স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ তিনটি সূচক দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়। বাংলাদেশ সাত বছর ধরে তিন সূচকেই মান অতিক্রম করেছে। সূচকগুলো হলো, মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচক। এক দশক ধরে এই তিন সূচকেই ক্রমাগত উন্নতি হয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের হিসাবে মানবসম্পদ সূচকের পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা খারাপ হয়েছে। তবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত আছে। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়েছে।

বাংলাদেশ নানা ধরনের যাচাই–বাছাই পেরিয়ে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য সময় নির্ধারণ করা আছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও এলডিসি থেকে উত্তরণে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিবিএসের পরিসংখ্যানের হিসাবে, এলডিসি উত্তরণে মাথাপিছু আয় হিসাবটি গত তিন বছরের গড় হিসাব ধরা হয়। গত জানুয়ারি মাসের হিসাবে গত তিন বছরের গড় মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৩৪ মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৬৮৪ ডলার। এক বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এলডিসি উত্তরণে মাথাপিছু আয়ের মান সীমা থেকে অনেক ওপরে আছে বাংলাদেশ। এলডিসি উত্তরণে মাথাপিছু আয় সূচকে ১ হাজার ৩০৬ ডলারের বেশি থাকতে হবে।

অন্যদিকে মানবসম্পদ সূচকেই এলডিসি উত্তরণের মান সীমা থেকে ওপরে আছে। কিন্তু গত এক বছরে এই সূচকের পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। মানব উন্নয়ন সূচকে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ পেয়েছিল ৭৭ দশমিক ৫ পয়েন্ট। ২০২৫ সালে এসে তা কমে ৭৭ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে। এলডিসি উত্তরণে এই সূচকে ৬৬ পয়েন্টের বেশি থাকতে হবে। শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, সাক্ষরতা, লিঙ্গ সমতাসহ স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যের সামাজিক উন্নয়ন দিয়ে এই সূচক নির্ণয় করা হয়। গত এক বছরে এসব সূচকের উন্নতি হয়নি। বিশেষ স্বাস্থ্য খাতের সূচক খারাপ হয়েছে। ২০২৪ সালে স্বাস্থ্য খাতে অর্জন ছিল ৭৭ পয়েন্ট। এবার তা কমে ৭৫ দশমিক ৮ পয়েন্ট হয়।

অন্যদিকে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকেও পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে। এই সূচকে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অর্জিত পয়েন্ট ছিল ২১ দশমিক ৯। ২০২৫ সালে তা আরও কমে ২১ দশমিক ৮ হয়েছে। এই সূচকে ৩২ পয়েন্ট বা এর কম থাকতে হয়। এই সূচক জিডিপিতে কৃষি, শিল্প ও সেবার অবদান, পণ্য রপ্তানি নিবিড়তা, পণ্য ও সেবা রপ্তানির অস্থিতিশীলতা, জনসংখ্যার হার (উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে), জনসংখ্যার হার, কৃষি উৎপাদনে অস্থিতিশীলতা, দুর্যোগের শিকার—এসব উপসূচক দিয়ে নির্ধারণ করা হয়। গত এক বছরে জিডিপিতে কৃষি, শিল্প ও সেবার অবদান এই উপখাত ছাড়া অন্য সূচকগুলোর উন্নতি হয়নি, আবার অবনতিও হয়নি। ওই সূচকে অবস্থা অপরিবর্তিত আছে।

এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে একটি দেশের মানমর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হয়। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারী আস্থা রাখতে পারেন। অন্যদিকে এলডিসি তালিকায় থাকলে ওই দেশকে নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় উন্নত দেশগুলো। এটি অনেকটা পরনির্ভরশীলতায় থাকার মতো বিষয়।

এলডিসি থেকে উত্তরণের নিয়ম

এলডিসি থেকে কোন দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। এ জন্য প্রতি তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা—এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যেকোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয়। এই মানদণ্ড সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।

সিডিপি পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে এসব মান অর্জন করলেই এলডিসি থেকে বের হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ করে। সিডিপির সুপারিশ প্রথমে জাতিসংঘের ইকোসকে যায়। প্রস্তুতির জন্য তিন বছর সময় দেওয়া হয়। তিন বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অনুমোদনের জন্য ওঠে। এরপর চূড়ান্তভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়ে যায় ওই দেশ।

বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদণ্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয়। ২০২১ সালেই বাংলাদেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পায় যে ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হতে পারে। ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা থাকলেও করোনাভাইরাসের কারণে প্রস্তুতির জন্য আরও দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ যদি এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হয়, তাহলে বাংলাদেশই হবে প্রথম দেশ, যারা তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে বের হবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পটভূমি বিবেচনা করে উন্নয়নশীল ও উন্নত, এই দুই শ্রেণিতে সব দেশকে ভাগ করে থাকে জাতিসংঘ। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যে দেশগুলো তুলনামূলক দুর্বল, তাদের নিয়ে ১৯৭১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা হয়। স্বল্পোন্নত দেশ হলেও এসব দেশ একধরনের উন্নয়নশীল দেশ। বর্তমানে বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ২০২৪ স ল পর স থ ত ত ন বছর এক বছর র জন য দশম ক এলড স

এছাড়াও পড়ুন:

লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা

লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।

সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।

আরো পড়ুন:

আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র

মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা

চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।

তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।

শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।

তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।

তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।

ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।

রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”

“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”

“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”

টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”

“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।” 

সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কানাডায় পোস্টগ্র্যাজুয়েশন ওয়ার্ক পারমিট, যে ১০ ভুলে বাতিল হয় আবেদন
  • অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৮.১৭%
  • সংখ্যার বেড়াজালে রূপা
  • ধ্বংসস্তূপেই ঋত্বিকের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন, পৈতৃক ভিটায় চলচ্চিত্র কেন্দ্র নির্মাণের দাবি
  • নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ৪০৩ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ
  • জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে নাগরিক সেবার মানোন্নয়নের তাগিদ ডিএসসিসির প্রশাসকের
  • বহুরূপী শিক্ষাবৈষম্যের বহুমাত্রিক আঘাত
  • শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ দিলো পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স
  • লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা
  • বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের মৃত্যু