জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘গণভোট জাতীয় নির্বাচনের দিন হওয়ার সুযোগ নেই। যারা সত্যিকার অর্থে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায় না, তারাই জুলাই সনদ নিয়ে টালবাহানা করছে। যারা ভোট চুরি করে ক্ষমতায় বসে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চায়, তারাই গণভোট সংসদ নির্বাচনের দিন চায়। কারণ, তারা তাদের সন্ত্রাসী, লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে ব্যালট ছিনতাই করে গণভোটে “না” প্রস্তাবে সিল মারার চক্রান্ত করছে। তারা চায় না, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া হোক।’

মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে খুলনার চুকনগর বাসস্ট্যান্ডে এক পথসভায় গোলাম পরওয়ার এ কথা বলেন। এর আগে চুকনগর বাজারে জামায়াতের কার্যালয় চত্বর থেকে শুরু হয়ে মিছিলসহকারে চুকনগর ব্রিজ রোড, যতিন–কাশেম রোড, পোস্ট অফিস রোড, ইউনিয়ন পরিষদ রোড, খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরা রোড প্রদক্ষিণ করে স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তিনি।

গোলাম পরওয়ার বলেন, পিআর পদ্ধতি নিয়ে যেসব রাজনৈতিক দল কঠোর অবস্থানে রয়েছে, তাদের একটু নমনীয় হয়ে বা ছাড় দিয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে। জাতীয় সংসদে যে বিষয়ে আলোচনা করা যায়, সে বিষয় নিয়ে নির্বাচনের আগেই আলোচনা করা সম্ভব। এ জন্য নির্বাচনের আগে যেসব রাজনৈতিক দল পিআর পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করছে, আলোচনা ও গোলটেবিল বৈঠকের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে ঐকমত্য হয়ে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, বাংলাদেশে আলোচনার মধ্য দিয়ে বহু অমীমাংসিত বিষয়ে জাতীয় নেতারা ঐকমত্য হওয়ার অনেক নজির আছে। বর্তমানে জাতীয় নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে জন–আকাঙ্ক্ষা ও জনদাবিতে পরিণত হওয়া পিআর পদ্ধতিতেই জাতীয় নির্বাচন হলে একদিকে যেমন মনোনয়ন–বাণিজ্য থাকবে না, অন্যদিকে ভোটকেন্দ্র দখল ও পেশিশক্তির ব্যবহার কমে যাবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নকারী কমিশন ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য রাজনৈতিক বিষয়গুলোসহ অন্যান্য বিষয়ে কিছু ছাড়ের মধ্য দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে জামায়াত সংস্কারে ছাড় দিয়েছে দাবি করে গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের স্বপ্নপূরণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না দিলে নিজেরা নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার শামিল হবে।’ জনগণকে আবার ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার দিকে ঠেলে না দিয়ে ৫ দফা দাবি মেনে নিতে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

পথসভায় জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মুন্সি মিজানুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি মিয়া গোলাম কুদ্দুস, জেলা কর্মপরিষদের সদস্য আবু ইউসুফ মোল্লা, উপজেলা আমির মোক্তার হোসেন, নায়েবে আমির হাবিবুর রহমান ও গাজী সাইফুল্লাহ, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি আবদুর রশিদ, সহকারী সেক্রেটারি ফরহাদ আল মাহমুদ, ডুমুরিয়া উপজেলা হিন্দু কমিটির সভাপতি কৃষ্ণ নন্দী, সাধারণ সম্পাদক দেবপ্রসাদ মণ্ডল, ডুমুরিয়া উপজেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবু তাহের প্রমুখ বক্তব্য দেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ ল ম পরওয় র জ ল ই সনদ ঐকমত য গণভ ট

এছাড়াও পড়ুন:

দুই প্রশ্নের গণভোটের বিপদ

৩২টি দল মিলে টানা কয়েক মাস সংবিধান সংস্কার নিয়ে ঐকমত্যে আসার চেষ্টা করার পর যেভাবে বৈঠকটির পরিসমাপ্তি টানা হলো, তাতে পুরো সংস্কারপ্রক্রিয়া টালমাটাল হয়ে পড়েছে।

সনদে ৮৪টি প্রস্তাব থাকছে। এর মধ্যে ৩৯টি প্রস্তাব মানে প্রায় অর্ধেক প্রস্তাবে কোনো না কোনো দলের দ্বিমত আছে। ২৫টি প্রস্তাবে আংশিক আপত্তি বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আছে। কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে ৩৯ প্রস্তাবে সবাই সম্মত, সেগুলো একটি তালিকা করে নাগরিকদের সম্মতি বা অসম্মতি জানার জন্য গণভোটে একটি প্রশ্ন থাকবে। সেসব প্রস্তাব নিয়ে টানা দুই মাস আলাপ করে দেশের সব দল ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি, সেগুলো নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন হবে।

নাগরিকদের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলতে হলে তাঁদের তো বুঝতে হবে, কী তাঁরা মত দিচ্ছেন। যেসব বিষয়ে তাঁদের পছন্দের রাজনৈতিক দলগুলো একমত পোষণ করেছে, সেসব বিষয়ে সম্মতি দেওয়াটা সহজ। কারণ, তাঁরা ভেবে নিতে পারেন যে যেসব বিষয়ে সব নেতা একমত হয়ে বসে আছেন, সেখানে তাঁর ‘হ্যাঁ’ বলাতে কোনো ঝুঁকি নেই। প্রতিটি প্রস্তাব নিয়ে তাঁর গবেষণা করার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু যেসব বিষয়ে কোনো না কোনো দল আপত্তি তুলেছে, সেই ব্যালটের কী হবে? কোনো প্রস্তাবে যদি কোনো দলের আপত্তি থাকে, তাহলে একজন নাগরিকের দায়িত্ব হবে সেই প্রস্তাব খতিয়ে দেখা বা তাঁর দল যেদিকে রায় দিয়েছে, সেদিকে থাকা। সে ক্ষেত্রে তাঁর দল যেগুলোতে সায় দিয়েছে, শুধু সেগুলোতে তিনি সম্মতি দিতে চাইবেন। কিন্তু ব্যালটে তিনি যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন, তাহলে যেসব প্রস্তাবে তিনি নিজে বা তাঁর দল সম্মতি দেয়নি, সেগুলোতেও তাঁর সম্মতি দেওয়া হয়ে যাচ্ছে।

আর যদি ‘না’ বলেন, তাহলে যেসব প্রস্তাবে তাঁর নিজের বা দলের সমর্থন আছে, সেগুলো বাতিল হয়ে যাবে। দেখা যাচ্ছে, গণভোটের এই দ্বিতীয় প্রস্তাব কোনোভাবেই কোনো অর্থবহ জনমত বিচার করতে পারবে না। অতএব গণভোটের ব্যালটে এই দ্বিতীয় প্রশ্ন রাখাটা অর্থহীন, অন্যায্য ও অবিবেচনাপ্রসূত।

সংবিধান ‘পিপলস উইল’ বা জনগণে সার্বভৌম ইচ্ছার প্রকাশ। অতএব সেটির ছায়াতলে সবাই এক হবে, সেটিই কাম্য। সেই সংবিধানের জন্যই জাতি যদি বিভাজিত হয়, তাহলে সেটি হবে চরম স্খলন।

সংবিধান দেশের আইনের ভিত্তি। এ জন্য সেটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হওয়া বাধ্যতামূলক। দেশের একটি ছোট অংশও যদি মনে করে যে তাদের জন্য এই সংবিধান অন্যায্য, তাহলে ঐক্যের বদলে সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যায্য না হলেও যদি জনমত সংবিধানের পক্ষে না থাকে, তবে যত ভালো বিশেষজ্ঞ দিয়েই সংবিধান তৈরি হোক না কেন, সেই সংবিধান দেশের কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে পারে না।

কমিশনের বৈঠকে এই প্রস্তাব নিয়ে কোনো আলাপ না করে কমিশন শেষে এসে এককভাবে গণভোটে দুটি প্রশ্ন নিয়ে নাগরিকদের কাছে রায় চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তারা শুধু বলল, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে এই কাজ করা হলো। বিশেষজ্ঞদের অজুহাত দিয়ে এ রকম অস্বচ্ছ গণভোট চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা খুবই অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত।

সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো যদি ধরে নিই, দেশের মানুষ পার্টি লাইনে বা দলীয়ভাবে বিভক্ত, তাহলে বিএনপি যেখানে আপত্তি দিয়েছে, সেটি হ্যাঁ ভোটে পাস হলে দেশের একটি বড় অংশ এই সংবিধান সংস্কারের বিপক্ষে চলে যাবে।

সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে একই সমস্যায় আমরা পড়ব। দেশের এক অংশের মানুষের কাছে চারটি মূলনীতি তাঁদের দেশভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। সেটি নিয়ে তাঁরা যে আপস করবেন না, সেটি কমিশনেই তাঁরা ওয়াকআউট করে জানিয়েছেন। এসব বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়ে পাস করিয়ে নিলে দেশের মানুষ বিভাজিত হবেন। তখন দেশকে মূল্য দিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা দিয়ে।

সংবিধান ‘পিপলস উইল’ বা জনগণে সার্বভৌম ইচ্ছার প্রকাশ। অতএব সেটির ছায়াতলে সবাই এক হবে, সেটিই কাম্য। সেই সংবিধানের জন্যই জাতি যদি বিভাজিত হয়, তাহলে সেটি হবে চরম স্খলন।

ভিন্নমত ও নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে যত কষ্টই হোক, ঐকমত্যে পৌঁছানো ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। আমাদের বুঝতে হবে যে সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের জন্য ঐকমত্যে পৌঁছানোর তুলনায় বিলম্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নয়। ইতিহাস আমাদের শেখায় টেকসই সংবিধান করতে দু–তিন বছর ধরে আলাপ করাটাই শ্রেয়। নেপাল রাজতন্ত্র বিলোপের সংবিধান করতে নেয় ৯ বছর। আর ইন্দোনেশিয়া তাদের স্বৈরাচার আমলের সংবিধান সংস্কার করতে নিয়েছিল তিন বছর। আমাদের আর এক বছর এই আলাপ করার জন্য তৈরি থাকতে হবে।

আমাদের দেশকে স্থিতিশীল রাখতে ও জাতীয় ঐক্য তৈরি করতে সামনের গণভোট জুলাই সনদকে জন–আকাঙ্ক্ষা হিসেবে বৈধতা দেবে এবং পরবর্তী সংসদকে সেই সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার করার ক্ষমতা দেবে। যেসব প্রস্তাবে সব দলের ঐকমত্য আছে, সেসব প্রস্তাব দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাস করবে; যেসব বিষয়ে আপত্তি আছে, সেসব বিষয়ে আগামী সংসদকে প্রয়োজনীয় আলাপ করে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। সেই চেষ্টা ঐকমত্যের কাছাকাছি পৌঁছালে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য দুই–তৃতীয়াংশের সম্মতিতে পাস করবেন।

আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে ঐকমত্য কমিশনকে মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র খুব নাজুক পরিস্থিতিতে আছে। অতএব সমস্যার সমাধানের দিকে না থেকে সমস্যার কারণ হয়ে উঠলে দেশ মহা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। ইতিহাস এ প্রক্রিয়াকে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবেই চিহ্নিত করবে। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি ডেকে না এনে, তাড়াহুড়া না করে দুই ধাপে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করাই এখন কমিশনের কর্তব্য।

সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কর্মী

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দলগুলোকে আজ জুলাই সনদ দেবে কমিশন
  • জুলাই সনদ আজ দলগুলোকে দেবে ঐকমত্য কমিশন
  • পিআর বুঝি না—এই কথা দায়িত্বশীলের হতে পারে না: মিয়া গোলাম পরওয়ার
  • দুই প্রশ্নের গণভোটের বিপদ
  • সুপারিশে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সময় বেঁধে দেওয়ার চিন্তা
  • ৫ দা‌বি‌তে দুই দিনের নতুন কর্মসূ‌চি জামায়া‌তের
  • এবার যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলী পর্যন্ত মানববন্ধন করবে জামায়াতে ইসলামী