মার্কিন ‘জীবনানন্দ গবেষকের’ সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের গলি–ঘুপচি ভ্রমণ
Published: 14th, October 2025 GMT
অধ্যাপক ক্লিন্টন বি সিলি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর ইমেরিটাস অধ্যাপক, একজন গবেষক ও অনুবাদক। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। ‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ ক্লিন্টন বি সিলির চৌদ্দটি প্রবন্ধের একটি সংকলন যেখানে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন সাহিত্যকর্মকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সমন্বিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
বইটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ইউপিএল থেকে। এই প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে একটি প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ইউপিএল, যেখানে লেখক ক্লিন্টন বি সিলিসহ আরও অনেকে অংশ নেন বাংলাদেশ, ভারত, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে।
জুমের মাধ্যমে যোগ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্লিন্টন বি সিলি ও গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, কলকাতা থেকে পবিত্র সরকার, সিডনি থেকে সাইদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম ও ফারুক মঈনউদ্দীন। ইউপিএলের কর্ণধার মাহরুখ মহিউদ্দিনের স্বাগত উদ্বোধনী বক্তব্যের পর সঞ্চালনার দায়িত্ব নেন ড.
অনুষ্ঠানের শুরুই প্রয়াত শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
ক্লিন্টন বি সিলি একজন জীবনানন্দ–অনুরাগী। তাঁর লেখা জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যিক জীবনী ‘আ পোয়েট অ্যাপার্ট’-এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রথমা প্রকাশনী’ থেকে ফারুক মঈনউদ্দীনের অনুবাদে ‘অনন্য জীবনানন্দ’ নামে। ক্লিন্টন সিলি এখানে দেখিয়েছেন, কেন জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যের ধারায় অনন্য বা অন্যদের থেকে আলাদা। এর প্রথম ভাগে জীবনানন্দের জীবনপথ, পারিবারিক প্রেক্ষাপট, কর্মজীবন ও সমসাময়িক সাহিত্যচর্চা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে তাঁর কবিতার বিষয় ও শৈলী বিশ্লেষণ, যেখানে প্রকৃতি, সময়, একাকিত্ব, মৃত্যু ও নারীচিত্রকে নতুন দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। লেখক দেখান, জীবনানন্দের কবিতা রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আধুনিকতার একান্ত নিজস্ব কণ্ঠস্বর সৃষ্টি করেছে। এখানে তিনি জীবনানন্দকে কেবল সাহিত্যিক নয়, বরং তাঁর সময়ের সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়ার এক নিয়ামক হিসেবে দেখিয়েছেন।
‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইতে ক্লিন্টন বি সিলি বাংলা মঙ্গলকাব্য, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মহাভারত, রামায়ণ, মীর মশাররফ হোসেন ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন গভীর, অন্তর্ভেদী ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ। সেই সঙ্গে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গ, রিজিয়া রহমান থেকে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ও রাজা প্রতাপাদিত্যও।‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইতে ক্লিন্টন বি সিলি বাংলা মঙ্গলকাব্য, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মহাভারত, রামায়ণ, মীর মশাররফ হোসেন ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন গভীর, অন্তর্ভেদী ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ। সেই সঙ্গে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গ, রিজিয়া রহমান থেকে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ও রাজা প্রতাপাদিত্যও।
অনুষ্ঠানে সিডনি থেকে যুক্ত অধ্যাপক ক্লিন্টন বি সিলির বন্ধু এবং একসময়ের ছাত্র সাইদ চৌধুরী সিলি সম্পর্কে একটি পরিচিতিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি জানান, ২০০৮ সালে কলকাতায় এই বই প্রথম প্রকাশের পর ২০১১ সালের দিকে প্রকাশনাটি বন্ধ হয়ে গেলে বইটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছিল না। এর এত বছর পর ইউপিএলের কাছে বইটি প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ করা হয় এবং ইউপিএল কর্তৃপক্ষ সানন্দে বইটি প্রকাশ করে। সাইদ চৌধুরী ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বরিশাল জিলা স্কুলে ক্লিন্টন বি সিলির ছাত্র ছিলেন।
অধ্যাপক পবিত্র সরকার তাঁর বক্তব্যে বলেন, হিন্দু রেনেসাঁ একসময় অনেকটা সত্যি ছিল। যে কারণেই হোক, বাঙালি বা ভারতীয় মুসলমানদের ইংরেজির প্রতি বিদ্বেষ ছিল, কারণ ইংরেজ এসে তাদের সাম্রাজ্য কেড়ে নিয়েছে। তারা ইংরেজি না শিখে খানিকটা পিছিয়ে পড়ে। ফলে যাঁরা রেনেসাঁসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই প্রধান নামগুলো ছিল হিন্দু। যদিও তার মধ্যে ডিরোজিও ছিলেন। ডিরোজিও এসে আরেক ধরনের নেতৃত্ব তৈরি করেছিলেন। হিন্দুদের মধ্যে একটা নাস্তিকীয় ধারা তৈরি হয়েছিল। তারপর মুসলমানরা এলেন। তাঁদের মধ্য থেকে বড় লেখক আসেন মীর মশাররফ হোসেন, যার কথা ক্লিন্টন তাঁর বইতে বলেছেন। ধীরে ধীরে মুসলমান লেখকেরা দৃশ্যে আবির্ভূত হতে লাগলেন। তাঁদের একটা অভিযোগ ছিল হিন্দু লেখকদের সম্বন্ধে, কারণ, অনেক হিন্দু লেখকের মধ্যে একধরনের পক্ষপাত ছিল, যেমন বঙ্কিমচন্দ্র। তখন দেশপ্রেমের উপন্যাস, নাটক যেগুলো জনপ্রিয় হয়েছিল, তাতে দেখা যাচ্ছিল, পরাধীনতার আসল কারণ হচ্ছে মুসলমানরা। ফলে আমাদের স্বদেশি উপন্যাসে দেখা গেল, মুসলমান শাসকেরা আমাদের শত্রু, ব্রিটিশ নয়। ব্রিটিশদের কথা তাঁরা বলতে পারেননি। সরকারি চাকরি বা যেকোনো কারণে। যার ফলে মুসলমান লেখকেরা অভিমান প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে একটা সত্য আছে। কিন্তু তাঁর মতে, আমরা যদি বঙ্কিমচন্দ্র ভালো করে পড়ি, দেখতে পাব, বঙ্কিমচন্দ্র মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে যতটা ছিলেন, মুসলমান সাধারণ মানুষদের ততটা সমালোচক ছিলেন না।
ক্লিন্টনের সঙ্গে পবিত্র সরকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়িয়েছিলেন। পবিত্র সরকার বলেন, মঙ্গলকাব্যের যে স্ট্রাকচার, তার সঙ্গে যে তাসের দেশের স্ট্রাকচারের একটা মিল আছে, এ পর্যন্ত কোনো বাঙালি সেটা বলেননি। ক্লিন্টন প্রথম বললেন। ক্লিন্টন আমেরিকান হয়ে বাঙালির মতো লিখেছেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইতে জীবনানন্দ হোক, মধুসূদন হোক, ভারতচন্দ্র হোক, রবীন্দ্রনাথ হোক বা মীর মশাররফ হোসেন—সবার সম্বন্ধে লেখাগুলোয় বাইরের দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি বাঙালি হিসেবেও একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
পবিত্র সরকারের বক্তব্যের সুর ধরে গায়ত্রী চক্রবতী স্পিভাক, ফারুক মঈনউদ্দীন ও ফিরদৌস আজিমের কাছে উপস্থাপক জানতে চান, যদি আমরা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য করতে চাই, তবে সাহিত্য সমালোচনা করতে একজনের কতটুকু অন্তর্দৃষ্টি বা ভেতরের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন?
ক্লিন্টনের সঙ্গে পবিত্র সরকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়িয়েছিলেন। পবিত্র সরকার বলেন, মঙ্গলকাব্যের যে স্ট্রাকচার, তার সঙ্গে যে তাসের দেশের স্ট্রাকচারের একটা মিল আছে, এ পর্যন্ত কোনো বাঙালি সেটা বলেননি। ক্লিন্টন প্রথম বললেন। ক্লিন্টন আমেরিকান হয়ে বাঙালির মতো লিখেছেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বলেন, তিনি আইডেনটিটি পলিটিকসের বিরুদ্ধে। তাঁর মতে, ‘আমরা সবাই ভাষার দিক থেকে বহিরাগত।’ তিনি জানান, যখন পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র পঁচিশ বছর। তিনি তখন সবে দেরিদার বইগুলো দেখছিলেন।
গায়ত্রীর মতে, তথাকথিত যে স্বাভাবিক ভাষা, সেটাও একদিক দিয়ে কৃত্রিম ভাষা। তিনি ভাষার মধ্যে ভাষার কঙ্কাল দেখতে পান। তিনি জানান, তাঁর একসময় বদভ্যাস ছিল, যখন বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে যেতেন, যাঁরা বাংলা জানেন না, ইংরেজি কথাগুলো তাঁদের ইন্দো-ইউরোপীয় উৎসগুলো থেকে দেখাতে যেতেন, এটা দেখানোর জন্য যে বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে কতটুকু সম্বন্ধ আছে। গায়ত্রী চক্রবর্তীর মতে, ক্লিন্টন বি সিলির বাংলায় তিনি সেই জিনিস দেখতে পান।
শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর গ্রিন রোডে ইউপিএল-এর প্রধান কার্যালয়ে ‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইটির প্রকাশনা উৎসব হয়উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ল ন টন ব অন ষ ঠ ন ম সলম ন প রক শ হয় ছ ল প রথম র একট
এছাড়াও পড়ুন:
ঢাকা কলেজে রাতে মিছিল, উত্তেজনা
ঢাকার সরকারি সাতটি কলেজ একীভূত করে প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি করা নিয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। মঙ্গলবার দিনভর পক্ষে–বিপক্ষে ব্লকেড কর্মসূচি, বিক্ষোভ ও কর্মবিরতি শেষে রাতে ঢাকা কলেজ ছাত্রাবাস এলাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
ঢাকা কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে ছাত্রদের একটি মিছিল কলেজের দক্ষিণ ছাত্রাবাসে দিকে যায়। এ সময় উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রদের ইঙ্গিত করে নানা স্লোগান দিতে শোনা যায়। এ নিয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এর আগে উচ্চমাধ্যমিকের এক ছাত্রকে মারধর ও শিক্ষককে হেনস্তার প্রতিবাদে মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড়ে ‘ব্লকেড কর্মসূচি’ পালন করেন ঢাকা কলেজের ছাত্ররা। এতে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রীরাও সংহতি জানান। তাঁরা কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার দাবিতে মিছিল করেন।
অপর দিকে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আন্দোলনকারী বেশ কিছু ছাত্র ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, স্নাতকের (সম্মান) এক ছাত্রকে মারধর করে পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বিক্ষোভ থেকে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে স্লোগান দেওয়া হয়।
এদিকে শিক্ষক হেনস্তা ও শিক্ষার্থীর ওপর হামলার প্রতিবাদে মঙ্গলবার সারা দেশে সরকারি কলেজ, সরকারি মাদ্রাসা ও অন্যান্য অফিসে দিনব্যাপী সর্বাত্মক কর্মবিরতি ও কালো ব্যাজ ধারণ করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা (শিক্ষক)। বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের ডাকে এ কর্মসূচি পালিত হয়। এতে কোনো ক্লাস হয়নি।
ঢাকা কলেজে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষকেরা বিভাগ ছেড়ে শিক্ষক লাউঞ্জে জমায়েত হয়ে প্রতিবাদ জানান। কলেজের শহীদ মিনারের সামনেও কিছুক্ষণ অবস্থান করেন তাঁরা। এতে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম ইলিয়াস হোসেনও অংশ নেন।
ঢাকার সাতটি বড় সরকারি কলেজ একীভূত করে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ নামে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় করতে যাচ্ছে সরকার। প্রস্তাবিত এই কাঠামো নিয়ে কলেজগুলোর শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন এবং শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন।
আরও পড়ুনসায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে ব্লকেড কর্মসূচি ঢাকা কলেজের ছাত্রদের১৩ ঘণ্টা আগে