বিচার বিভাগ স্বাধীন না হলে কোনো সেক্টরের সংস্কার কার্যক্রমই স্থায়িত্ব পাবে না: প্রধান বিচারপতি
Published: 4th, May 2025 GMT
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একটি অপরিহার্য বিষয়। যদি বিচার বিভাগ স্বাধীন না হয়, কোনো সেক্টরের সংস্কার কার্যক্রমই স্থায়িত্ব পাবে না। বিচার বিভাগে সংস্কারের ওপর ভিত্তি করে আরও বৃহত্তর সংস্কারের কাঠামো নির্মিত হতে পারে। বর্তমান সাংবিধানিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে বিচার বিভাগই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ কার্যকর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অডিটরিয়ামে এ কে খান ফাউন্ডেশন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘৭ম এ কে খান মেমোরিয়াল ল লেকচার-২০২৫’-এ ‘রিমেইনিং দ্য ফিউচার অব জাস্টিস’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন। মূল বক্তা হিসেবে সেমিনারে বক্তব্য দেন তিনি। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ক্রমবিকাশ বিচারপ্রক্রিয়ায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। যার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব। তিনি বলেন, বিচারব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই প্রযুক্তিনির্ভর নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতার ওপর। প্রযুক্তিগত এই পরিবর্তনগুলোকে কেবল বাধা হিসেবে দেখলে চলবে না, সেগুলোকে উদ্ভাবনের অনুঘটক হিসেবেও বিবেচনা করা প্রয়োজন।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি আধুনিক জীবনব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে এবং বিচারব্যবস্থা এ পরিবর্তনের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।…এখন অপরাধের প্রকৃতিতে এক মৌলিক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। আগে যেখানে অপরাধ হতো বাস্তব জগতে, এখন তা ক্রমে স্থানান্তরিত হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেটের মতো ভার্চ্যুয়াল জগতে। তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল জগৎ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে অনেক সময়ই মৌলিক অধিকার, বিশেষত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের শঙ্কা দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে এমন একটি পরিশীলিত ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা তৈরি করা, যা একদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করবে, অন্যদিকে সাইবার অপরাধ, হয়রানি এবং গোপনীয়তার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করবে।’
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড.
২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নিজের ঘোষিত বিচার বিভাগ সংস্কার রোডম্যাপ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন ও পদ্ধতিগত দক্ষতা—এই তিনটি লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, এর অংশ হিসেবে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার হস্তক্ষেপ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েনমেন্ট কাউন্সিল এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা দুটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগ ও অপসারণের একমাত্র ক্ষমতা রাখে। বিচার বিভাগের পূর্ণ প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্টের অধীন একটি আলাদা বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন হয়েছে, যা সংস্কার অগ্রগতির মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করবে। সারা দেশে বিচারকদের বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও সামঞ্জস্য নিশ্চিত করতে একটি বিস্তৃত বদলি ও পদায়নে নীতিমালা সরকারের কাছে ইতিমধ্যে পেশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
জেলা পর্যায়ে বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগবিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, বিচারিক সংস্কার রোডম্যাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে জেলা পর্যায়ে বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা হলে বাণিজ্যিক বিরোধগুলোর দ্রুত ও কার্যকর সমাধান নিশ্চিত হবে। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ সংস্কারে সহযোগিতা প্রদানে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যা বাংলাদেশে ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
শিশুরা কোথায় নিরাপদ?
নারী ও শিশু ধর্ষণ একটি নৈতিক অবক্ষয়জনিত সামাজিক অপরাধ। এরূপ বেদনাদায়ক সংবাদ গণমাধ্যমে ব্যাপক মাত্রায় প্রচারিত হচ্ছে। মাগুরার আছিয়া নামে ৮ বছরের কন্যাশিশুকে বাঁচানো গেল না। দেশের সব গণমাধ্যম নির্মম এই সংবাদটি প্রচার করেছে। আছিয়া বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে বোনের শ্বশুর কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়। বোনের স্বামীর সহায়তায় শ্বশুর হিটু শেখ আছিয়াকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি সেই পাষণ্ড। ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার চেষ্টা করে। অচেতন অবস্থায় মাগুরা হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পর্যায়ক্রমে ফরিদপুর মেডিকেল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। সর্বশেষ সংকটাপন্ন অবস্থায় সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে ৮ বছরের কন্যাশিশুটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। জীবন ও জগৎ দেখার আগেই নিষ্পাপ একটি শিশুটির জীবনাবসান হয়।
শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের নারী নানাভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুসন্ধানক্রমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ধর্ষণ সম্পর্কিত ভয়ানক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রতিবেদনে ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে ৬ হাজার ৩০৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪৭১ জন ১৮ বছরের কম বয়সী। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার ১০৭ জন, যার মধ্যে ৬৬ জন শিশু।
দেশের সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ষণ একটি চিহ্নিত সামাজিক অপরাধ। ধর্ষণ ও ধর্ষণের শাস্তির বিধানাবলি উল্লেখ আছে ১৮৬০ সালের ‘দণ্ডবিধি’র ৩৭৫ নম্বর ধারায়। তা ছাড়া বাংলাদেশে যৌন নিপীড়নমূলক আইন হচ্ছে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (২০০৩ সালে সংশোধিত)’। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ নম্বর ধারায় ধর্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে– ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।’
ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনে শাস্তির বিধান অত্যন্ত কঠিন। আইনের বিধানমতে– কেউ ধর্ষণের শিকার, ভিকটিম মারা গেলে, দলগত ধর্ষণের শিকার ও ধর্ষণের চেষ্টার জন্য পৃথক শাস্তির বিধান আছে। এ ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান হচ্ছে– মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১০-৫ বছর সাজা ইত্যাদি। দেশে ধর্ষণের অভিযোগে অনেক মামলা হয়। কিন্তু দায়েরকৃত মামলা যথাসময়ে সম্পন্ন হয় না। সাক্ষীর অনুপস্থিতি, বিলম্বে প্রতিবেদন পেশ, বাদীর সময় প্রার্থনাসহ বিবিধ কারণে বিচারিক প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়। ফলে ধর্ষণের শাস্তির গতি খুবই মন্থর।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে শিশু ধর্ষণ অন্যতম সামাজিক ব্যাধি। ধর্ষণের শিকার শুধু কন্যাশিশু নয়, ছেলে শিশুরাও। শিশুদের প্রতি বর্বর যৌনাচরণ বর্তমান সমাজের একটি নগ্ন রূপ। আতঙ্কের বিষয়, বেশির ভাগ শিশু যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে পরিচিতজনের হাতেই। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক নিবন্ধ অনুযায়ী, প্রায় ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতনকারী শিশুর পরিচিত ও নিকটাত্মীয়। শিশুদের প্রতি পুরুষদের যৌন ইচ্ছা অনুভূত হচ্ছে কেন? চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, এরূপ পুরুষরা ‘পিডোফাইল’ হিসেবে অভিহিত। পিডোফাইলদের চিহ্নিত করতে হবে এবং তাদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে শিশুদের সুরক্ষায় অধিকতর সতর্ক হতে হবে।
ধর্ষণ একটি ঘৃণ্য মানবাচরণ। দেশে যৌনবাদের উত্থানে বিব্রত গোটা সমাজ ব্যবস্থা। কুরুচিপূর্ণ মানুষ প্রবৃত্তির তাড়নায় অশ্লীল পথ অবলম্বন করছে। আজ নারী, কিশোরী, কন্যাশিশু এমনকি ছেলেশিশুও যৌন নিপীড়কদের শিকার হচ্ছে। ধর্ষকরা সমাজের বর্ণচোরা। এসব হীনচরিত্রের ব্যক্তি সমাজ এবং সভ্যতার প্রতি আনুগত্যশীল নয়। তারা সমাজের অগ্রযাত্রা ব্যাহত ও সামাজিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে। তাই ধর্ষণ প্রতিরোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রুত কার্যকর করতে হবে। পরিবার, বিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা জোরদার করতে হবে। যে কোনো নারীর শ্লীলতাহানি ও নিষ্পাপ শিশুর প্রতি বর্বরতায় গোটা সমাজ লজ্জিত হয়। এতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ব্যক্তিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। সমাজে বসবাসকারী সবার প্রতি শোভন আচরণ এবং পারস্পরিক আস্থা জোরদার হোক।
মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ: অধ্যক্ষ, জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি, ঢাকা