা যায়। দূষিত পানি ও ভেজাল খাদ্য খেয়ে মারা যায়। আমরা একটা দূষণের মধ্যে বাস করছি। বাংলাদেশকে সুন্দর রাখতে হলে একে বদ্বীপের মতোই রাখতে হবে। সেটা করতে গেলে আমাদের নদীকে রক্ষা করতে হবে।’

আজ শনিবার রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে অলাভজনক সংস্থা ওয়াটার্স কিপার্স আয়োজিত ‘পিএফএএস পলিউশন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ ইন বাংলাদেশ’ নামের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন সমাজকল্যাণ ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ।

পিএফএস (পার-ও পলিফ্লুরোঅ্যালকাইল) হলো মানুষ ও পরিবেশের জন্য বিষাক্ত একটি রাসায়নিক। মানুষের দেহে ও পরিবেশে এটার ভয়াবহতার কারণে এটাকে ‘ফরএভার পলিউশন’ বা চিরস্থায়ী দূষণও বলা হয়। বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও চামড়াশিল্প থেকে এ দূষণ নদী ও পরিবেশে ছড়াচ্ছে। পোশাকশিল্পে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরিতে পিএফএস ব্যবহার করা হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা বলেন, ‘পৃথিবীর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর সফলতা পরিবেশ ধ্বংসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যেমন আমরা ভূপৃষ্ঠের পানি রক্ষা করতে পারিনি। এখনো করছি না। শিল্পায়নের কারণে ভূপৃষ্ঠের পানি আমরা নষ্ট করে ফেলেছি।’

বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর দেশ হিসেবে দেখতে চাইলে নদীগুলোকে রক্ষার বিকল্প নেই বলে জানান সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ।

পোশাকশিল্পের খাতকে বাংলাদেশের ‘ব্লু আইড বয়’ মন্তব্য করে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা বলেন, ‘গার্মেন্টসকে সুনীতির মধ্যে আনতে গেলে মালিকেরা উৎপাদন খরচের কথা বলবেন। যারা শ্রমিকদের পাঁচ টাকা বাড়তি দেয় না, তারা আমাদের নদী রক্ষা করবে বলে মনে হয় না।’

নদী রক্ষা কমিশনে কাজ করার স্মৃতি স্মরণ করে শারমীন এস মুরশিদ বলেন, ‘আমাদের সময়ে নদী রক্ষা নিয়ে কিছু মৌলিক গবেষণাভিত্তিক ভালো কাজ করেছিলাম। প্রতিটি জেলার নদীর কোনটার কী অবস্থা সেটি তুলে ধরেছিলাম। কারা দখলদার, কারা দূষণকারী, সেগুলো উল্লেখ করেছিলাম। সে বই এখন শেলফের মধ্যে পড়ে থাকে। কাজে লাগানো হয় না।’

সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা আরও বলেন, বাংলাদেশ দরিদ্র নয়; কিন্তু অব্যবস্থাপনার দেশ। এটি এমন একটি দেশ, যেখানে রাষ্ট্রীয় ভান্ডার শূন্য করে ফেললেও তাকে দুর্নীতি বলা যায় না। অথচ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।

শারমীন এস মুরশিদ বলেন, একটি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশকে রাজনীতি ও গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নিতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারমুখী হওয়ার পরামর্শ দেন উপদেষ্টা শারমীন মুরশিদ। রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘যদি তারা ভাবে, যেভাবে তারা চলে এসেছে, সেভাবে চলবে। প্লিজ, ডোন্ট মেক মিসটেক। ৩০ হাজার মানুষ পঙ্গু, ১ হাজার ৫০০ ছেলেমেয়ে মারা গেছে। এটাকে মুছে দেওয়া যাবে না।’

উপদেষ্টা শারমীন পিএফএসের দূষণ নিয়ে সমন্বিত নীতি প্রণয়ন করার বিষয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন গণসংহতি আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, ‘জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিকে একটি চিকিৎসা–সংক্রান্ত বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। দূষণের উৎস, বর্জ্যের উৎস কোথায়, সেটি অজানা কিছু নয়। সেসব জায়গায় সরকারের ম্যাকানিজম নিশ্চয়ই আছে। তবে সেটা যে কার্যকর না, তা বোধগম্য। আমাদের বড় আকারের পরিকল্পনা দরকার। কোথায় শিল্প হবে, কোথায় কৃষি হবে, কোথায় জনবসতি হবে সেটা ঠিক করতে হবে।’

অনুষ্ঠানে ‘ডেলিগেশন অব ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন টু বাংলাদেশ’-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার হুবার্ট ব্লুম বলেন, পরিবেশ রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নতির মধ্যে বাংলাদেশ ভারসাম্য রাখতে পারেনি। শিল্পের উন্নয়ন পিএফএসের দূষণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি বৈশ্বিক একটি সমস্যা, যার জন্য আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ দরকার।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ওয়াটার্স কিপার্সের বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন র জন ত আম দ র পর ব শ

এছাড়াও পড়ুন:

অবৈধভাবে খাল দখল: এক কিলোমিটারেই ১১ ভবন, ৭০ দোকান

লক্ষ্মীপুরে অবৈধভাবে খাল দখলের যেন মহোৎসব চলছে। জেলার পাঁচ উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক খাল ইতিমধ্যে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। প্রতিদিনই খালের দুই পাড় ভরাট করে গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা। এতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ব্যহত হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। 

জেলার কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট বাজার এলাকায় জারিরদোনা খালের এক কিলোমিটার জায়গায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ১১টি বহুতল ভবন ও ৭০টির মতো দোকানপাট। নির্মাণ করা হয়েছে ১১টি বক্স কালভার্ট। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নাকের ডগায় খাল দখল করলেও প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে। এতে দখলদাররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে এবং দখল করেই যাচ্ছে। 

এদিকে, লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে ৮০ জন দখলবাজের তালিকা তৈরি করে তাদের দখলে থেকে খালটি উদ্ধার করতে উচ্ছেদের আদেশ হলেও কার্যকর প্রদক্ষেপ নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল ওহাব, আক্তার হোসেন ও এলাকাবাসী আজাদ উদ্দিন ও আব্দুর রহমান জানান, উপজেলার চরফলকন, চরলরেন্স, হাজিরহাট ও সাহেবেরহাট ইউনিয়নসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিকাজে এই খালের পানি ব্যবহার করা হয়। পানির স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে যেমন পানির সংকটে কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। আবার বর্ষা মৌসুমেও পানি নিষ্কাশনজনিত সমস্যায় সয়াবিন, ধান, মরিচ, বাদাম ও সবজিসহ বিভিন্ন ফসল ও বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, খালের দুই পাড়ে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় প্রতিদিনই অবৈধভাবে গড়ে উঠছে কোনো না কোনো স্থাপনা। পাউবোর কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে চলে এসব অবৈধ দখল। কয়েক দিন পরপর দখলদারদের হাত থেকে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চালায় প্রশাসন। কিন্তু উচ্ছেদের কিছুদিন পর আবারও দখল হয়ে যায়।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, হাজিরহাট বাজারের উত্তর অংশের ১০০ মিটারের মধ্যে ‘হাজী মোতাহের হোসেন সুপারমার্কেট, আল মোস্তফা মঞ্জিল নামে চারতলাসহ অন্তত ১১টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ছোট-বড় প্রায় ৭০টি টিনশেড দোকানঘর নির্মাণ করা হয়েছে।

উপজেলা ভূমি অফিসের তথ্য মতে, পিএস জরিপে হাজিরহাট বাজার অংশে খালের প্রশস্ততা ছিল গড়ে প্রায় ৩২ ফুট। বর্তমান আরএস জরিপে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০ ফুটে।

কমলনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরাফাত হুসাইন বলেন, “এরই মধ্যে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদেরকে নোটিশ করা হয়েছে। কিন্তু তারা কোন সাড়া দেয়নি। জেলা প্রশাসনের নির্দেশে তালিকাভূক্ত ৮০ স্থাপনার বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযানসহ শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

অন্যদিকে রহমতখালী খালের লক্ষ্মীপুর পৌরসভা এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ময়লা পানি, আবর্জনা আর সংকীর্ণতায় অস্তিত্ব হারাতে বসেছে খালটি। দুই পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে দোকান ও বাড়িঘরসহ অবৈধ স্থাপনা। বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা এসব স্থাপনা চলছে বহাল তবিয়তে। এতে ময়লা-আর্বজনার স্তূপ জমে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে খালটি। এর ফলে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে আর দুর্ভোগ বাড়ছে মানুষের। একই অবস্থা ডাকাতিয়া নদীতেও।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর সদর, রায়পুর, রামগতি, কমলনগর ও রামগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া রহমতখালী খাল ও ডাকাতিয়া নদীসহ প্রায় অর্ধশতাধিক খালই এখন মৃতপ্রায়। প্রায় ১৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এসব খাল ও নদীর অস্তিত্ব ছিল।

লক্ষ্মীপুর জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী মাহীর আসহাব বলেন, “রহমতখালী খাল প্রায় ২০০ ফুট চওড়া ছিল। দখলের কারণে তা এখন মাত্র ৩০-৪০ ফুটে দাঁড়িয়েছে। পৌরসভার বেশির ভাগ বর্জ্যই এখন এই খালে যাচ্ছে। ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।”

জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদুল জামাল বলেন, “খাল দখলে কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে অবৈধ দখলদারদের তালিকা করা হয়েছে। এরপর উদ্ধার অভিযান চালানো হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে কিছু কিছু জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে।”

ঢাকা/লিটন/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ