সাভারে ২৫ লাখ টাকা ছিনতাই: ৯ জন গ্রেপ্তার, ৫ লাখ টাকা উদ্ধার
Published: 14th, October 2025 GMT
ঢাকার সাভারে নগদ ২৫ লাখ টাকা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকার ৭টি পে-অর্ডার ছিনতাইয়ে মামলায় নয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
আজ মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) জাহিদুল ইসলাম খান এ তথ্য জানান। গ্রেপ্তার ডাকাতদের কাছ থেকে ছিনতাইকৃত ৫ লাখ টাকা, একটি নোয়া মাইক্রোবাস, ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত খেলনা পিস্তলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।
আরো পড়ুন:
ঝিনাইদহে মা-মেয়েকে মারধর, থানায় অভিযোগ
শ্রীনগরে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণের ভিডিও ভাইরাল
গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে ডেলিকেট গার্মেন্টসের তিন কর্মকর্তাকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে অস্ত্রের মুখে গাড়িতে তুলে নিয়ে মারধর করে তাদের কাছে থাকা ২৫ লাখ টাকা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকার ৭টি পে-অর্ডার ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
গ্রেপ্তাররা হলেন, পাবনার চাটমোহর থানার শহিদুল ইসলাম (৪২), শেরপুরের শ্রীবরদী থানাধীন ধাতুয়া গ্রামের সুমন মিয়া (৬৫), পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানার গাবুয়া গ্রামের ইদ্রিস (৪৮), মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার করতল এলাকার উজ্জ্বল (৪২), ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা থানাধীন ভাটপাড়া গ্রামের মামুন আহম্মেদ মিন্টু (৫২), মাগুরার সদর থানার বাটাজোর গ্রামের ইউনুস বিশ্বাসের ছেলে মেহেদী হাসান (২৭), সাতক্ষীরার দেবহাটা থানাধীন গুরুগ্রাম এলাকার মৃত মোশাররফ হোসেনের ছেলে শামীম আহম্মেদ সবুজ (৩২), পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থানার দক্ষিণ বড় মাচুয়া গ্রামের শাহাদাত (৬০) এবং শরীয়তপুরের সখিপুর থানার কানুন গো সাহেবের কান্দি গ্রামের মৃত নুরুল হক প্রধানের ছেলে মো.
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত রবিবার (১২ অক্টোবর) বিকালে সাভারের ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে র্যাব পরিচয়ে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে নোয়া মাইক্রোবাসসহ প্রথমে ডাকাত দলের সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর কাকরাইল এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরো দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে বলেও জানান তিনি। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে।
ডাকাতির মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ২৫ সেপ্টেম্বর সাভারের ফুলবাড়িয়ার ডেলিকেট গার্মেন্টস লিমিটেডের তিন কর্মকর্তা জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য ব্যাংক থেকে টাকা তুলে তেজগাঁও রেজিস্ট্রি অফিসে যাওয়ার পথে তাদের প্রাইভেটকারটি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ভাঙ্গাব্রিজ এলাকায় পৌঁছায়। সেখানে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতদলের সদস্যরা তাদের গাড়ির গতিরোধ করে। পরে ডাকাতরা তাদের নোয়া মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে মারধর করার পাশাপাশি সঙ্গে থাকা নগদ টাকা ও পে-অর্ডারগুলো ছিনিয়ে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নামিয়ে দেয়।
২৬ সেপ্টেম্বর কারখানার একজন কর্মকর্তা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে সাভার মডেল থানায় মামলা করেন।
ঢাকা/সাব্বির/বকুল
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ছ নত ই ২৫ ল খ ট ক
এছাড়াও পড়ুন:
হাসান হাফিজের কবিতা: এখন যৌবন যার
হাসান হাফিজের কবিতার সঠিক মূল্য নির্ধারণের জন্য আমার মনে হয় কয়েক দশক পেছনে ফিরে যেতে হবে। একথা যদিও প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে, সত্যিকার অর্থেই তিনি সাত দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি। তিনি শুরু থেকেই কবিতার পাশাপাশি লেখক হিসেবে নিজেকে বহুমাত্রায় বিস্তৃত করে চলেছেন। ফলে কাল-প্রবাহের সঙ্গে তাঁর নিজের সৃষ্টিশীল-কর্মের উজ্জ্বলতার ওপর তাঁর নিজেরই সৃষ্টিশীলতার বহুমুখী প্রলেপ পড়া অসম্ভব নয়। কারণ পাঠকের স্মৃতি বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিকর্ম একইসঙ্গে বেশি দিন ধারণ করতে পারে না। অধিকাংশ সময়ে নতুন সৃষ্টিকর্ম দ্বারা নতুনভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। উদাহরণ হিসেবে হাসান হাফিজের একটি কাব্যগ্রন্থের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে, প্রকাশ করেছিল উত্তরসূরি প্রকাশন, কাব্যগ্রন্থের নাম ‘এখন যৌবন যার’।
পাঠক কাব্যগ্রন্থটির নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে অন্যতম জনপ্রিয়তম কবি প্রয়াত হেলাল হাফিজের কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র সঙ্গে একটি যোগসাজশ তৈরি করার চেষ্টা করবেন। যদিও হেলাল হাফিজের কাব্যগ্রন্থের নামটি কিন্তু অধিকাংশ পাঠক গ্রন্থটির ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি বহুল পাঠ করে থাকেন- ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। কবির কাছে শুনেছি এটি উত্তাল গণ-আন্দোলনে দেয়ালে লেখা তারুণ্যের স্পর্ধিত উচ্চারণ থেকে সৃষ্ট। তবে আশ্চর্য হলো কবি হেলাল হাফিজের কবিতার নাম বা গ্রন্থের নাম দুটির কোনোটাই এটি নয়; অথচ কবি হাসান হাফিজের গ্রন্থের নাম ‘এখন যৌবন যার’ যার প্রকাশকাল ছিল কবি হেলাল হাফিজের বছর চারেক আগে।
প্রসঙ্গটি উল্লেখের অন্যতম কারণ দুই কবির মধ্যে ছিল এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, যত না রচনার দিকে তার চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত যোগাযোগ- দুজনই প্রায় একই সময়ে সাংবাদিকতা করেছেন, লেখালেখি করেছেন এবং জাতীয় প্রেসক্লাবকে নিজেদের দ্বিতীয় ঘরবাড়ি করে তুলেছিলেন। কবি হেলাল হাফিজ বয়সে কবি হাসান হাফিজের কিছুটা জ্যেষ্ঠ ছিলেন, এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান ছিল। কিন্তু হেলাল হাফিজের একটি কাব্যগ্রন্থ বারংবার উচ্চারণের ফলে অনেকের মধ্যে একটি ধারণা কাজ করে থাকে- কবি হাসান হাফিজের কাব্যগ্রন্থটি নামের ক্ষেত্রে কবি হেলাল হাফিজের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। প্রভাবিত হওয়া সাহিত্যের ক্ষেত্রে দূষণীয় নয়, কিন্তু ইতিহাসের খাতিরে এসব স্পষ্ট থাকা জরুরি। কবি হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি আগে লিখিত হলেও গ্রন্থ নামের ক্ষেত্রে কবি হাসান হাফিজ এগিয়ে ছিলেন। কবি হাসান হাফিজ কোনো এক আলোচনায় বলেছিলেন, তার লেখক নামটির ক্ষেত্রে কবি হেলাল হাফিজের একটি অবদান আছে। সাহিত্যে পারস্পরিক সম্পর্কের জগতের যেমন একটি মূল্য আছে, তেমন তার স্বতন্ত্রের ক্ষেত্রেও গুরুত্ব অনেক। সুতরাং দুই কবির একটা দূরবর্তী সম্পর্কের কথা দিয়ে শুরু করলেও বিষয় ও অঙ্গশৈলীর ক্ষেত্রে প্রার্থক্য বিস্তর। হাসান হাফিজ সত্তর দশকের কবিতার ক্ষেত্রে তখন ছিলেন যথেষ্ট অগ্রণী এবং তিরিশোত্তর আধুনিক কবিতা এবং ষাট দশকের ঢাকার কবিতার এক সার্থক উত্তরসূরি। এবার হাসান হাফিজের ১৯৮২ সালে প্রকাশিত ‘এখন যৌবন যার’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা থেকে কিছুটা উদ্ধার করা যাক :
‘রক্তে ঘূণপোকা
আগুনের জ্বলন্ত নিয়মে
চোখে ছেঁড়া মেঘ
ফেরা বুঝি এখনই সুদূর
আগুনে সিগ্রেট ছাই
পাই বা না পাই ভালোবাসি
হৃদয়ে ধরেছে জং
রঙ তার কখনো মোছে না
বুকভরা দীর্ঘশ্বাস
দুঃখজাত পরবাস
তবুও তোমার কাছে আসি
বেদনা বর্ণিল মোহে
মৃত্যু ও পতন ভালোবাসি।’
এটাই পূর্ণাঙ্গ কবিতা। হাসান হাফিজের এই কবিতার ক্ষেত্রে ষাট এবং সত্তর দশকের অপরাপর কিছু কবিতার সঙ্গে তুলনামূলক পাঠ করা গেলে এর বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। আগুন আছে, প্রেম আছে, প্রেমে বিষণ্ন ও বিসর্জন আছে। তারুণ্যে স্পর্ধা ও রোমান্টিকধর্মীতার আবেগ খুব দক্ষ শিল্পীর মতো নিয়ন্ত্রিত।
আরেকটি কবিতা:
‘সব চিহ্ন মুছে ফেলেছি
শীতল তাচ্ছিল্যে প্রেমে ক্ষমায়
ঘৃণা আমি কিছুতেই জাগাতে পারি না
তোমার দুচোখ বাধা দ্যায়
পলাতক রোগা দীর্ঘশ্বাস
আমার লাঞ্ছিত চুলে স্নেহ দ্যায় : যে রকম তুমি উন্নয়নশীল দেশে বুঝি আবেগই প্রধান।’
এখানেও ঠিক একই ভাবে প্রেম বিপ্লব আত্ম-নিয়ন্ত্রণ বঞ্চনা এক যৌক্তিক পারম্পার্যের দ্বারা গ্রথিত হয়েছে- ‘যে রকম তুমি উন্নয়নশীল দেশে বুঝি আবেগই প্রধান।’ হাসন হাফিজ যখন এ কবিতা লিখছেন, তখনো ঢাকার কবিতা গদগদে আবেগ এবং শব্দের আধিক্যে সরব। ধরা যাক সালটি ১৯৭৪, এক তরুণ কবি বেড়ে উঠছেন, যুদ্ধ প্রেম বিপ্লব দেখেছে, প্রকৃতির নিয়মে কোকিল ডাকছে- শরীরের নিয়মে প্রেম আসছে, তবু সালটি যদি গত শতাব্দীর চুয়াত্তর হয়, তখন কীভাবে কবি তাঁর কালের কবিতা রচনা করবেন। সত্যি সত্যি হাসান হাফিজ যেন জয়নুলের তুলির টানে লিখেছেন-
‘মৃত্যু, নীলটিপ ও কোকিল।
অপুষ্টি প্রাধান্য পাচ্ছে
মৃত্যু তালিকায়, মানুষের ফুসফুস
রক্ত, শ্লেষ্মা, ঘাম, দুঃখে
ডালপালা ছড়াচ্ছে ক্যান্সার
কোকিল ডাকছে তবুও।’
এভাবেই হাসান হাফিজ তাঁর সময়ের নির্মাতা হয়ে উঠছেন। যীশুর মতো ক্রুশের যন্ত্রণা সহ্য করছেন, কিছু নেই তার উচ্চকিত চিৎকার। ‘যীশু’ কবিতায় তাঁর সেই কষ্টের প্রকাশ তিনি স্মিতবাক্যে করেন প্রকাশ- ‘সুন্দর মানেই তো ইচ্ছাকৃত পরাজয়/ বেদনায় বিষে ক্ষয়ে অনিশ্চিত বেঁচে থাকা।’
এই হলো হাসান হাফিজ। শুরুতেই কবি হেলাল হাফিজের কবিতা গ্রন্থের নামের বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম কারণ এমন একটি গ্রন্থ যেটি এমন একটি নাম নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে- ‘এখন যৌবন যার’- প্রতিটি কবিতা অপ্রয়োজনীয় আবেগ থেকে মুক্ত। সত্তর আশির দশকের মন ও মেজাজের মধ্য দিয়ে হাসান হাফিজের কবিতা আস্বাদন করতে হবে। হাসানের কবিতা পাঠের জন্য তৎকালীন ইতিহাসের নিবিষ্টতা দাবি রাখে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সত্তর দশকের কবিতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে যতটা আবেগ ও মেদ অবশিষ্ট ছিল, হাসান হাফিজের ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি- এখানেই তিনি স্বতন্ত্র শৈলী সন্ধানী। হাসান হাফিজ পাঠককে সহজেই নিয়ে যেতে পারেন সত্তার গভীরে। অন্তঃপ্রকৃতি এবং বহির্বিশ্বের বিভিন্ন উপাদান নিয়ে তাঁর কাব্য জগৎ নির্মিত হয়েছে। জীবনের সব জটিল বিক্ষোভ, কষ্ট ও সংবেদনা তাঁর কবিতায় স্থিত ও স্মিত ভাষা পেয়েছে। জীবনের পরম নিস্পৃহতা ও পরম দ্রষ্টব্য তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছে। তাঁর কবিতার ভেতরে ভেতরে ঢুকে পড়েছে স্বদেশ চেতনা ও প্রকৃতি চেতনা। তাঁর কবিতা কখনো বস্তুগত সত্যের পারম্পার্য গ্রন্থিত করা যায় না।
আমরা কবিদের নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রায়ই বলে থাকি- এই কবি আলাদা, এই কবি প্রাতস্বিক, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কিংবা এই কবিকে আলাদা করে চেনা যায়। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে হয়তো এই দাবি সত্য, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা সহজ প্রমাণযোগ্য নয়। কারণ ভাষা ও বিষয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন জড়াজড়ি করে থাকে যে, তার গিঁট সহজে ছোটানো যায় না। আবার আলোচকের কাছে তা সহজ হলেও তিনি সহজ করে বলতে পারেন না, কিংবা বললেও তাঁর পাঠক সহজভাবে বুঝতে পারেন না। কিন্তু হাসান হাফিজের ক্ষেত্রে এসব কিছুই ঘটে না, তিনি যেমন করে বলেন- পাঠক ও সমালোচক- ঠিক তেমন করেই বোঝেন কিংবা বুঝেছেন বলে দাবি করতে পারেন। তার মানে এই নয়, হাসান হাফিজ সহজ বিষয় সহজ করে লেখেন, বরং তিনি কঠিন ও সহজ বিষয়ের সীমার ভেদরেখা সহজেই ঘুঁচিয়ে দিতে পারেন। তাঁর জগত শিশুদের মতো সরল ও কৌতূহলী, কিন্তু প্রাজ্ঞ ও জ্ঞানীর মতো গুঢ় অর্থবহ। হাসান হাফিজকে সত্তর দশকের বাংলা কবিতার আলাদা স্বর ও সুর বললে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়, কিংবা তাকে আলাদভাবে তুলে ধরতেও কষ্ট হয় না। তাঁর কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রচিত পথই পাঠককে এগিয়ে নিয়ে যায়। কবিতার জন্ম-প্রক্রিয়া নিয়ে হাসান হাফিজ যখন লেখেন-
‘ভেতরে জন্মাচ্ছে কেউ, টের পাও?
চেতনার রক্তস্রোত স্পর্শকাতরতা
চষা খেতে উদাসী হাওয়ার নাচ,
যুদ্ধজাহাজের শান্ত শীতল ক্রুরতা
মননের ধমনীতে ফিনকি দেয়া নশ্বরতা বিষ
তোমার ভেতরে ঘটছে যন্ত্রণার আলো-আঁধারিতে
ইস্পাতকোমল কোনো জন্মের প্রক্রিয়া’
প্রকৃত কবি এভাবেই টের পান তাঁর নিজেকে, নিজের সত্তার ভাঙ্গন, যুদ্ধ-ধ্বংস; তবু সে স্বপ্ন দেখে ‘ভূমিষ্ট হবার মুক্তি অবারিত শস্যমুখ/ টের পাও কবি তুমি হেমবর্ণ এই জাগরণ।’ হাসান হাফিজ যেভাবে বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি তিনি এই গ্রহের মহাবিশ্বের সৃষ্টিচেতনা ও সৃষ্টিবেদনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছেন। যীশুর মতো যেন তাঁর মুক্তি নেই; একটি ক্রুশের যন্ত্রণাময় জগতের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের নিয়ে চলেন, তিনি আমাদের তাঁর যাত্রার সঙ্গী করেন; তখন তাঁর বানানো জগতও আমাদের বানানো মনে হয় না। শব্দগুলো সজীব হয়ে ওঠে।
হাসান হাফিজের কবিতা আমাদের এই সত্যের মুখে, একই সঙ্গে দ্বিধা ও সন্দেহের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়- কতদূর এগুলো মানুষ! এই সভ্যতা, এই আবিষ্কার, এই মানবযাত্রা, এই হাহাকার উদযাপনই কি মানব নিয়তি। আপতভাবে তাঁর কবিতা শব্দ প্রতীক মেটাফরের খেলা মনে হতে পারে, মনে হতে পারে কেবল শব্দ প্রতীকের দ্বারা, কেবল পরিচিত শব্দরাজি দ্বারা তিনি নির্মাণ করেছেন দ্ব্যার্থক জীবনবোধের স্তম্ভ। কিন্তু তা অতীব সত্য হয়ে, ‘শুধু ছিঁড়ে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসে বিপ্লবের রুগ্ন বীজ বুনে যাওয়া জীবনে জীবনে’- যার নির্মম বোধের তাড়না থেকে আমাদের মুক্তি নেই। কবির আমি মানে- আমরা এক প্রাগৈতিহাসিক যুগে যে যাত্রার সূচনা করেছিলাম, যার অযুত সহস্র কোটি মুখ সব কিছু গ্রাস করে ফেলছে। কারণ ‘লৌকিকতা সবচেয়ে বড় বাধা।’
হাসান হাফিজের কবিতায় রয়েছে শৈল্পিক নির্মাণ ও সহজাত জীবনবোধের অনুভূতি। তার উচ্চারণ স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণসত্তার সঙ্গে সংযুক্ত। বিষয়কে তিনি সহজে আড়াল করতে পারেন কাব্যের দ্ব্যার্থবোধকতায়। এলিয়ট বলতেন ‘সঙ্গীতের মতোই কবিতাতেও থিমের পুনরাবৃত্ত ব্যবহার স্বাভাবিক। বিভিন্ন দলের বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে একটি থিমের বিকাশ ঘটে এবং তা কিছুটা তুলনীয় কাব্যের সম্ভাবনার সঙ্গে- কবিতাতেও রয়েছে পরিবর্তনের সম্ভাবনা এবং তা সিম্ফনির বিভিন্ন মুভমেন্টের সঙ্গে তুলনীয়-বিষয়বস্তুর বৈপরীত্যময় সজ্জারও রয়েছে সম্ভাবনা।’ হাসান হাফিজের কবিতায় সেই সুরের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। ‘তোমাকে কখনো আমি উত্তরের উত্তাপ দেবো না।’
সমাজের অনাচার বৈষম্যে ব্যথিত কবির মর্ম থেকে উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। কখনো হাল্কাচালে আবার কখনো তীক্ষ্ম ব্যঙ্গ, তির্যক বিদ্রূপের মধ্য দিয়ে শোষকগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ রূপায়িত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে তিনি অত্যন্ত প্রত্যয়ী মনোভাব নিয়ে বিশ্বাস করেছেন সমাজের যে বঞ্চিত, সর্বহারা নিপীড়িত মানুষের দল যুগ যুগ ধরে অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার ও নিষ্ঠুরতা সহ্য করে আসছে একদিন আবর্তের পর আবর্ত রচনা করে এমন এক শঙ্খধ্বনি জাগাবে, যে ধ্বনিতে অগণিত ভাষাহীন, মৌনমুখ বঞ্চিতদের বিদ্রোহের ধ্বনি বেজে উঠবে। ‘বন্দী’ কবিতায় তিনি বলেন-
‘সুন্দরের চোখ বাঁধা কালো ন্যাকড়ায়
চলছে জিজ্ঞাসাবাদ, দেহ তল্লাশিও,
সেই সঙ্গে অকথ্য নির্মম অত্যাচার
কে বেঁধেছে অমন সুন্দর জোড়াচোখ
মানুষের কলঙ্কিত হাত।
গুড়িয়ে দিয়েছে কারা ঘামে গড়া সৌধ?
মানুষের হঠকারী হাত।’
কবি মানব হৃদয়ের আবিষ্কারক মানুষের যে সর্বব্যাপ্ত অনুভূতি, প্রেমিক হৃদয়ের হাহাকার, সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসা, মরদেহের অমরতার আকাঙ্ক্ষা কবি ভাষার মাধ্যমে তা ধারণ করেন। ভাষার সঙ্গে চেতনা আর বস্তুর সংঘাতের তীব্রতাই শিল্পের গভীরতা নির্ণায়ক। সেদিক দিয়ে হাজার বছর আগের কবির সঙ্গে বর্তমান কবির পার্থক্য কম। মানুষের জীবন এক কষ্টময় অভিযাত্রা। চেতনার অনুভূতি যত জাগ্রত, ব্যথা ততো তীব্র। প্রতিনিয়ত মানুষকেও পাখির মতো অদৃশ্য ছায়া ফেলে শূন্যে উড়ে যেতে হয়। সত্তর দশকের আরেক প্রতিভাবান অকাল আত্মহননের কবি ফজল মাহমুদ স্মরণে কবি বলেন- ‘পাথর আত্মায় আগুন ঠুকে হৃদয় জ্বালানো
নিচে নামতে নামতে হয়তো কোনোদিন কোনোভাবে
জন্মেও জটিল অর্থ অবিশ্বাস্য পেয়ে যেতে পারি।’
কবিতা মানুষের সমান বয়সী, মায়ের কোলের সমান, মায়ের জরায়ুতে কখন সে নিয়েছিল আশ্রয়, সে জানে না, জানার উপায় নেই, মানব শিশু বারংবার মায়ের কাছে ফিরে আসে, মায়ের বুকে মুখ রাখে, মায়ের শরীর থেকে বিচ্ছিন্নতাই মানুষের বিরহ বেদনা, সে আবার মিলিত হতে চায়, পারে না, আজীবন অনুসন্ধান করে মায়ের বুক, মায়ের সঙ্গেই তার খুনসুটি, মায়ের সঙ্গেই তার প্রেম। প্রকৃতপক্ষে একটি কবিতাই মানুষ লিখে চলেছে- তার নাম ভালোবাসা। ভালোবাসাকে নিয়ে লেখা কবিতাই কবিতার নানা রকম ফের, শিশু যদি মায়ের কোল থেকে বিচ্ছিন্ন না হতো, তাহলে তাকে করতে হতো না স্তনের সন্ধান, খুঁজতে হতো না তৃষ্ণার জল। স্নেহবঞ্চিত শিশু স্নেহের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়। মায়ের বিকল্প সে কোথাও খুঁজে পায় না। স্নেহ পেলে ভালোবাসা পেলে একটি জীবন সে দান করতে পারে জগৎ মাতার ক্রোড়ে। গণিকা থেকে মন্দির পর্যন্ত কবি দেখেন ভালোবাসার প্রতিরূপ। কখনো মা কখনো প্রিয়তমাকে পেতে চান অকৃত্রিম আবরণহীন। কবি এভাবেই বলেন ‘মর্মছেড়া আলোর চিৎকার’ কবিতায়-
‘আমাকে ধারণ করে ভালোবাসা নিষ্ঠা ও ক্ষমায়
মন্দিরে গুহায় গাত্রে ফুটে ওঠে চিত্রকল্প
জলরঙ মিথুনের মর্মছেঁড়া আলোর চিৎকার
সঙ্গমতাপিত চোখে তারপর নেমে আসে
আত্মা থেকে ঝরে পড়া পাহাড়প্রমাণ অবসাদ
নিঝুম নিঃশব্দ আর অতরান্ত ঘুম।’
আধুনিককালে এসে কবিতা একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করলেও ঠিক সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়- এটিই কবিতা। সুতরাং বলাই যায়, কবিতা নানা রকম। তাছাড়া কবিতা লেখার অধিকার কোনো সীমিত বিষয় নয়, মনের ভাবানুভূতি ভাষাশৈলির বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রকাশিত হলে আমরা তাকে কবিতা বলি। কবিতার বিষয়-আঙ্গিক ও শৈলি নিয়ে অনেক কথা আছে থাকবে, কিন্তু সকল কবিতাই ব্যক্তির মনের জারকে সৃষ্টি হয়ে থাকে এবং তার জন্য সমশ্রেণির একটি পাঠকসমাজও হাজির থাকে। সহজ কবিতা লেখা সহজ নয়- এ কথা কবিগুরু বলে গেছেন অনেক আগে। কিন্তু হাসান হাফিজ সহজ করেই কবিতার বিষয় তুলে ধরতে পারেন। নিজের কষ্ট দুঃখ সুখ ও স্বপ্নযাত্রা নিজের অতীত ভাষায় কবিতার বহুবিধ অলঙ্কারকে উপেক্ষা করে বলতে পারেন। এটাও কবির অন্যতম গুণ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। ‘হাওয়া, খুব হাওয়া
বহুজন্ম পর
তোমাকে নিজের বুকে পাওয়া,
পাতা ঝরে যায় শীতে,
নির্জনতা তোমার নিয়ম আছে।’
আধুনিক বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি, নাগরিক বিষয়াদির চাপে কবিতা পুরোপরি গ্রামীণ জীবনকে প্রত্যাখ্যান করেনি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ দাশ ও আল মাহমুদের মতো নাগরিক কবিদের কাব্য-পরিধি একইসঙ্গে শহর ও গ্রামের সর্বগ্রাসী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে; তেমন আধুনিক কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে কুমুদরঞ্জন মল্লিক, জসীমউদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া বিশেষত গ্রামীণ জীবনের ভাষ্যকার হয়েও আধুনিকতার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত নন। তার পরবর্তীকালে পঞ্চাশ দশকে ওমর আলী- এই রূপের ধারক হয়েও সমকালীন কাব্যাঙ্গনে যথেষ্ট দাপুটে কবিতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। হাসান হাফিজ পুরো নাগরিক কবি হওয়া সত্ত্বেও গ্রাম জীবনের অভিজ্ঞতা ও সরলতা কবিতা থেকে পরিত্যাগ করেননি। স্মৃতির জগত থেকে, পাঠের জগত থেকে শব্দ তথ্য আহরণ করে হয়তো সব কবিই জীবনের কোনো সময় গ্রাম শহরের যে গল্প উপস্থাপন করেন, ছন্দ উপমা উৎপ্রেক্ষায় গ্রাম জীবনের গল্প করেন, সংকেতে এঁকে দেন আবহমান থেকে বয়ে চলা চলিষ্ণু জীবনের ঘটনাবলী, তখন সে-সব কবিতায় কবির চাতুর্য দক্ষতার ছাপ হলেও হাসান হাফিজের মতো প্রত্যক্ষদর্শী অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত কবিদের মতো আমাদের আলোড়িত করে না। যেমন হাসান হাফিজের কবিতায়- ‘ডাকাতিয়া নদী দেখেছিল তার/ নৌকা দুটি/ তরুণ গাছের ছায়া।’ কিংবা ‘সবুজ পাতার ঘর আঁচল,’ ‘রোদের সঙ্গে মেঘের সঙ্গে।’
কবি হাসান হাফিজের কবিতা এবং অন্যান্য গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক, বহুমাত্রিক লেখক তিনি। এই রচনায় আমি মূলত তাঁর প্রথম দিককার কাব্যগ্রন্থ ‘এখন যৌবন যার’ নিয়ে এই আলোচনা করলাম যাতে তাঁর বহুমাত্রিক রচনা সম্ভারের মধ্যে কাব্যের শ্রেষ্ঠত্বের ইঙ্গিত মেলে। যাতে পল্লবগ্রাহী পাঠক বইয়ের শিরোনাম পাঠে বিভ্রান্ত না হন।