হাতুড়ি নিয়ে যুবদল নেতাকে যুবলীগ নেতার ধাওয়া
Published: 8th, August 2025 GMT
ঢাকার ধামরাইয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা মো. মিজানুর রহমান। বিষয়টি জানতে পেরে বাঁধা দিতে গেলে ধস্তাধস্তি হয় স্থানীয় যুবদল নেতা লিটন মাহমুদ মুরাদের সঙ্গে। একপর্যায়ে তাকে পরবর্তীতে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন ওই যুবলীগ নেতা।
পর দিন আগেই ওৎ পেতে থেকে লিটনকে আসতে দেখে তাকে হাতুড়িসহ দেশিয় অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া দেন মিজানুর তার ভাই ও ভাগ্নে। সেখান থেকে পালিয়ে একটি বসতবাড়িতে আশ্রয় নেন লিটন। এরপর স্থানীয়রা গিয়ে লিটনকে উদ্ধার করে।
পরবর্তীতে খবর পেয়ে পুলিশ এলে তাদের সামনেই লিটনকে হত্যার হুমকি দিয়ে বলেন, “ওর হাত-পা ভাইঙ্গা তারপর জেলে যামু।” সেখানে থাকা পুলিশ তাকে আটক করে পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ধামরাইয়ের আফিকুল ইসলাম সাদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়।
গত ২২ জুলাই ধামরাইয়ের বালিয়া ইউনিয়নের তেলিগ্রাম এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় ধামরাই থানায় লিখিত অভিযোগ করেন তিনি।
অভিযুক্ত মিজানুর রহমান ধামরাই উপজেলার বালিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। পরবর্তীতে তিনি যুবলীগে যোগ দেন। ধামরাই উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল ইসলামের অনুসারী ছিলেন তিনি। বিষয়টি নিশ্চিত করেন যুবলীগের জ্যেষ্ঠ এক নেতাও। মিজানুরের ফেসবুক আইডিতেও আওয়ামী লীগের পক্ষে নানা পোস্ট দেখা যায়।
ভুক্তভোগী লিটন মাহমুদ মুরাদ ধামরাই উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের তেলিগ্রাম এলাকার বাসিন্দা। তিনি বালিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সাবেকসহ দপ্তর ও প্রচার সম্পাদক।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) তেলিগ্রাম এলাকায় গিয়ে কথা হয় এলাকাবাসীর সঙ্গে। তারা জানান, ২০০৬ সালের দিকে ঘোষিত বালিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন মো.
লিটন মাহমুদ মুরাদের করা অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ২১ জুলাই তেলিগ্রামের ব্রিজের পাশে একটি স্থানে মিজানুর রহমানসহ আরও ৮-১০ জন বৈঠক করেন। তারা আওয়ামী লীগের পক্ষে একটি মিছিলের প্রস্তুতি নেন। বিষয়টি জানতে পেরে সেখান যান লিটনসহ আরও কয়েকজন। তারা মিজানুরদের বাঁধা দিতে গেলে একপর্যায়ে সেখানে তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়।
পরে আশপাশের লোকজন এসে তাদের থামিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। তবে মিজানুর সেসময় লিটনকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এর পরের দিন বিকেলের দিকে তেলিগ্রাম স্ট্যান্ডের দিকে আসার সময় তিনি দেখতে পান আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা মিজানুর রহমান, তার ভাই মতিয়ার রহমান মুক্তার ও ভাগ্নে স্বপন হোসেন হাতুড়ি নিয়ে তার দিকে ধেয়ে আসছেন।
আতঙ্কিত হয়ে তিনি দৌড়ে পার্শ্ববর্তী আক্কাস নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেন। একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে। পরে তিনি ফোন করলে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশের উপস্থিতিতেই মিজানুর রহমান লিটনকে হত্যার হুমকি দেন। একপর্যায়ে পুলিশ মিজানুরকে আটক করে।
পুলিশ জানায়, খবর পেয়ে তারা ঘটনাস্থলে যান। পরে তারা মিজানুরের আওয়ামী লীগের মিছিলের প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন ও লিটনকে হাতুড়িসহ ধাওয়া দেওয়ার বিষয়টিও জানতে পারেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে তাকে ধামরাই থানায় আফিকুল ইসলাম সাদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
লিটনকে হাতুড়িসহ ধাওয়া দেওয়ার ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী তেলিগ্রাম স্ট্যান্ডের মুদি দোকানি আব্দুর রশিদ। তিনি বলেন, “আমি দোকানে ছিলাম। হঠাৎ লিটনকে রাস্তায় আসতে দেখে হাতুড়ি হাতে নিয়ে তাকে মিজান তার ভাই ও ভাতিজা ধাওয়া দেয়। পুলিশ আসার পরও মিজানুর তাকে হুমকিধামকি দিচ্ছিল।”
লিটনকে আশ্রয় দেওয়া আক্কাস আলীর স্ত্রী পঞ্চাশোর্ধ জোসনা বেগম বলেন, “লিটন দৌড়ায়া আসছে, তারে মিজানুর, তার ভাই ও ভাগ্নে হাতুড়ি দিয়ে মারতে আসছে। আমরা লিটনকে দরজা বন্ধ করে বাঁচাই। পরে আশপাশের লোকজন এসে তাকে নিয়া যায়।”
এদিকে এ ঘটনায় এখনও আতঙ্কগ্রস্ত ভুক্তভোগী যুবদল নেতা লিটন মাহমুদ মুরাদ। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের মিছিল ঠেকানোর কারণে যুবলীগ নেতা আমাকে হত্যার চেষ্টা করে। আমাকে হাতুড়ি নিয়ে ধাওয়া দেয়। পালিয়ে আমি রক্ষা পাই। আমি এখনও হুমকির মধ্যে আছি। আমি যুবলীগ নেতা মিজানুরের শাস্তির দাবি জানাই।”
ছেলেকে হাতুড়ি দিয়ে ধাওয়া দেওয়ার ঘটনায় আতঙ্কিত লিটনের বাবা কফিল উদ্দিন বলেন, “আমার ছেলেকে যুবলীগ নেতা হত্যার চেষ্টা করলো। আমি এর বিচার চাই। জুলাই-আগস্টে তারা মানুষ হত্যা করছে। এখনও সেই চেষ্টা চালাচ্ছে।”
ধামরাই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, “খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। গিয়ে দেখি মিজানুর লিটনকে হুমকি দিচ্ছেন। তাকে আটক করি। তারপর এলাকাবাসীর কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি, মিজানুর আওয়ামী লীগের পক্ষে মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেটি নিয়ে যুবদল নেতা লিটনের সঙ্গে তার বিরোধ হয়। সেদিন রাতে লিটনের বাড়িতে আগুন দেয় মিজানুর। আর পর দিন লিটনকে হাতুড়িসহ ধাওয়া দেয় মিজানুর, তার ভাই ও ভাতিজা। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে যায়। পুলিশের উপস্থিতি দেখে মিজানুরের সঙ্গীরা পালিয়ে যায়। পরে মিজানুরকে আটক করা হয়।”
ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, “মিজানুর রহমান একসময় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সাবেক সংসদ সদস্য এমএ মালেকের অনুসারী থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল ইসলামের সাথে রাজনীতি করতো। গত ১৫ বছর ফ্যাসিস্টের যত অপকর্ম, সেগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ ঘোষিত হরতালের সময় সে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। এতে স্থানীয় ছাত্রদল যুবদলের নেতাকর্মীরা তাকে বাধা দেয়। পরবর্তীতে ২২ জুলাই সে যুবদলের এক নেতাকে হাতুড়ি দিয়ে ধাওয়া দেয়।”
তিনি আরো বলেন, “খবর পেয়ে কাওয়ালীপাড়া বাজার তদন্ত কেন্দ্রের এসআই সেখানে গিয়ে তার হাতে হাতুড়ি দেখতে পায়। তাকে নিবৃত করার জন্য আটক করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, সে ছাত্রলীগ, যুবলীগের প্রভাব ব্যবহার করে নানা অপকর্মে জড়িত ছিল। ৫ আগস্ট ২০২৪ এ থানা এলাকায় মারামারি ও গোলাগুলিতে সে উপস্থিত ছিল বলেও জানা যায়। পরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ধামরাইয়ে সাদ হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে। লিটনের করা অভিযোগটিও তদন্ত করা হচ্ছে।”
স্থানীয়দের অভিযোগ, যুবলীগের ছত্রছায়ায় জালিয়াতি, হয়রানিসহ নানা অপকর্মে জড়িত ছিল মিজানুর রহমান।
স্থানীয় আতাউর রহমান বলেন, “মিজানুরের বোন জামাই আবুল নিজের জমি একটি ব্যাংকে রেখে ঋণগ্রহণ করে। পরে সেই তথ্য লুকিয়ে তিনি জমিটি একজনের কাছে বিক্রি করেন। ওই ব্যক্তি আগের দলিল চাইলে মিজানুর তাকে বলেন, দলিল আতাউরের কাছে রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক বিচার বসে। সেখানেও মিজানুর দলিল আতাউরের কাছে রয়েছে দাবি করে তাকে হয়রানি করেন। পরে বিচার সংশ্লিষ্টরা দলিল উদ্ধার করতে গেলে সেটি বালিয়া কৃষি ব্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয়। সেখানে দলিল জমা রেখে আবুল হোসেন ঋণগ্রহণ করেন।”
ঢাকা/আরিফ/এস
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম ছ ল র প রস ত ত ম জ ন র রহম ন য বল গ ন ত য বদল ন ত একপর য য় পরবর ত ত য বল গ র হ ত ড় সহ ল ইসল ম খবর প য় ল টন র হত য র ন ল টন আগস ট আওয় ম ব ষয়ট ল টনক
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই ঘোষণাপত্রে কী আছে, যা জানা গেল
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ‘৩৬ জুলাই উদ্যাপন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন।
জুলাই ঘোষণাপত্র
১। যেহেতু উপনিবেশ বিরোধী লড়াইয়ের সুদীর্ঘকালের ধারাবাহিকতায় এই ভূখণ্ডের মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল;
এবং
২। যেহেতু, বাংলাদেশের আপামর জনগণ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বিবৃত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে;
এবং
৩। যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রনয়ন পদ্ধতি, এর কাঠামোগত দুর্বলতা ও অপপ্রয়োগের ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ক্ষুণ্ণ করেছিল;
এবং
৪। যেহেতু স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে বাকশালের নামে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে এবং মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে, যার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশে সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতির পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রবর্তনের পথ সুগম হয়, এবং
৫। যেহেতু আশির দশকে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় বছর ছাত্র-জনতার অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং ১৯৯১ইং সনে পুনরায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এবং
৬। যেহেতু দেশী-বিদেশী চক্রান্তে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় ১/১১ -এর ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা, আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদের পথ সুগম করা হয়; এবং
৭। যেহেতু গত দীর্ঘ ষোল বছরের ফ্যাসিবাদী, অগণতান্ত্রিক এবং গণবিরোধী শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে এবং একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অতি উগ্র বাসনা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে সংবিধানের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক পরিবর্তন করা হয় এবং যার ফলে একদলীয় একচ্ছত্র ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়; এবং
৮। যেহেতু শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন, গুম-খুন, আইন-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং একদলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধ্বংস করে; এবং
৯। যেহেতু, হাসিনা সরকারের আমলে তারই নেতৃত্বে একটি চরম গণবিরোধী, একনায়কতান্ত্রিক, ও মানবাধিকার হরণকারী শক্তি বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদী, মাফিয়া এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রের রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে; এবং
১০। যেহেতু, তথাকথিত উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী নেতৃত্বে সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বিগত পতিত দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ ও এর অমিত অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং এর পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করে; এবং
১১। যেহেতু শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ গত প্রায় ষোল বছর যাবত নিরন্তর গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করে জেল-জুলুম, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়; এবং
১২। যেহেতু বাংলাদেশে বিদেশী রাষ্ট্রের অন্যায় প্রভুত্ব, শোষণ ও খবরদারিত্বের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে বহিঃশক্তির তাবেদার আওয়ামী লীগ সরকার নিষ্ঠুর শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করে; এবং
১৩। যেহেতু অবৈধভাবে ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার তিনটি প্রহসনের নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন) এদেশের মানুষকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করে; এবং
১৪। যেহেতু, আওয়ামী লীগ আমলে ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয় এবং সরকারী চাকুরীতে একচেটিয়া দলীয় নিয়োগ ও কোটাভিত্তিক বৈষম্যের কারণে ছাত্র, চাকুরী প্রত্যাশী ও নাগরিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম হয়; এবং
১৫। যেহেতু বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ওপর চরম নিপীড়নের ফলে দীর্ঘদিন ধরে জনরোষের সৃষ্টি হয় এবং জনগণ সকল বৈধ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই চালিয়ে যায়;
এবং
১৬। যেহেতু, সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিলোপ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ব্যাপক দমন-পীড়ন, বর্বর অত্যাচার ও মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ড চালানো হয়, যার ফলে সারা দেশে দল-মত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়;
এবং
১৭। যেহেতু ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী, শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ যোগদান করে এবং আওয়ামী ফ্যাসিবাদী বাহিনী রাজপথে নারী-শিশুসহ প্রায় এক হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে, অগনিত মানুষ পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করে এবং আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন প্রদান করে;
এবং
১৮। যেহেতু, অবৈধ শেখ হাসিনা সরকারের পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জনগণ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে, পরবর্তী সময়ে ৫ আগস্ট ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ পরিচালনা করে এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনরত সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতা তথা সর্বস্তরের সকল শ্রেণী, পেশার আপামর জনসাধারণের তীব্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গণভবনমুখী জনতার উত্তাল যাত্রার মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়;
এবং
১৯। যেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট মোকাবেলায় গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রত্যয় ও প্রয়োগ রাজনৈতিক ও আইনি উভয় দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত, বৈধ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত;
এবং
২০। যেহেতু জনগণের দাবি অনুযায়ী এরপর অবৈধ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রীম কোর্টের মতামতের আলোকে সাংবিধানিকভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠন করা হয়;
এবং
২১। যেহেতু, বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের ফ্যাসিবাদবিরোধী তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়;
এবং
২২। সেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধান ও সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে;
এবং
২৩। সেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ বিগত ষোল বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম কালে এবং ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালীন সময়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গুম-খুন, হত্যা, গণহত্যা, মানবতা বিরোধী অপরাধ ও সকল ধরনের নির্যাতন, নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধসমূহের দ্রুত উপযুক্ত বিচারের দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে;
এবং
২৪। সেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ জুলাই গনঅভ্যুত্থানের সকল শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করে শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং আন্দোলনকারী ছাত্রজনতাকে প্রয়োজনীয় সকল আইনি সুরক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।
এবং
২৫। সেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ যুক্তিসঙ্গত সময়ে আয়োজিতব্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রতিশ্রুত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।
এবং
২৬। সেহেতু বাংলাদেশের জনগণ এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছে যে একটি পরিবেশ ও জলবায়ু সহিষ্ণু অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষিত হবে।
এবং
২৭। বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে।
এবং
২৮। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই ঘোষণাপত্র প্রনয়ণ করা হলো।
ঢাকা/রায়হান/সাইফ