Risingbd:
2025-05-21@22:37:08 GMT

স্বপ্নের দেশ আমেরিকা

Published: 21st, May 2025 GMT

স্বপ্নের দেশ আমেরিকা

৩১ মে ২০০৭। দুপুর দেড়টায় নিউইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্টে নামলাম। হংকং থেকে দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা একটানা ভ্রমণ করে আমেরিকায় পৌঁছানো; যা ছিল আমার জীবনের  অভুতপূর্ব ঘটনা! আমেরিকা পৃথিবীর স্বপ্নের দেশ। কেউ বলে স্বর্গের দুয়ার। সেই প্রত্যাশিত স্বর্গের দুয়ারে হাজির হলাম আমি!

মুক্তধারা ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান আমেরিকার জাতিসংঘ ভবনের সামনে বাংলাদেশের শহীদ মিনার স্থাপন করে দিবসটি পালন করে আসছে ১৫ বছর ধরে। সেই মুক্তধারা ফাউন্ডেশন প্রতি বছর আমেরিকায় আয়োজন করে আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসবের। এবার এই উৎসবের আয়োজন করা হয় আরো বড় পরিসরে। আমেরিকার ৪টি স্টেটে। নিউইয়র্ক, ডালাস, লসএঞ্জেলস এবং নিউ জার্সিতে; জুনের ১ তারিখ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে।

মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট বিশ্বজিৎ সাহা এই আর্ন্তজাতিক বাংলা উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ থেকে অনেককেই আমন্ত্রণ জানান, আমাকেও একটি আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছেন অংশগ্রহণের জন্য। বাংলাদেশের ডেলিগেটসদের মধ্যে ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যার প্রয়াত ড.

আনিসুজ্জামান, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, লেখিকা রাবেয়া খাতুন, ‘বাংলার গান’খ্যাত গায়ক মাহমুদুজ্জামান বাবু, কদ্দুস বয়াতি, হাবিব ওয়াহিদ এবং ফেরদৌস ওয়াহিদ। আমি পুরো ইভেন্টের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করছিলাম। 

আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসবে ডেলিগেট হিসেবে অংশগ্রহণের  আমন্ত্রণ পাওয়ার পর থেকেই ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা হচ্ছিল। এশিয়া মহাদেশের প্রায় সবগুলো দেশ আমি ইতোমধ্যেই সফর শেষ করেছি, তারপরও আমেরিকা বলে কথা! হয়তো কোন সময় আমেরিকা যাওয়া হতোই কিন্তু এই অপ্রত্যাশিত আমন্ত্রণে বেশ উত্তেজনা হচ্ছিল। আমেরিকা যাবার প্রথম শর্তই হলো ভিসা পাওয়া। আমার বর্তমান ব্যবসায়িক অবস্থান, বহু দেশের ভিসা আছে পাসপোর্টে, এতে ভিসা না দেবার কোনো কারণ নেই, তবুও আমেরিকার ভিসা বলে কথা, যদি ভিসা না পাই এই ভয়ে কাউকে কিছু বলি না। ভিসার কাগজপত্র রেডি করে ভিসা ফরম ফিল-আপ করে জমা দিলাম। ঠিক তিনদিন পর ইন্টারভিউয়ের ডেট দিলো। যথারীতি তিনদিন পর আমেরিকান  এ্যাম্বাসিতে গিয়ে হাজির হলাম। অনেক মানুষ বসে আছে বিরস মুখে ইন্টারভিউয়ের জন্য। সবার বুক দুরুদুরু, কি হবে ভিসা কি পাবো? আমি বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটল এক দুঃখজনক ঘটনা। এক মহিলা ইন্টারভিউ রুম থেকে বেরিয়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলেন তাঁর মেয়ে অসুস্থ আমেরিকায়, মেয়েকে দেখতে যাবেন কিন্তু তাকে রিফিউজ করেছে, ভিসা দেয়নি। মন খারাপ হয়ে গেল। 

একসময় ডাক পড়লো এক নাম্বার কাউন্টারে। এখানে পাসপোর্ট জমা দিলাম, আঙুলের ছাপ দিলাম এবং আবার ইন্টারভিউয়ের অপেক্ষায় বসে থাকলাম। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ডাক পড়লো। লাল চুল-দাঁড়ির এক যুবক কর্মকর্তা। কাচের জানালার ওপাশ থেকে ‘হ্যালো’ বললেন। আমিও হাসি মুখে ‘হাই’ বললাম। তার হাতে আমার পাসপোর্ট। আমেরিকা কেন যাবো, কয়দিন থাকবো এ রকম সামান্য প্রশ্ন। আমিও উত্তর দিলাম। কোম্পানির কাগজপত্র দেখতে চাইলো দিলাম, খুব দ্রুত পাতা উল্টিয়ে দেখলেন, তারপর কম্পিউটারে দ্রুত কিছু টাইপ করলেন। আমি কম্পমান বক্ষে অপেক্ষা করছি- কী হবে, ভিসা  কি দেবে?

অফিসার মুখ তুলে হাসি মুখে আমার দিকে তাকালেন এবং যে কথাটি বললেন তা হলো ‘ইউ আর কোয়ালিফাই ফর মালটিপল ভিসা, প্লিজ কালেক্ট ইয়োর পাসপোর্ট উইথ ভিসা ডে আফটার টুমোরো, থ্যাংক ইউ, হ্যাব এ গুড ডে।’ আমি মহা খুশী হয়ে অফিসারকে থ্যাংকস দিয়ে কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলাম।  ভিসা পেলাম তাও আবার মাল্টিপল ভিসা। আগামী এক বছর যতবার খুশি আমেরিকা যেতে পারবো! আল্লার কাছে শোকরিয়া আদায় করলাম। 

আমি আমেরিকা যাবার পথে হংকং হয়ে যাবো বলে সবার আগেই রওনা হলাম। ২৬ তারিখ রাতে বাংলাদেশ থেকে ড্রাগন এয়ারে। হংকং পৌঁছলাম ২৭ তারিখ ভোরে। ছোট ভাই দুলু এয়ারপোর্টে এসেছিল আমাদের রিসিভ করতে। মোমেনা, সেতু মনি, তাসিন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। খুব খুশি সবাই। হংকং ছিলাম চারদিন। 

৩১ তারিখ সকালে ক্যাথে প্যাসিফিকে রওনা হলাম নিউ ইয়র্ক।  টানা ১৪ ঘণ্টা কী করে কাটাবো এই চিন্তা এবং অসুস্থ হয়ে যাবার ভয় ছিল মনে। বাস্তবে যা ঘটলো তা হলো- উড়োজাহাজে উঠে এয়ার হোস্টেসদের হাসি মুখের আমন্ত্রণে, সিটে বসে গান শোনার, মুভি দেখার, খেলার এবং বই পড়ার আয়োজন দেখে এবং এসব কিছুতে অভ্যস্ত হতে ঘণ্টা দুই কেটে গেল। আমার জন্য আগে থেকেই অর্ডার দেয়া মুসলিম ফুড সরবরাহ করলো , দীর্ঘ সময় নিয়ে খেলাম। কোনো তারা নেই বরং সময় কাটানোই কাজ। খেয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম, না ঘুম আসে না। এয়ার ফোন কানে লাগিয়ে অডিও চ্যানেলের সবগুলো চ্যানেল ঘোড়ালাম। অডিও চ্যানেলে হঠাৎ করেই পেয়ে গেলাম একটি হিন্দি গানের চ্যানেল। পুরোনো এবং নুতন হিন্দি গান হচ্ছে, চমৎকার! অনেকক্ষণ গান শুনে কাটালাম। ভিডিও চ্যানেলগুলোতে সব ইংরেজি ছবি হচ্ছে টিপে টিপে সবগুলো চ্যানেল দেখলাম এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের উপর একটা মুভিতে স্থির হলাম। চমৎকার ছবি! এক ইংরেজ তার নিগ্রো প্রেগনেন্ট বৌকে নিয়ে যুদ্ধের মধ্যে পালানো এবং গুলি, শেল, বোমা, আগুন, লাশ এসবের মধ্যেও এক বিধ্বস্ত ঘরের ভাঙা দেয়ালের আড়ালে প্রসব বেদনায় কাতরানো বৌকে নিয়ে ভয়াবহ উত্তেজনার মধ্যে সন্তানের জন্ম, আর্মিদের নজরে পড়া, প্রসূতী এবং সদ্য জন্ম নেয়া শিশুর প্রতি মমতায়, সম্মানে ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়ানো, যুদ্ধ গোলাগুলি বন্ধ এবং কিছুক্ষণ পর আবার যুদ্ধ। একটি ভয়াবহ শ্বাসরুদ্ধকর ছবি। ঘণ্টা দুয়েকের ছবি শেষ হলো।  

প্লেনে ওঠার পর এতো কিছু করেও মাত্র ৫ ঘণ্টা পার করতে পেরেছি। আরো ৯ ঘণ্টা কী করে কাটাব তাই ভাবছি। গায়ে কম্বল টেনে পা দুটো সামনের আসনের নিচে লম্বা করে মেলে দিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করলাম। ঢাকার কথা মনে পড়ছে, নিজের বিছানার কথা মনে পড়ছে, নানা হাবিজাবি চিন্তা মাথার মধ্যে ভিড় করছে ঘুম আসছে না। এক টানা গোঁ গোঁ শব্দ। আরাম হচ্ছে না। আমার এক বন্ধু রাবু অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার, লন্ডন থাকে, একটি ব্রিটিশ কোম্পানিতে আগে চাকরি করতো এখন নিজের যোগ্যতায় বিশ্ব ব্যাংকে চাকরি করে। সারা পৃথিবীতে ওদের কাজ। প্লেনে করে উড়ে বেড়াতে হয় এক দেশ থেকে আরেক দেশে। আমি আমেরিকা যাবো, লম্বা প্লেন জার্নি করতে হবে বলে ওকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম কী করে এই দীর্ঘ জার্নি পাড় করবো। রাবু বলেছিল ভয়ের কিছু নেই, সময় কেটে যাবে। ওর উপদেশ ছিল হালকা ঢোলাঢালা পোশাক পরতে হবে অর্থাৎ আরামদায়কক হওয়া চাই। টাই কোট স্যুট পরা ঠিক হবে না। সাথে নিতে হবে হালকা কোনো উপন্যাস আর প্লেনে বসে খেতে হবে প্রচুর লিক্যুইড, ফলের জুস, বিয়ার কিংবা ওয়াইন; যদি অভ্যাস থাকে। কারণ দীর্ঘ প্লেন জার্নিতে শরীর ড্রাই হয়ে যায়। 

ওর উপদেশ মতো আমি পোশাক পরেছি। প্লেনে ওঠার পর থেকেই কমলার জুস খাচ্ছি। পানি তো খাচ্ছিই । সুবিধা আছে সব রকম। আসনের হাতলে আছে কলিং লাইট সুইচ। সুইচ টিপলেই মাথার উপড় ছোট্ট হলুদ বাতি জ্বলে ওঠে। এয়ার হোস্টেস তার জায়গায় বসে এই লাইট দেখেই ছুটে আসে কাছে।  জানতে চায় কী চাই, আমি বলি জুস কিংবা পানি বা চা কফি। এক মিনিটেই নিয়ে হাজির। আসনে বসে এক সময় পায়ের জুতো খুলে ফেলেছি আরাম করে বসার জন্য।

প্লেনে ওঠার পর এয়ার হোস্টেস প্রত্যেক যাত্রীকে দিয়েছে একটা এয়ার ফোন সেট, একটা কম্বল প্যাকেট, একটা ছোট্ট সুন্দর হলুদ চেইন লাগানো ব্যাগ। খুলে দেখি এর মধ্যে আছে এক জোড়া মোজা, একটা টুথ ব্রাশ, ছোট্ট একটা টুথ পেস্টের টিউব, এক প্যাকেট বাদাম। জুতা খুলে সেই মোজা জোড়া পড়ে নিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ বসে আছি তলপেট ভারী হয়েছে। লিক্যুইড যা খেয়েছি সব গিয়ে জমেছে। এবার চাপ দিচ্ছে জল বিয়োগ করা দরকার। পাশের সিটের মহিলাকে ইশারা করলাম টয়লেটে যাবো। সিট ছেড়ে উঠে আমাকে বের হবার সুযোগ দিলো। পায়ে জুতা পরতে গিয়ে দেখি জুতায় পা ঢুকছে না। দীর্ঘ সময় বসে থাকায় পা ফুলে গেছে। জুতা না পরে মোজা পরেই  বেরিয়ে এলাম। দুই সারি আসনের মাঝে লম্বা চলার প্যাসেজ। উঠে দাঁড়িয়ে একটু হেঁটে বেশ লাগলো। এয়ার হোস্টেস অবশ্য আগেই এসব বলে দিয়েছিল, বলেছিল সারাক্ষণ বসে না থেকে মাঝে মাঝে হাঁটতে। ব্যায়াম করতে, আঁড়মোড় ভাঙতে। আমি তাই করলাম। প্লেনের ফ্রেশ রুম ছোট্ট কিন্তু চমৎকার। এই ছোট্ট পরিসরেই অনেক ব্যবস্থা। জল বিয়োগ করে তলপেট হালকা করলাম। ঠান্ডা পানি গরম পানির ব্যবস্থা আছে, লিক্যু্ইড সাবান দিয়ে ভালো করে হাত-মুখ ধুলাম। দুই রকম টিস্যু পেপার আছে কুলুপ এবং হাত-মুখ মোছার জন্য। মুখে মাখার জন্য লোশন এবং হাতে মাখার জন্য আলাদা লোশন আছে। দীর্ঘ সময় নিয়ে এসব ব্যবহার করে ফ্রেশ রুম থেকে বের হলাম। প্যাসেজ ধরে এ মাথা থেকে ও মাথা দুবার হাঁটলাম। যাত্রীরা বেশীর ভাগ ঘুমোচ্ছে। কেউ ছবি দেখছে, কেউ বই পড়ছে, কেউ-বা ল্যাপটপ খুলে লিখছে। প্লেনজুড়ে আবছা অন্ধকার, নিস্তব্ধতা, আবার এসে নিজের সিটে বসলাম। 

আমাদের প্লেন ২২ হাজার ফুট উপড় দিয়ে ৫৭০ মাইল বেগে প্যাসিফিক ওশানের উপড় দিয়ে ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে টিভি স্ক্রিনে প্লেনের ক্যাপ্টেন এই ফিচার দেখায়। আরো দেখায় প্লেনের ভেতরে এবং বাইরের তাপমাত্রা ইত্যাদি। সুদীর্ঘ ক্লান্তিকর সময় কাটানোর বর্ণনা দেয়াটাও ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে। পরের ঘণ্টাগুলো কীভাবে কাটিয়েছি, কী কী করেছি সে বর্ণনাটাও ক্লান্তিকর। ঘুম কিংবা ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা, বইপড়া, গান শোনা, ছবি দেখা এবং নানারকম খাদ্য গ্রহণের মধ্য দিয়েই  পার করেছি দীর্ঘ সময়। প্লেনের ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিলেন আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের প্লেন নিউ ইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। সমস্ত যাত্রীর মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন, আড়মোড় ভেঙে জেগে উঠলেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমাদের বিশাল প্লেনটির চাকা আমেরিকার মাটি স্পর্শ করলো। 

মোটেই পছন্দ হলো না পুরোনো এয়ারপোর্ট ভবন। আমি হংকং, সিংগাপুর, ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট দেখেছি, কি সুন্দর ঝকঝকে, অত্যাধুনিক। আর আমেরিকান একটা এয়ারপোর্ট- তার এই হাল! পরক্ষণে এ-ও বুঝলাম এটা অনেক দিনের পুরোনো এয়ারপোর্ট, আজ থেকে ৫০ বছর আগে যখন তৈরি হয়েছিল তখন হয়তো এটাই ছিল পৃথিবীর সবচাইতে আধুনিক এয়ারপোর্ট। সুতরাং অত্যাধুনিক এয়ারপোর্ট হংকং ব্যাংককের সাথে এর তুলনা করা ঠিক নয়। বেশ কিছুদূর হেঁটে এসে ইমিগ্রেশন। লাইনে দাঁড়ালাম। দীর্ঘ লাইন তবে অনেকগুলো ডেস্ক থাকায় সময় বেশি লাগার কথা নয়। বুকের মধ্যে দুরুদুরু, যারা আগে এসেছিলেন তাদের কেউ কেউ ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। আমেরিকান ইমিগ্রেশন অনেক প্রশ্ন করবে, ছোট ঘরে নিয়ে ইন্টারগেশন করবে, তারপর ছাড়বে। মনে মনে তৈরি হচ্ছিলাম। আসলে বাংলাদেশি পাসপোর্ট এবং মুসলমান পাসপোর্ট দেখলেই এরা সন্দেহ করে। ভাবে এরা সবাই ফকিরের দেশ থেকে এসেছে, আর হয়তো ফিরে যাবে না। 

আমি লাইনের সামনে চলে এসেছি, আমার সামনে আর মাত্র একজন। তারপর ডাক পড়লো। গুড আফটারনুন বলে আমার পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম অফিসারের হাতে, একবার পাসপোর্টের দিকে আর একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন অফিসার। ভাবলেশহীন থমথমে মুখ। পাসপোর্টের পাতা উল্টিয়ে দেখছেন। আমার পাসপোর্টে অনেক দেশের ভিসা আছে। এটা আমার একটা বড় ভরসা। পাসপোর্ট দেখা শেষ, এবার প্রশ্ন- কী কারণে এসেছ?, ক’দিন থাকবে? এটাই কি প্রথম? আমি ধীরে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিলাম। ইন্টারন্যাশনাল বাঙালি  ফেস্টিভ্যালে এটেন্ড করতে এসেছি। একুশ দিন থাকবো, তারপর ফিরে যাবো আমার দেশে। হ্যাঁ এটাই আমার আমেরিকায় প্রথম সফর। আর কোনো প্রশ্ন নয়, অফিসার আমার পাসপোর্ট নিয়ে পিছনে দাঁড়ানো এক সিনিয়র অফিসারের কাছে গেলেন এবং ফিরে এসে পাসপোর্টের পাতায় সীল মেরে ‘ওকে, হ্যাভ এ নাইস ডে’ বলে হেসে পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিলেন। আমিও ‘থ্যাংকস’ বলে বেরিয়ে এলাম। এবার লাগেজ ক্লেইম এরিয়ায় এলাম লাগেজ নিতে।

পাশেই অনেকগুলো ট্রলি লাইন করে রাখা। একটা নিতে হবে। এগিয়ে গেলাম। ট্রলি ধরে টানছি কিন্তু কিছুতেই খুলছে না, পায়ের চাকাটা কোথায় যেন আটকে আছে। খোলার চেষ্টা করছি এ সময় এক কালো নিগ্রো এগিয়ে এলো। হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? ইফ ইউ নিড ট্রলি, ইউ হ্যাভ টু পে ওয়ান ডলার। বুঝলাম এক ডলার পেমেন্ট করতে হবে। আমার পকেটে খুচরা ডলার ছিল, ডলার দেবার পর ট্রলির চাকা খুলে গেল। আমি ট্রলি ঠেলে লাগেজ বেল্টের কাছে এসে দাঁড়ালাম। অবাক হলাম আমাদের এশিয়া মহাদেশের কোনো এয়ারপোর্টে ট্রলির জন্য টাকা দিতে হয় না। অথচ আমেরিকার এয়ারপোর্টে সামান্য ট্রলির জন্য টাকা দিতে হলো! লাগেজ পেয়ে গেলাম। ট্রলিতে উঠিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমাকে নেবার জন্য এয়ারপোর্টে কারো আসার কথা। কিন্তু কাউকে দেখছি না। যাত্রীরা বের হচ্ছে, গাড়িতে উঠে চলে যাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। কেউ আসছে না আমার দিকে। 

খুব চিন্তায় পড়লাম। শেষে ফোন সেট বের করে রমিং অন করে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট বিশ্বজিৎ সাহাকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, আপনি দাঁড়ান। দুজন গেছে। ওরা আপনাকে খুঁজে নেবে। দাঁড়িয়ে রইলাম আরো প্রায় ১৫ মিনিট।  না কেউ আসছে না। মহাবিরক্ত হয়ে আবার ফোন করলাম বিশ্বজিৎ সাহাকে। এবার আর ফোনই ধরছে না। মেজাজ খুব খারাপ হলো। তাকে বারবার বলেছি, আমি আমেরিকায় প্রথম যাচ্ছি রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না, তাছাড়া দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টার জার্নি করে গিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে চাইনি বলে গতকাল রাতেও হংকং থেকে ফোনে বলেছি- এয়ারপোর্টে কাউকে রিসিভ করার জন্য। অথচ এখন কারো দেখা নেই। রাগে দুঃখে অপমানে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। আমাকে এখন হোটেলে যেতে হবে। রাস্তা পাড় হয়ে ট্যাক্সির কিউতে এসে দাঁড়ালাম। এখানেও এক  অফিসার যাত্রীদের ট্যাক্সি করে দিতে সাহায্য করছেন। কোনো অসঙ্গতি নেই। জ্যাম নেই। ট্যাক্সি এসে দাঁড়াচ্ছে, যাত্রীরাও একেক করে ট্যাক্সিতে উঠে চলে যাচ্ছে। একটা ট্যাক্সি এসে দাড়াঁলো। আমি লাগেজ ট্যাক্সির পিছনে উঠিয়ে নিজে উঠে বসলাম। পকেট থেকে হোটেলের ঠিকানা লেখা কাগজ ড্রাইভারের হাতে দিতে গিয়ে লক্ষ করলাম ড্রাইভার বাঙালি।  মনে মনে স্বস্তি পেলাম। কুমিল্লার মানুষ। বললাম, এই হোটেল কি আপনি চিনতে পারছেন? বললেনম, হ্যাঁ। জ্যাম না থাকলে ২০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবো। (চলবে)

তারা//

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর দ র ঘ সময় আম র ক র র আম র ক আম র ক য় গ রহণ র মন ত র আম দ র র জন য র হল ম অফ স র বলল ন ত রপর করল ম প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা: সেনাপ্রধান

মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

বুধবার সকালে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে আয়োজিত এক সভায় (অফিসার্স অ্যাড্রেস) মব ভায়োলেন্স, সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বিষয়ে জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান প্রতিবেদন, অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান সংস্কারসহ নানা প্রশ্নের উত্তর দেন সেনাপ্রধান। এ সময় তিনি এ কথা জানান। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এ বিষয়ে কোনো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়নি। পরে যোগাযোগ করা হলে আইএসপিআর কোনো মন্তব্য করবে না বলে জানায়।  

ঢাকা সেনানিবাসে অনুষ্ঠিত এ সভায় ঢাকার বাইরের বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তারা ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। বৈঠকে উপস্থিত সূত্রগুলো জানায়, অফিসার্স অ্যাড্রেসে প্রথমে সেনাপ্রধান বক্তব্য রাখেন। এরপর বিভিন্ন ইউনিট থেকে যেসব কর্মকর্তা যুক্ত ছিলেন তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সেনাপ্রধান। 

সভায় শিগগিরই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। আগামী  ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে নিজের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিরলস ভূমিকা ও প্রতিশ্রুতির প্রশংসা করেন সেনাপ্রধান। সেনা কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলা ও আনুগত্য বজায় রাখারও আহ্বান জানান তিনি।

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে মানবিক করিডোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে। এটি হতে হবে বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। করিডোরের ব্যাপারে জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার বিষয়ও এখানে যুক্ত।  

সেনাপ্রধান বলেন, আগস্ট থেকে সেনাবাহিনীর ধারাবাহিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু মহল তাঁকে ও বাহিনীকে অন্যায্যভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। 

ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর– এমন কোনো কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনও যুক্ত হবে না।  কাউকে তা করতেও দেওয়া হবে না। এই বাস্তবতায় সব পর্যায়ের সেনাসদস্যকে নিরপেক্ষ থাকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। আগামীতে নির্বাচনী দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের নির্দেশ দেন সেনাপ্রধান। 

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা সহযোগিতা করছি। সহযোগিতা করে যাব। সামনে ঈদ। মানুষ যেন নিরাপদে ঈদ উদযাপন করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করতে হবে। 

বাংলাদেশ নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান বলেন, এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলা হয়নি। আমাদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। 

নির্যাতিতদের অধিকারের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন সেনাপ্রধান। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্যের পর এক ঘণ্টাব্যাপী প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। একজন কর্মকর্তা বিভিন্ন অভিযোগে বরখাস্ত সেনাসদস্যদের অপরাধের বিষয়গুলো আইএসপিআরের মাধ্যমে প্রকাশ করার কথা জানান।  

বন্দর নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে জেনারেল ওয়াকার বলেন, এখানে স্থানীয় মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের মতামত প্রয়োজন হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে। সংস্কার নিয়ে করা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কী সংস্কার হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে– এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ