ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান মানবিক সংকটের নিন্দা জানিয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে যুদ্ধ শেষ করতে কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে উপনীত হতে না পারলে যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরও পদক্ষেপ নিতে পারে।

গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে বক্তৃতাকালে ল্যামি গাজায় ত্রাণ বিতরণের নতুন ব্যবস্থারও সমালোচনা করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল–সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) গাজায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু জিএইচএফের কয়েকটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে জড়ো হওয়া ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার ঘটনার পর সংগঠনটির তীব্র সমালোচনা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল–সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) গাজায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু জিএইচএফের কয়েকটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণ নিতে জড়ো হওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার ঘটনার পর সংগঠনটির তীব্র সমালোচনা হচ্ছে।

মঙ্গলবার ল্যামি বলেন, ‘আমরা খুবই স্পষ্ট করে বলছি, ত্রাণ বিতরণের জন্য গঠিত এ সহায়তা ফাউন্ডেশনকে আমরা সমর্থন করি না। এটি ভালোভাবে কাজ করছে না। অসংখ্য মানুষ প্রায় অনাহারে থাকছেন। বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। (গাজায়) ত্রাণ বিতরণের জন্য গঠিত এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বৈশ্বিকভাবে নিন্দা জানানোর ক্ষেত্রে আমরা সামনের সারিতে রয়েছি।’

গত কয়েক সপ্তাহে জিএইচএফের সহায়তা নিতে গিয়ে প্রায় ৭৫০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

আরও পড়ুনইসরায়েলি মন্ত্রী স্মোট্রিচ ও বেন-গভিরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল যুক্তরাজ্য১০ জুন ২০২৫

পার্লামেন্টের একজন সদস্য এদিন ল্যামিকে প্রশ্ন করেন, গাজায় যদি এ অসহনীয় পরিস্থিতি চলতেই থাকে, তবে যুক্তরাজ্যের সরকার কি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে? জবাবে ল্যামি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা নেব।’

যুক্তরাজ্য গত মাসে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ ও জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের ওপর সে দেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পাশাপাশি যুক্তরাজ্যে তাঁদের কোনো সম্পদ থাকলে, তা জব্দ করা হবে বলেও জানায়। অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগে এই উগ্রবাদী দুই ইহুদি নেতার বিরুদ্ধে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

এর আগে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও নরওয়ে ইসরায়েলি দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

আরও পড়ুনফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উসকানি, দুই ইসরায়েলি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে পাঁচ দেশের নিষেধাজ্ঞা১১ জুন ২০২৫

ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রবেশ করতে পারছে না, কয়েক লাখ ফিলিস্তিনি অনাহারে রয়েছেন, ছোট্ট ভূখণ্ডটিতে যেকোনো সময় দুর্ভিক্ষ নেমে আসতে পারে। অবরোধের কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ সংকটের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা স্থগিত করেছে। গত বছর লন্ডন ইসরায়েলে কিছু অস্ত্র রপ্তানিও বন্ধ করে দিয়েছে।

আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে পারি, আপনি জি-৭–এর আর কোনো অংশীদার বা ইউরোপজুড়ে আর কোনো মিত্র খুঁজে পাবেন না, যারা এ ব্যাপারে এই সরকারের চেয়ে বেশি কিছু করেছে।ডেভিড ল্যামি, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

অনেকেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এসব পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের সমর্থক কয়েকজন এসব পদক্ষেপকে প্রতীকী হিসেবে সমালোচনা করেছেন এবং বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে ইসরায়েলের ওপর কার্যকর কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিশ্ব ব্যর্থ হয়েছে।

মঙ্গলবার ল্যামি পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা ও অবৈধভাবে বসতির সম্প্রসারণের নিন্দাও করেছেন। তিনি বলেছেন, এসব কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের প্রকাশ্য লঙ্ঘন।

আরও পড়ুনগাজায় বিতর্কিত সংস্থার ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ৩ ফিলিস্তিনি নিহত, আহত ৪৬২৮ মে ২০২৫

যুক্তরাজ্যের চাপে ইসরায়েল সরকার তার আচরণে কোনো পরিবর্তন এনেছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ল্যামি স্বীকার করেন, ‘পরিবর্তন যথেষ্ট নয়।’

তবে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লন্ডনের বর্তমান অবস্থানকে সমর্থন করে বলেন, ‘আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে পারি, আপনি জি-৭–এর আর কোনো অংশীদার বা ইউরোপজুড়ে আর কোনো মিত্র খুঁজে পাবেন না, যারা এ ব্যাপারে এই সরকারের চেয়ে বেশি কিছু করেছে।’

মঙ্গলবার ল্যামি পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা ও অবৈধভাবে বসতির সম্প্রসারণের নিন্দাও করেছেন। তিনি বলেছেন, এসব কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের প্রকাশ্য লঙ্ঘন।

তবে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাজ্য কেবল ‘একটি পক্ষ মাত্র’ বলেও স্বীকার করে নেন ডেভিড ল্যামি।

যুক্তরাজ্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। পাশাপাশি, দেশটি ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি বন্দীদের অবস্থান শনাক্ত করতে সহায়তার অংশ হিসেবে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্স শত শত নজরদারি অভিযান চালিয়েছে।

আরও পড়ুনমার্কিন-ইসরায়েলি ত্রাণকেন্দ্রে খাবার নিতে এসে প্রাণ গেছে ৭৪৩ ফিলিস্তিনির০৬ জুলাই ২০২৫

যুক্তরাজ্য নিজ দেশেও ফিলিস্তিনি অধিকারকর্মীদের ওপর কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। সম্প্রতি তারা ‘প্যালেস্টাইন অ্যাকশন’ নামের একটি অধিকার সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে এবং এর বেশ কয়েকজন সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে।

যুক্তরাজ্যের বর্তমান লেবার সরকার এখনো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। গত এক বছরে কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ল্যামি বলেন, লন্ডন চায় ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি যেন শুধু প্রতীকী না হয়ে বরং দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দিকে একটি বাস্তব অগ্রগতির অংশ হয়।

ল্যামি আরও বলেন, ‘যুক্তরাজ্য এমন এক সময়ে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে চায়, যা বসতি সম্প্রসারণ, সহিংসতা এবং গাজায় যে ভয়াবহতা আমরা দেখছি, তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ন্যায্য আকাঙ্ক্ষার পক্ষে পরিবেশ বদলে দিতে সহায়ক হবে।’

আরও পড়ুনগাজায় বিতরণ করা বিতর্কিত সংস্থা জিএইচএফের ত্রাণের বাক্সে কী আছে৩১ মে ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র ব র দ ধ য ক তর জ য র প ত র ণ ব তরণ জ এইচএফ র র পরর ষ ট ব যবস থ আর ক ন মন ত র বল ছ ন সরক র র ওপর সমর থ

এছাড়াও পড়ুন:

মার্কিন-ইসরায়েলি ত্রাণকেন্দ্রে খাবার নিতে এসে নিহত ৭৪৩ ফিলিস্তিনি

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ও ইসরায়েলসমর্থিত সংস্থা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে খাবার নিতে এসে ৭৪৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। কয়েক সপ্তাহে ত্রাণ নিতে গিয়ে আহত হয়েছেন আরও চার হাজার ৮৯১ জন। গতকাল শনিবার এ তথ্য জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

গাজায় মে মাসের শেষ দিক থেকে ত্রাণ বিতরণ শুরু করে জিএইচএফ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জিএইচএফের কেন্দ্রগুলোতে হামলায় অন্তত ৭৪৩ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৪ হাজার ৮৯১ জন আহত হয়েছেন।

এদিকে মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের দেওয়া যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য কাতারে প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তবে আলোচনা চললেও গাজায় ইসরায়েলের হামলা থামেনি। আজ রোববার ভোরেও গাজাজুড়ে ইসরায়েলের হামলায় ২৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

জিএইচএফ ইতিমধ্যে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। একাধিক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, সংস্থাটির কর্মীদের পাশাপাশি ইসরায়েলি বাহিনীও ত্রাণ নিতে আসা মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে।

গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সংখ্যার বিষয়ে আল জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ বলেন, মর্মান্তিক বিষয় হলো- তারা সবাই ত্রাণ নিতে ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে গিয়েছিলেন এবং খাবারের প্যাকেটের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

হানি মাহমুদ গাজা নগরী থেকে সংবাদ সংগ্রহ করছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। হিসাব করে খাবার খাচ্ছে। অনেক পরিবারই খাবার খেতে পারছে না। অনেক মা নিজে না খেয়ে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন।’

এই সপ্তাহের শুরুতে কয়েকজন মার্কিন ভাড়াটে কর্মীর বরাত দিয়ে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলোতে সহায়তা নিতে আসা ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি ও স্ট্যান গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। তারা আরও বলেন, সেখানে অস্ত্রে সজ্জিত কর্মীরা যেন যা খুশি তাই করছেন।

তবে জিএইচএফ এপির প্রতিবেদনকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে, তাদের কাছে নিজেদের কার্যক্রম স্থলগুলোর নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জুনের শেষ দিকে ট্রাম্প প্রশাসন জিএইচএফের জন্য ৩ কোটি ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে খাবার নিতে গিয়ে আহত হওয়া মজিদ আবু লাবান আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমার সন্তানেরা টানা তিন দিন না খেয়ে ছিল। তাই আমি বাধ্য হয়ে ওই (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে গিয়েছিলাম।’

গাজায় আজও নিহত ২৭ জন

গাজায় ২০ মাসের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে। আজ রোববার ভোরেও গাজাজুড়ে ইসরায়েলের হামলায় ২৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজা নগরীর কাছের এলাকা তুফাতে হামলায় তিন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আল-আহলি আরব হাসপাতাল। দক্ষিণের খান ইউনিসে একটি তাঁবুতে ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় দুজন নিহত হন এবং আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন। আগের দিন শনিবার ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৭৮ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরায়েল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে কী আছে, এটা কি গাজায় যুদ্ধ থামাতে পারবে
  • মার্কিন-ইসরায়েলি ত্রাণকেন্দ্রে খাবার নিতে এসে নিহত ৭৪৩ ফিলিস্তিনি