‘আইএফআইসি শ্রীপুর বন্ডের’ তহবিল ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম তদন্তে বিএসইসি
Published: 14th, October 2025 GMT
পুঁজিবাজারে বন্ড খাতে তালিকাভুক্ত বেক্সিমকো গ্রুপের আইএফআইসি গ্যারান্টেড শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ডের তহবিল ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, দুর্নীতি ও সার্বিক কার্যক্রম তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বন্ডটির সঙ্গে সম্পৃক্ত সব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম অনুসন্ধান করার লক্ষ্যে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গঠিত তদন্ত কমিটিকে আগামী ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।
তবে আইএফআইসি গ্যারান্টেড শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ডটির মাধ্যমে সংগৃহীত তহবিল অপব্যবহার হয়েছে কি-না, তা অনুসন্ধানের লক্ষ্যে ইতিপূর্বে জারি করা বিএসইসির তদন্তের আদেশ বাতিল করে নতুন আদেশ জারি করা হয়েছে।
আরো পড়ুন:
কারণ ছাড়াই বাড়ছে ওয়েব কোটসের শেয়ারদর
পুঁজিবাজারে সূচকের পতন, বেড়েছে লেনদেন
সম্প্রতি বিএসইসির মার্কেট ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
২০২৪ সালে আইএফআইসি গ্যারান্টিড শ্রীপুর টাউনশিপ জিরো কুপন বন্ড ইস্যু করে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল। তবে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ নির্ধারিত প্রকল্প ও খাতে বিনিয়োগ হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখবে বিএসইসি। বিনিয়োগকারীদের তহবিল যথাযথ খাতে ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা-তদন্তের মূল লক্ষ্য।
আইএফআইসি গ্যারান্টিড শ্রীপুর টাউনশিপ জিরো কুপন বন্ডের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন-বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মাদ রাকিবুর রহমান, উপ-পরিচালক শাহনেওয়াজ এবং সহকারী পরিচালক মো.
বিএসইসির তদন্ত আদেশ
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইএফআইসি গ্যারান্টেড শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ডের ইস্যুয়ার শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেড, ট্রাস্টি সন্ধানী লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেড ও নিরীক্ষক এম.জে. আবেদীন অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের ওপর উক্ত বন্ড সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সম্পকিত বিষয় এবং আইএফআইসি গ্যারান্টেড শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ডের মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থের ব্যবহারের বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদশ, ১৯৬৯ এর ধারা ২১ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ আন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩ এর ধারা ১৭ক এ প্রদন্ত ক্ষমতাবলে তিন জন কর্মচারীর সমন্বয়ে একটি অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটির সদস্যরা এই আদেশ জারির তারিখ থেকে ৬০ দিবসের মধ্যে অনুসন্ধান ও তদন্ত সম্পন্ন করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবে।
আগে এ বিষয়ে বিএসইসির চলতি বছরের ২৭ আগস্ট জারি করা তদন্তের আদেশ বাতিল করা হলো।
যেসব বিষয় খতিয়ে দেখবে তদন্ত কমিটি
গঠিত তদন্ত কমিটি আইএফআইসি গ্যারান্টেড শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ডের ইস্যুয়ার শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেড, ট্রাস্টি সন্ধানী লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেড ও নিরীক্ষক এম.জে. আবেদীন অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের সকল কার্যক্রম অনুসন্ধান করে দেখবে।
শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ প্রকল্প অনুযায়ী ব্যবহার করা হয়েছে কি না, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছে কি না, কিংবা কোনো অনিয়ম বা তথ্য গোপন করা হয়েছে কি না-তা যাচাই করবে গঠিত তদন্ত কমিটি।
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
‘আইএফআইসি গ্যারান্টিড শ্রীপুর টাউনশিপ জিরো কুপন বন্ড’ শীর্ষক ১৫০০ কোটি টাকা অভিহিত মূল্যের ও ১০০০ কোটি টাকা ইস্যু মূল্যের বন্ড ২০২৩ সালের ৪ জুন ৮৭১তম কমিশন সভায় অনুমোদিত হয়েছিল। ওই বছরের ১২ জুলাই সেটার সম্মতিপত্র ইস্যু করা হয়েছিল। ওই বন্ডটির ইস্যুয়ার ছিল শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেড, যা ওই বছরের ২ মার্চ নিবন্ধিত একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। কোম্পানিটি নিবন্ধিত হওয়ার পরপরই ২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল ওই বন্ড ইস্যুর আবেদন করেছিল। ওই কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ছিল ৫০০ কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন ছিল ৩৩৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে মাত্র ৪ দিনের ব্যবধানে ২৪৮ কোটি টাকার নগদ অর্থ ভূমি ক্রয় বা উন্নয়ন সংক্রান্ত কারণে উত্তোলন করা হয়েছিল, যেটি কমিশনের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।
এছাড়া ওই বন্ডটির জামিনদার (গ্যারান্টার) হিসেবে আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসি, অ্যাডভাইজার ও অ্যারেঞ্জার হিসেবে আইএফআইসি ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড, ট্রাস্টি হিসেবে সন্ধানী লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেড, ক্রেডিট রেটিং প্রদানকারী হিসেবে ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড, নিরীক্ষক হিসেবে এমজে আবেদীন অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট দায়িত্ব পালন করেছে। আইএফআইসি ব্যাংক ওই বন্ড ইস্যু করেনি, মূলত রিয়েল এস্টেট কোম্পানি শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেড (এসটিএল) ওই বন্ডের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করেছে। কিন্তু বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে বন্ডের নাম হিসেবে ‘আইএফআইসি আমার বন্ড’ নামটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা বিনিয়োগকারীকে ধারণা দেয় যে, এ বন্ড আইএফআইসি ব্যাংক ইস্যু করেছে। কিন্তু আইএফআইসি ব্যাংক ছিল মূলত বন্ডটির জামিনদার (গ্যারান্টার)। এভাবে বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা হয়।
এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার কারণে বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার ও আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে পুঁজিবাজারে আজীবন অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে বিএসইসি। পাশাপাশি একইসঙ্গে সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানকে আজীবন, বিএসইসির সাবেক কমিশনার শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ ও আইএফআইসি ইনভেস্টমেন্টের সাবেক সিইও ইমরান আহমেদকে ৫ বছর পুঁজিবাজারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া সালমান এফ রহমানকে ১০০ কোটি টাকা, তার ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানকে ৫০ কোটি টাকা ও ক্রেডিট রেটিং প্রদানকারী ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিংকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে।
ঢাকা/এনটি/এসবি
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গ য র ন ট ড শ র প র ট উনশ প গ র ন জ র শ র প র ট উনশ প ল ম ট ড স ক উর ট জ ব এসইস র ব যবহ র লক ষ য তহব ল আহম দ রহম ন
এছাড়াও পড়ুন:
পাঁচ ব্যাংক একীভূতকরণ: বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বিএসইসির চি
দুর্বল ও তারল্য সঙ্কটে ভুগতে থাকা পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। যেখানে আমানতকারীদের সম্পূর্ণ সুরক্ষার কথা বলা হলেও ব্যাংকগুলোর শেয়ারহোল্ডার সাধারণ বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এ কারণে পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে এ বিষয়ে একটি চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ অনুযায়ী, একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না। নতুন ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে। তবে সেখানে ওই পাঁচ ব্যাংকের বিনিয়োগকারীদের কোনো শেয়ার থাকবে না। এসব ব্যাংকের শেয়ার নতুন করে ইস্যু করা হবে।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকের বর্তমান অবস্থার জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দায় নেই। এ জন্য দায়ী ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তা ও পরিচালকেরা এবং তারা চিহ্নিত। তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা দরকার বলে তারা মনে করছেন। তারা বলছেন, যেহেতু এখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দায় নেই, তাহলে তাদের শেয়ার কেন বাজেয়াপ্ত করা হবে? এ কারণে পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণ বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি। তাদের দাবি, সরকার ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের সুরক্ষার বিষয়টি যেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখছে, একই রকমভাবে শেয়ারহোল্ডারদের বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত।
এদিকে পাঁচটি দুর্বল শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক একীভূত করার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে সমস্যাগ্রস্ত থাকা নয়টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ১৪টি প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এর সঙ্গে যুক্ত। তবে পাঁচ ব্যাংক একীভূত করা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে পরামর্শ করেনি। উল্লেখ্য, ব্যাংক একীভূতকরণ বাস্তবায়নের জন্য অর্থমন্ত্রণালয়ের ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস ডিভিশন (এফআইডি) আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। সেখানেও বিএসইসি’র প্রতিনিধি নেই। এমনকি সংশ্লিষ্ট তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য পায়নি। তারা শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগকারীদের জানাতে মূল্যসংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের সুযোগও পায়নি। ফলে, লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এখনো জানেন না তাদের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ কী?
গভর্নরকে দেওয়া চিঠিতে বিএসইসি জানিয়েছে, একীভূত করতে যাওয়া পাঁচটি ব্যাংক; ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি এবং এক্সিম ব্যাংক পিএলসির বর্তমান এই অবস্থার জন্য কোনোভাবেই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দায়ী নন। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ-২০২৫ এর ধারা-৭৭ এ বর্ণিত দায়ী ব্যক্তিগণ ব্যাংকগুলোর এই অবস্থার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী, যা বাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশে স্বীকৃত। উক্ত পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করার কথা জানিয়েছে বিএসইসি।
১. ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিটে প্রদর্শিত সম্পদ মূল্যায়নের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর লাইসেন্স, ব্রাঞ্চ নেটওয়ার্ক, ক্লায়েন্ট বেজ, হিউম্যান রিসোর্স বেজ, সার্ভিস ডেলিভারি মেকানিজম এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু, ইত্যাদি মূল্যায়ন করে বিক্রয় মূল্য বিবেচনায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ নির্ধারণ করা।
২. ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিটে প্রদর্শিত সম্পদ মূল্যায়নের পাশাপাশি ব্যাংক প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে সংরক্ষিত জামানত এবং দায়ী ব্যক্তিপণের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে আদায়যোগ্য অর্থ বিবেচনায় নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ নির্ধারণ করা।
৩. ধারা-৭৭ এ বর্ধিত দায়ী ব্যক্তিগণ কর্তৃক ধারণকৃত শেয়ার ব্যাতীত অন্যান্য সাধারণ শেয়ারহোল্ডারগণ বা সাধারণ বিনিয়োগকারী কর্তৃক বিনিয়োগকৃত অর্থ সাধারণ বিনিয়োগকারীর ন্যূনতম স্বার্থ মূল্য বিবেচনা করে একীভূতকরণের অনুপাত নির্ধারণ করা।
৪. উপরিউক্ত মূল্যায়ন বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংক পাঁচটির সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ মূল্য অনুপাতে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা। এবং ব্যাংকগুলোতে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ মূল্য অনুপাত নির্ধারণ ও তা ঘোষণা না করে অথবা সাধারণ বিনিয়োগকারী কর্তৃক ধারণকৃত শেয়ারের এক্যুইজেশন মূল্য নির্ধারণ এবং তা ঘোষণা না করে স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে তালিকাচ্যুত না করার কথাও গভর্নরকে দেওয়া চিঠিতে বিএসইসি জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে শরিয়াহভিত্তিক এই পাঁচটি ব্যাংক চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ব্যাংকগুলোর ঋণের বেশিরভাগই খেলাপি হয়ে থাকায় গ্রাহক আমানত ফেরত পাচ্ছেন না। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরই ধরাবাহিকতায় ব্যাংক খাতে সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জবাবদিহি নিশ্চিতকরণসহ সামগ্রিক আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করে একটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ। গত ৯ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এর নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। নতুন এ ব্যাংকের দুটি নাম প্রস্তাব করা হয়েছে- ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ ও ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’। ব্যাংকটি বাণিজ্যিকভাবে ও পেশাদারির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে বলেও জানানো হয়েছে।
একীভূত করার ফলে কেউ চাকরি হারাবেন না এবং কোনো আমানতকারী আমানত হারাবেন না। প্রাথমিকভাবে নতুন ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ ব্যাংকের সব দায় ও সম্পত্তি গ্রহণ করে নতুন ব্যাংকটি তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা সরকার দেবে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে নগদ, বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা সুকুক বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের শেয়ার দিয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা মূলধনে রূপান্তর করা হবে বেইল-ইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। পরে আবার রেজল্যুশন পরিকল্পনা অনুযায়ী তা পরিশোধ করা হবে আমানতকারীদের। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমানতকারী ও অন্যান্য পাওনাদারের ঋণের একাংশ বাতিল হয়ে শেয়ারে রূপান্তরিত হয়, সেটাই হচ্ছে বেইল-ইন। নতুন ব্যাংকটি প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন হবে। পরে পর্যায়ক্রমে মালিকানা বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হবে। নতুন ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে।
এছাড়া ইসলামি ধারার যে পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে শিগগিরিই প্রশাসক বসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা একীভূত প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবেন। প্রশাসক হিসেবে এক্সিম ব্যাংকের দায়িত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শওকত উল আলম, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বে নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ বদিউল আলম দিদা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বে মো. সালাহ উদ্দীন ইউনিয়ন ব্যাংকের দায়িত্বে পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হাসেম ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বে মকসুদুল আলমকে নিযুক্ত করা হবে। তাদের সহায়তা করার জন্য প্রত্যেক ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও চারজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। এর মাধ্যমে পাঁচ ব্যাংক মিলে ইসলামি ধারার একটি ব্যাংক গড়ে উঠবে। চলতি সপ্তাহের মধ্যে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের আলোকে প্রতিটি ব্যাংকে প্রশাসকদের দায়িত্ব নেওয়ার কথা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। একজন সাধারণ শেয়ায়হোল্ডারের যত ধরনের অধিকার পাওয়ার বিষয়টি আইনে বলা হয়েছে তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হয়েছে।”
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার দরকার ছিল। ব্যাংকগুলোকে পরিচালনা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। তারপরেও ব্যাংকগুলো ঠিক মতো পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি এবং তাদের সংকটও কাটেনি। চোর-বাটপাররা আমনতকারীদের টাকা নিয়ে গেছে, তাই সরকার ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব নিয়েছে। আমি তো মনে করি, ব্যাংকগুলোর আমানতকারীরা ভাগ্যবান। ব্যাংকগুলোর নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি) পজিটিভ থাকলে শেয়ারহোল্ডাররা কিছু পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। তবে এনএভি নেতিবাচক থাকলে কিছুই পাওয়ার কথা না। তারপরেও, সরকার চাইলে সাধারণ বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কথা বিবেচনা করতে পারে। কারণ ব্যাংকগুলোর এমন পরিণতির জন্য আমানতকারী ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দোষ দেওয়া যাবে না।”
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যানুযায়ী, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৬৯.২০ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.৮৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৭.৯২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৫২.৯৬ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩১.৬১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২৮.৬২ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.২৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৬৫.১৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এক্সিম ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২৭.৬৫ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.৬৩ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩৯.২৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৩.৬৯ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.০১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩১.৮১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
ঢাকা/এনটি/তারা