রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রুশ বাহিনীর জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী সময় ছিল গত বছর। এ বছর অন্তত ৪৫ হাজার ২৮৭ জন নিহত হয়েছেন।

নিহতের এ সংখ্যা যুদ্ধের প্রথম বছরের তুলনায় প্রায় তিন গুণ এবং ২০২৩ সালে হওয়া ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও অনেক বেশি। এ যুদ্ধে ২০২৩-এ বাখমুতে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও প্রাণঘাতী লড়াই হয়।

যুদ্ধের শুরুতে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখলের একেকটি লড়াইয়ে ধাপে ধাপে রাশিয়ার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে ২০২৪ সালে যুদ্ধের সম্মুখভাগ ধীরগতিতে এগোতে থাকায় নিহতের সংখ্যা মাসে মাসে বাড়তে থেকেছে। আর এটাই বিবিসিকে ইউক্রেনে কিলোমিটারপ্রতি ২৭ প্রাণহানির হিসাব প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে। [এ হিসাব করা হয়েছে গত বছরের অনুমিত মৃত্যুর সংখ্যা ১ লাখ ১২ হাজারের ভিত্তিতে]

স্বতন্ত্র গণমাধ্যম মিডিয়াজোনা আর একদল স্বেচ্ছাসেবকের সহযোগিতায় বিবিসি রুশ সার্ভিস ওপেন সোর্স বা উন্মুক্ত সূত্রে প্রাপ্ত রাশিয়ার কবরস্থান, স্মৃতিসৌধ এবং শোক সংবাদের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে।

এ পর্যন্ত ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার অভিযানে ১ লাখ ৬ হাজার ৭৪৫ জন নিহত রুশ সেনার নাম শনাক্ত করেছে বিবিসি।

তবে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা স্পষ্টতই আরও অনেক বেশি। সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বিবিসি নিহত সেনাদের যে সংখ্যা পেয়েছে, সেটা মোট নিহতের মাত্র ৪৫ থেকে ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রকৃত নিহতের সংখ্যা ১ লাখ ৬৪ হাজার ২২৩ থেকে ২ লাখ ৩৭ হাজার ২১১ জনের মধ্যে হতে পারে।

২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির দিনটি রুশ বাহিনীর জন্য সে বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন ছিল।

ওই দিন দখলকৃত দোনেৎস্কের ভলনোভাখা শহরের কাছে একটি প্রশিক্ষণ ভূমি ইউক্রেনের দূরপাল্লার এইচআইএমআরএএস (উচ্চ গতিসম্পন্ন আর্টিলারি রকেট সিস্টেম) মিসাইল হামলায় ৩৬তম মোটরাইজড রাইফেল ব্রিগেডের সদস্য আলদার বাইরভ, ইগর বাবিচ, ওখুঞ্জন রুস্তামভসহ বহু সৈন্য নিহত হন।

একটি মেডেল প্রদান অনুষ্ঠানের জন্য তাঁদের লাইনে দাঁড় করানো হয়েছিল। কমান্ডার কর্নেল মুসায়েভসহ এই হামলায় ৬৫ জন সৈন্য নিহত হন, আহত হন আরও অনেকে।

সাইবেরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল বারিশিয়া থেকে আসা ২২ বছর বয়সী বাইরভ খাদ্যের মান ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হওয়ার লক্ষ্যে পড়াশোনা করছিলেন। কিন্তু সামরিক চাকরিতে বাধ্যতামূলক ডাক পড়ায় তিনি পেশাদার সৈনিক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি যুদ্ধ করতে ইউক্রেনে যান। রুশ সেনারা সে বছরের মার্চে কিয়েভের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় বোরোদিয়াঙ্কার যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। যুদ্ধে শহরটি প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। এ সময় রুশ সৈনারা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যায় জড়িত ছিলেন বলে ইউক্রেনীয় বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে।

সাইবেরিয়ার চিতা শহরের ৩১ বছর বয়সী ওখুঞ্জন রুস্তামভ বিশেষ বাহিনীতে বাধ্যতামূলক চাকরি শেষে ঢালাইকর (ওয়েল্ডার) হিসেবে কাজ করতেন। ২০২২ সালের অক্টোবরে রুশ বাহিনী আংশিক সেনা সংগ্রহের সময় তাঁকে সামরিক বাহিনীতে ডাকা হয়।

৩২ বছর বয়সী ইগর বাবিচ অবশ্য স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। এর আগে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি সেরিব্রাল পালসিতে (জটিল স্নায়বিক রোগ) আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের ফিজিওথেরাপি দিতেন।

বিবিসির সংগৃহীত উপাত্ত অনুযায়ী, ওই দিন মোট ২০১ জন রাশিয়ান সৈন্য প্রাণ হারান।

প্রশিক্ষণ ভূমিতে হামলার কয়েক ঘণ্টা পর রাশিয়ার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করে যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক সাফল্যের খবর দেন।

কিন্তু এতে প্রশিক্ষণ ভূমিতে হামলার কোনো উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রোজকার প্রতিবেদনে এ বিষয়ে একটি শব্দও ছিল না।

ওখুঞ্জন রুস্তামভের এক আত্মীয় জানান, যুদ্ধ চলার সময় ইতিমধ্যে তিনি পরিবারের ঘনিষ্ঠ তিন সদস্যকে হারিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘২০২২ সালের ডিসেম্বরে আমার স্বামী মারা যান। ১০ ফেব্রুয়ারিতে আমার ধর্মপিতা (গডফাদার) এবং ২০ ফেব্রুয়ারিতে নিহত হন আমার সৎভাই। এক শবযাত্রা থেকে আরেক শবযাত্রা।’

বিশ্লেষণে বিবিসি সৈন্যদের মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট তারিখকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। যখন তা পাওয়া যায়নি, তখন তারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার তারিখ বা মৃত্যুর খবর প্রকাশের তারিখ ব্যবহার করেছে।

যুদ্ধের প্রথম দুই বছরে অর্থাৎ ২০২২ ও ২০২৩ সালে, রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করেছে। কখনো প্রচণ্ড যুদ্ধে অনেক মানুষ নিহত হতো, কখনো আবার পরিস্থিতি শান্ত থাকাত।

২০২৩-২৪ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চুক্তিবদ্ধ হওয়া হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবককে ১০ থেকে ১৫ দিনের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো হয়। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ যোদ্ধাদের বেঁচে ফেরার সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ ২০২৩ সালের কথা ধরা যায়। বেশির ভাগ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে। এ সময় রুশ বাহিনী দোনেৎস্ক অঞ্চলের ভুহলেদার ও বাখমুত শহর দখলের চেষ্টা চালিয়েছিল।

বিবিসির হিসাব অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের প্রথম বছরে রাশিয়া কমপক্ষে ১৭ হাজার ৮৯০ জন সৈন্য হারিয়েছে। এ হিসাবে দখলকৃত পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার দুই বদলি বাহিনী বা অনিয়মিত যোদ্ধাদলের ক্ষয়ক্ষতি হিসাব করা হয়নি।

২০২৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ৬৩৩।

২০২৪ সালের কখনো হতাহতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে দেখা যায়নি। এ সময় আভদিভকা ও রোবোটাইনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পোক্রোভস্ক ও তোরেতস্কের দিকে তীব্র আক্রমণ চালানো হয়।

২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ইউক্রেনীয় বাহিনী কুরস্ক অঞ্চলে সীমান্ত পেরিয়ে আক্রমণ চালালে সেখানেও বাধ্যতামূলকভাবে নিযুক্ত রুশ সেনারা নিহত হন। শুধু আগস্টের ৬ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে আনুমানিক ১ হাজার ২২৬ জন রুশ সেনা প্রাণ হারান।

তবে শীর্ষ পর্যায়ের মার্কিন সামরিক বিশ্লেষক মাইকেল কফম্যানের মতে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে পূর্ব দিকে ধীর অগ্রগতির সময় রুশ বাহিনীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়।

মাইকেল কফম্যান ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এ সময় সাঁজোয়া গোলন্দাজ আক্রমণকারীদের বিক্ষিপ্ত দল নিয়ে অবিরত আক্রমণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। এ কারণে রুশদের দখলে নেওয়া নতুন ভূখণ্ডের তুলনায় সামগ্রিক হতাহতের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়।’

প্রায় দুই বছর তীব্র যুদ্ধের পর ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর রাশিয়ান বাহিনী দোনেৎস্কের ভুহলেদার সামরিক সরঞ্জামের ঘাঁটি দখল করে নেয়।

যুদ্ধ-গবেষণা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের (আইএসডব্লিউ) অনুমান, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের ২ হাজার ৩৫৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে।

এমনকি তখনো যুদ্ধের সম্মুখভাগে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পতন ঘটেনি।

এই অভিযানে অন্তত ১১ হাজার ৬৭৮ রুশ সেনা নিহত হয়েছেন।

ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিবিসি শুধু সেসব সেনাসদস্য ও কর্মকর্তা নিহত হওয়ার হিসাব করেছে, যাঁদের নাম প্রকাশ্য শোক সংবাদে ছিল এবং যাঁদের নিহত হওয়ার বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার তারিখ এ সময়সীমার মধ্যে পড়েছে।

আইএসডব্লিউর তথ্যমতে, ২০২৪ সালে রাশিয়া সামগ্রিকভাবে ৪ হাজার ১৬৮ বর্গকিলোমিটার জমি দখল করেছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, প্রতি বর্গকিলোমিটার দখলকৃত ভূখণ্ডের জন্য ২৭ জন রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। তবু তো এখানে আহতের হিসাবে করা হয়নি।

যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে রুশ বাহিনীতে নিয়োগকে প্রভাবিত করছে

রাশিয়া বিভিন্ন উপায়ে নিজের কমতে থাকা সেনাবল বাড়ানোর পথ খুঁজে বের করেছে।

বিশ্লেষক মাইকেল কফম্যান বলেন, ‘২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়া সেনা নিয়োগ বাড়ায়। নিয়োগপ্রাপ্তদের সংখ্যা নিহতদের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায়। ফলে মস্কো নতুন করে বহর সাজানোর সুযোগ পায়।

রাশিয়ার তিনটি অঞ্চলে নতুন নিয়োগ চুক্তিতে সই করা সেনাদের এককালীন প্রণোদনার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। অধিকাংশ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী সেনারা যে যুদ্ধভাতা পান, তা স্থানীয় গড় আয়ের তুলনায় পাঁচ থেকে সাত গুণ বেশি।

যাঁরা ২০২৪ সালে কার্যকর হওয়া একটি আইনের বলে ফৌজদারি মামলার হাত থেকে বাঁচতে সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিলেন, বিবিসি তাঁদেরও ‘স্বেচ্ছাসেবী’ হিসেবে গণ্য করেছে।

বিবিসির হিসাবে দেখা যাচ্ছে, নিহতদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক সৈন্যদের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এ পর্যন্ত শনাক্তকৃত মোট নিহত সেনাদের চার ভাগের এক ভাগই স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধা।

২০২৩-২৪ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চুক্তিবদ্ধ হওয়া হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবককে মাত্র ১০ থেকে ১৫ দিনের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো হয়। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ যোদ্ধাদের বেঁচে ফেরার সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিয়েছে।

হতাহতের সংখ্যার বিবেচনায় রাশিয়ার বাশখোর্তোস্তান প্রজাতন্ত্র শীর্ষে রয়েছে। এ পর্যন্ত সেখানে ৪ হাজার ৮৩৬ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা, যাঁদের ৩৮ শতাংশ কোনো সামরিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই যুদ্ধে গিয়েছিলেন।

রুশ শহর উফায় রাশিয়ান সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করার এককালীন প্রণোদনা স্থানীয় গড় [মাসিক] বেতন ৬৭ হাজার ৫৭৫ রুবেলের (৬০০ পাউন্ড) ৩৪ গুণ।

উন্মুক্ত তথ্যসূত্র থেকে সংগৃহীত মৃত্যুর হিসাব সব সময়ই অসম্পূর্ণ থাকবে।

কেননা গত কয়েক মাসে নিহত সেনাদের বড় অংশের মরদেহ এখনো যুদ্ধক্ষেত্রেই পড়ে থাকতে পারে। সেগুলো উদ্ধার করাও মাঠে সক্রিয় সেনাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

যদি দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের স্বঘোষিত প্রজাতন্ত্রগুলোর যোদ্ধাদের হতাহতের চিত্র আমলে নেওয়া হয়, তাহলে রুশ সেনাদের প্রাণক্ষয়ের প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ।

শোক সংবাদ ও নিখোঁজ যোদ্ধাদের অনুসন্ধান-সংক্রান্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ ২১ হাজার থেকে ২৩ হাজার ৫০০ জন নিহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এভাবে হিসাব করলে মোট নিহত সেনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৫ হাজার থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার ৭০০।

আরও পড়ুনজেলেনস্কির বিদায় চান ট্রাম্প-পুতিন দুজনই, তা কি সম্ভব১১ এপ্রিল ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ২০২৪ স ল র ২০২৩ স ল হ স ব কর ইউক র ন মন ত র র জন য বছর র র দখল এ সময় র সময় হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

আশা আর অচলাবস্থার দোলাচলে দেশ 

১৫ বছরের অগণতান্ত্রিক শাসনের অবসানের পর বিক্ষোভকারীরা ‘বাস্তব পরিবর্তনের’ আশা করেছিলেন। কিন্তু এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতার দখলদারিত্ব ও সংস্কারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের ব্যর্থতার কারণে নতুন করে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা।

আজ ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট। এক বছর আগে, ২০২৪ সালের এই দিনে স্বৈরাচার, দুর্নীতি, গুম, দমন-পীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধ চূড়ান্ত রূপ নেয় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। পতন ঘটে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের। মঙ্গলবার ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ পালিত হচ্ছে দেশজুড়ে। আজ সাংবাদিক মওদুদ আহমেদ সুজনের একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আলজাজিরা। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের চাওয়া বনাম বাস্তবতার চিত্র। 

সিনথিয়া মেহরিন সকাল এখনও মনে করতে পারেন গত বছরের ১৫ জুলাইয়ের সেই আঘাতের কথা। সেদিন তিনি সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে ঢাকায় সরকারি চাকরিতে বিতর্কিত কোটা প্রথার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের এক কর্মীর হামলায় সকালের মাথায় ১০টি সেলাই লাগে এবং তিনি সাময়িকভাবে স্মৃতিভ্রষ্ট হন। সকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। 

ঠিক এর একদিন পর ২৩ বছর বয়সী আরেক শিক্ষার্থী আবু সাঈদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভে অংশ নেন। ওই বিক্ষোভে গুলি চালায় পুলিশ। তার হাত প্রসারিত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাওয়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণআন্দোলনের সূচনা করে।

কঠোর দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে রাস্তায় নামে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। পরে এই তরুণদের সঙ্গে অভিভাবক, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষও আন্দোলনে যোগ দেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মতো বিরোধী দলগুলো একজোট হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

“দূর-দূরান্ত থেকেও শিক্ষার্থীরা এসে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, সত্যিকার পরিবর্তন আসছে।” আলজাজিরাকে বলেন সকাল।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাজার হাজার বিক্ষোভকারী শেখ হাসিনার বাসভবন ও কার্যালয় ঘেরাও করে। ঠিক তার আগ মুহূর্তে সাবেক প্রধানমন্ত্রী একটি সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যান। এখনও তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। এদিকে, তার বিরুদ্ধে দেশের আদালতের মানবতাবিরোধী অপরাধসহ বিভিন্ন মামলার বিচারকাজ চলছে। 

জাতিসংঘের তথ্যমতে, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের আগপর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হন।

শেখ হাসিনা পালানোর তিন দিন পর ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে। 

আজ (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ নতুনভাবে দিনটি স্মরণ করছে। এক বছর পর এসেও আন্দোলনকারী সকাল বলেন, “২০২৪ সালের আন্দোলনকে যে ঐক্য ও আশার প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছিল, সেটি এখন হতাশা ও বিভাজনের জায়গা দখল করে নিয়েছে।” 

“তারা বিপ্লবটাকে বিক্রি করে দিচ্ছে,” বলেন তিনি।

বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচনের আগেই ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা যে পরিবর্তনের জন্য লড়েছি, তা এখনও অধরাই রয়ে গেছে। এই সরকার গণঅভ্যুত্থানের মালিকানা ধরে রাখতে পারেনি।”

‘আমার সন্তানের আত্মত্যাগ কীসের জন্য?’

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু তার সরকার একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের বিষয়ে ঐকমত্য খোঁজার চেষ্টা করলেও রাজনৈতিক চাপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকা বিভিন্ন পক্ষ এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথনকশা নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে।

আজ বিকেলে হাসিনার পতনের বর্ষপূর্তিতে অধ্যাপক ইউনূস ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নামে একটি নথি প্রকাশ করবেন। এতে তার সরকারের প্রস্তাবিত গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো ও তা বাস্তবায়নের রোডম্যাপ উল্লেখ থাকবে। তবে এ নিয়ে অনেকেই আশাবাদী নন।

“আমাদের সন্তানরা ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু আমরা সেটা পাচ্ছি না,” বললেন সানজিদা খান দীপ্তি। তিনি ১৭ বছর বয়সী ছেলে আনাসকে হারিয়েছেন ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার চাঁনখারপুল এলাকায় একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিতে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, আনাস নিরস্ত্র ছিল এবং পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, তখনই তার পিঠে গুলি লাগে। হাতে জাতীয় পতাকা ধরা অবস্থায় ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়। 

“জুলাইয়ের হত্যাকাণ্ড নিয়ে যেসব সংস্কার ও বিচারের আশায় ছিলাম তা যথাযথভাবে হচ্ছে না,” আলজাজিরাকে বলছিলেন ৩৬ বছর বয়সী এই মা। 

“আমরা ন্যায়ের, শান্তির ও ভালো একটি দেশের স্বপ্নে রাস্তায় নেমেছিলাম। যদি সেটি না আসে, তাহলে আমার সন্তানের আত্মত্যাগের মানে কী?”

“কোনো অনুশোচনা নেই,” বললেন খোকন চন্দ্র বর্মণ। যিনি নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে মুখের প্রায় পুরোটা হারিয়েছেন।

তিনি বলেন, “আমার আত্মত্যাগ একটি বৈষম্যমূলক সরকারের পতনে সহায়তা করেছে—এটা আমার গর্ব।”

বর্মণের বিশ্বাস, এখন ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে দেশ তুলনামূলকভাবে ভালো আছে।

“পুরোনো দানবেরা এক রাতেই চলে যাবে না। কিন্তু আমরা আশাবাদী।” বলেন তিনি।

আতিকুল গাজীও একমত। তিনি আলজাজিরাকে বলেন, “ইউনূস স্যার পারবেন। তিনি নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক দলগুলো যদি পুরোপুরি সহযোগিতা করত, তাহলে পরিস্থিতি আরো ভালো হতো।”

২১ বছর বয়সী এই টিকটকার ঢাকার উত্তরা এলাকার বাসিন্দা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট খুব কাছ থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি তার বাম হাত হারান।

হাত হারানোর পরও হাসিমুখে তোলা তার একটি সেলফি ভিডিও ২০২৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ভাইরাল হয়।

“আমি ভয় পাই না… আমি আবার মাঠে ফিরেছি। একটি হাত না থাকলেও, আমার জীবন আবার উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম” বলেন তিনি। 

‘অস্থিরতা বাড়তে পারে’
সবাই কিন্তু খুব আশাবাদী নন। “সেটা ছিল এক নজিরবিহীন ঐক্যের মুহূর্ত,” বললেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী।

২০২৪ সালের ২৯ জুলাই ক্যাম্পাসে একটি বিক্ষোভে তিনি একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। গত মাসে আন্দোলনের স্মরণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “ঐক্য রক্ষা করা নতুন সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তারা সেটা ধরে রাখতে পারেনি।”

আওয়ামী লীগবিরোধী বিশাল জনমতকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে দ্রুত নির্বাচনের দাবি করে আসছে। কিন্তু ২০২৪ সালের আন্দোলনের ছাত্রনেতারা গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলো ভোটের আগে কাঠামোগত সংস্কারের পক্ষে।

এমন বৈচিত্র্যময় দাবি সামলাতে ইউনূস সরকার ২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করে। এ কমিশনের দায়িত্ব বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ প্যানেল প্রদত্ত সংস্কার পরিকল্পনাগুলো একত্র করে একটি রাজনৈতিক রূপরেখায় রূপান্তরিত করা। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে যেই দল বা জোট বিজয়ী হবে, তাদের এই রূপরেখা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।

তবে এখন পর্যন্ত কমিশনের বৈঠকগুলোতে দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধই প্রধান হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, সংসদের উভয় কক্ষে অনুপাতভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব, এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়া আরো নিরপেক্ষ ও দলনিরপেক্ষ করার মতো বিষয়গুলোতে।

রাজনীতি বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি সতর্ক করে বলেছেন, “যদি রাজনৈতিক শক্তিগুলো সংস্কার নিয়ে একমত না হতে পারে, তবে অস্থিরতা বাড়তে পারে।” 

তবে ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির হিউম্যানিটারিয়ান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অ্যাডজাংক্ট ফেলো মুবাশ্বার হাসান মনে করেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থার সম্ভাবনা ‘অত্যন্ত কম’ এবং অধিকাংশ পক্ষই আগামী বছরের নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

তবে তিনি প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোর বিষয়ে সন্দিহান। এগুলোকে তিনি ‘চকচকে কিন্তু অন্তঃসারশূন্য পুনর্গঠন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

“কিছু গণতান্ত্রিক অগ্রগতি হবে বটে, তবে প্রকৃত পরিবর্তন নয়,” আলজাজিরাকে বলেন মুবাশ্বার হাসান।

তিনি বলেন, “এক সময় কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী আওয়ামী লীগের কার্যক্রমন এখন নিষিদ্ধ—এই বাস্তবতা বাংলাদেশের নির্বাচনি গণতন্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে দুর্বল করতে পারে।” 

আনাসের মা দীপ্তি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো এখন ক্ষমতা দখলে ব্যস্ত, অথচ যারা গত বছরের দমন-পীড়নে দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।” 

সন্তান হারানো এই মা আলজাজিরাকে বলেন, “যারা সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিল এমন অধিকাংশ কর্মকর্তাই এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলো শুধু ক্ষমতা নিয়ে ব্যস্ত।”

২০২৪ সালের গণআন্দোলন ও ছাত্রবিক্ষোভের অনুপ্রেরণায় গঠিত একটি দলনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। এটি আন্দোলনের সময় গড়ে ওঠা তরুণ শিল্পী, কবি, লেখক, নাট্যকর্মী ও একটিভিস্টদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক বিভক্তির ঊর্ধ্বে উঠে একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক এবং মানবিক সমাজের পক্ষে সাংস্কৃতিক চর্চা ও সচেতনতা গড়ে তোলা।

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদি সতর্ক করে বলেন, “সংস্কার ও ন্যায়বিচার ছাড়া যদি নির্বাচন হয়, তাহলে দেশ আবার ফ্যাসিবাদের মুখে পড়তে পারে।”

‘বিক্ষোভের শহর’

গণআন্দোলনের পর থেকে ঢাকায় যেন প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিক্ষোভ হচ্ছে। সরকারি অফিস ঘেরাও, রাস্তায় মিছিল, দাবিদাওয়ার স্লোগানে মুখর ঢাকা এখন অনেকের চোখে ‘বিক্ষোভের শহর’।

পুলিশ এখনো বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পায়নি। শেখ হাসিনার দমন-পীড়নমূলক শাসনে তাদের ভূমিকার জন্য তারা জনমনে অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী দেশের রাস্তায় টহল দিচ্ছে। তাদের হাতে বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। 

মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ৭২ জন নিহত এবং ১,৬৭৭ জন আহত হয়েছে। এ সময়ে পুলিশের পাশাপাশি আলোচিত বাহিনী র‍্যাবের বিরুদ্ধে ৮টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও নথিভুক্ত হয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য অপরাধও বেড়েছে।

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত খুনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১,৫৮৭টি, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। ডাকাতির ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৩১৮টিতে পৌঁছেছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ৯,১০০ ছাড়িয়ে গেছে। অপহরণ ও সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনাও বেড়েছে।

মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির’ নির্বাহী পরিচালক মো. ইজাজুল ইসলাম আলজাজিরাকে বলেন, “মব জাস্টিস এবং লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাকাণ্ড বেড়ে গেছে, যেগুলোর অনেকগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাদের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ না করে, তবে মনোবলহীন পুলিশ এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।” 

পুলিশের এই মনোবল ভাঙার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ২০২৪ সালের আন্দোলন। ওই সময় সারা দেশে ৫০০ এর বেশি থানায় হামলা হয় এবং এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে রাস্তায় কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চোখে পড়েনি। 

ইজাজুল ইসলাম বলেন, “পুলিশকে এই নৈতিকভাবে ভেঙে পড়া অবস্থান থেকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে।” 

আলজাজিরার সঙ্গে কথা বলা মাঠপর্যায়ের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা আরেকটি সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তাদের ভাষায়, গ্রামীণ এলাকায় ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক শৃঙ্খলা’ ভেঙে পড়েছে।

কুড়িগ্রামের রৌমারী থানার এক সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আলজাজিরাকে বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে স্থানীয় বিরোধের মীমাংসায় পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা একসঙ্গে কাজ করত। সেই কাঠামো আর নেই। এখন বিএনপি, জামায়াতসহ একাধিক পক্ষ বাজার, পরিবহন কেন্দ্র ও সরকারি টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে।”

ঢাকায় পরিস্থিতি আরো জটিল

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার তালেবুর রহমান আলজাজিরাকে বলেন, “প্রতিদিন রাস্তায় বিক্ষোভ সামলানো আমাদের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

তিনি বলেন, “ঢাকা যেন এখন ‘বিক্ষোভের শহর’ হয়ে গেছে। মানুষ তাদের দাবি জানাতেও সরকারি অফিসে ঢুকে পড়ছে।”

তবুও তিনি দাবি করেন, ২০২৪ সালের আন্দোলনের পরপর যে বিশৃঙ্খলা ছিল, এখন পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো।

গত ১৫ জুলাই একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এমনটা দাবি করে বলেন, “যদি সামগ্রিক পরিসংখ্যান বিবেচনা করেন, তাহলে দেখা যাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীলতার দিকেই যাচ্ছে।”

তিনি আরো বলেন, “অনেকেই যারা এতদিন ন্যায়বিচার পায়নি তারা এখন সামনে এসে মামলা দায়ের করছে।” 

ঢাকার অভিজাত বসুন্ধরা এলাকার ৩৮ বছর বয়সী রিকশাচালক মো. শাইনুর বলেন, “সবকিছু ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাচ্ছে।”

অর্থনীতিতেও কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। পোশাক কারখানা ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি।

২০২৪ সালের মে মাসে যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৪ বিলিয়ন ডলার, ২০২৫ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলার। এর পেছনে রয়েছে অবৈধ অর্থপাচারের বিরুদ্ধে অভিযান, রেকর্ড প্রবাসী আয় এবং আইএমএফের নতুন অর্থায়ন। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.৭ শতাংশ, ২০২৫ সালের জুনে তা কমে ৮.৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

তবে ব্যাপক বেকারত্ব সমস্যা এখনও রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ বর্তমানে কর্মহীন। তারা শিক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণের সঙ্গেও যুক্ত নয়। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। ফলে পোশাক খাতের ৪০ লাখ শ্রমিকের জীবিকা কিছুটা হুমকির মুখে।

ঢাকায় ফিরে আসা গাজী এখনও ২০২৪ সালের আন্দোলনের স্মৃতি ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর।

তিনি বলেন, “যারা আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন এবং যারা আহত হয়েছেন, মানুষ যেন তাদের মনে রাখে।”

“আমি এক হাত হারিয়েছি, কিন্তু কোনো আফসোস নেই। প্রয়োজনে জীবনও দিয়ে দেব। তবু এই দেশ ভালো চলুক, যেই ক্ষমতায় থাকুক” বলেন তিনি। 

ঢাকা/ইভা/তারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাকিস্তানে ইমরান খানের দলের বিক্ষোভে ব্যাপক ধরপাকড়, ১৪৪ ধারা জারি
  • দিল্লি সকালেও আঁচ করতে পারেনি, দিন শেষে ভারতে পালাতে বাধ্য হবেন শেখ হাসিনা
  • শুল্কনীতি নিয়ে ট্রাম্পের হুমকিকে ‘অন্যায্য ও অযৌক্তিক’ বলল ভারত
  • বিশ্বে ছাত্রদের নেতৃত্বে শীর্ষ ১০টি আন্দোলন
  • ৫ আগস্ট চিরদিনের জন্য আমার স্মৃতিতে খোদাই হয়ে গেছে: বাঁধন
  • আশা আর অচলাবস্থার দোলাচলে দেশ 
  • গাজায় হামলা বন্ধে নেতানিয়াহুকে চাপ দিতে ট্রাম্পকে ইসরায়েলের সাবেক কর্মকর্তাদের চিঠি
  • যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার দায়ে স্বামীর মৃত্যুদণ্ড
  • জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: শাহরুখ-রানী-বিক্রান্ত কত টাকা পাবেন?
  • সৌদি আরবে এক দিনে আটজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর