অন্তর্বর্তী সরকারকে শত্রু নয়, বন্ধু বাড়াতে হবে
Published: 3rd, May 2025 GMT
বাংলাদেশে ৫ আগস্ট ২০২৪-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পর্যালোচনায় চাণক্যের (কৌটিল্য) ‘শত্রু-মিত্র’ নীতির বিবেচনা ক্রমেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। তাঁর রচিত অর্থশাস্ত্র প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক কূটনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই দলিলের অন্যতম আলোচিত কৌশলগত ধারণা– ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’– মিত্রতা ও শত্রুতার ভারসাম্য রক্ষায় বাস্তববাদী কূটনীতির নির্দেশনা দেয়। এই নীতিতে ‘শত্রুর বন্ধু শত্রু’– এ ধরনের কোনো ধারণা নেই। বরং শত্রুতা না বাড়িয়ে কৌশলগত মিত্রতা বাড়ানোরই পরামর্শ আছে। এই তত্ত্ব মূলত সীমান্ত ভাগাভাগি করা রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। তবে আন্তঃরাষ্ট্রের (ম্যাক্রো পারস্পেক্টিভ) পাশাপাশি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর (মাইক্রো পারস্পেক্টিভ) কৌশল নির্ধারণেও গুরুত্ব বহন করে। রাজনীতি (রিয়েলপলিটিক অর্থে) মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক খেলা হলেও দেশ ও জনগণের ভাগ্য নির্ধারণে রাজনীতিই শেষ এবং একমাত্র ভরসা। রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল রাষ্ট্র যে কোনো স্থায়ী সফলতার পূর্বশর্ত। তাই যাবতীয় কল্যাণার্থে রাজনৈতিকভাবে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হলে শত্রুতা নয়, বরং পারস্পরিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
ইতিহাসের পাঠ থেকে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার। বিপ্লব বা গণআন্দোলনের পরে ক্ষমতা পায় সেই দল বা শক্তি, যারা বিপ্লব সংঘটিত করে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কোনো একক সুগঠিত রাজনৈতিক দলের বিপ্লবী গণআন্দোলনের সরাসরি ফসল নয়। যে আন্দোলনের ফসল এ সরকার, তার নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা থাকলেও বিভিন্ন মৃত্যুপথের রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এতে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। তাই এ সরকারের মূল দায়িত্ব হবে রাজনৈতিক মেরূকরণ না বাড়িয়ে, বরং ভারসাম্য রক্ষা করা।
বাংলাদেশে বর্তমানে যদি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়, তাহলে বিএনপি সম্ভাব্য বিজয়ী শক্তি হতে পারে– এটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণে অনেকটাই পরিষ্কার। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার যদি স্বপ্রণোদিত কিংবা অন্য কোনো শক্তির প্ররোচনায় বিএনপি কিংবা অন্য যে সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আছে সেগুলোকে একেবারে কোণঠাসা করার নীতি গ্রহণ করে এবং শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে তাদের নেতৃত্ব, কর্মী ও রাজনৈতিক অধিকার দমন করে, তবে এই শত্রুতা শুধু বেড়েই চলবে। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি সাধারণ মানুষের আস্থাও কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ছিল নিপীড়ন, বৈষম্য ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিপরীতে একটি ন্যায়ভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রচলন। এই স্পিরিট ধারণ করে যেসব বাম-মধ্য-ডানপন্থি রাজনৈতিক সংগঠন– বিশেষত বিগত সরকারের আমলে যে দলগুলো দমন-পীড়নের শিকার হয়েছিল– তাদের রাজনৈতিক অধিকার পুনঃস্থাপন ও নির্বাচনের আগে একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করাই এ সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হওয়া উচিত।
গত ১৫-১৬ বছরে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করেছে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের প্রয়াস চালিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে যদি দলটির কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ থাকে, তবে তা যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। একই সঙ্গে দলের ভেতর থেকেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। কিছু ব্যক্তির বিচ্যুতির কারণে পুরো দলকে খাটো করা বা রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য প্রমাণের চেষ্টা গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করবে। মনে রাখতে হবে বিগত সময়ে বিএনপি নানা ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন ও রাজনৈতিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে। তৎকালীন শাসকের দলটিকে ভাঙার বহু চেষ্টার পরও বিএনপি অটুট আছে। এটি কোনো ঐশ্বরিক বা নির্ভুল রাজনৈতিক দল নয় যে এর সব কর্মী সহিংসতা বা চাঁদাবাজির অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় এও সত্য, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতা গণতান্ত্রিক ভারসাম্য ভেঙে দেয়, যার ফল দীর্ঘ মেয়াদে কর্তৃত্ববাদী শাসন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। আমরা বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে এ বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছি। সুতরাং এ মুহূর্তে সবচেয়ে যুক্তিসংগত পথ হলো, সব গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক ও নির্বাচনী রূপরেখা নির্ধারণ করা।
বর্তমানে জনপরিসরে একটি সাধারণ অভিযোগ উঠেছে যে, সরকার বিতাড়িত আওয়ামী লীগের মতো নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করছে। যদি সরকারের মধ্যে এমন মনোভাব থেকেও থাকে, তা পরিহার করা উচিত। পরিবর্তে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যেখানে সব কার্যকর রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারে, জনগণের আস্থা অর্জনে কাজ করতে পারে এবং দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে তুলতে পারে। তাই এ মুহূর্তে শত্রুতা নয়, রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও সমঝোতা দরকার। শত্রু কমানোর কৌশলই হতে পারে এ সরকারের প্রকৃত নীতিগত সাফল্য। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার প্রবণতা কীভাবে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে এবং জনগণের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিগত শাসকগোষ্ঠীর একচোখা সিদ্ধান্ত ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা শুধু রাজনৈতিক সংকটই সৃষ্টি করেনি, বরং তা দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে। কর্তৃত্ববাদী একমুখিতা রাজনীতিকে সংকীর্ণ করে তুলেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকৃত সাফল্য মাপা হবে তার সময়কালে ক্ষমতার ব্যবহার কতটা ন্যায়নিষ্ঠ ছিল, আর কতটা স্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক কাঠামো তারা রেখে যেতে পারবে তার ওপর। এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ রয়েছে– একটি গ্রহণযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা; সেই সঙ্গে আস্থাহীনতার দীর্ঘ ছায়া সরিয়ে একটি আলো ঝলমলে রাজনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেওয়া।
ড.
sazzadhsiddiqui@du.ac.bd
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গণত ন ত র ক গ রহণয গ য র জন ত ক স ও র জন ত ক র জন ত ক প সরক র র এ সরক র শত র ত ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিন: রুহুল কবির রিজভী
নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার জনগণের কাছেই ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘যদি আবার ফ্যাসিবাদের কোনোভাবে উত্থান ঘটে, তাহলে কেউ বাঁচতে পারবেন না। তাই ঐক্যের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’ সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে একযোগে কাজ করারও আহ্বান জানান তিনি।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে মহান মে দিবস উপলক্ষে বরিশাল জেলা ও মহানগর শ্রমিক দল আয়োজিত শ্রমিক সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। সমাবেশ শেষে আয়োজিত শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন রিজভী। শোভাযাত্রাটি নগরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় সদর রোডে জেলা বিএনপির কার্যালয়ের এসে শেষ হয়।
পালিয়ে থেকেও দেশে হত্যার রাজনীতি অব্যাহত রেখেছেন শেখ হাসিনা—এমন মন্তব্য করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘২৬২ জনকে হত্যার হুমকি দিয়ে দেওয়া তাঁর বক্তব্য ফরেনসিক রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চিত হয়েছে, ভয়াবহ ওই হুমকির কণ্ঠ শেখ হাসিনারই। একটি কথা মনে রাখতে হবে—এই দেশে যদি আবারও ফ্যাসিস্ট ফিরে আসে, তাহলে কেউই রেহাই পাবে না।’ তিনি বলেন, ‘দ্রুত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে।’
রুহুল কবির রিজভী আরও বলেন, বর্তমান সরকারকে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর কথা শুনবেন না এটা হতে পারে না। শুধু উপদেষ্টাদের নিয়ে মানবিক করিডর দিতে চাইছেন। দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হতে পারে, সে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া খুবই দুঃখজনক। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশে নির্বাচিত সরকার না থাকায় ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এ অবস্থায় শেখ হাসিনার বিচার অনতিবিলম্বে সম্পন্ন করা প্রয়োজন। তা না হলে দেশে আবার ভয়াবহ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করতে হবে এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’
সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম, সহসাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান, মাহবুবুল হক, সহ–বন ও পরিবেশ সম্পাদক কাজী রওনাকুল ইসলাম, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান মামুন, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান, সদস্যসচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার, মহানগর শ্রমিক দলের সদস্যসচিব শহিদুল ইসলাম, জেলা শ্রমিক দলের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলাম প্রমুখ বক্তব্য দেন।