ভারতে বিরোধী দলগুলোর দাবি ছিল, পেহেলগাম–কাণ্ড ও অপারেশন সিঁদুর নিয়ে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার। সেই দাবি আমলে না নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সর্বদলীয় সংসদীয় প্রতিনিধিদের পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল নরেন্দ্র মোদি সরকার।

এই লক্ষ্যে সাতটি রাজনৈতিক দলের সাতজন সংসদ সদস্যের অধীন সাতটি দল গড়া হবে। আজ শনিবার সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ওই সাত নেতার নাম ঘোষণা করেছে। প্রতিটি দলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছয়–সাতজন করে সদস্য থাকবেন।

এসব দল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশের পাশাপাশি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশে যাবেন ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের নিরলস সংগ্রাম এবং অপারেশন সিঁদুরের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করবেন। আন্তসীমান্ত ‘সন্ত্রাস’ মোকাবিলা ভারতকে কীভাবে করতে হচ্ছে, তা বোঝানোর পাশাপাশি প্রতিনিধিরা সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে পাকিস্তানের ‘যোগসাজশ’ তুলে ধরবেন। সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী চলতি মাসেই এই প্রতিনিধিদলগুলোর সফর শুরু হবে।

আজ শনিবার যে সাত দলের সাত নেতার নাম ঘোষণা করা হয়, যাঁরা প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কংগ্রেসের শশী থারুর, বিজেপির রবিশংকর প্রসাদ ও বৈজয়ন্ত পান্ডা, জেডিইউর সঞ্জয় কুমার ঝা, ডিএমকের কানিমোঝি করুণানিধি, এনসিপির (শারদ পাওয়ার) সুপ্রিয়া সুলে ও শিবসেনার (শিন্ডে) শ্রীকান্ত একনাথ শিন্ডে। প্রতিনিধিদলের সফর কবে থেকে শুরু হবে সরকারি বিবৃতিতে তা জানানো না হলেও সরকারি সূত্রের খবর, ২৩ মে থেকে যাত্রা শুরু হবে।

কংগ্রেসের অনেকেই মনে করেন, বারবার দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে মন্তব্য এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে থারুর ‘লক্ষ্মণরেখা’ লঙ্ঘন করছেন। এই সুযোগে বিজেপিও নানাভাবে থারুরকে তোষামোদ করছে।

এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার, কংগ্রেসসহ সব বিরোধী দল পেহেলগাম–কাণ্ড ও অপারেশন সিঁদুর নিয়ে আলোচনার জন্য সংসদের উভয় কক্ষের বিশেষ যৌথ অধিবেশন ডাকার যে দাবি জানিয়ে আসছে, তা মানার কোনো আগ্রহ সরকারের নেই। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে দুটি সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটিতেও উপস্থিত ছিলেন না। তাঁর উপস্থিতিতে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার দাবিও বিরোধীরা জানিয়েছেন। সেই দাবিও মোদি মানেননি; বরং শোনা যাচ্ছে, সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করবে, সেই সময় প্রধানমন্ত্রী এনডিএ–শাসিত রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠক ডাকতে চলেছেন।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত অন্য রাজনৈতিক বিতর্কও তুলে দিয়েছে। যেমন দলকে না জানিয়ে দলীয় নেতাদের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বেছে নেওয়া। এই বিতর্কে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে কংগ্রেস। প্রশ্ন উঠেছে কেরালার তিরুবনন্তপুরম থেকে নির্বাচিত লোকসভার সদস্য শশী থারুরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঘিরেও।

কংগ্রেসের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ শনিবার এক্স হ্যান্ডলে দাবি করেন, গত শুক্রবার সংসদীয়মন্ত্রী কিরেন রিজিজু কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে ও লোকসভার বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে চার সংসদ সদস্যের নামের তালিকা চান। সেই অনুযায়ী গতকাল শুক্রবার দুপুরের মধ্যেই কংগ্রেস সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আনন্দ শর্মা, লোকসভার উপনেতা গৌরব গগৈ, রাজ্যসভার সদস্য সৈয়দ নাসির হুসেন ও লোকসভার সদস্য রাজা ব্রার নামপ্রস্তাব পাঠিয়ে দেয়।

ওই চারজনের মধ্যে শশী থারুরের নাম ছিল না। অথচ আজ শনিবার সকালে সরকার থারুরকে একটি দলের নেতা হিসেবে বেছে নেয় এবং তাঁর নাম জানিয়েও দেয়। কংগ্রেস সূত্রে বলা হয়, থারুরকে নেতা করার বিষয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে সরকার কোনো আলোচনাই করেনি।

সরকারি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে থারুর তা গ্রহণ করে এক্সে জানিয়ে দেন—এই আমন্ত্রণ তাঁকে ‘সম্মানিত’ করেছে। তিনি বলেন, দেশের স্বার্থ যেখানে জড়িত এবং তাঁর সহায়তা প্রয়োজন, সেখানে তিনি সদা প্রস্তুত। কাউকে তাঁর অভাব বোধ করতে দেবেন না।

কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনা না করে একটি প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির নেতা শশী থারুরের নাম ঘোষণা এবং দলের অনুমতি না নিয়ে থারুরের সেই প্রস্তাব গ্রহণ বুঝিয়ে দিচ্ছে কংগ্রেস ও থারুরের সম্পর্ক ক্রমে জটিলতর হয়ে উঠেছে। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া কোন দিকে গড়ায়, আপাতত সেদিকেই সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ।

সুযোগ বুঝে বিজেপিও ঘোলা জলে মাছ ধরতে প্রস্তুত। বিজেপির মুখপাত্র অমিত মালব্য দলে থারুরের অবস্থান নিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বের সমালোচনা করে এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, থারুরের অভিজ্ঞতা ও বাগ্মিতা প্রশ্নাতীত; তবুও কংগ্রেস দল, বিশেষ করে রাহুল গান্ধী সর্বদলীয় প্রতিনিধি হিসেবে তাঁকে মনোনয়ন করলেন না? এটা কি নিরাপত্তাহীনতা, ঈর্ষা, নাকি হাইকমান্ডকে ছাপিয়ে যাওয়ার কারণে অসহিষ্ণুতা?

কংগ্রেসের সঙ্গে শশী থারুরের দূরত্ব কিছুদিন ধরেই বেড়ে চলেছে। বিজেপি সেই সুযোগ গ্রহণে সচেষ্ট। ২০১৪ সালে এক লেখায় প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রশংসা করার পর শশী থারুরকে কংগ্রেসের মুখপাত্র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০২০ সালে সর্বস্তরে সাংগঠনিক নির্বাচন দাবি করে যাঁরা সোনিয়া গান্ধীকে চিঠি লিখেছিলেন, থারুর ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

সেই নেতারা ওই সময় ‘জি–২৩’ গোষ্ঠীভুক্ত বলে পরিচিত হয়েছিলেন। দুই বছর পর থারুর কংগ্রেস সভাপতি পদে নির্বাচনে দাঁড়ান খাড়গের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি অপারেশন সিঁদুর নিয়ে তিনি সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কংগ্রেসের অনেকেই মনে করেন, বারবার দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে মন্তব্য এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে থারুর লক্ষ্মণরেখা লঙ্ঘন করছেন। এই সুযোগে বিজেপিও নানাভাবে থারুরকে তোষামোদ করছে।

সরকারি সূত্র অনুযায়ী, শশী থারুরের নেতৃত্বাধীন দলটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোয় যাবে। অন্য দলগুলো যাবে সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, আলজেরিয়া, ওমান, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ অন্যান্য দেশে। সাত প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যদের নাম দু–এক দিনের মধ্যেই চূড়ান্ত হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক র সদস য ল কসভ র থ র রক দল র স প রস ত মন ত র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

পাহাড় থেকে পৃথিবীর পথে 

পিঠে থুরুং (ঝুড়ি) বাঁধা এক জুমিয়া নারী। মাথায় পাগড়ির বা শিরস্ত্রাণের মতো একটা ট্যাংক। ছবির পরিসরজুড়ে বিশালাকৃতির সেই নারীর চারপাশে বন্দুকধারী অসংখ্য ছায়ামূর্তি। তাদের আকৃতি নারীর তুলনায় বহুগুণ খর্বকায়। ট্যাংকের নল দিয়ে সেসব ছায়ামূর্তির ওপর পড়ছে পাতা আর ফুল।

শিল্পী জয়দেব রোয়াজা কালি ও কলমে এই ছবি এঁকেছিলেন ২০২৩ সালে। তাঁর অন্য সব ছবির মতোই এটিও পাহাড়ের সমকালীন অবস্থাই কেবল তুলে ধরে না; বরং তাকে ভীষণভাবে ছাপিয়ে যায়। বাস্তবতা পেরিয়ে জাদুবাস্তবতার সীমায় এসে দাঁড়ায়। মানুষের জীবন, সংগ্রাম আর প্রকৃতি সব ভেঙেচুরে কবিতার একটি পঙ্‌ক্তির ভেতরে যেন প্রবেশ করে।

১৯৭৩ সালে খাগড়াছড়ির খামারপাড়ার একটি ত্রিপুরা পরিবারে জন্ম জয়দেব রোয়াজার। মা নীহারিকা ত্রিপুরা আর বাবা হিরণ্ময় রোয়াজা। হিরণ্ময় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে একটি হাসপাতালে চাকরি করতেন। শান্ত নিরিবিলি পাড়ার বাসিন্দা তাঁরা। পাহাড়, ঝিরি, ঝরনা আর জুমখেত দেখতে দেখতে বড় হওয়া। স্কুলে কবিতার বইয়ের ইলাস্ট্রেশন নকল করে খাতায় আঁকতেন। কবিতার চেয়ে ভালো লাগত ইলাস্ট্রেশন। শেষে এই ভালো লাগারই জয় হলো। বাংলাদেশের এই সময়কার এক উজ্জ্বল শিল্পী জয়দেব। তাঁর শিল্পকর্মের পরিচিতি ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। 

একনজরে জয়দেব

চারুকলার নতুন মাধ্যম পারফরম্যান্স আর্ট। জয়দেব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই এই মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই ধারার শিল্পীরা নিজের শরীরকেই করে তোলেন ক্যানভাস। সঙ্গে থাকে নানা প্রকাশভঙ্গি। পারফরম্যান্স করতে গিয়ে ছবি আঁকা ছাড়েননি তিনি। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের যেমন স্টোরিবোর্ড, তেমনি জয়দেবের পারফরম্যান্সের প্রতিটি ভঙ্গির ছবি আঁকা থাকে তাঁর স্কেচ খাতায়। এভাবেই দুই মাধ্যমকে যুক্ত করেছেন নিজের ধরনে। পাশাপাশি বড় ক্যানভাসেও ছবি আঁকেন। কালি ও কলমেই সিদ্ধহস্ত তিনি।

ভারতের কোচি বিয়েনাল, হংকং আর্ট বেজেল, অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে এশিয়া প্যাসিফিক ট্রায়েনিয়ালে অংশ নিয়েছেন তিনি। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১১টির বেশি দেশে তিনি পারফরম্যান্স করেছেন। হয়েছে চিত্র প্রদর্শনীও। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের টেট মডার্ন মিউজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, চীনের হংকংয়ের এম প্লাস, ফ্রান্সের প্যারিসের ক্যাডিস্ট ফাউন্ডেশন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির গুগেনহাইম, ভারতের নয়াদিল্লির কিরণ নাদার মিউজিয়ামসহ বিশ্বের খ্যাতনামা বহু জাদুঘরে তাঁর শিল্পকর্ম রক্ষিত আছে। বাংলাদেশে তাঁর শিল্পসংগ্রহ রয়েছে সামদানি আর্ট ফাউন্ডেশন এবং দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে। শিল্পবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা আর্ট রিভিউ এশিয়া, আর্ট নিউজ, ফোর্বস এবং ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু পত্রিকায় তাঁর শিল্পকর্মের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। আবুধাবির গুগেনহাইম মিউজিয়াম জয়দেবের একটি শিল্পকর্ম বেশ ভালো দামে কিনে নিয়েছে। বর্তমানে তিনি মুম্বাইভিত্তিক ঝাভেরি কনটেমপোরারি গ্যালারির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। 

পাহাড় আর ঝিরির পথে পথে

খাগড়াছড়ি আর রাঙামাটির ঝিরি পথে বা কাপ্তাই হ্রদের নির্জনতায় সময় কাটে জয়দেব রোয়াজার। আন্তর্জাতিক খ্যাতি এলেও জীবন কাটান পাহাড়ি জুমিয়াদের মতো। কখনো মাছ ধরতে চলে যান জেলেদের সঙ্গে। আবার কখনো ঝিরি পথে হেঁটে হেঁটে দিন কাটে তাঁর। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার কামিলাছড়ি গ্রামে নির্জন হ্রদের ধারে গড়ে তুলেছেন স্টুডিও। সেখানে সপ্তাহের দুই দিন কাটে তাঁর। পাহাড় ও পাহাড়ের মানুষজনকে নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা বুনে তোলেন ক্যানভাসে।

জয়দেব দেশের শিল্পীসমাজ ও শিল্পবোদ্ধাদের জগৎ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন। তাঁর কথায়, ঢাকা তাঁকে কখনো টানে না। দু-এক দিন ঢাকা বা দেশের বাইরে থাকলে হাঁপিয়ে ওঠেন। ভাবেন, কখন ফিরবেন পাহাড়ে। 

সম্প্রতি কামিলাছড়িতে তাঁর স্টুডিওতে গিয়ে দেখা গেল আট ফুট দীর্ঘ একটি ক্যানভাসে কাজ করছেন তিনি। তিনতলা স্টুডিওর বারান্দায় এসে দাঁড়ালে অবারিত নীল হ্রদের হাতছানি। হ্রদের পাড়ে ঢেউখেলানো পাহাড়ের সারি। সেদিকে তাকালে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয়। বারান্দায় বসে কথায় কথায় জানালেন নির্জন এই পাহাড়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে ছবি বিক্রির টাকায় এই স্টুডিও গড়ে তুলেছেন। স্ত্রী হাসনাহেনা পরশের সঙ্গে মিলে জঙ্গল পরিষ্কার করেছেন। একটাই চাওয়া, একটু আড়াল, একটু নির্জনতা। ছবি আঁকার জন্য এটুকু পরিসর চেয়েছেন জীবন থেকে। 

জয়দেব রোয়াজা

সম্পর্কিত নিবন্ধ