জাতীয় বাজেট একটি রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের রাজনৈতিক দলিল। এটি কেবল অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নয়, বরং নাগরিক অধিকারের দিকনির্দেশক। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেট হওয়া উচিত ন্যায়ভিত্তিক, প্রয়োজননির্ভর এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক। কিন্তু বাংলাদেশের বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশের প্রায় ৩৫.১ শতাংশ গ্রামীণ নারীর জন্য বরাদ্দ এখনও প্রান্তেই রয়ে গেছে– সংখ্যায়, কাঠামোয় এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বাজেটের এমন পরিস্থিতি নারীদের পদ্ধতিগতভাবে পিছিয়ে রাখার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। 
গত তিন অর্থবছরে বাজেটে মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়ানোর বিপরীতে নারীর বরাদ্দ পর্যালোচনা করলে বৈষম্যের রেখাচিত্রই উঠে আসে। 

* ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় মাথাপিছু বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩৯,৮৮৬ টাকা। সেখানে গ্রামীণ নারীর জন্য মাথাপিছু বাজেট বরাদ্দ ছিল ৫,৫৯৮ টাকা।
* ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাতীয় মাথাপিছু বরাদ্দ ছিল ৪৬,১২৫ টাকা। এ বছর গ্রামীণ নারীর জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ দ্বিগুণ অর্থাৎ ১০,৮১৪ বাড়ানো হয়। আগের অর্থবছরের চেয়ে ৫,২১৬ টাকা বেড়েছে।
* ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় মাথাপিছু গড় বাজেট বরাদ্দ ছিল ৪৭,০৩২ টাকা, অথচ গ্রামীণ নারীর জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ আগের বছরের চেয়ে নাটকীয়ভাবে অনেক বেশি কমে যায়, মাত্র ১,৪৮৬ টাকা– যা জাতীয় মাথাপিছু বাজেটের তুলনায় প্রায় ৯৬.

৮% কম। 

এই চিত্রে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, জাতীয় বাজেটের সামগ্রিক আকার বাড়লেও গ্রামীণ নারীর জন্য বরাদ্দ তার অনুপাতে একেবারেই বাড়েনি বরং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এক ধাক্কায় তা অনেক নিচে নেমেছে। 
গ্রামীণ নারীর জন্য সাধারণত জাতীয় বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিভিন্ন  প্রশিক্ষণ,  সামাজিক সুরক্ষা বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে। প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য মোট বাজেট বরাদ্দ হয়েছে ৮৭৪.৯৪ কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় এ বরাদ্দে সামান্য বাড়লেও বাস্তব চাহিদা ও কাঠামোগত বৈষম্য নিরসনের ক্ষেত্রে এটি একেবারেই অপর্যাপ্ত। এই বরাদ্দের মধ্যে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১৮.৫৫ কোটি টাকা, যা বিভিন্ন প্রকল্পভিত্তিক ব্যয়ের জন্য নির্ধারিত। যেমন– নারী ও শিশু উন্নয়নবিষয়ক গবেষণা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়ন, আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণ, সামাজিক সুরক্ষা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যক্রম শহরকেন্দ্রিক ও মধ্যবিত্ত নারীর উপযোগী, গ্রামীণ নারীর কৃষি, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও জীবিকা সমস্যাগুলো প্রতিফলিত নয়। বাস্তবে এ বরাদ্দগুলোতেও তিনটি বড় যে বৈষম্য দেখা যায় তা হলো– অপ্রতুল বরাদ্দ, বাস্তবায়নে বৈষম্য এবং অবহেলিত ক্ষেত্র। ফলে গ্রামীণ নারী শ্রম দিলেও বাজেটে তাদের শ্রমের কোনো হিসাব নেই। উন্নয়ন প্রকল্পে তারা উপকারভোগী হিসেবে বিবেচিত হলেও, অধিকারভোগী হিসেবে নয়। 

সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চলের রওশন আরা বেগম, যিনি গরু পালেন ও শাকসবজি চাষ করেন। হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন ‘বাজেটের কথা শুনি, কিন্তু বুঝি না আমাদের জন্য কিছু আছে কিনা। আমাদের গরু-মুরগির জন্য কিছু সহায়তা পেলে বড় ভালো হতো। ভাতা কারা পায়, জানি না। আমরা অনেকেই পাই না। কাজ করি, কষ্ট করি, কিন্তু আমাদের কপালে কিছু নেই।’ রওশন আরার মতো নারীর জীবনে বাজেটের অস্তিত্ব নেই। অথচ তারা প্রতিদিন রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে সামনে টেনে নিচ্ছেন।

বাজেটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ঠিক করে দেয়– কে গুরুত্বপূর্ণ, কার জন্য কী বরাদ্দ থাকবে। গ্রামীণ নারীকে শুধুই ‘উপকারভোগী’ হিসেবে না দেখে ‘অধিকারভোগী নাগরিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের মাথাপিছু বরাদ্দ কমিয়ে নয়– দ্বিগুণ করে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কৃষিতে স্বীকৃতি দিতে হবে। বাজেটে আলাদা লাইন আইটেম রাখতে হবে ‘গ্রামীণ নারী’ নামে। বাজেট হতে হবে এমন এক রূপরেখা, যা প্রান্তিক নারীর শ্রমকে কেন্দ্রের মর্যাদা দেয়, যাতে রওশন আরাদের মতো নারীরা একদিন বলতে পারেন– ‘এই বাজেট আমাদের কথা বলে’।

সানজিদা খান রিপা: প্রোগ্রাম ম্যানেজার, এএলআরডি
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক ষমত গ র ম ণ ন র র জন য ব জ ট বর দ দ বর দ দ ছ ল র জন য ম আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

দেশে খাদ্য পরিস্থিতি অত্যন্ত সন্তোষজনক: উপদেষ্টা

দেশে বর্তমানে খাদ্য পরিস্থিতি অত্যন্ত সন্তোষজনক, দাবি করে খাদ্য ও ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, “বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলন হয়েছে। যদি আমন মৌসুমেও ভালো ফলন হয়, তাহলে বিদেশ থেকে আর চাল আমদানির প্রয়োজন হবে না।”

শুক্রবার (২০ জুন) পটুয়াখালী সার্কিট হাউজে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভায় খাদ্য অধিদপ্তরের পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় জানানো হয়, চলতি বোরো মৌসুমে পটুয়াখালী জেলায় ধান ও চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ১ হাজার ৯২৫ মেট্রিক টন ও ৫ হাজার ৬৯৫ মেট্রিক টন। ইতোমধ্যে ইতোমধ্যে ১ হাজার ৯২৫ মেট্রিক টন ধান এবং ৪ হাজার ৯৯৭ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।

বরগুনা জেলার লক্ষ্যমাত্রা ৫০০ মেট্রিক টন ধান ও ১ হাজার ৫১৩ মেট্রিক টন চাল। এর বিপরীতে ৫০০ মেট্রিক টন ধান এবং ১ হাজার ৩৪৯ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। বরগুনার ছয়টি এলএসডির (স্থানীয় সংগ্রহ কেন্দ্র) সম্মিলিত ধারণক্ষমতা ১৫ হাজার মেট্রিক টন।

খাদ্য উপদেষ্টা বলেছেন, “আমরা যে ভালো অবস্থানে আছি, তা বলছি ঠিকই; তবে এ অবস্থান রক্ষা করা কঠিন। কারণ, খাদ্য ক্রমাগত খরচ হচ্ছে, আবার ক্রমাগত সংযোজনও হচ্ছে। এজন্য নিয়মিত তদারকি জরুরি।” 

তিনি জেলা প্রশাসকদের স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য সংগ্রহ ও বিতরণ কার্যক্রম ‘ক্লোজ মনিটরিং’ করার নির্দেশ দেন।

উপদেষ্টা বলেন, “এই বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে মোট ১৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধান ও চাল সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ টন ধান এবং ১৪ লাখ টন চাল কেনা হবে।" 

কৃষকদের জন্য ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে ধানের দাম প্রতি কেজি ৩৬ টাকা ও চালের দাম ৪৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় কেজি প্রতি ৪ টাকা বেশি।

বোরো সংগ্রহ কার্যক্রম চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল শুরু হয়েছে। চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।

সভায় জানানো হয়েছে, ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে খাদ্য ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়িয়ে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে, যা চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ছিল ৮ হাজার ৫৯ কোটি টাকা।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে ওএমএস ও টিসিবি কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে। আগামী অর্থবছরে ওএমএস কার্যক্রমের আওতায় উপকারভোগী পরিবারের সংখ্যা ৫০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫৫ লাখে উন্নীত করার পরিকল্পনা আছে। প্রতিটি পরিবারকে মাসে ৩০ কেজি চাল ১৫ টাকা কেজি দরে সরবরাহ করা হবে। বর্তমানে এ কার্যক্রম বছরে পাঁচ মাস চালু থাকলেও আগামী অর্থবছর থেকে তা ছয় মাস কার্যকর থাকবে।

মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন। উপস্থিত ছিলেন বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

ঢাকা/এএএম/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চামড়ার দেশেই বছরে ১,৫০০ কোটি টাকার চামড়া আমদানি
  • রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে আয় বাড়াতে চায় সরকার
  • শিক্ষা নিয়ে নাগরিকদের উদ্বেগ আমলে নিন
  • দেশে খাদ্য পরিস্থিতি অত্যন্ত সন্তোষজনক: উপদেষ্টা
  • বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৩%
  • জনস্বাস্থ্যবিরোধী বাজেট: সিগারেটের নিম্ন ও মধ্যম স্তর একত্র করার দাবি
  • বাজেট: করদাতার ঘাড়ের বোঝা বাড়বে নাকি কমবে
  • ২ কোম্পানির ক্রেডিট রেটিং নির্ণয়
  • কমলা-মাল্টা-লেবুতে সম্ভাবনার সুবাস