Prothomalo:
2025-05-13@17:29:28 GMT

কাবার গিলাফ ‘কিসওয়া’

Published: 13th, May 2025 GMT

পবিত্র কাবাঘরকে আবৃত করা কাপড়টি আরবিতে কিসওয়া নামে পরিচিত, যাকে বাংলায় আমরা গিলাফ বলি। এই কিসওয়া কাবাঘরের পবিত্রতা ও মর্যাদার প্রতীক। ইতিহাসের পাতায় কিসওয়ার উৎপত্তি ও বিবর্তন একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বহন করে, যা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্যে ভরপুর।

কিসওয়ার ঐতিহাসিক উৎপত্তি

ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুযায়ী, পঞ্চম শতাব্দীতে ইয়েমেনের রাজা তুব্বা আবু কারিব আসাদ প্রথম কাবাঘরে কিসওয়া প্রদান করেন। তিনি ছিলেন হিমিয়ার রাজবংশের শাসক এবং তাঁর রাজত্বকাল ৩৮৮-৪২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ধরা হয়। তিনি প্রথমে পৌত্তলিক ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁর পুত্রকে মদিনায় হত্যা করা হলে প্রতিশোধ নিতে তিনি মদিনা শহর ধ্বংসের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু মদিনার দুই ইহুদি র‍্যাবাই তাঁকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখেন এবং তাঁর প্রভাবে তিনি ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেন।

মদিনা থেকে ইয়েমেন ফেরার পথে তিনি মক্কায় পৌঁছান। পথে একটি প্রতিপক্ষ গোত্র তাঁকে কাবাঘরে ধনসম্পদ লুকানো আছে বলে লুটতরাজে উৎসাহিত করে। কিন্তু ইহুদি র‍্যাবাইরা তাঁকে জানান, কাবাঘর কোনো ধনভান্ডার নয়, বরং এটি হজরত ইব্রাহিম (আ.

) কর্তৃক নির্মিত সৃষ্টিকর্তার পবিত্র উপাসনালয়। তাঁরা তাঁকে কাবা তাওয়াফ, কোরবানি এবং পবিত্রতা বজায় রাখার পরামর্শ দেন।

রাজা তুব্বা মক্কায় ছয় দিন অবস্থান করেন। তিনি কাবা তাওয়াফ করেন, পশু কোরবানি করে মাংস ও মধু মক্কাবাসীদের মধ্যে বিতরণ করেন এবং মাথা মুণ্ডন করেন। এ সময় তিনি স্বপ্নাদেশে তিনবার কাবাঘরকে কিসওয়া দিয়ে আচ্ছাদনের নির্দেশ পান। প্রথমে তিনি সাধারণ কাপড়, দ্বিতীয়বার উন্নতমানের কাপড় এবং শেষে উৎকৃষ্ট ইয়েমেনি কাপড় দিয়ে কাবাকে আবৃত করেন। এটিই ছিল কাবাঘরের প্রথম কিসওয়া। তিনি কাবার জন্য একটি দরজা ও তালার ব্যবস্থাও করেন।

আরব নিউজ (২০২১) অনুসারে, তুব্বা আল-হুমাইরি (আবু কারিব আসাদ) প্রথমে ‘খাসফ’ নামক মোটা কাপড়, তারপর ‘মাফির’ (ইয়েমেনের একটি শহরে তৈরি কাপড়), এরপর ‘মিলা’ (নরম ও পাতলা কাপড়) এবং সবশেষে ‘ওয়াসায়েল’ নামক লাল ডোরাকাটা ইয়েমেনি কাপড় দিয়ে কাবাকে আবৃত করেন।

আরও পড়ুনমক্কার জমজম কূপের উৎপত্তি০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

কিসওয়ার বিবর্তন

কিসওয়ার রং ও উপাদান সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে।

 ১. রাসুলুল্লাহ (সা.): মক্কা বিজয়ের পর বিদায় হজে তিনি সাদা ও লাল ডোরাকাটা ইয়েমেনি কাপড়ের কিসওয়া দেন।

 ২. খুলাফায়ে রাশেদিন: হজরত আবু বকর (রা.), উমর (রা.), এবং উসমান (রা.) সাদা কাপড়ের কিসওয়া ব্যবহার করেন।

 ৩. ইবনে জুবায়ের: তিনি লাল ব্রোকেড কাপড় ব্যবহার করেন।

 ৪. আব্বাসীয় খেলাফত: একবার সাদা এবং একবার লাল কাপড়ের কিসওয়া তৈরি করা হতো। আব্বাসীয় খলিফা আল-নাসির কিসওয়ার রং সবুজ এবং পরে কালো ব্রোকেডে পরিবর্তন করেন, যা বর্তমানে প্রচলিত।

 ৫. সেলজুক সুলতান: তিনি হলুদ ব্রোকেড কাপড় ব্যবহার করেন।

 বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে সর্বোত্তম কাপড় ব্যবহৃত হয়। মিসরের কুবাতি কাপড় এবং ইয়েমেনের উন্নতমানের কাপড় কিসওয়া তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে।

আরও পড়ুনসহজ ওমরাহ ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

আধুনিক কিসওয়া

বর্তমানে সৌদি আরবে ‘দ্য কিং আবদুল আজিজ কমপ্লেক্স ফর ম্যানুফ্যাকচারিং দ্য কাবা কিসওয়া’ নামক একটি বিশেষ কারখানা কিসওয়া তৈরি করে। প্রতিটি কিসওয়া তৈরিতে:

১. উপাদান: ৬৭০ কিলোগ্রাম প্রাকৃতিক রেশম ও তুলার সুতা।

২. ক্যালিগ্রাফি: কোরআনের আয়াত ও ক্যালিগ্রাফির জন্য ১২০ কিলোগ্রাম সোনার প্রলেপ দেওয়া রুপার সুতা।

৩. ব্যয়: প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ সৌদি রিয়াল।

 কিসওয়া পরিবর্তনের সময়

 প্রথাগতভাবে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণে জিলহজ মাসের ৯ তারিখে (যখন হজযাত্রীরা আরাফায় যান) কিসওয়া পরিবর্তন করা হতো। ফলে ঈদুল আজহার দিন কাবা নতুন কিসওয়ায় আচ্ছাদিত থাকত। তবে ২০২২ সাল থেকে এই সময় পরিবর্তন করে হিজরি নববর্ষের প্রথম দিন, অর্থাৎ ১ মহররম নির্ধারণ করা হয়েছে।

 ঐতিহাসিক পটভূমি

সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার আগে আরব উপদ্বীপ বিভিন্ন খেলাফত ও সালতানাতের অধীনে ছিল। তারা মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং হজ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত। খলিফা বা সুলতানের তত্ত্বাবধানে হজ কাফেলার সঙ্গে নতুন কিসওয়া মক্কায় পাঠানো হতো এবং পুরোনো কিসওয়া ফেরত নেওয়া হতো। কিসওয়া প্রদানকে ধর্মীয় কর্তব্য ও মহান সম্মান হিসেবে গণ্য করা হতো।

 কিসওয়া কেবল একটি কাপড় নয়, বরং কাবাঘরের পবিত্রতা, ঐতিহ্য এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক। এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম শাসক ও সম্প্রদায়ের ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাক্ষ্য বহন করে।

আরও পড়ুনহজ করতে গিয়ে মক্কা মদিনায় হারিয়ে গেলে কী করবেন০৮ মে ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ক সওয় ক সওয় র ন কর ন ক ব ঘর প রথম ব যবহ

এছাড়াও পড়ুন:

কাবার গিলাফ ‘কিসওয়া’

পবিত্র কাবাঘরকে আবৃত করা কাপড়টি আরবিতে কিসওয়া নামে পরিচিত, যাকে বাংলায় আমরা গিলাফ বলি। এই কিসওয়া কাবাঘরের পবিত্রতা ও মর্যাদার প্রতীক। ইতিহাসের পাতায় কিসওয়ার উৎপত্তি ও বিবর্তন একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বহন করে, যা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্যে ভরপুর।

কিসওয়ার ঐতিহাসিক উৎপত্তি

ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুযায়ী, পঞ্চম শতাব্দীতে ইয়েমেনের রাজা তুব্বা আবু কারিব আসাদ প্রথম কাবাঘরে কিসওয়া প্রদান করেন। তিনি ছিলেন হিমিয়ার রাজবংশের শাসক এবং তাঁর রাজত্বকাল ৩৮৮-৪২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ধরা হয়। তিনি প্রথমে পৌত্তলিক ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁর পুত্রকে মদিনায় হত্যা করা হলে প্রতিশোধ নিতে তিনি মদিনা শহর ধ্বংসের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু মদিনার দুই ইহুদি র‍্যাবাই তাঁকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখেন এবং তাঁর প্রভাবে তিনি ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেন।

মদিনা থেকে ইয়েমেন ফেরার পথে তিনি মক্কায় পৌঁছান। পথে একটি প্রতিপক্ষ গোত্র তাঁকে কাবাঘরে ধনসম্পদ লুকানো আছে বলে লুটতরাজে উৎসাহিত করে। কিন্তু ইহুদি র‍্যাবাইরা তাঁকে জানান, কাবাঘর কোনো ধনভান্ডার নয়, বরং এটি হজরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক নির্মিত সৃষ্টিকর্তার পবিত্র উপাসনালয়। তাঁরা তাঁকে কাবা তাওয়াফ, কোরবানি এবং পবিত্রতা বজায় রাখার পরামর্শ দেন।

রাজা তুব্বা মক্কায় ছয় দিন অবস্থান করেন। তিনি কাবা তাওয়াফ করেন, পশু কোরবানি করে মাংস ও মধু মক্কাবাসীদের মধ্যে বিতরণ করেন এবং মাথা মুণ্ডন করেন। এ সময় তিনি স্বপ্নাদেশে তিনবার কাবাঘরকে কিসওয়া দিয়ে আচ্ছাদনের নির্দেশ পান। প্রথমে তিনি সাধারণ কাপড়, দ্বিতীয়বার উন্নতমানের কাপড় এবং শেষে উৎকৃষ্ট ইয়েমেনি কাপড় দিয়ে কাবাকে আবৃত করেন। এটিই ছিল কাবাঘরের প্রথম কিসওয়া। তিনি কাবার জন্য একটি দরজা ও তালার ব্যবস্থাও করেন।

আরব নিউজ (২০২১) অনুসারে, তুব্বা আল-হুমাইরি (আবু কারিব আসাদ) প্রথমে ‘খাসফ’ নামক মোটা কাপড়, তারপর ‘মাফির’ (ইয়েমেনের একটি শহরে তৈরি কাপড়), এরপর ‘মিলা’ (নরম ও পাতলা কাপড়) এবং সবশেষে ‘ওয়াসায়েল’ নামক লাল ডোরাকাটা ইয়েমেনি কাপড় দিয়ে কাবাকে আবৃত করেন।

আরও পড়ুনমক্কার জমজম কূপের উৎপত্তি০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

কিসওয়ার বিবর্তন

কিসওয়ার রং ও উপাদান সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে।

 ১. রাসুলুল্লাহ (সা.): মক্কা বিজয়ের পর বিদায় হজে তিনি সাদা ও লাল ডোরাকাটা ইয়েমেনি কাপড়ের কিসওয়া দেন।

 ২. খুলাফায়ে রাশেদিন: হজরত আবু বকর (রা.), উমর (রা.), এবং উসমান (রা.) সাদা কাপড়ের কিসওয়া ব্যবহার করেন।

 ৩. ইবনে জুবায়ের: তিনি লাল ব্রোকেড কাপড় ব্যবহার করেন।

 ৪. আব্বাসীয় খেলাফত: একবার সাদা এবং একবার লাল কাপড়ের কিসওয়া তৈরি করা হতো। আব্বাসীয় খলিফা আল-নাসির কিসওয়ার রং সবুজ এবং পরে কালো ব্রোকেডে পরিবর্তন করেন, যা বর্তমানে প্রচলিত।

 ৫. সেলজুক সুলতান: তিনি হলুদ ব্রোকেড কাপড় ব্যবহার করেন।

 বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে সর্বোত্তম কাপড় ব্যবহৃত হয়। মিসরের কুবাতি কাপড় এবং ইয়েমেনের উন্নতমানের কাপড় কিসওয়া তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে।

আরও পড়ুনসহজ ওমরাহ ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

আধুনিক কিসওয়া

বর্তমানে সৌদি আরবে ‘দ্য কিং আবদুল আজিজ কমপ্লেক্স ফর ম্যানুফ্যাকচারিং দ্য কাবা কিসওয়া’ নামক একটি বিশেষ কারখানা কিসওয়া তৈরি করে। প্রতিটি কিসওয়া তৈরিতে:

১. উপাদান: ৬৭০ কিলোগ্রাম প্রাকৃতিক রেশম ও তুলার সুতা।

২. ক্যালিগ্রাফি: কোরআনের আয়াত ও ক্যালিগ্রাফির জন্য ১২০ কিলোগ্রাম সোনার প্রলেপ দেওয়া রুপার সুতা।

৩. ব্যয়: প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ সৌদি রিয়াল।

 কিসওয়া পরিবর্তনের সময়

 প্রথাগতভাবে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণে জিলহজ মাসের ৯ তারিখে (যখন হজযাত্রীরা আরাফায় যান) কিসওয়া পরিবর্তন করা হতো। ফলে ঈদুল আজহার দিন কাবা নতুন কিসওয়ায় আচ্ছাদিত থাকত। তবে ২০২২ সাল থেকে এই সময় পরিবর্তন করে হিজরি নববর্ষের প্রথম দিন, অর্থাৎ ১ মহররম নির্ধারণ করা হয়েছে।

 ঐতিহাসিক পটভূমি

সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার আগে আরব উপদ্বীপ বিভিন্ন খেলাফত ও সালতানাতের অধীনে ছিল। তারা মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং হজ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত। খলিফা বা সুলতানের তত্ত্বাবধানে হজ কাফেলার সঙ্গে নতুন কিসওয়া মক্কায় পাঠানো হতো এবং পুরোনো কিসওয়া ফেরত নেওয়া হতো। কিসওয়া প্রদানকে ধর্মীয় কর্তব্য ও মহান সম্মান হিসেবে গণ্য করা হতো।

 কিসওয়া কেবল একটি কাপড় নয়, বরং কাবাঘরের পবিত্রতা, ঐতিহ্য এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক। এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম শাসক ও সম্প্রদায়ের ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাক্ষ্য বহন করে।

আরও পড়ুনহজ করতে গিয়ে মক্কা মদিনায় হারিয়ে গেলে কী করবেন০৮ মে ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ