অধ্যাপক ক্লিন্টন বি সিলি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর ইমেরিটাস অধ্যাপক, একজন গবেষক ও অনুবাদক। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। ‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ ক্লিন্টন বি সিলির চৌদ্দটি প্রবন্ধের একটি সংকলন যেখানে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন সাহিত্যকর্মকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সমন্বিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

বইটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ইউপিএল থেকে। এই প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে একটি প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ইউপিএল, যেখানে লেখক ক্লিন্টন বি সিলিসহ আরও অনেকে অংশ নেন বাংলাদেশ, ভারত, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে।

জুমের মাধ্যমে যোগ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্লিন্টন বি সিলি ও গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, কলকাতা থেকে পবিত্র সরকার, সিডনি থেকে সাইদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম ও ফারুক মঈনউদ্দীন। ইউপিএলের কর্ণধার মাহরুখ মহিউদ্দিনের স্বাগত উদ্বোধনী বক্তব্যের পর সঞ্চালনার দায়িত্ব নেন ড.

নাজিয়া মনজুর। মুক্ত আলোচনা পর্বে অংশ নেন, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, শফি আহমেদ ও শামসুল বারী। ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রসচিব নজরুল ইসলাম।

অনুষ্ঠানের শুরুই প্রয়াত শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

ক্লিন্টন বি সিলি একজন জীবনানন্দ–অনুরাগী। তাঁর লেখা জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যিক জীবনী ‘আ পোয়েট অ্যাপার্ট’-এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রথমা প্রকাশনী’ থেকে ফারুক মঈনউদ্দীনের অনুবাদে ‘অনন্য জীবনানন্দ’ নামে। ক্লিন্টন সিলি এখানে দেখিয়েছেন, কেন জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যের ধারায় অনন্য বা অন্যদের থেকে আলাদা। এর প্রথম ভাগে জীবনানন্দের জীবনপথ, পারিবারিক প্রেক্ষাপট, কর্মজীবন ও সমসাময়িক সাহিত্যচর্চা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে তাঁর কবিতার বিষয় ও শৈলী বিশ্লেষণ, যেখানে প্রকৃতি, সময়, একাকিত্ব, মৃত্যু ও নারীচিত্রকে নতুন দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। লেখক দেখান, জীবনানন্দের কবিতা রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আধুনিকতার একান্ত নিজস্ব কণ্ঠস্বর সৃষ্টি করেছে। এখানে তিনি জীবনানন্দকে কেবল সাহিত্যিক নয়, বরং তাঁর সময়ের সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়ার এক নিয়ামক হিসেবে দেখিয়েছেন।

‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইতে ক্লিন্টন বি সিলি বাংলা মঙ্গলকাব্য, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মহাভারত, রামায়ণ, মীর মশাররফ হোসেন ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন গভীর, অন্তর্ভেদী ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ। সেই সঙ্গে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গ, রিজিয়া রহমান থেকে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ও রাজা প্রতাপাদিত্যও।

‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইতে ক্লিন্টন বি সিলি বাংলা মঙ্গলকাব্য, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মহাভারত, রামায়ণ, মীর মশাররফ হোসেন ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন গভীর, অন্তর্ভেদী ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ। সেই সঙ্গে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গ, রিজিয়া রহমান থেকে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ও রাজা প্রতাপাদিত্যও।

অনুষ্ঠানে সিডনি থেকে যুক্ত অধ্যাপক ক্লিন্টন বি সিলির বন্ধু এবং একসময়ের ছাত্র সাইদ চৌধুরী সিলি সম্পর্কে একটি পরিচিতিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি জানান, ২০০৮ সালে কলকাতায় এই বই প্রথম প্রকাশের পর ২০১১ সালের দিকে প্রকাশনাটি বন্ধ হয়ে গেলে বইটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছিল না। এর এত বছর পর ইউপিএলের কাছে বইটি প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ করা হয় এবং ইউপিএল কর্তৃপক্ষ সানন্দে বইটি প্রকাশ করে। সাইদ চৌধুরী ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বরিশাল জিলা স্কুলে ক্লিন্টন বি সিলির ছাত্র ছিলেন।

অধ্যাপক পবিত্র সরকার তাঁর বক্তব্যে বলেন, হিন্দু রেনেসাঁ একসময় অনেকটা সত্যি ছিল। যে কারণেই হোক, বাঙালি বা ভারতীয় মুসলমানদের ইংরেজির প্রতি বিদ্বেষ ছিল, কারণ ইংরেজ এসে তাদের সাম্রাজ্য কেড়ে নিয়েছে। তারা ইংরেজি না শিখে খানিকটা পিছিয়ে পড়ে। ফলে যাঁরা রেনেসাঁসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই প্রধান নামগুলো ছিল হিন্দু। যদিও তার মধ্যে ডিরোজিও ছিলেন। ডিরোজিও এসে আরেক ধরনের নেতৃত্ব তৈরি করেছিলেন। হিন্দুদের মধ্যে একটা নাস্তিকীয় ধারা তৈরি হয়েছিল। তারপর মুসলমানরা এলেন। তাঁদের মধ্য থেকে বড় লেখক আসেন মীর মশাররফ হোসেন, যার কথা ক্লিন্টন তাঁর বইতে বলেছেন। ধীরে ধীরে মুসলমান লেখকেরা দৃশ্যে আবির্ভূত হতে লাগলেন। তাঁদের একটা অভিযোগ ছিল হিন্দু লেখকদের সম্বন্ধে, কারণ, অনেক হিন্দু লেখকের মধ্যে একধরনের পক্ষপাত ছিল, যেমন বঙ্কিমচন্দ্র। তখন দেশপ্রেমের উপন্যাস, নাটক যেগুলো জনপ্রিয় হয়েছিল, তাতে দেখা যাচ্ছিল, পরাধীনতার আসল কারণ হচ্ছে মুসলমানরা। ফলে আমাদের স্বদেশি উপন্যাসে দেখা গেল, মুসলমান শাসকেরা আমাদের শত্রু, ব্রিটিশ নয়। ব্রিটিশদের কথা তাঁরা বলতে পারেননি। সরকারি চাকরি বা যেকোনো কারণে। যার ফলে মুসলমান লেখকেরা অভিমান প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে একটা সত্য আছে। কিন্তু তাঁর মতে, আমরা যদি বঙ্কিমচন্দ্র ভালো করে পড়ি, দেখতে পাব, বঙ্কিমচন্দ্র মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে যতটা ছিলেন, মুসলমান সাধারণ মানুষদের ততটা সমালোচক ছিলেন না।

ক্লিন্টনের সঙ্গে পবিত্র সরকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়িয়েছিলেন। পবিত্র সরকার বলেন, মঙ্গলকাব্যের যে স্ট্রাকচার, তার সঙ্গে যে তাসের দেশের স্ট্রাকচারের একটা মিল আছে, এ পর্যন্ত কোনো বাঙালি সেটা বলেননি। ক্লিন্টন প্রথম বললেন। ক্লিন্টন আমেরিকান হয়ে বাঙালির মতো লিখেছেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইতে জীবনানন্দ হোক, মধুসূদন হোক, ভারতচন্দ্র হোক, রবীন্দ্রনাথ হোক বা মীর মশাররফ হোসেন—সবার সম্বন্ধে লেখাগুলোয় বাইরের দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি বাঙালি হিসেবেও একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

পবিত্র সরকারের বক্তব্যের সুর ধরে গায়ত্রী চক্রবতী স্পিভাক, ফারুক মঈনউদ্দীন ও ফিরদৌস আজিমের কাছে উপস্থাপক জানতে চান, যদি আমরা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য করতে চাই, তবে সাহিত্য সমালোচনা করতে একজনের কতটুকু অন্তর্দৃষ্টি বা ভেতরের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন?

ক্লিন্টনের সঙ্গে পবিত্র সরকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়িয়েছিলেন। পবিত্র সরকার বলেন, মঙ্গলকাব্যের যে স্ট্রাকচার, তার সঙ্গে যে তাসের দেশের স্ট্রাকচারের একটা মিল আছে, এ পর্যন্ত কোনো বাঙালি সেটা বলেননি। ক্লিন্টন প্রথম বললেন। ক্লিন্টন আমেরিকান হয়ে বাঙালির মতো লিখেছেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বলেন, তিনি আইডেনটিটি পলিটিকসের বিরুদ্ধে। তাঁর মতে, ‘আমরা সবাই ভাষার দিক থেকে বহিরাগত।’ তিনি জানান, যখন পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র পঁচিশ বছর। তিনি তখন সবে দেরিদার বইগুলো দেখছিলেন।

গায়ত্রীর মতে, তথাকথিত যে স্বাভাবিক ভাষা, সেটাও একদিক দিয়ে কৃত্রিম ভাষা। তিনি ভাষার মধ্যে ভাষার কঙ্কাল দেখতে পান। তিনি জানান, তাঁর একসময় বদভ্যাস ছিল, যখন বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে যেতেন, যাঁরা বাংলা জানেন না, ইংরেজি কথাগুলো তাঁদের ইন্দো-ইউরোপীয় উৎসগুলো থেকে দেখাতে যেতেন, এটা দেখানোর জন্য যে বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে কতটুকু সম্বন্ধ আছে। গায়ত্রী চক্রবর্তীর মতে, ক্লিন্টন বি সিলির বাংলায় তিনি সেই জিনিস দেখতে পান।

শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর গ্রিন রোডে ইউপিএল-এর প্রধান কার্যালয়ে ‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইটির প্রকাশনা উৎসব হয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক ল ন টন ব অন ষ ঠ ন ম সলম ন প রক শ হয় ছ ল প রথম র একট

এছাড়াও পড়ুন:

সংযুক্ত আরব আমিরাত: মরুভূমির বুকে ঐক্যের বিজয়

১৯৭১ সাল। বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল বছর, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার বছর। কাকতালীয়ভাবে ঠিক এই একই বছরে, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মরুভূমির বুকে জন্ম নিচ্ছিল আরেকটি নতুন রাষ্ট্র, যার ভিত্তি কোনো যুদ্ধ নয়; বরং ছিল অটুট ‘ঐক্য’।

আজ ২ ডিসেম্বর, সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) জাতীয় দিবস। দেশটি দিনটিকে উদ্‌যাপন করে ‘স্পিরিট অব দ্য ইউনিয়ন’ বা ঐক্যের চেতনার বিজয় হিসেবে।

ব্রিটিশরা যখন পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল বা তৎকালীন ‘ট্রুশিয়াল স্টেটস’ ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়, তখন এই অঞ্চলের ছোট ছোট শেখতন্ত্রগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু আবুধাবির শাসক শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান এবং দুবাইয়ের শাসক শেখ রাশিদ বিন সাইদ আল মাকতুম এক দূরদর্শী স্বপ্ন দেখলেন। তাঁরা বুঝলেন, আলাদা থাকলে টিকে থাকা কঠিন, কিন্তু এক হলে তাঁরা অজেয়।

১৯৭১ সালের এই দিনে দুবাইয়ের ‘ইউনিয়ন হাউস’-এ এক ঐতিহাসিক দলিলে স্বাক্ষর করেন ছয়টি আমিরাতের (আবুধাবি, দুবাই, শারজাহ, আজমান, উম্ম আল-কুওয়াইন ও ফুজাইরাহ) শাসকেরা। রাস আল খাইমাহ এই জোটে যোগ দেয় পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে। প্রথমবারের মতো পান্না, সাদা, কালো আর লালের সংমিশ্রণে তৈরি আমিরাতের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। শেখ জায়েদ হন দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং ‘ফাদার অব দ্য নেশন’।

১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর এক পতাকার নিচে আসেন আমিরাতের নেতারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ