জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতে ব্যাপকহারে বেড়েছে মুসলিম বিদ্বেষমূলক ঘটনা। অ্যাসোসিয়েশন অব প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, ২২ এপ্রিল পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতীয় মুসলিম ও কাশ্মীরিদের উপর বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা সামনে এসেছে। এসব ঘটনার মধ্যে গণপিটুনি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট এবং যৌন সহিংসতার মতো বিষয়গুলো রয়েছে। ২২ এপ্রিল থেকে ৮ মে পর্যন্ত ভারতজুড়ে ১৮৪ টি ঘৃণামূলক অপরাধের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১০৬টি ঘটনার পিছনে ইন্ধন জুগিয়েছে পহেলগামের ঘটনা। 

এই ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ৮৪টি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, ৬৪টি ভয় দেখানোর ঘটনা, ৪২টি হয়রানি, ৩৯টি হামলা, ১৯টি ভাঙচুর, ১৪টি হুমকি এবং সাতটি গালিগালাজের ঘটনা। পাশাপাশি তিনটি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। 

এসব ঘৃণমূলক অপরাধের পিছনে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), হিন্দু রক্ষা দল, বজরং দল, সকল হিন্দু সমাজ-এর মতো হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এবং বিজেপি সদস্যরা রয়েছে। এমনকি মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন সিনিয়র রাজনীতিবিদরাও এসব ঘটনায় জড়িত।

এপিসিআর-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের উত্তরপ্রদেশে সর্বাধিক ৪৩টি ঘৃণাত্মক অপরাধের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এরপরই রয়েছে মহারাষ্ট্র (২৪), উত্তরাখণ্ড (২৪), মধ্যপ্রদেশ (২০), হরিয়ানা (৯), কর্ণাটক (৭), বিহার (৬), দিল্লী (৬), চন্ডিগড় (৬), হিমাচল প্রদেশ (৬), পাঞ্জাব (৪), রাজস্থান (৩), তেলেঙ্গানা (৩), কেরল (২), জম্মু-কাশ্মীর (২) এবং ওড়িশা, অন্ধপ্রদেশ ও আসামে একটি করে ঘটনা ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গে এরকম ৯টি ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। 

উল্লেখিত রাজ্যগুলোর মধ্যে যেমন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) শাসিত রয়েছে, তেমনি কংগ্রেস, তেলেগু দেশম পার্টি, জনতা দল ইউনাইটেড, জম্মু এন্ড কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স, তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলোও রয়েছে।

পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ২৪ ঘন্টার কম সময়ের মধ্যে উত্তর প্রদেশের আগ্রা জেলায় বিরিয়ানির দোকানের মালিক মোহাম্মদ গুলফামকে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে। ২৩ এপ্রিল রাতে ২৫ বছর বয়সী গুলফাম যখন দোকান বন্ধ করেছিলেন, সেসময় তিন যুবক এসে তাকে বাইরে টেনে এনে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। ওই ঘটনায় গুলফামের চাচাতো ভাই সৈয়ফ আলীও আহত হয়। পরে ওই হামলাকারী নিজেকে ‘ক্ষত্রিয় গো রক্ষা দলের’ সদস্য দাবি করে জানায় পহেলগামে হামলার প্রতিশোধ নিতেই তারা এই কাজ করেছে। 

কংগ্রেস শাসিত কর্নাটকে ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেওয়ায় এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২৯ এপ্রিল রাজ্যটির মেঙ্গালুরু শহরের পাশেই কুদুপ গ্রামে কেরলের ওয়ানাড জেলার বাসিন্দা আশরাফকে লাঠি দিয়ে আঘাত করার পাশাপাশি লাথি মারা হয়। পরে প্রচন্ড রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।

মমতা ব্যানার্জির রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও গত কয়েক দিনে এরকম একাধিক ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার ফেসবুকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য এবং ছবি পোস্ট করার অভিযোগে বারাসাতের বাসিন্দা রিজওয়ান কুরেশীর মাংসের দোকানে ভাঙচুর চালানো হয়, তাকে মারধর করে উত্তেজিত জনতা। পরে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই রাতেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভারতবিরোধী মন্তব্য করায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বারাসাতের হাটখোলা। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়া হয়। এ ঘটনায় তাতে এক পুলিশ সদস্য আহত হয়। ওই ঘটনায় বুধবার একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে বারাসাত আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়।

সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশের শামলি জেলার ঝিনঝানা গ্রামে। সেখানে ২৮ এপ্রিল সরফারাজ নামে একজন মুসলিম ব্যক্তিকে তার নাবালক সন্তানের সামনে বারবার কুড়াল দিয়ে আঘাত করা হয়। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, হামলাকারীক বারবার বলতে শোনা যায় ‘২৬ কে বদলে ২৬ মারুঙ্গা’ (অর্থাৎ ২৬ জনের প্রতিশোধ নিতে আমি ২৬ জনকে হত্যা করবো)। 

উত্তর প্রদেশের আলিগড় শহরে নয় বছর বয়সী এক কিশোরকে পাকিস্তানি পতাকায় প্রস্রাব করতে বাধ্য করা হয়। কারণ তারই এক বন্ধু পাকিস্তানবিরোধী পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছে বলে অভিযোগ উঠে।

হামলার শিকার হয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা এবং সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও। মধ্যপ্রদেশে নজর দৌলত খান নামে এক ‘গভর্নমেন্ট রেলওয়ে পুলিশে’র (জিআরপি) কর্মকর্তা পার্কিং স্পেসে কয়েকজনকে মদপান করতে বাধা দেওয়ায়, তার পোশাক ছিঁড়ে দেওয়া হয়। বিহারে একজন স্থানীয় সাংবাদিক এবং তার ভাইকে কুর্তা-পাজামা পরার জন্য প্রহার করা হয়।

ইসলামফোবিয়া এমন জায়গায় পৌঁছেছে, সাত মাসের গর্ভবতী এক মুসলিম নারীকে ধর্মের কারণে এক স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেন বলে অভিযোগ। সি কে সরকার নামে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনেন মেহেফুজা খাতুন নামের একজন আইনজীবী।

এসব ঘটনার পাশপাশি ভারতের বিভিন্ন স্থানে পড়াশোনা বা কাজের জন্য বসবাসকারী কাশ্মীরিদের হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে।  কোথাও হোস্টেল ও ভাড়া নেয়া বাড়ি খালি করতে বলা হয়। কোথাও সহকর্মী বা সহপাঠীদের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, কোথাও আবার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে যৌন সহিংসতা এবং ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে এপিসিআর সদস্য তাজিন জুনাইদ বলেন  “যখন ঘৃণামূলক অপরাধ ঘটে, তখন সেগুলি বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে না। এর পিছনে কিছু প্রেক্ষাপট থাকে। এর কিছু ভিত্তি থাকে। দেশজুড়ে সহিংসতার পিছনেও পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা ইন্ধন জুগিয়েছে। এমনকি যেসব জায়গায় সহিংসতা ঘটেনি, সেখানেও পহেলগামের ঘটনার প্রভাব পড়েছিল। স্থানীয় মুসলিম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছিল।”

সুচরিতা/শাহেদ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর অপর ধ র ঘটন র সদস য র ঘটন এসব ঘ

এছাড়াও পড়ুন:

আমিনা বেওয়ার জীবন লড়াইয়ের, সুখের সঙ্গে তাঁর হয়নিকো দেখা

কাঠফাটা রোদে গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছেন একজন বৃদ্ধা। মাথায় ডালি। কাছে গিয়ে দেখা গেল, ডালিভর্তি বাদাম। গ্রাম ঘুরে সেগুলো বিক্রি করছেন তিনি। নাম আমিনা বেওয়া। বয়স ৭০ পেরিয়েছে।

রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর ইউনিয়নের বামনপাড়া গ্রামে গত রোববার দুপুরে আমিনা বেওয়ার সঙ্গে দেখা হয়। বামনপাড়ার পাশে মাস্টারপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। দুই গ্রামের দূরত্ব প্রায় আধা কিলোমিটার।

চানাচুর, বাদাম, বুটসহ শিশুদের বিভিন্ন খাবার ফেরি করে সাধারণত পুরুষেরাই বিক্রি করেন। নারী বিক্রেতা দেখা যায় কম। সেই ব্যতিক্রমী একজন আমিনা বেওয়া। কত দিন ধরে এ কাজ করছেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, কমসে কম ২০ বছর তো হবে। তেল, সাবান, লবণ, মসলাসহ নানা জিনিস ফেরি করে বিক্রি করেন। আগে ছেলে ফেরদৌসকে নিয়ে যেতেন। এখন সে ঢাকায় থাকে।

আগে ছেলের সঙ্গে ভারে করে মালামাল নিতেন আমিনা বেওয়া। এখন বয়স হয়েছে, তাই ডালি নেন। ডালিতে বেশি মালপত্র বহন করা সম্ভব হয় না। তাই বিক্রিও কম হয়।
দুপুরের প্রচণ্ড রোদে মাঠে কাজ করছিলেন অনেকে। কেউ ছাতা, কেউ টুপি দিয়ে মাথা ঢেকেছেন। কেউ কেউ গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তেমনি এক গাছের ছায়ায় বসে আমিনার সঙ্গে কথা হয়। বৃদ্ধ বয়সে রোদে কেন বের হন—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘চলি ফিরি খাওয়া নাগে।’ অর্থাৎ যত দিন চলতে পারবেন, তত দিন কাজ করে খেতে চান।

আমিনা জানান, বদরগঞ্জ হাট থেকে কারও মাধ্যমে বা নিজেই কাঁচা বাদাম কিনে আনেন। আবার কখনো মনিরপুর মিলেরপাড়ার প্রদীপ কুমারের হোটেল থেকে ২০-৩০ পিস শিঙাড়া এনে বিক্রি করেন।

যে বয়সে সন্তানদের সেবা পাওয়ার কথা, সে বয়সে আমিনা পরিশ্রম করছেন। কোনো আক্ষেপ আছে কি না, জানতে চাইলে উল্টো সন্তানদের জন্য কিছু করতে না পারার দুঃখবোধ তাঁর কণ্ঠে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘চল চল যমুনা যাই’— এই ধরনের রাজনীতি আর হতে দেব না: তথ্য উপদেষ্টা
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে নিহত ১, অগ্নিসংযোগ
  • সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ও ইসলামপন্থী নেতা শারার সঙ্গে বৈঠক করলেন ট্রাম্প, সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় আগ্রহ
  • দেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে শান্তির বার্তা ছড়াতে আলিয়ার বিশেষ উদ্যোগ
  • দেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে শান্তির বার্তা ছড়াতে আলিয়ার উদ্যোগ
  • গ্রামীণ ব্যাংকের পর্ষদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকতে হবে, কমছে সরকারি শেয়ার
  • কালিয়াকৈরে ৯৯৯-এ কল পেয়ে একজনের লাশ উদ্ধার করল পুলিশ
  • আমিনা বেওয়ার জীবন লড়াইয়ের, সুখের সঙ্গে তাঁর হয়নিকো দেখা
  • নূর খান ঘাঁটিতে ভারতীয় হামলা মার্কিন হস্তক্ষেপের কারণ: এনওয়াইটি