ছোট ব্রয়লার মুরগির খামারিদের ‘হিট অ্যাকশন প্ল্যান’
Published: 4th, May 2025 GMT
বাণিজ্যিক ব্রয়লার ফার্মিংয়ে ‘হিট’ স্ট্রেস বিশ্বব্যাপী একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। এই হিট স্ট্রেসের ফলে সরাসরি মুরগির শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে সামার হিট ওয়েভ পোলট্রিশিল্পের জন্য এক নীরব ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে যখন মুরগির বডি ওয়েট এক কেজির ওপরে থাকে। হিট স্ট্রেসের ফলে মুরগির স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণ, পানি গ্রহণ ও পুষ্টি বিপাক কমে যায়। ফলে মাংসের পরিমাণও কমে যায়।
অন্যদিকে এই সময় ফার্মের লিটার সারাক্ষণ ভেজা থাকে। অ্যামোনিয়া–সৃষ্ট দুর্গন্ধের কারণে আশপাশের পরিবেশ অসহনীয় হয়ে পড়ে। তবে সামার হিট ওয়েভের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো মুরগির ঘন ঘন হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া এবং মারা যাওয়া। এর ফলে খামারি সরাসরি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
বাতাসে তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম হলে সেটিকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলে। তাপমাত্রা যদি ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে তাহলে সেটিকে মাঝারি এবং ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে সেটিকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলে। আর তাপমাত্রা যদি ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে যায়, সেটিকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলে।
আমাদের দেশের সঙ্গে ভারতের প্রায় ২৪৬ কিলোমিটার স্থল সংযোগ রয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তর প্রদেশ রাজ্যগুলোর সঙ্গে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যেমন চুয়াডাঙ্গা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, রংপুর জেলাগুলো সংযুক্ত। ভারতের ওই এলাকাগুলোতে এপ্রিল মাস থেকে তাপমাত্রা ৪২ থেকে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ওঠানামা করে। তাই ওই সব এলাকার উত্তপ্ত বায়ু প্রথমে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোকে উত্তপ্ত করে এবং পরে বেশির ভাগ জেলায় তা ছড়িয়ে পড়ে।
এ ছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ছোঁয়ায় ইতিমধ্যে স্থানীয়ভাবে তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। আমাদের দেশে ২০২৩ সালে একটানা ২৩ দিন মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। গরমকালে বাতাসে তাপমাত্রা (৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ও জলীয় বাষ্পের পরিমাণ (৮৫ শতাংশ) অধিক থাকায় ফিলিং টেম্পারেচার অনেক বেশি অনুভূত হয়। দ্রুত বর্ধনশীল ব্রয়লার মুরগির সহনীয় বাতাসের তাপমাত্রা হলো ২৫-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আর্দ্রতা (৫৫-৬০ শতাংশ)।
সবশেষে প্রতিবছর গ্রীষ্মকালীন তাপপ্রবাহ চলার সময় খতিয়ে দেখতে হবে যে কী কাজ করেছে, কী করেনি এবং কী নতুন চ্যালেঞ্জ এসেছে। এসব নিয়ে একটি টেকসই রিপোর্ট কার্ড তৈরি করতে হবে। ধারাবাহিকভাবে শেখা ও কাজ করাই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা থেকে এসব ক্ষুদ্র ব্রয়লার খামারিদের টিকে থাকার পথ।যদি এই হিট ইনডেস্কে কোনো তারতম্য হয়, তা অবশ্যই মুরগির বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। গবেষণায় দেখা গেছে, হঠাৎ করে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে মুরগি ‘একিউট হিট স্ট্রেসে’ (বহমান তাপমাত্রা যদি ১-৫ দিন থাকে) আক্রান্ত হয়। এর ফলে বাজারে বিক্রির বয়সী মুরগির মৃত্যুর কারণে খামারির ব্যাপক ক্ষতি হয়। একিউট হিট স্ট্রেস সাধারণত মুরগির বৃদ্ধি কম হওয়াতে কোনো বিশেষ ভূমিকা নেই। অন্যদিকে যদি হিট ওয়েভ ৫ দিনের বেশি চলমান থাকে তাকে ক্রনিক হিট স্ট্রেস বলে। আর তেমন হলে মুরগির সামগ্রিক বৃদ্ধিতে ব্যাপক ধস নামায়।
অন্য আরেক ধরনের হিট স্ট্রেস আছে, যা চক্রাকারের। যেমন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অত্যধিক গরম থাকার পর আস্তে আস্তে তাপ কমতে থাকা। এই ধরনের হিট স্ট্রেস সাধারণত আমাদের দেশে সাধারণ। তা একিউট বা ক্রনিকের মতো ঝুঁকিপূর্ণ নয়। ব্রয়লার মুরগি যদি ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ৫৫ শতাংশ আর্দ্রতায় একটানা ১৪ দিন পালন করা হয় তবে প্রতিটি মুরগি প্রায় ৫০ শতাংশ খাবার কম খায় ফলে তাদের ৬৬ শতাংশ ওজন বৃদ্ধি কমে যায়।
অন্যদিকে স্বাভাবিক অবস্থায় একটি মুরগি তার মোট গ্রহণ করা খাদ্যের প্রায় ২ দশমিক ৫ গুণ পানি খায়। বাইরের তাপমাত্রা বেশি থাকায় ড্রিংকারের পানি খুব দ্রুত গরম হয়ে যায়। ফলে গরমে ব্রয়লার পানি কম খায়। মুরগি কম পানি পান করায় তার খাদ্যনালিতে ক্ষত হয়। এমনকি অহজমযোগ্য খাদ্য পায়ুপথ দিয়ে সরাসরি বের হয়ে লিটারে যুক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ওই সব লিটার নষ্ট হয়ে বিশেষ করে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি করে। এই গ্যাস বায়ুর চেয়ে হালকা হওয়ায় দ্রুত ওপরে উঠে যায় এবং আশপাশে গন্ধ ছড়ায়। মোটাদাগে অত্যধিক গরম ব্রয়লারের খাদ্য ও পানি গ্রহণ কমিয়ে দেয়, ফলে খাদ্য বা পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হিট স্ট্রেস কমানো সম্ভব নয়।
গ্রীষ্মকালে খামারির ‘তাপ নিয়ন্ত্রণ’ পরিকল্পনা যা হতে পারে তা নিচে বলা হলো।
১.
২. ঘন ঘন ঠান্ডা পানির জোগান নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে দুপুরের পর থেকে প্রতি ৩০ মিনিট অন্তর তা করতে হবে। খাবারের পাত্রের সমপরিমাণ পানির পাত্র এবং পানির পাত্রের সমপরিমাণ খাবারের পাত্র দেওয়া উত্তম।
৩. গরমকালে খামারিদের অবশ্যই খাঁচায় ব্রয়লার পালনে উৎসাহিত হতে হবে, যা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানসম্মত উপায়।
৪. টিনের চালে পানি বা ভেজা বস্তা দিতে হবে, যেন শেড ঠান্ডা থাকে। পারলে সিলিং ফ্যানের পরিবর্তে টানেল ফ্যান ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫. অবশ্যই ঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং পর্দা ব্যবস্থাপনা সঠিক হতে হবে।
৬. ঘরের উচ্চতা ১৩ ফুট হবে, যার ভেতর ১ ফুট নিচে সিলিং হবে মাটির প্রলেপ। এই প্রক্রিয়ায় টিনের ওপরে তাপ লাগলেও ১ ফুট ভেন্টিলেশন জায়গা থাকায় গরম নিচে নামবে না, তার ওপর মাটির প্রলেপ থাকায় ঘর ঠান্ডা থাকবে।
৭. মুরগির ঘরে হালকা রঙের ছাদ দেওয়া যেতে পারে।
৮. ঘরের দুই পাশে লতাপাতা–জাতীয় গাছ ‘সবুজ পর্দা’ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৯. অবশ্যই ঘরের বারান্দা ২-৩ ফুট থাকতে হবে।
১০. মুরগির খাবারে শক্তির পরিমাণ কম থাকতে হবে এবং শক্তির উৎস হতে হবে আঁশজাতীয় খাদ্য।
সবশেষে প্রতিবছর গ্রীষ্মকালীন তাপপ্রবাহ চলার সময় খতিয়ে দেখতে হবে যে কী কাজ করেছে, কী করেনি এবং কী নতুন চ্যালেঞ্জ এসেছে। এসব নিয়ে একটি টেকসই রিপোর্ট কার্ড তৈরি করতে হবে। ধারাবাহিকভাবে শেখা ও কাজ করাই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা থেকে এসব ক্ষুদ্র ব্রয়লার খামারিদের টিকে থাকার পথ।
ড. মো. আবুল কালাম আজাদ গবেষক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স লস য় স র ম রগ র স ব শ ষ কর পর ম ণ ক জ কর র ওপর গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
মালয়েশিয়ায় আরো বাংলাদেশি কাজ করার সুযোগ পাবেন: আশা প্রধান উপদেষ্টার
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে আরো অধিকসংখ্যক বাংলাদেশি কাজ করার সুযোগ পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
মালয়েশিয়া সফরের দ্বিতীয় দিনে মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ আশা প্রকাশ করেন তিনি। এর আগে কুয়ালালামপুরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন। এরপর দুই দেশের মধ্যে ৫টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং তিনটি সহযোগিতামূলক নোট বিনিময় স্বাক্ষর করা হয়।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় কাজ করছে। তারা উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠান, যা তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবনযাপন, সন্তানের লেখাপড়া এবং ভালো শিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করছে। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের জন্য এই দরজা খোলা থাকবে এবং আমাদের দেশের আরো অধিকসংখ্যক তরুণ-তরুণী এখানে কাজ করার সুযোগ পাবেন।”
বাংলাদেশের কর্মীদের মালয়েশিয়ায় কাজ করার সুযোগ দেওয়ায় দেশটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, “মালয়েশিয়ার জনগণ তাদের সঙ্গে পরিবারের একজন সদস্য এবং বন্ধুর মত আচরণ করে। এতে তারা খুব খুশি। তারা অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি এখান থেকে অনেক কিছু শেখে, যা দেশে ফিরে যাওয়ার পর নিজের ব্যবসা দাঁড় করাতে সহায়ক হয়।”
মালয়েশিয়ার ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমরা বাংলাদেশকে একটা উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আপনারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করুন এবং প্রযুক্তি নিয়ে আসুন। আমাদের মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে আপনারা পণ্য উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করতে পারেন।”
একটা টেকসই অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে বিনিয়োগ ও ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গত বছর ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমেছিল। আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক বিদায় নিয়েছে। এরপর নতুন সরকারের দায়িত্ব নিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশে স্থিতিশীলতা ফেরাতে আমরা সহযোগিতা খুঁজছিলাম, আর তখন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বন্ধুর মত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আমাদের শক্তি জুগিয়েছিলেন। ”
বাংলাদেশে সঠিক পথ নিশ্চিত করতে দৃঢ় সংকল্পের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমরা দেশে শৃঙ্খলা ফেরাতে পেরেছি। অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করেছি।”
“ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবারও কার্যকর করা গেছে। যে কারণে এক বছরের মাথায় এসে আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারছি।” আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাও জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা সংকট নিরসন এবং আসিয়ানের সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য মালয়েশিয়ার জোরালো সমর্থন চান।
সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম আশা প্রকাশ করে বলেন, “দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার সম্পর্ক উভয় দেশের জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে সহায়ক হবে।”
তথ্যসূত্র: বাসস
ঢাকা/ইভা