অন্তর্বর্তী সরকারকে শত্রু নয়, বন্ধু বাড়াতে হবে
Published: 3rd, May 2025 GMT
বাংলাদেশে ৫ আগস্ট ২০২৪-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পর্যালোচনায় চাণক্যের (কৌটিল্য) ‘শত্রু-মিত্র’ নীতির বিবেচনা ক্রমেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। তাঁর রচিত অর্থশাস্ত্র প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক কূটনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই দলিলের অন্যতম আলোচিত কৌশলগত ধারণা– ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’– মিত্রতা ও শত্রুতার ভারসাম্য রক্ষায় বাস্তববাদী কূটনীতির নির্দেশনা দেয়। এই নীতিতে ‘শত্রুর বন্ধু শত্রু’– এ ধরনের কোনো ধারণা নেই। বরং শত্রুতা না বাড়িয়ে কৌশলগত মিত্রতা বাড়ানোরই পরামর্শ আছে। এই তত্ত্ব মূলত সীমান্ত ভাগাভাগি করা রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। তবে আন্তঃরাষ্ট্রের (ম্যাক্রো পারস্পেক্টিভ) পাশাপাশি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর (মাইক্রো পারস্পেক্টিভ) কৌশল নির্ধারণেও গুরুত্ব বহন করে। রাজনীতি (রিয়েলপলিটিক অর্থে) মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক খেলা হলেও দেশ ও জনগণের ভাগ্য নির্ধারণে রাজনীতিই শেষ এবং একমাত্র ভরসা। রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল রাষ্ট্র যে কোনো স্থায়ী সফলতার পূর্বশর্ত। তাই যাবতীয় কল্যাণার্থে রাজনৈতিকভাবে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হলে শত্রুতা নয়, বরং পারস্পরিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
ইতিহাসের পাঠ থেকে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার। বিপ্লব বা গণআন্দোলনের পরে ক্ষমতা পায় সেই দল বা শক্তি, যারা বিপ্লব সংঘটিত করে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কোনো একক সুগঠিত রাজনৈতিক দলের বিপ্লবী গণআন্দোলনের সরাসরি ফসল নয়। যে আন্দোলনের ফসল এ সরকার, তার নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা থাকলেও বিভিন্ন মৃত্যুপথের রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এতে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। তাই এ সরকারের মূল দায়িত্ব হবে রাজনৈতিক মেরূকরণ না বাড়িয়ে, বরং ভারসাম্য রক্ষা করা।
বাংলাদেশে বর্তমানে যদি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়, তাহলে বিএনপি সম্ভাব্য বিজয়ী শক্তি হতে পারে– এটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণে অনেকটাই পরিষ্কার। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার যদি স্বপ্রণোদিত কিংবা অন্য কোনো শক্তির প্ররোচনায় বিএনপি কিংবা অন্য যে সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আছে সেগুলোকে একেবারে কোণঠাসা করার নীতি গ্রহণ করে এবং শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে তাদের নেতৃত্ব, কর্মী ও রাজনৈতিক অধিকার দমন করে, তবে এই শত্রুতা শুধু বেড়েই চলবে। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি সাধারণ মানুষের আস্থাও কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ছিল নিপীড়ন, বৈষম্য ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিপরীতে একটি ন্যায়ভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রচলন। এই স্পিরিট ধারণ করে যেসব বাম-মধ্য-ডানপন্থি রাজনৈতিক সংগঠন– বিশেষত বিগত সরকারের আমলে যে দলগুলো দমন-পীড়নের শিকার হয়েছিল– তাদের রাজনৈতিক অধিকার পুনঃস্থাপন ও নির্বাচনের আগে একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করাই এ সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হওয়া উচিত।
গত ১৫-১৬ বছরে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করেছে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের প্রয়াস চালিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে যদি দলটির কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ থাকে, তবে তা যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। একই সঙ্গে দলের ভেতর থেকেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। কিছু ব্যক্তির বিচ্যুতির কারণে পুরো দলকে খাটো করা বা রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য প্রমাণের চেষ্টা গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করবে। মনে রাখতে হবে বিগত সময়ে বিএনপি নানা ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন ও রাজনৈতিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে। তৎকালীন শাসকের দলটিকে ভাঙার বহু চেষ্টার পরও বিএনপি অটুট আছে। এটি কোনো ঐশ্বরিক বা নির্ভুল রাজনৈতিক দল নয় যে এর সব কর্মী সহিংসতা বা চাঁদাবাজির অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় এও সত্য, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতা গণতান্ত্রিক ভারসাম্য ভেঙে দেয়, যার ফল দীর্ঘ মেয়াদে কর্তৃত্ববাদী শাসন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। আমরা বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে এ বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছি। সুতরাং এ মুহূর্তে সবচেয়ে যুক্তিসংগত পথ হলো, সব গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক ও নির্বাচনী রূপরেখা নির্ধারণ করা।
বর্তমানে জনপরিসরে একটি সাধারণ অভিযোগ উঠেছে যে, সরকার বিতাড়িত আওয়ামী লীগের মতো নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করছে। যদি সরকারের মধ্যে এমন মনোভাব থেকেও থাকে, তা পরিহার করা উচিত। পরিবর্তে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যেখানে সব কার্যকর রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারে, জনগণের আস্থা অর্জনে কাজ করতে পারে এবং দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে তুলতে পারে। তাই এ মুহূর্তে শত্রুতা নয়, রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও সমঝোতা দরকার। শত্রু কমানোর কৌশলই হতে পারে এ সরকারের প্রকৃত নীতিগত সাফল্য। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার প্রবণতা কীভাবে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে এবং জনগণের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিগত শাসকগোষ্ঠীর একচোখা সিদ্ধান্ত ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা শুধু রাজনৈতিক সংকটই সৃষ্টি করেনি, বরং তা দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে। কর্তৃত্ববাদী একমুখিতা রাজনীতিকে সংকীর্ণ করে তুলেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকৃত সাফল্য মাপা হবে তার সময়কালে ক্ষমতার ব্যবহার কতটা ন্যায়নিষ্ঠ ছিল, আর কতটা স্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক কাঠামো তারা রেখে যেতে পারবে তার ওপর। এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ রয়েছে– একটি গ্রহণযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা; সেই সঙ্গে আস্থাহীনতার দীর্ঘ ছায়া সরিয়ে একটি আলো ঝলমলে রাজনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেওয়া।
ড.
sazzadhsiddiqui@du.ac.bd
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গণত ন ত র ক গ রহণয গ য র জন ত ক স ও র জন ত ক র জন ত ক প সরক র র এ সরক র শত র ত ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
বিসিএস ক্যাডার এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে তুলনা কেন?
বিসিএস ক্যাডার মূলত প্রশাসনের মুষ্টিমেয় কিছু কর্মকর্তা। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, সততা ও নৈতিকতা অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা হবে– যেভাবে সমাজের অন্যান্য পেশাজীবী থেকে আলাদা জীবনাদর্শ, মান-মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান হওয়ার কথা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের। তবে দুটো পেশার ধারা সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী। একটির সঙ্গে অন্যটির তুলনা, সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য নিয়ে ভাবা অর্থহীনভাবে কালক্ষেপণের নামান্তর মাত্র। মূলত এই পেশা দুটি উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থার দুটি অবিচ্ছেদ্য ভিত্তি স্তম্ভ– ঠিক যেভাবে মনুষ্যদেহের দুটো হাত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রধান কাজ রাষ্ট্রের কল্যাণসাধনে দক্ষ ও উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানবসম্পদ তৈরি এবং গবেষণাসমৃদ্ধ কর্মপন্থা উদ্ভাবন। অধিকন্তু, নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাসহ আনুষঙ্গিক অনেক কার্যাবলি তাদের সম্পাদন করতে হয়। অন্যদিকে ক্যাডার সার্ভিসের প্রধান কাজ সরকারের নির্বাহী আদেশের সঠিক ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। এখানে দক্ষ ও উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানবসম্পদ সরকারের প্রতিনিধি হয়ে উদ্ভাবিত ও প্রচলিত সব কর্মপন্থার নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলন ও প্রয়োগের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের জনগণের সেবা করবে। এভাবে ব্যাটে-বলে সমন্বয় করে কাজ করলে সম্মানজনক এ পেশা দুটির মধ্যে তুলনা করার কোনো সুযোগ নেই। প্রত্যেকের উদ্দেশ্য একটাই হবে– দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করা এবং স্বীয় পরিবার-পরিজন নিয়ে সাধ্যমতো জীবন উপভোগ করা। কে কার থেকে বড়, এটা ভাবার সুযোগ এখানে নেই। পাশাপাশি এখানকার প্রশাসনিক ক্ষমতা নিয়েও গর্ব করার কিছু নেই, যা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের জনগণের প্রতি আমানতদারি মাত্র।
দুটো পেশাতেই নিজেদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের পাশাপাশি পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতার বিষয়টিও আমলে নিতে হয়। কারণ বর্তমান জমানায় পকেটে টাকা না থাকলে শুধু সম্মান ও বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে সংসার চলে না, যদিও কর্মদক্ষতা থাকলে টাকা অনেকভাবেই উপার্জন করা সম্ভব। তবে সেই কর্মদক্ষতা কোন পথে পরিচালিত হবে সেটিই বিবেচ্য বিষয়। অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যা পেশাগত উৎকর্ষ ক্ষুণ্ন করে। যদিও বাস্তবে সেটিই বেশি হচ্ছে। পেশাগত আদর্শ থেকে মুখে নৈতিকতার বুলি আওড়ালেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের কার্যকলাপ সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র বহন করে, যারা প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকতা পেশার মান-মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছেন। অন্যদিকে ক্যাডার সার্ভিসেও কর্মকর্তাদের বিরাট একটি অংশ দুর্নীতি করে দেশ ভাসিয়ে দিচ্ছেন, গুছিয়ে নিচ্ছেন নিজেদের আখের, যারা অন্তর্বর্তী সরকারের সদ্য প্রস্তাবিত সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিসংশ্লিষ্ট বরখাস্তের আইনটি প্রণয়নের ঘোর বিরোধী। তবে এ আইনের কিছু নেগেটিভ দিকও রয়েছে– যেখানে সৎ ও নিরপরাধ কোনো কর্মকর্তাও দুর্নীতিবাজ কোনো সিনিয়র কর্মকর্তার প্রতিহিংসা বা রোষানলের শিকার হতে পারেন।
সরকারি এই পেশায়ও দেখা যায় তুখোড় মেধাবী ও কর্মদক্ষ হওয়া সত্ত্বেও অনেক চৌকস অফিসার পেশাদার দুর্নীতিবাজদের কাছে কোণঠাসা ও ধরাশায়ী হয়ে থাকেন, ঠিক যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে অসাধারণ মেধাবী ও নিবেদিতপ্রাণ অনেক শিক্ষক দলদাস শিক্ষকদের কাছে থাকেন অসহায় ও পদে পদে তাদের করুণার মুখাপেক্ষী। তাদের সম্পর্কের ধরন হয় অনেকটা প্রভু-ভৃত্যের মতো। প্রভুর দ্বারস্থ না হলে ভৃত্যের হয় না কোনো কল্যাণসাধন, সেটা হতে পারে নিয়োগ ও পদোন্নতি লাভ, কোনো পদ-পদবি অর্জন কিংবা নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষা ছুটি থেকে প্রেষণে নিয়োগ লাভ পর্যন্ত। মূলত এসব দলীয় সেবাদাসই নিকট অতীতে ফ্যাসিজমের আশীর্বাদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক নিষ্ঠাবান, সৎ ও মেধাবী শিক্ষককে দাবিয়ে রেখেছেন নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় তাদের কেউ কেউ ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে গাড়িতে আগুন লাগিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিপদে ফেলে ফ্যাসিস্ট সরকারের মনোরঞ্জনের চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। কেউ কেউ আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে কর্মরত থাকা অবস্থায় কৃত দুর্নীতির দায়ে দুদকের দাগি আসামি হওয়া সত্ত্বেও মুখে বড় বড় বুলি আওড়িয়েছেন এবং নিজ নিজ বিভাগে সহকর্মীদের ওপর চালিয়েছেন অত্যাচারের স্টিম রোলার। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তারা সদা ষড়যন্ত্র ও মনগড়া কুৎসা রটনায় লিপ্ত ছিলেন। গবেষণার ধারেকাছে না থেকেও জোরপূর্বক ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্যের গবেষণা প্রবন্ধে নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য করেছেন। তাদের কেউ কেউ ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখের মধ্যরাতে বিসিএসআইআরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সপরিবারে পালিয়ে গিয়ে সেনানিবাসে আশ্রয় নেন এবং প্রাণে রক্ষা পান। বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে প্রাণনাশ হলে এসব তথাকথিত প্রগতিশীলই আজ বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র বানিয়ে দিতেন। মূলত এরাই বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে শিক্ষা, গবেষণা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চায় অগ্রযাত্রার পথে প্রধান অন্তরায়। জাতির বিবেক পরিচয়ে এই শিক্ষক সম্প্রদায় প্রকৃতপক্ষে জাতির আজন্ম শত্রু।
আমার সরকারি পেশার মেয়াদ মূলত শুরু হয় ০৬-০৭-২০০২ থেকে, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিসিএসআইআর হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করি ০৫-০৫-২০০৫ তারিখে। আমার সরকারি চাকরির মেয়াদ ০৩+২০ = ২৩ বছর। অথচ সারাজীবনেও তিন কোটি টাকার সম্পদ জমা হবে, এটা আমার কাছে দুরাশা মাত্র। হায়রে সোনার বাংলাদেশ, যেখানে দেশপ্রেম, সততা ও যোগ্যতার বাজারে সোনা থেকে রুপার দাম বেশি। ২০১৪ সালে জাপানে গোল্ডেন থার্টি প্রোগ্রামে সাড়ে চার লাখ টাকা বেতনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতার সুযোগ ফেলে দিয়ে দেশে এসেছিলাম মাত্র ২২ হাজার টাকা বেতনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা পেশা ধরে রাখার জন্য। ভেবেছিলাম জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা করার দেনা কিছুটা হলেও শোধ হবে।
আমার পরিবারে তেমন কোনো টানাপোড়েন ছিল না। আমার মরহুম পিতাও দেশের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করতেন, যদিও অকালপ্রয়াণে তিনি তাঁর কর্মজীবন পুরোপুরি সমাপ্ত করতে পারেননি। আমার ভাইয়েরাও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এবং যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত ও স্বয়ংস্বম্পূর্ণ। আমার স্ত্রী উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও সন্তানকে নিজ হাতে দেখভালের উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় গৃহিণীর পেশা বেছে নিয়েছে। এক কথায় আমার একার উপার্জনেই মাত্র তিন সদস্যের ছোট একটি সংসার চলে। অথচ কিই-বা গচ্ছিত আছে আমাদের? অবশ্য জাতি গড়ার কারিগর একজন শিক্ষক হিসেবে বেশি কিছু থাকার প্রয়োজনীয়তাও কখনও অনুভব করিনি। দেখা যায়, দিন শেষে নুন আনতেই পান্তা ফুরায়।
অন্যদিকে সদ্যপ্রয়াত পুলিশ সদস্য ছিলেন পিতৃহীন অসচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা ক্যাডার সার্ভিসের এক তরুণ কর্মকর্তা। চাকরির সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে ৬-৭ বছর। সরকারের সপ্তম গ্রেডের একজন কর্মকর্তা হলেও ইতোমধ্যে হয়েছিলেন কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। যৌতুককে না বলে দরিদ্র শ্বশুরবাড়িতেও নিয়মিত সাহায্য-সহযোগিতা করতেন– যা ছিল কোনো কোনো সম্প্রদায়ের পুরুষ সমাজের কাছে অত্যন্ত উদার মনমানসিকতার পরিচয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে এসব তথ্যই বেরিয়ে এলো। ভেতরে আরও কত কী আছে, তা জানার চেষ্টা নাই-বা করলাম। পরিসংখ্যানবিদ্যায় এভাবে হাঁড়ির ভাতের চাল একটা টিপলেই অন্যগুলোর অবস্থা বোঝা যায়। এখান থেকেই প্রতীয়মান হয়, একেকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কতটা বিত্ত-বৈভবের মালিক এবং কীভাবে তারা অঢেল সম্পদ উপার্জন করে রাতারাতি গরিব থেকে বিত্তশালী বনে যান।
মাঝেমধ্যে মনের অজান্তেই আক্ষেপ হয়, এসব দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তার জীবনাদর্শ বেছে নিলে আজ হয়তোবা আমিও অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হতাম। বর্ষা মৌসুমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে আমি এবং আমার পরিবারকে রিকশা ভাড়ার জন্য দর-কষাকষি করতে হতো না। প্রতি ঈদে আমিও বাসার আসবাব পরিবর্তন করতে পারতাম। আমার ছেলে বিলাসবহুল গাড়িতে স্কুলে যাতায়াত করত। সপরিবারে গাড়ির বহর নিয়ে নিজ গ্রামের বাড়িতে শোডাউন করতাম। তখন মনে হয়, বিসিএস ক্যাডার কি আসলেই আলাদিনের চেরাগ? ২৪তম বিসিএস রেলওয়ে ক্যাডারের চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে কি আমি ভুল করেছিলাম? তা না হলে আজ হয়তোবা আমিও অনেক সম্পদশালী থাকতাম, যদিও পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী এমন জীবনযাপন কখনোই কাম্য ছিল না।
পরিশেষে বলতে চাই, সততা, নৈতিকতা ও দেশপ্রেম শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় না। এটি মূলত পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষার ধারাবাহিকতা মাত্র। সততা ও নৈতিকতার ধারাটি বংশগতভাবে অর্জিত মজ্জাগত একটি শিক্ষা– যা মানবদেহের রক্তের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয়। তাই সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আগে প্রত্যেক প্রার্থীর পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো করে খতিয়ে দেখা উচিত। অন্যদিকে চাকরিতে প্রবেশের পর কেউ দুর্নীতি করলে তাঁকে কঠোর আইনের আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই, সেটা মৃত্যুর পরে হলেও। কারও অকালপ্রয়াণ যেমন অপ্রত্যাশিত, ঠিক তেমনি উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিনির্মাণে দুর্নীতি দমনে যে কোনো ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শনও অনাকাঙ্ক্ষিত।
ড. মো. এরশাদ হালিম: অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়