বাংলাদেশে ৫ আগস্ট ২০২৪-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পর্যালোচনায় চাণক্যের (কৌটিল্য) ‘শত্রু-মিত্র’ নীতির বিবেচনা ক্রমেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। তাঁর রচিত অর্থশাস্ত্র প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক কূটনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই দলিলের অন্যতম আলোচিত কৌশলগত ধারণা– ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’– মিত্রতা ও শত্রুতার ভারসাম্য রক্ষায় বাস্তববাদী কূটনীতির নির্দেশনা দেয়। এই নীতিতে ‘শত্রুর বন্ধু শত্রু’– এ ধরনের কোনো ধারণা নেই। বরং শত্রুতা না বাড়িয়ে কৌশলগত মিত্রতা বাড়ানোরই পরামর্শ আছে। এই তত্ত্ব মূলত সীমান্ত ভাগাভাগি করা রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। তবে আন্তঃরাষ্ট্রের (ম্যাক্রো পারস্পেক্টিভ) পাশাপাশি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর (মাইক্রো পারস্পেক্টিভ) কৌশল নির্ধারণেও গুরুত্ব বহন করে। রাজনীতি (রিয়েলপলিটিক অর্থে) মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক খেলা হলেও দেশ ও জনগণের ভাগ্য নির্ধারণে রাজনীতিই শেষ এবং একমাত্র ভরসা। রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল রাষ্ট্র যে কোনো স্থায়ী সফলতার পূর্বশর্ত। তাই যাবতীয় কল্যাণার্থে রাজনৈতিকভাবে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হলে শত্রুতা নয়, বরং পারস্পরিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

ইতিহাসের পাঠ থেকে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার। বিপ্লব বা গণআন্দোলনের পরে ক্ষমতা পায় সেই দল বা শক্তি, যারা বিপ্লব সংঘটিত করে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কোনো একক সুগঠিত রাজনৈতিক দলের বিপ্লবী গণআন্দোলনের সরাসরি ফসল নয়। যে আন্দোলনের ফসল এ সরকার, তার নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা থাকলেও বিভিন্ন মৃত্যুপথের রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এতে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। তাই এ সরকারের মূল দায়িত্ব হবে রাজনৈতিক মেরূকরণ না বাড়িয়ে, বরং ভারসাম্য রক্ষা করা। 

বাংলাদেশে বর্তমানে যদি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়, তাহলে বিএনপি সম্ভাব্য বিজয়ী শক্তি হতে পারে– এটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণে অনেকটাই পরিষ্কার। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার যদি স্বপ্রণোদিত কিংবা অন্য কোনো শক্তির প্ররোচনায় বিএনপি কিংবা অন্য যে সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আছে সেগুলোকে একেবারে কোণঠাসা করার নীতি গ্রহণ করে এবং শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে তাদের নেতৃত্ব, কর্মী ও রাজনৈতিক অধিকার দমন করে, তবে এই শত্রুতা শুধু বেড়েই চলবে। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি সাধারণ মানুষের আস্থাও কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ছিল নিপীড়ন, বৈষম্য ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিপরীতে একটি ন্যায়ভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রচলন। এই স্পিরিট ধারণ করে যেসব বাম-মধ্য-ডানপন্থি রাজনৈতিক সংগঠন– বিশেষত বিগত সরকারের আমলে যে দলগুলো দমন-পীড়নের শিকার হয়েছিল– তাদের রাজনৈতিক অধিকার পুনঃস্থাপন ও নির্বাচনের আগে একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করাই এ সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হওয়া উচিত। 

গত ১৫-১৬ বছরে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করেছে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের প্রয়াস চালিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে যদি দলটির কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ থাকে, তবে তা যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। একই সঙ্গে দলের ভেতর থেকেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। কিছু ব্যক্তির বিচ্যুতির কারণে পুরো দলকে খাটো করা বা রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য প্রমাণের চেষ্টা গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করবে। মনে রাখতে হবে বিগত সময়ে বিএনপি নানা ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন ও রাজনৈতিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে। তৎকালীন শাসকের দলটিকে ভাঙার বহু চেষ্টার পরও বিএনপি অটুট আছে। এটি কোনো ঐশ্বরিক বা নির্ভুল রাজনৈতিক দল নয় যে এর সব কর্মী সহিংসতা বা চাঁদাবাজির অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় এও সত্য,  রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতা গণতান্ত্রিক ভারসাম্য ভেঙে দেয়, যার ফল দীর্ঘ মেয়াদে কর্তৃত্ববাদী শাসন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। আমরা বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে এ বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছি। সুতরাং এ মুহূর্তে সবচেয়ে যুক্তিসংগত পথ হলো, সব গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক ও নির্বাচনী রূপরেখা নির্ধারণ করা।

বর্তমানে জনপরিসরে একটি সাধারণ অভিযোগ উঠেছে যে, সরকার বিতাড়িত আওয়ামী লীগের মতো নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করছে। যদি সরকারের মধ্যে এমন মনোভাব থেকেও থাকে, তা পরিহার করা উচিত। পরিবর্তে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যেখানে সব কার্যকর রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারে, জনগণের আস্থা অর্জনে কাজ করতে পারে এবং দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে তুলতে পারে। তাই এ মুহূর্তে শত্রুতা নয়, রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও সমঝোতা দরকার। শত্রু কমানোর কৌশলই হতে পারে এ সরকারের প্রকৃত নীতিগত সাফল্য। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার প্রবণতা কীভাবে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে এবং জনগণের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিগত শাসকগোষ্ঠীর একচোখা সিদ্ধান্ত ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা শুধু রাজনৈতিক সংকটই সৃষ্টি করেনি, বরং তা দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে। কর্তৃত্ববাদী একমুখিতা রাজনীতিকে সংকীর্ণ করে তুলেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকৃত সাফল্য মাপা হবে তার সময়কালে ক্ষমতার ব্যবহার কতটা ন্যায়নিষ্ঠ ছিল, আর কতটা স্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক কাঠামো তারা রেখে যেতে পারবে তার ওপর। এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ রয়েছে– একটি গ্রহণযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা; সেই সঙ্গে আস্থাহীনতার দীর্ঘ ছায়া সরিয়ে একটি আলো ঝলমলে রাজনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেওয়া। 

ড.

সাজ্জাদ সিদ্দিকী: বিভাগীয় প্রধান, শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত গণত ন ত র ক গ রহণয গ য র জন ত ক স ও র জন ত ক র জন ত ক প সরক র র এ সরক র শত র ত ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই ঘোষণাপত্র আসছে, উপদেষ্টা আসিফের ফেসবুক পোস্ট

জুলাই ঘোষণাপত্র আসছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এ কথা জানান তিনি।

উপদেষ্টা আসিফ ওই ফেসবুক পোস্টে ৩৬ জুলাই আন্দোলনে শিল্পীদের রাজপথের ভূমিকা তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, ‘হত্যার বিচার ও চলমান দমন-পীড়ন বন্ধের দাবিতে রাজপথে নামেন শিল্পীরা। সকাল ১১টায় সংসদ ভবনের সামনে মানববন্ধনের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি থাকলেও খামারবাড়ি মোড়ে পৌঁছালে পুলিশ তাঁদের পথ আটকে দেয়। বাধা পেরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে স্লোগান দিতে দিতে তাঁরা পৌঁছান ফার্মগেট। যেখানে ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে রাজপথেই প্রতিবাদ চালিয়ে যান।’

মেট্রোরেলের পিলারে আঁকা গ্রাফিতির উদ্বোধন

গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস তুলে ধরে ঢাকার মেট্রোরেলের পিলারে আঁকা গ্রাফিতির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।

এ জন্য বিজয় সরণি মেট্রোরেল স্টেশন চত্বরে গতকাল এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা আসিফ বলেন, ‘গ্রাফিতিগুলো আমাদেরকে আওয়ামী স্বৈরশাসনের ভয়াল দিনগুলো এবং জনগণের সাহসী প্রতিরোধের ইতিহাস বারবার স্মরণ করিয়ে দেবে। ভবিষ্যতে দেশে যেন আর কোনো স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে লক্ষ্যে এসব গ্রাফিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

বিগত ১৬ বছরের আওয়ামী স্বৈরশাসনের নিপীড়ন, জনগণের টানা প্রতিরোধ এবং শেখ হাসিনার পতন ঘটানো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস তুলে ধরে ঢাকার মেট্রোরেলের পিলারে এসব গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দেশে জনগণের সরকার জরুরি হয়ে পড়েছে: এ্যানি
  • ইসি মেরুদণ্ডহীন প্রতিষ্ঠান: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী
  • শহীদ মিনার থেকে এক দফা ঘোষণা
  • আজ বন্ধু দিবস
  • এই অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে
  • শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা চুক্তি অবিলম্বে প্রকাশের দাবি সিপিবির
  • ১৬ বছর বিএনপির নেতাকর্মীরা ঘরে ঘুমাতে পারেনি: নিপুণ রায়
  • বাগেরহাটে সংসদীয় আসন কমানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ
  • জুলাই যোদ্ধাদের মারামারি আমাদের ব্যথিত করে: এ্যানি
  • জুলাই ঘোষণাপত্র আসছে, উপদেষ্টা আসিফের ফেসবুক পোস্ট